দুনিয়ার লীলা বোঝা কঠিন! আমরা এখানে পচা ফুল;—গলাপচা বয়সেও দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছি! আর, সবে ফুটতে শুরু করেছে যে-ফুল, তাকে অকালে ঝরে যেতে হয়! দীপংকর দীপ যেমন ঝরে গেল অকালে! জ্বলে-পুড়ে ছারখার বাংলাদেশে মানুষকে খুনসুটিভরা পারিবারিক জীবনের মূল্য তুলে ধরতেই যেন-বা কন্টেন্ট বানাত ছেলেটি। করোনা মহামারির সময় প্রথম চোখে পড়ে তাকে। ষোল-সতেরো বছরের এক ছেলে মা, ভাই, ঠাকুমা আর পাড়ার বন্ধুদেরকে ঘিরে প্রতিনিয়ত তৈরি হতে থাকা পারিবারিক খুনসুটির গল্পগুলো বলে যাচ্ছে বেশ!
সিলেটি ভাষায় কন্টেন্ট তৈরির জোয়ার মূলত ওইসময় প্রবল হয়ে ওঠে। সিলেট ও আসামের আঞ্চলিক সীমানা ছাপিয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সিলেটি মানুষজনকে পরে যেটি একসুতোয় গেঁথে নিয়েছে অনেকখানি। অনলাইনে এখন সিলেটি নাটক আর ফান কন্টেন্টের ছড়াছড়ি। সিংহভাগ সস্তা ও অখাদ্য যদিও;—বৈচিত্র্য নেই তেমন। দীপের কন্টেন্ট তার মধ্যে থেকেছে সুস্থির, নির্মল ও অন্তরঙ্গ। পাড়াতো জীবন আর পারিবারিক অন্তরঙ্গতায় সুস্থির। সব বয়সের দেখার উপযুক্ত, এবং সেখানে খুনসুটির মধ্যে ছিল না আতিশয্য বা বাড়তি কিছু করে দেখানোর প্রাণান্ত কসরত।

এই পরিমিত রসবোধটাই ছিল তার ম্যাজিক। এটুকু দিয়ে ছেলেটি সিলেটিদের মন জয় করে নিয়েছিল। আমাদের অতি চেনা যে-দৈনন্দিনকে দীপ অনবরত মজা ও আমোদের ছলে তুলে ধরত, এবং সেখানে তার সাফল্য এজন্য যে,—এই লাইফটাকে সে ধারণ ও বিশ্বাস করেছে মনপ্রাণে। সেখানে কেবল ভিউ কামানোর মতলব থাকেনি। চোখের সামনে তার দর্শকশ্রেণি ধীরে-ধীরে গড়ে উঠতে দেখেছি। দীপের কন্টেন্টকে যারা ওই দৈনন্দিন যাপনের মতো ধারণ করেছে। ছেলেটি তাদের ঘরের একান্ত একজন হয়ে উঠেছিল এভাবে। যে-কারণে তার অকালে ঝরে যাওয়াটা সিলেটি সমাজকে পোড়াচ্ছে বেশ।
মালয়েশিয়ায় পড়তে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি তার জন্য মর্মান্তিক হয়ে উঠল অবশেষে। এই ছেলে পরিবারঅন্তপ্রাণ। পাড়া অন্তপ্রাণ। হুল্লোড় অন্তপ্রাণ। সবার সাথে মিলেমিশে আনন্দ কুড়িয়ে নিতে সহজাত। প্রবাস তার জন্য নয়। আরো পরে যেতে পারত বিদেশে। বুঝতে পারেনি,—সেখানে যাওয়ার পর তাকে একলা মানিয়ে নিতে হবে সবকিছুর সঙ্গে। পরিবার আর পাড়াতো বন্ধুদের সাথে পাবে না। মামাকে নিয়ে ইয়ার্কি ও তামাশাভরা কন্টেন্ট বানানোর দিনগুলো আসবে না ফেরত কখনো! এটি মনে হচ্ছে তাকে কষ্ট ও পীড়া দিয়েছিল মর্মান্তিক।
বিদেশে অন্য কিছু বানাতে হতো তাকে। সেটি হতে পারত মালয়েশিয়ার জনজীবন। হতে পারত সেখানে বাস করতে থাকা বাঙালি সমাজ। অনেক কিছু হতে পারত বা সে করতে পারত, যদি যেত আরো কিছুদিন পর। এতো অল্প বয়সে একলা যাওয়াটা নিতে পারেনি ছেলেটি। সবাই সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না। দীপের পক্ষে কঠিন ছিল পরিজনহীন বিদেশ-বাড়িতে নিজেকে অভ্যস্ত করা।

তার আকস্মিক চলে যাওয়ার পেছনে অন্য কোনো কারণ অথবা দুঃখবোধ আছে কি-না জানি না, তবে প্রবাসে একলা যাপনের ভার যে-তাকে পীড়িত করে তুলছিল, তার আভাস কিন্তু নিজেই দিয়েছিল, এমনকি চলে যাওয়ার আগেও। দীপংকর দীপের মধ্যে একজন ভালো অভিনয়শিল্পী হওয়ার সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছিল ক্রমশ। মানুষকে নির্মল আনন্দে বিনোদিত করার সহজাত ক্ষমতা সকলের থাকে না। তার তা ছিল। সেইসঙ্গে ছিল পারিবারিকতার প্রগাঢ় এক দ্যুতি। বড়ো নির্মল ছিল তা! এগুলোর ওপর ভর দিয়ে বড়ো কিছু হতে পারত ছেলেটি;—দূর ভবিষ্যতে। সেই সম্ভাবনা অসমাপ্ত রেখে ঝরে গেল হঠাৎ!
দীপের তারুণ্যদীপ্ত হাসিখুশি মুখখানা চোখে ভাসছে! মর্মান্তিক! ভীষণ মর্মান্তিক!—যখন এমন করে কেউ হঠাৎ জীবন থেকে ছুটি নিয়ে নেয়;—তাও আবার জীবন শুরু হওয়ার বয়সে যে-কিনা সবে পা দিয়েছিল! কত কী করা বাকি ছিল তার! মনে-মনে ভাবছি তার মা ও ঠাকুমার কথা। এই ভার তাঁরা কী-করে বইবেন বাকি জীবন! ছেলেটি যে-ছিল তাদের জীবনে ফল্গুধারার মতো;—যেটি আর কখনো ফেরত পাওয়ার নয়।
. . .

. . .



