নেটালাপ - পোস্ট শোকেস

‘ধোপা’ নিয়ে নেটালাপ

Reading time 10 minute
5
(60)
@thirdlanespace.com

. . .

History behind the words – Mukhujje Moshai; Source – Mukhujje Moshai YTC

. . .

ইন্টারেস্টিং বাবুল ভাই! পাশ্চাত্য কেতা অনুসরণ করতে যেয়ে শব্দের প্রতীকী অর্থে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। প্রতীকী শব্দের ব্যাকরণগত ইতিহাস অভিধানে গমন করলে পাই, কিন্তু শব্দগুলোর উৎপত্তি ও বিবর্তন সেখান থেকে ভালোভাবে জানা যায় না। দৈনন্দিন জীবন ও অন্যান্য প্রয়োজনে ব্যবহৃত শব্দরা কীভাবে এলো, তার পরিষ্কার ব্যাখ্যা তুলে ধরতে ভাষাতাত্ত্বিকরা হামেশা অপারগ বোধ করে। ইতিহাসবিদকে হয়রান দেখি আমরা! ধরে নেওয়া হয়,—শব্দগুলো সংস্কৃত, বিদেশি অথবা আঞ্চলিক ভাষায় প্রচলিত শব্দমূল থেকে উদ্ভূত। জনসমাজে মৌখিক ও লিখিত রূপে ব্যবহৃত হওয়ার ধারায় ঘটেছে বিবর্তন। প্রতীকী শব্দার্থবিধি মেনে সাজানো অভিধান অগত্যা সিংহভাগ শব্দের শিকড় সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিতে হিমশিম বোধ করে এ-কারণে!

মুখুজ্যে মশাই যদিও এখানে ধোপার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ধপধপে সাদা শব্দটির উৎস ইতিহাস থেকে চমৎকারভাবে তুলে এনেছেন। মিশমিশে কালো দূর অতীতে দাঁতের সৌন্দর্য বর্ধনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল,—এই তথ্যটি অবশ্য অজানা নয়। ঊনবিংশ শতকের সাহিত্যে নানান ছলে এর উল্লেখ দেখেছি মনে পড়ে। তবে, ধোপা শব্দটির উৎপত্তি ব্যাখ্যায় ওই-যে সংস্কৃত ধাবন শব্দটি মুখুজ্যে মশাই উল্লেখ করলেন,—এখানে তাঁর শব্দার্থ-বিচার প্রতীকীর বাইরে যেতে পারেনি।

অভিধান-প্রণেতা ও ভাষাতাত্ত্বিক পশ্চিম গোলার্ধে প্রচলিত রীতি-নিয়ম মেনে শব্দের অর্থ ও বুৎপত্তি বের করায় ধোপাকে তাঁরা ধাবন-এ নির্দিষ্ট করে নিয়েছেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষকে ভিত্তি ধরে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী শব্দের বুৎপত্তি ও ইতিহাস নিয়ে যেসব কাজ করে গেছেন, সেখানে কিন্তু ধাবন সরাসরি ধোপা শব্দটির উৎসমূল নয় কোনোভাবে! কলিম ও রবি মৌলিক একটি আবিষ্কারের জনয়িতা। আর সেটি হলো,—উপমহাদেশীয় ভাষাবৃক্ষ, বিশেষ করে বাংলা ভাষা কখনো প্রতীকী বা সিম্বলিক শব্দার্থ মেনে গড়ে ওঠেনি

বাংলা ভাষা মূলত বর্ণ নির্ভর ক্রিয়াভিত্তিক তরিকায় অভ্যস্ত থেকেছে অতীতে;—এই মতের সপক্ষে যুক্তিবিস্তার করেছেন দুজনেই। তাঁদের মতানুসারে,—অত্র অঞ্চলে যত শব্দের উদ্ভব ঘটেছে, তার সবগুলোর সঙ্গে সামাজিক জীবনাচার ও জীবিকা নির্বাহে সূত্রে নির্দিষ্ট কর্মের যোগসূত্র রয়েছে। শব্দগুলোর কোনোটাই যে-কারণে আগডুম-বাগডুম বা ননসেন্স নয়। প্রকৃত কারণ জানা গেলে উৎপত্তির ইতিহাস কাজেই আমরা অনায়াস জানতে ও বুঝতে পারব।

এই জায়গা থেকে কলিম খান বারবার দাবি করেছেন,—পৌরাণিক সাহিত্যের যেসব কাহিনি ও ব্যাখ্যায় আমরা এখন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, সেগুলো মোটা দাগে যথার্থ নয়। পুরাণে ব্যবহৃত শব্দের চাবি খুলতে বিফল হওয়ার কারণে প্রতীকী অর্থ ও ব্যাখ্যা আরোপ করে এগুলোকে অতিকাল্পনিক গাঁজাখুরি ধরে নিয়েছি। বাস্তবতা যদিও ভিন্ন;—ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির শরণাপন্ন হলে মিথ হিসেবে চিহ্নিত কাহিনিগুলোর নেপথ্যে সক্রিয় সামাজিক ইতিহাসের ছবিটি আমরা ঠিকঠাক ধরতে পারব।

একগুচ্ছ বই লিখে নিজের দাবিকে প্রতিষ্ঠা দিতে কলিম খান চেষ্টায় ত্রুটি করেননি। ভাষাতাত্ত্বিকরা অবশ্য তাঁর এসব ব্যাখ্যাকে বাতুলের প্রলাপ বলে হামেশা উড়িয়ে দিয়েছেন। মিজানুর রহমান ত্রৈমাসিক পত্রিকায় একসময় কলিম খানের পরম ভাষার সংকেত ধারাবাহিক বের হতো। ওই সুবাদে বাংলাদেশও ঘুরে গিয়েছিলে এই বিদ্যাজীবী। মানুষটি আবেপ্রবণ ও সহজ-সরল ছিলেন। বাংলাদেশের বজ্জাত বিদ্বানমহলের ব্যাপারে ওয়াকেবহাল ছিলেন না তিনি। তাঁকে নিয়ে আয়োজিত সেমিনারে বজ্জাতরা ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর ওপর। তাদের প্রশ্ন ও যুক্তির মধ্যে গভীর কোনো সারবত্তা আদৌ ছিল না। বেচারা কলিম খানকে ডেকে এনে একপ্রকার অপদস্থ করে ছাড়ে তারা।

Mijanur Rahman and his contribution – Collage; @thirdlanespace.com

ওইসময় বা সামান্য আগে-পরে হতে পারে,—মঈন চৌধুরীর সঙ্গে কলম-বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন কলিম খান। মঈন চৌধুরী যেসব পয়েন্ট থেকে তাঁকে আঘাত হেনেছিলেন, আমি পড়ে দেখেছি,—কলিম খানের মূল বক্তব্য ও যুক্তিকে বোঝার ধারেকাছে ছিলেন না মঈন। ছোটকাগজ প্রান্ত-র সম্পাদক, দর্শন পড়ুয়া ও বিজ্ঞানভাবিক লেখক হিসেবে আমাদের এখানে দারুণ প্রশংসিত মঈন চৌধুরীর মধ্যে ছদ্ম সাম্প্রদায়িক অভিমান আর মুসলমানিত্বের গোমর ছিল পীড়াদায়ক। এই ধরনের বিতর্ক অবশ্য পরে কলিম খান এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, যে-কারণে তিনি ও রবি মিলে বঙ্গীয় শব্দকোষের সম্প্রসারণ বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও সরল শব্দার্থকোষ আমাদেরকে উপহার দিয়ে যেতে পেরেছেন।

প্রারম্ভিক কথাগুলো বললাম এ-কারণে,—বাঙালি সমাজে বিদ্যাচর্চার কাঠামোয় আমরা পিউরিটান মানসিকতায় অভ্যস্ত। বিকল্প চিন্তা বা তত্ত্বকে আতশকাচের নিচে ফেলে যৌক্তিকতা যাচাই, প্রাসঙ্গিক তর্ক-বিতর্ক, যুক্তি ও পালটা যুক্তির মধ্য দিয়ে একে গ্রহণ অথবা খারিজ করার কালচারে অভ্যস্ত নই। কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী প্রস্তাবিত ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থ ব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করে বড়ো পরিসরে কোনো আলাপ আপনি পাবেন না। আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় প্রচলিত অভিধানে এরকম প্রচুর শব্দ রয়েছে, যেগুলোর অর্থ ও উৎস ব্যাখ্যায় প্রতীকী অর্থের পাশাপাশি রবি ও কলিম প্রস্তাবিত ক্রিয়াভিত্তিক অর্থকে অনায়াসে স্থান দেওয়া যেত। এতে করে আমাদের জানাশোনা ও সৃজনশীল ব্যাখ্যার দিগন্ত প্রসারিত হতো অনেকখানি।

রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির সপক্ষে ওকালতিটা অন্তত করতে পারতেন। ইনফ্যাক্ট, অভিধান সংকলনের মতো হাড়ভাঙা খাটনির ভার বহনে হরিচরণকে তিনি অনুপ্রেরণা ও সাহস যুগিয়েছিলেন তখন। রবি তাঁকে বলেছিলেন,—শব্দের যতরকম উৎস আমাদের এখানে পাওয়া যায়, সেগুলো ব্যবহার করে অভিধান লেখো তুমি। রবি ঠাকুরের আদেশ শিরোধার্য করে দরিদ্র স্কুলমাস্টার তাঁর গোটা জীবন কেবল এর পেছনে ব্যয় করেছিলেন। পরিশেষটা বড়ো নির্মম ছিল যদিও!

দরিদ্র স্কুলশিক্ষক ও পরে দেশভাগের খাড়ায় পড়ে কলকাতায় বস্তিতে ঠাঁই নিতে বাধ্য হওয়া হরিচরণ নিজেকে কেবল ওই একটি কর্মে ধ্বংস করেছিলেন। তাঁর পুত্রবধূ ছিলেন একমাত্র সহায় ও ভরসা। শ্বশুরকে মমতায় আগলে না রাখলে হরিচরণের পক্ষে কাজটি করা সম্ভব নাও হতে পারত। বুদ্ধদেব বসু এই শব্দসংগ্রাহকের জীবন বিধ্বংসী কর্ম নিয়ে একটি জীবন নামে চমৎকার ছোটগল্প লিখেছিলেন। গল্পটি নিয়ে পরে ছবিও তৈরি হয়েছিল। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেখানে হরিচরণের ভূমিকায় দারুণ অভিনয় করেছিলেন।

Kalim Khan and Ravi Chakrabarti’s Groundbreaking Work; Image Source – Google Image

যাইহোক, মূল কথায় আসি। ধোপা শব্দের আদি উৎস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী ধূ ধাতুমূলকে বেছে নিয়েছেন। সেখানে তাঁরা দুজন বলছেন, আমি উধ্দৃত করছি :

একালে আমরা ধূলি বা ধুলো বলতে dust বুঝি। কিন্তু ধূলি শব্দটি তার চেয়ে অনেক বেশি কথা বলে। অজিন শব্দের অর্থে সেকথা যেমন আমরা বুঝতে পারি, তেমনি উপরোক্ত অর্থেও সেকথা বোঝা যায়। বস্তুত কোনো সত্তা যখন নিজের ভিতর থেকে ধৃত বস্তু বিন্দু বিন্দু রূপে ত্যাগ করে এবং সেই ত্যক্ত বস্তু ‘রেণু, রজঃ, চূর্ণ, গুঁড়া’ রূপে আমাদের সামনে প্রতিভাত হয়, তখনই তাকে ধূলি বলে। কোনো বস্তু বা বিষয়ের অভ্যন্তরে ধৃত সমস্ত কলুষকে বিন্দু বিন্দু করে বের করে দেওয়াকে সেকারণেই ধোলাই বলে। যে প্রক্রিয়ার দ্বারা ধু-করা বা ভেতরের ধৃত কলুষকে বাইরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়, তাকে সেকারণেই ধোয়া বলে। [উৎস : বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ : কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী]

রবি ও কলিম খানের অভিধানে ব্যবহৃত ব্যাখ্যা পড়ে কারো মনে হতে পারে,—ধূ নামক বর্ণকে সারবত্তা ধরে এঁনারা কী আবোলতাবোল বকে যাচ্ছেন! তাঁদের ব্যাখ্যাকে আবোলতাবোল মনে হবে, যখন আপনি শব্দার্থ খুঁজতে যাবেন। এটি হচ্ছে প্রতীকী শব্দার্থবিধির মূল তরিকা। কোনো অক্ষর বা বর্ণ নয়, বরং বর্ণের সঙ্গে বর্ণ যোগ হয়ে যে-শব্দ তৈরি হয়,—তাকে ভিত্তি মেনে প্রতীকী শব্দার্থবিধি শব্দের অর্থ ব্যাখ্যা করে। এভাবে শব্দটির আদি উৎস সংস্কৃত বা অন্যান্য ভাষায় খোঁজে সে।

কলিম খানদের তরিকা ভিন্ন। তাঁদের বইপত্র যদি পাঠ করে থাকেন, তাহলে জানবেন,—ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থ বলতে তারা প্রতিটি বর্ণকে মিন করছেন। অর্থাৎ, ব্যঞ্জনবর্ণ ও স্বরবর্ণের একটিও নিছক অকারণে সৃষ্ট নয়। প্রতিটি বর্ণ প্রাচীনকালে কোনো-না-কোনো ক্রিয়া সম্পাদনের কারণার্থে সৃষ্টি হয়েছিল। ক্রিয়াকে যদি প্রাচীন সাহিত্যিক ও অন্যান্য উৎসে খোঁজ করি, তাহলে বর্ণকে কেন্দ্র করে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দভাণ্ডারের বিস্ময়কর এক খনির সন্ধান আমরা পেতে পারি। যেখান থেকে পরে বিচিত্র শব্দ, অর্থ ও ব্যাখ্যা তৈরি করে নেওয়া সম্ভব। এই যেমন, ধূ ধাতুমূলকে ব্যবহার করে বিবর্তিত ধূমা/ধোয়া শব্দের উৎস ব্যাখ্যায় রবি চক্রবর্তী ও কলিম খান কী বলছেন তার একটু তুলে দেই বরং :

পৌরাণিক কাহিনিতে আছে, পার্বতী একবার ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হয়ে মহাদেব শিবের কাছে তাঁর খিদে মেটানোর জন্য মিনতি করেন। সদাশিব শিব খাদ্য দান করতে অসমর্থ হন। তখন পার্বতী ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মহাদেবকেই গ্রাস করে ফেলেন। এই সময় পার্বতীর দেহ হতে ধূম নির্গত হয়ে তাঁকে বিবর্ণ করে। মহাদেব তখন মায়া দ্বারা শরীর কম্পিত করে বলেন, ‘তুমি আমাকে গ্রাস করে বিধবা হয়েছ, অতএব এখন থেকে তুমি বৈধব্যবেশেই অধিষ্ঠান করবে এবং এই বেশেই তুমি পূজনীয়া হয়ে ধূমাবতী নামে প্রসিদ্ধা হবে।’ (পৌ.অ.)।

উপরোক্ত বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, পরিচালকদের গ্রাস করে ফেলায় একটি সমাজগোষ্ঠীর থেকে ধূম বা বিক্ষোভ নির্গত হয়, সামাজিক সম্পর্কের বিভিন্ন স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপ ধোঁয়াটে হয়ে ঢাকা পড়ে এবং সেই ধূম সমগ্র সমাজকে বর্ণহীন বা বর্ণাশ্রম ধৰ্ম্মহীন করে দেয়। জনগোষ্ঠীর এই রূপটিকেই ধূমাবতী বলে। এরকম ঘটে তখনই যখন পরিচালকদের পরিচালনে গুরুতর ত্রুটি দেখা দেয়। আমাদের মনে হয়, যখন পরিচালক নিজেই স্থাণু (শিবের একটি রূপ) হয়ে পড়েন, পরিচালিতদের মধ্যে দেহবাদিতার রমরমা হয়, লোকে দেহের প্রয়োজনকেই একমাত্র বিচার্য বিষয়, কামনার বিষয় বলে মনে করে, তখনই।

কিন্তু দেহবাদিতা মানে তো আগুনে ঘি ঢেলে নেভানোর চেষ্টা, এবং এ-চেষ্টা নিতান্তই পাগলামি। বিশ্বায়নের সাম্প্রতিক কালখণ্ডে এরকম পরিস্থিতি খানিকটা দেখা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি যদি আরও দশ-বিশ বছর চলে, আজকের পৃথিবীর সমাজগোষ্ঠীগুলিও ধূমাবতী হয়ে যাবে। [উৎস : বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ : কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী]

Verb-based semantics of Kalim Khan and Ravi Chakravarti; Podcast with Ravi Chakravarti; Source – Dialoguein YTC

খেয়াল করুন বাবুল ভাই,—রবি ও কলিম মিলে এখানে ধূমা/ ধোয়া/ ধূমাবতী শব্দের উৎস ব্যাখ্যায় শিব-পার্বতীর যে-পৌরাণিক কাহিনি ব্যবহার করছেন, সেটি নিছক গাঁজাখুরি গল্পকাহিনিতে সীমিত থাকছে না। এর মধ্যে তাঁরা ওইসময়ের সমাজ-কাঠামো ও তার বিন্যাসকেও ধারণ করছেন। সমাজ স্বয়ং সেখানে শিবের মতো স্থাণু বা আমাদের ইউনূস স্যারের মতো সব জেনেশুনে নির্বিকার থাকায় সামাজিক ক্ষোভ তখন ধূমায়িত হয়েছিল। পার্বতীর শিবকে ভক্ষণ করা ধূমায়িত সংহারের খবর দিচ্ছে এখানে।

কলিম খানদের পুরাণ ব্যাখ্যার তরিকা বাংলার বিদ্বানসমাজ মেনে নিতে পারেননি। এর সবটাই দুজনের উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত কাল্পনিকতা বলে উড়িয়ে দিতে মরিয়া থেকেছেন! এর পেছনে নাকি গভীর ভাষাতাত্ত্বিক বিবর্তন ও সমাজ-ইতিহাসের বালাই নেই! উড়িয়ে দেওয়ার সময় ভুলে যাচ্ছেন,—তাঁরা স্বয়ং যেসব উৎসে ভর দিয়ে পুরাণ ব্যাখ্যা করেন,—সেগুলোর সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিকতা প্রমাণিত নয়!

ইতিহাস হচ্ছে নমুনা বা নিদর্শনের টুটাফাটা সূত্র ধরে অগ্রসর হওয়ার একটি পন্থা। সেগুলোকে জোড়া দিয়ে-দিয়ে একটি বয়ান ইতিহাসবিদ দাঁড় করান। কল্পনা ও অনুমানের শরণ তাঁকেও নিতে হয় সেখানে। কলিম ও রবি যেমন বর্ণভিত্তিক শব্দার্থকে চাবি ধরে পুরাণ-কাহিনির নেপথ্যে সক্রিয় সামাজিক বাস্তবতাকে অনুমান ও এর একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। ইতিহাসের প্রচলিত ও স্বীকৃত পন্থার বরখেলাফ তা কোনোভাবে ছিল না।

সত্য-মিথ্যা বড়ো কথা নয়, ব্যাখ্যা কতখানি যৌক্তিক হয়ে উঠছে, সেটি হচ্ছে প্রতিপাদ্য বিষয়। কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী এভাবে ভারতবর্ষের অতি সনাতন ইতিহাসে প্রবেশ করেছিলেন। তাঁরা দেখিয়েছেন,—পুঁজিবাদের উদ্ভব রাম-রাবণের যুগ বা তারো আগে থেকে সমাজে ঘটে আসছিল। আজকের মতো করে অবশ্যই ঘটেনি, কিন্তু এর বীজ খুঁজতে নেমে পাশ্চাত্য বিশ্বে তৈরি বয়ানগুচ্ছ মধ্যযুগের দ্বিতীয় পর্বে এসে থেমে পড়ে;—সেখানে চক্কর দেয় অধিক। কলিম খানরা রামায়ণ, মহাভারত ও আরো প্রাচীন কালে বীজ সুপ্ত দেখতে পাচ্ছেন। ভারতবর্ষে অন্ততপক্ষে তাই ছিল বলে তাঁরা মানতেন ও অন্যকে মানানোর চেষ্টা করেছেন।

জানি না বোঝাতে পারলাম কি-না। কলিম খানের বইপত্র অনলাইনে সুলভ। কষ্ট করে যদি তার দু-চারটায় চোখ বোলান, তাহলে সহজে বুঝে যাবেন তিনি ও রবি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন। দুজনের ব্যাখ্যা ও বিবরণের অনেককিছু মেনে নেওয়া শক্ত ঠেকবে, তবে পাঠ করতে বসে চমকে উঠতে হয়! একবাক্যে উড়িয়ে দেওয়া ও অযৌক্তিক বলে খারিজ করার আগে ভাবতে হয় দুবার। মঈন চৌধুরীর মতো আকাট পন্থা ধরে আগালে অবশ্য খারিজ করা ব্যাপার থাকছে না!

Kalim Khan and Ravi Chakrabarti; Image Source – Google Image

ধোপায় ফিরি আরেকবার। ধোপা/ ধোবা এই-যে শব্দগুলো আমরা ব্যবহার করছি, তার পেছনে মুখুজ্যে বাবুর বর্ণনা মোতাবেক সমাজ-ইতিহাস নিশ্চয় রয়েছে। ধোপা স্বয়ং বর্ণভিত্তিক সমাজে পেশাজীবী শ্রেণি;—এবং বহু পুরাতন পেশাজীবী তারা। কাপড়কে রঞ্জিত করার ইতিহাস এদিক থেকে সঠিক। কিন্তু, ধোপা/ ধোবা বা হিন্দি ধোবি ইত্যাদির শাব্দিক উৎসমূল ওই একটি বর্ণ ধূ থেকেই বিবর্তিত। যেমন বিবর্তিত আরো হাজারো শব্দ।

কলিম খানরা এই ফাইট দিতে চেয়েছিলেন,—বাংলা বর্ণমালার একটি বর্ণও নিছক সিম্বলিক বা প্রতীকী নয়, যেমনটি আমরা ইংরেজি বা অন্য ভাষায় সচরাচর দেখে থাকি। প্রতিটি বর্ণ সুনির্দিষ্ট ক্রিয়া সম্পাদনের দায় মিটাতে গিয়ে উদ্ভুত হয়েছিল। সমাজে বর্ণগুলোর উৎপত্তি ও বিকাশ-বিবর্তন এই নিয়মছকে ঘটেছে। আজকে আমরা ধোপা বলছি, একসময় ধোপাও বলত না লোকজন;—তারা বলত ধোপ। রবি ও কলিম জানাচ্ছেন :

আপনার জামায় কালো দাগ পড়েছে। আপনি ধোপাকে বললেন, ‘দেখো, জামার এইখানটায় কালো কালো ছোপ পড়েছে, এটাকে ধুয়ে ধোপদুরস্ত করে দিয়ো। ছোপ ছোপ দাগ জামার নিজস্ব রংকে ছাদিত করে দেয়, ঢেকে দেয়। আর সেই দাগকে ধূ করে বা ধৌত করে জামার নিজস্ব রংকে প্রকাশিত করে দেওয়া গেলে সে হয়ে গেল ধোপ।

এই শব্দটির ব্যবহার এখন শোনা যায় না। কিন্তু এমনকি ১৯৫০ সালেও এর ব্যবহার ছিল। ছাত্রবোধ অভিধান এই শব্দের ব্যবহার দেখাচ্ছে ‘কাপড়ের ধোপ খুলে নাই।’ তাহলে দেখা যাচ্ছে, ছোপ শব্দের ভিতরে ছো-পালিত হয় বা গোপন করে দেওয়া হয়, আর ধোপ শব্দের ভিতরে ধো-পালিত হয় বা সুপ্রকাশ পালিত হয়।

সুপ্রকাশ পালিত হয়;—কথাটির অর্থ এই-যে ,—কাপড় পরিষ্কার করা আমাদের এখানে নিছক বস্তগত অর্থ বহন করত না। বিচিত্র আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় অনুষঙ্গের প্রসারের কারণে প্রাচ্য ও ভারতবর্ষীয় মননে ধৌতকরণ মানে হচ্ছে দেহস্বরূপা জগতে যা-কিছু ময়লা জমেছে,—তাকেও পরিষ্কার করা। সকল দাগ মুছে ঝকঝকে বা পরিচ্ছন্ন হয়ে ওঠা। [উৎস : বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ : কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী]

প্রতীকী অর্থে এটি কিন্তু পরে মোড় নিয়েছিল অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার দিকে। শব্দের অর্থ ব্যাখ্যায় সুতরাং প্রতীকীর পাশাপাশি ক্রিয়াভিত্তিককে রাখলে ক্ষতি নেই মনে করি। এতে বরং আমাদের কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটবে। কবিতা ও অন্যান্য সাহিত্যিক অভিজ্ঞতাকে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থ দিতে পারে নতুন ব্যঞ্জনা। পোড়ার দেশে আমাদের কবিলেখক এতটাই আজব কিসিমের হতে আছেন ক্রমশ, তাদের মরমে কিছু পশে না। বিকল্পকে সম্ভাবনা রূপে ব্যবহারের মানসিকতা কাজেই এখন আর বেঁচে নেই!
. . .

Bindu Bisarga by Debotosh Das; A thriller novel, based on Kalim Khan’s works; Image Source – Google Image

সংযুক্তি :

কলিম খানকে নিয়ে বিরচিত রহস্য-উপন্যাস বিন্দুবিসর্গ-এর কাভার আজকের নেটালাপে সংযুক্ত করছি। দেবতোষ দাশ বিরচিত উপন্যাসটি কলকাতা বইমেলায় মার কাটকাট বিক্রি হয় তখন। কলিম খানকে ওপার বাংলার শিক্ষিত সমাজ আরেকটু নিবিড়ভাবে জানাবোঝার সুযোগ পান তাতে। ইউরোপ-আমেরিকায় গুণী ব্যক্তি ও তাঁর কাজকর্ম নিয়ে থ্রিলার ধাঁচে গল্প-আখ্যান লেখার চল অনেক পুরোনো। গোয়েন্দা কাহিনির বাড়বাড়ন্ত থাকলেও মাসুদ রানা ছাড়া সার্থক থ্রিলার বাংলা ভাষায় নেই। দেবতোষ দাশ এগিয়ে এসেছেন। কলিম খানের মনীষা ও জীবনব্যাপী সম্পন্ন কর্মকে উপজীব্য করে রচিত আখ্যানটি মারাত্মক লেভেলের এ-কথা বলব না;—তবে পড়তে মন্দ লাগেনি। বড়ো কথা, কলিম খানের পরমা ভাষার প্রকৃতিকে সহজ ভাষায় ধরিয়ে দিতে লেখক সচেতন থেকেছেন আগাগোড়া। রোমাঞ্চ আখ্যানটির কাহিনি-সংক্ষেপ একবার ইয়াদ করা যেতে পারে :

জনপ্রিয় ও বহুলপঠিত এক সংবাদপত্রের সম্পাদক বিল্বদল চট্টোপাধ্যায় বা বিলুকে কে বা কারা মাঝরাতে খুন করে। পুলিশ তদন্তে নেমে ধরণী কয়াল ওরফে ডিকে-র ওপর হত্যারহস্য উদঘাটনের ভার চাপায়। ডিকে সরাসরি পুলিশের লোক নয়, তবে স্পাই হিসেবে সুনামের সঙ্গে কাজ করে আসছেন।

ডিকে-র তদন্তে বেরিয়ে আসে মহাভারত ও রামায়ণ নিয়ে কলিম খান ওরফে কবীর খানের নতুন ব্যাখ্যা সম্বলিত রচনা পত্রিকায় ছাপানোর উদ্যোগ নেওয়া বিলুর জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উগ্রপন্থী চক্র কোনোভাবে চায়নি কবীর খানের এই রচনাটি আলোর মুখ দেখুক। হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক শিবিরে তাতে ধস নামার সম্ভাবনা তীব্র হবে। বিরোধীরাও কবীর খানের লেখাটিকে অ্যানক্যাশ করবে তাৎক্ষণিক। আর, পাবলিক নতুন ব্যাখ্যায় প্রভাবিত হবে ব্যাপক। সুতরাং তাদের মূল লক্ষ্য,—কবীর খান সহ তাঁর পাণ্ডুলিপি নিকেশ করা।

চক্রের মূল হোতা নীলকণ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কবীর খানের সহপাঠী ছিল। তাঁর কাজবাজের ব্যাপারে খুভ ভালো জানে সে। বিলুর ব্যক্তিগত সহকারী নিবেদিতা আর ডিকে মিলে কি পারবে কবীর খান ও তাঁর ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি থেকে বেরিয়ে আসা ভারত-ইতিহাসের নতুন ব্যাখ্যাকে বাঁচিয়ে রাখতে?

রহস্য-উপন্যাসের কাঠামো মেনে জমাট বিবরণকে জায়গা দিয়েছেন দেবতোষ। রোমাঞ্চ আখ্যানের বড়ো দিক হলো,—আলাভোলা কলিম খানের মূল থিয়োরিকে প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখে তুলে ধরেছে এটি। বিন্দুবিসর্গ বাজিমাত করায় দ্বিতীয় খণ্ড বের করার ভাবনা দেবতোষের ছিল, হয়তো তা বেরিয়েছে ইতোমধ্যে। কলিম খান জীবদ্দশায় তাঁকে নিয়ে রচিত উপন্যাসটি দেখে যেতে পেরেছিলেন। শিশুর মতো খুশি হয়েছিলেন পাঠ করে। আফটার অল, তাঁর একজীবনের সাধনা নিয়ে কেউ লিখছে, তাতেই তৃপ্ত ছিলেন এই গুণী। 
. . .

মিনহাজভাই, আপনার মন্তব্য ভালো লাগলো। আজকে আলাপের সূত্রে কলিম খানের প্রসঙ্গ উঠল বলে তাঁর পরমাভাষার সংকেত বইটা হাতে নিলাম (সংগ্রহে ছিল)। বইয়ের এক অধ্যায়ে লিখেছেন :

পণ্য বা শব্দকে তাদের স্ব-অর্থের মধ্যে বন্দি করে রাখলে তারা নিরর্থক হয়ে যাবে, হয়ে যাবে মূল্যহীন। পণ্যসৃজনকারীরা জেনে যান, Branding adds Value to a product, শব্দসৃজনকারীরা বুঝে যান, শৈলীই তাঁদের সৃষ্টিকে ব্যর্থতার হাত বাঁচিয়ে (স+অর্থক) তুলতে পারে।

খুব তাৎপর্যময় ভাষ্য, যা আধুনিক শিল্প, ভাষা ও অর্থনীতির একটি জটিল যোগসূত্র তুলে ধরে। কলিম খান তাঁর পরমাভাষার সংকেত-এ ভাষার গভীরতর দর্শন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এমন-এক কথন উপস্থাপন করেছেন, যা শুধু ভাষাতাত্ত্বিক নয়—সমকালীন অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিশ্লেষণের দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। নিশ্চয় কোনও পণ্য বা শব্দকে যদি তার স্ব-অর্থ বা নিজস্বতায় একান্তভাবে আবদ্ধ করে রাখা হয়, তবে তা হয়ে উঠতে পারে নিরর্থক, এমনকি মূল্যহীন। কারণ, মানবচেতনায় অর্থ প্রবাহমান, অর্থ সম্পর্কগত (relational), এবং অর্থ বিপ্রতীপের ভিতর দিয়ে নির্মিত হয়।

এখানে আসে ব্র্যান্ডিং ও শৈলীর প্রসঙ্গ। যেমনভাবে ব্র্যান্ডিং একটি সাধারণ পণ্যে যোগ করে তার বাঞ্ছিত প্রতীকতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক মান, তেমনই শব্দের নিরেট অর্থ নয়—তার উপস্থাপন, তার প্রক্ষেপণ, তার শৈলীই হয়ে ওঠে প্রধান। কবিতা, নাটক, এমনকী সংবাদেও শব্দের শৈলীর মধ্য দিয়েই তৈরি হয় তাৎপর্য, আবেদন, এবং অভিঘাত।

যেমন ‘পাথর’ শুধু একটা বস্তু নয়—শিল্পীর হাতে, সে হয়ে ওঠে প্রতিবাদের প্রতীক; প্রেমিকের মুখে, সে হতে পারে বুকের ভার। ‘রুটি’ হয়ে যেতে পারে বিপ্লবের সংকেত। তাই শব্দের ভেতরের ‘স্ব-অর্থ’ নয়, তার বহুবিচিত্র সম্ভাব্যতা ও প্রসারণশীল দ্যোতনাই তাকে গুরত্বপূর্ণ করে তোলে। একেই বলা যায়, ‘স+অর্থকতা’—যা কেবল শৈলী দিয়েই অর্জিত হয়।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে শিল্প বা সাহিত্যসৃষ্টি একরৈখিক অর্থ নয়, বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনার মধ্যে সত্য অর্থে জীবনধর্মী হয়ে ওঠে। ফলে, লেখক, কবি কিংবা চিন্তকের দায়িত্ব শুধু ‘কথা বলা’ নয়, কীভাবে বলা হলো, সেই ‘কীভাবে’-এর ভিতরেই নিহিত থাকে তার সৃষ্টির ভবিষ্যৎ!

. . .

Dhobi Ghat (Mumbai Diaries) Movie Trailer by Kiran Rao; Source Aamir Khan Production YTC

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 60

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *