দেখা-শোনা-পাঠ

রিদম জিরোয় চিরন্তন মানব প্রবৃত্তি

Reading time 4 minute
5
(1)

দেশজুড়ে ধর্ষণ-উৎসবের নির্মম শিকার শিশু আছিয়াকে কবরে শুইয়ে দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে একটি ঘটনা আচমকা মনে ভেসে উঠছে। বিগত শতাব্দীর সত্তর দশকের ঘটনা। স্থানকাল আমাদের এখানকার নয়। সুদূর সার্বিয়ায় ঘটনাটি ঘটেছিল। দেশটির নাগরিক মেরিনা আব্রামোভিচ ছিলেন পারফর্মিং আর্টিস্ট। মানব প্রবৃত্তি আসলে কেমন সেটি জানার কৌতূহল চেপেছিল তাঁর মাথায়। যেহেতু পারফর্মিং আর্টিস্ট, মেরিনা সিদ্ধান্ত নিলেন একটি প্রদর্শনী করবেন তিনি। তাঁর ভূমিকা সেখানে থাকবে স্ট্যাচুর। প্রদর্শনী কক্ষে তিনি প্রস্তরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকবেন। পাশের টেবিলে সাজানো থাকবে রকমারি জিনিসপত্র। এই যেমন, ফুলের তোড়া, কেক, চকোলেট, লিপিস্টিক থেকে শুরু করে ছুরি, কাঁচি ইত্যাদি সরঞ্জাম। প্রদর্শনী কক্ষে আগতরা প্রস্তরমূর্তির মতো টেবিলের পাশে দাঁড়ানো মেরিনার সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করছেন সেটি যাচাই করা ছিল শিল্পীর উদ্দেশ্য।

মেরিনা এই মর্মে লিখিত অনুমতিপত্র ঝুলিয়ে দিলেন প্রদর্শনী কক্ষে। সেখানে বলা ছিল,—পরবর্তী পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা তিনি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন। দর্শকরা তাঁর সঙ্গে যেমন খুশি আচরণ করতে পারেন। প্রথম আড়াই ঘণ্টা ভালোই কাটল মেরিনার। আজব প্রদর্শনী দেখতে আসা দর্শক তাঁর সঙ্গে সদয় থাকলেন বেশ। কেউ তাঁর চুল আঁচড়ে দিলেন। লিপিস্টিক দিয়ে অধর রঞ্জিত করলেন অনেকে। হাতে ফুলের তোড়া ধরিয়ে দিলেন কিছু দর্শক। ভালোবেসে চুম্বনও করলেন অনেকে।

Marina Abramović – Rhythm 0; Image Source – arte-mag.it

পরিবেশটা বদলাতে শুরু করে হঠাৎ! দর্শকদের একাংশ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন মেরিনার প্রতি। তাঁর গালে থাপ্পড় কষালেন তারা। চিমটি কাটলেন। গালিগালাজ করতে বাকি রাখলেন না। মুখে থুতু ছুড়েও মারলেন অনেকেেই। সময় যত গড়াতে থাকল প্রদর্শনী কক্ষে সমেবত দর্শকের হিংস্রতার মাত্রা তীব্র হতে লাগল। মেরিনার জামাকাপড় তারা ছিঁড়ে ফেললেন। কিল-চড়-ঘুষি আর অকথ্য গালাগালির সঙ্গে আরম্ভ হলো ছুরি-কাঁচির ব্যবহার। দেহের কোনো অংশ বাকি থাকল না। যৌনহেনস্থা থেকে শুরু করে সবরকম হেনস্থা চলল বাকিটা সময়। শেষদিকে এক দর্শক ছুরি দিয়ে আঘাত করে বসলেন মেরিনার তলপেটে। আর একজন তার কানের কাছে ট্রিগার চেপে ধরতে যাচ্ছিলেন প্রায়।

প্রথম অড়াই ঘণ্টার বিপরীত ছিল পরের দুই ঘণ্টা। ভালোবাসা ও সহানুভূতি দ্রুত মোড় নিয়েছিল জিঘাংসায়। মেরিনার প্রতি দর্শকের হিংস্র হয়ে ওঠা আটকানোর মতো কেউ কি ছিলেন না সেখানে? হ্যাঁ, ছিলেন। উন্মত্ত দর্শকের তুলনায় তারা সংখ্যায় নগণ্য ছিলেন সেখানে। হতচকিত আর ভীতসন্ত্রস্ত তো বটেই! স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন তারা। দর্শক বনে দেখলেন মানুষ মুহূর্তে কতটা পাশব করে তুলতে পারে নিজেকে।

যাইহোক, মেরিনাকে অবশেষে উদ্ধার করা হয়। তিনি তখন আহত ও বিপন্ন। হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসা আর শল্যচিকিৎসকের অধীনে বেঁচে ফিরেছিলেন কোনোমতে। নিজের এই পরীক্ষার নাম শিল্পী রেখেছিলেন রিদম জিরোপরীক্ষাটি যে এতদূর মর্মান্তিক হতে পারে, সেটি তিনি নিজে হয়তো কল্পনা করতে পারেননি!

ঘটনাটি এখানে পেশ করছি একথা ভেবে,—মানব প্রজাতিকে মহৎ ভাবার বাতিক থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। না, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই;—কথাটি বিলকুল মিথ্যে। বড়ু চণ্ডীদাস বড়ো কবি হতে পারেন, কিন্তু তাঁর রচিত স্তোকবাক্য মানুষের দেহমনে সক্রিয় জান্তব প্রবৃত্তিকে আড়াল করে রাখে।

Rest Energy (1980) – Marina Abramović; Image Source – businessandarts.net

মানুষ কেবল শাাসন ও শৃঙ্খলায় স্ববশ থাকে মনে হচ্ছে। জঙ্গলে যেমন প্রাকৃতিক নিয়মের অধীনে পশুরা বসবাস করে, যেখানে নিয়মের লঙ্ঘন মানে নিজেকে বিপন্ন করে তোলা বোঝায়। সমাজবদ্ধ জীব মানুষকেও কাজেই থাকতে হয় নিয়ম ও শৃঙ্খলায়। শৃঙ্খলা অনেকসময় শৃঙ্খল হয়ে ওঠে তার জন্য। মানুষের তখন এর বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে উপায় থাকে না। এতে নিয়মের লঙ্ঘন ঘটে না, বরং নিয়মের অপব্যবহার যে ঘটানো হচ্ছে, এটি হলো তার বিরুদ্ধে মানুষের যৌক্তিক আপত্তি ও সংক্ষোভ। এটি হচ্ছে প্রতিবাদ, এবং এরকম প্রতিবাদ তাকে মহান প্রতিপন্ন করে অনেকক্ষেত্রে। ভালোবাসা ও সহানুভূতি জন্ম নেয় তখন। কিন্তু নিয়ম ও শৃঙ্খলায় যদি ঘাটতি পড়ে, মানুষ ফেরত যায় চিরাচরিত পাশব প্রবৃত্তির জগতে। এবং সেখানে তারচেয়ে অধিক নির্দয়-নিষ্ঠুর প্রাণী জগতে দুটি নেই।

মানব প্রজাতির সঙ্গে জিনগত ঐক্য ইঁদুর থেকে শুরু করে বানর প্রজাতির সঙ্গে বেশ নিবিড়। বাকিরা নিছক প্রাকৃতিক বিবর্তনে নিয়মবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল। মানুষ তা নয়। কারণটি তার মস্তিষ্কের অভূতপূর্ব বিকাশের মধ্যে নিহিত। তার মস্তিষ্ক হচ্ছে কোরান ও বাইবেলে বর্ণিত জ্ঞানবৃক্ষের উপমা। আদম ও হাওয়াকে জ্ঞানবৃক্ষের ফল ভক্ষণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন ঈশ্বর। এই ফল যতটা উপাদেয়, ঠিক ততটাই বিষাক্ত তার জন্য। হিন্দু পুরাণে আছে,—সমুদ্রমন্থনে যত ধনরত্ন উঠেছিল সেগুলো বাকিরা দুহাত ভরে লুটে নিতে দেরি করেনি। মন্থন শেষে তলানিতে পড়ে থাকল নির্জলা বিষ। কে এখন বিষের ভাণ্ড পান করবে? কেউ ছিল না। ভগবান শিবকে তার পুরোটা ভক্ষণ করতে হলো! বিষ পান করে নীলকণ্ঠ হলেন পশুপতি শিব।

Audience –  Marina Abramović Rhythm 0; Source – arte-mag.it

মানুষকে কে সৃষ্টি করেছে তা আমরা সম্যক জানি না। হতে পারে অনামা ঈশ্বর তাকে সৃষ্টি করেছিলেন। প্রাণবিকাশের প্রাকৃতিক নিয়মেও সৃষ্টি হতে পারে। কোনো কার্যকারণের অস্তিত্ব হয়তো এর পেছনে ছিল না! কারণবিহীন উপায়ে ধরায় অন্য জড়বস্তু ও জীবদের সঙ্গে মানুষের আগমন ঘটে, এবং বাকিদের থেকে নিজেকে ক্রমাগত পৃথক করতে থাকে সে। হয়ে ওঠে দেব ও দানব।

নিজের জীবনকে বিপন্ন করে মেরিনা আব্রামোভিচ এই-যে রিদম জিরোর পরীক্ষাটি নিয়েছিলেন, তার মধ্য দিয়ে আমরা মানব প্রজাতি চিরন্তন বিষবৃক্ষের নিকট ফেরত যাচ্ছি। আমরা ফলভক্ষণ করেছিলাম এই পরিণাম না জেনে,—এখন থেকে আমরা হয়ে উঠব এমন এক অভিশাপ, যার দিকে তাকালে মন ভালোবাসায় ভরে উঠবে তাৎক্ষণিক, এবং ভালোবাসা অচিরে মোড় নেবে ঘৃণায়। মানুষ তার নিজেকে ঘৃণা করে, যেখানে তার নিজের ও অন্যের প্রতি ভালোবাসা হচ্ছে নিছক অভিনয়। সে অবিনয়ী ও দুর্বিনীতি;—যেখানে পাশবতা হচ্ছে তার আদি চালিকাশক্তি। বাকিটা সমাজের বুকে বিচরণের সুবাদে সৃষ্ট, এবং সে-কারণে তারা মুহূর্তে বিপন্ন হয়ে পড়ে। মানুষকে কাজেই আইন ও শঙ্খলা দিয়ে বাঁধা ছাড়া স্ববশ রাখা কঠিন।

মেরিনা তার নিজ দেহকে অবিরত বিপন্ন করে কাজটি এখনো করে চলেছেন। এর পেছনে শিল্পী এই অনুভবকে মূল্যবান মনে করেন,—মানুষ হচ্ছে পীড়নযন্ত্র এবং পীড়ন সহ্য করতে পারার কুশলতায় সে হয়ে ওঠে খাঁটি সোনা। এছাড়া তার পক্ষে অন্যকে পীড়িত হতে দেখে সেটি বন্ধ করার পথ অন্বেষণ কভু সম্ভব নয়।
. . .

The dark side of humanity – Marina Abramovic’s – rhythm 0 performance; Source – Antiquity Lens YTC

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 1

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *