আমেরিকা’স গট ট্যালেন্ট (America’s got talent) ওরফে এজিটির মঞ্চে চুয়ান্ন বছর বয়সী এক লোক গান করতে উঠেছেন। কাঠের আসবাব নির্মাতা লোকটির জন্য জীবন সহজ ছিল না। বউ ও ছেলেকে ভালোবেসে লাগাতার কাজ করে গেছেন। ছেলেকে মানুষ করতে বাড়তি খাটনি দিয়েছেন দিনের-পর-দিন। ছেলে মানুষ হয়েছে, কিন্তু সে আজ তার পাশে নেই। ধন্যবাদ পর্যন্ত না দিয়ে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। স্ত্রীও ধরেছে একই পথ। পরিজনহারা সর্বস্বান্ত ভদ্রলোক তবু তাদেরকে এখনো ভালোবাসেন। তাদের কথা ভেবে নিজেকে প্রবঞ্চিত আর একলা লাগে। পরিত্যক্ত ভাবতে মন চায়। গানের সুরে বেঁধে দুখী জীবনের কাহিনি মঞ্চে গাইছেন পড়ন্ত বয়সে পা রাখা আসবাব নির্মাতা। মর্মন্তুদ আক্ষেপে গাঁথা গানটি শুনতে বসে গানমঞ্চের বিচারক ও দর্শকরা চোখ মুছছেন ঘনঘন। শিল্পীর গায়কি দখলে নিয়েছে অগণিত দর্শক-শ্রোতার হৃদয়।
গানটি ইউটিউবে রিলিজ করেছে মে মাসের ৪ তারিখ। অর্ধকোটি মানুষ ইতোমধ্যে শুনে ফেলেছেন। টিকটক, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, এক্স ইত্যাদি হিসাবে নিলে ভিউয়ের সংখ্যা অবিশ্বাস্য অঙ্কের হবে নিশ্চয়। প্রচুর রিলস ছাড়া হয়েছে এ-পর্যন্ত। আবেগের পারদ চড়চড় করে ওপরে তোলা গায়কিতে চোখের জল ধরে রাখা কঠিন মানছেন অনেকে! হৃদয়স্পর্শী গানটি সংক্রামক হওয়ার কারণে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার সময় শ্রোতা-দর্শক ইউটিউব চ্যানেলের নামধাম আর মন্তব্য বিভাগে ঝোলানো স্বীকারোক্তি খেয়াল করতে ভুলে যাচ্ছেন। শিল্পীর ব্যাপারে বিস্তারিত জানার ফুরসত মিলছে না কারো! এতটাই সম্মোহন তৈরি করেছেন চুয়ান্ন বছরে পা রাখা গায়ক আর্নেস্টো।
ইউটিউব চ্যানেলটির মন্তব্য বিভাগ অবশ্য গায়কের ব্যাপারে তথ্য দিতে কৃপণতা করেনি। সেখানে তারা বলছে,—গানটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে। আর্নেস্টো নামে চুয়ান্ন বছর বয়সী এই গায়কের অস্ত্বিত্ব পৃথিবীতে নেই। তিনি হচ্ছেন এআই টুল কাজে লাগিয়ে সৃষ্ট অ্যাভাটার। দর্শককে বিনোদন দানের উদ্দেশ্যে তাকে সৃজন করা হয়েছে। যে-ভদ্রলোক কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন, তাঁর চ্যানেলের নাম হচ্ছে এজিটি ভার্স এআই (AGTverseai)। নামে নিজের পরিচয় আসলে দিয়েই রেখেছেন ভদ্রলোক। গানের আবেগে মজে থাকা দর্শক-শ্রোতা তা খেয়াল করার অবস্থায় নেই বোঝা যাচ্ছে!
আমেরিকান আইডল-এর মতো না হলেও আমেরিকা’স গট ট্যালেন্ট-এর জনপ্রিয়তাও কম নয়। এবিসি নেটওয়ার্কের জোর প্রতিদ্বন্দ্বী এনবিসিতে নিয়মিত চলে এই মিউজিক রিয়েলিটি শো। কুড়িটি সিজন তারা পার করে ফেলেছে। এখন তাদের নামপরিচয় ব্যবহার করে ভদ্রলোক কাণ্ডটি কীভাবে ঘটালেন, তার কিছু বোঝা গেল না! এজিটির সঙ্গে গোপন বোঝাপড়া ও চুক্তিতে সই করে হয়তো কারবারটি ঘটিয়েছেন তিনি! গোমর ফাঁস করার মতো তথ্য প্রদানে গুগল মামা ফেল মারছেন এখানে।
গানমঞ্চের বিচারকরা বেশ পরিচিতমুখ। আমেরিকান আইডল-এ এঁনাদের দুই-একজনকে দেখেছি অতীতে। এখন এজিটির হয়ে বিচারকের চেয়ারে বসেছেন বোঝা যায়। ভদ্রলোক সেগুলো বেশ জুড়ে দিয়েছেন এখানে। জাজ ও অডিয়েন্সের পুরোটা হতে পারে এআই দিয়ে পুনরায় সৃজন করেছেন তিনি! এরকম হওয়াটা বিচিত্র নয়। ঘটনা যেমন হোক, বিশ্ব জুড়ে ট্রেন্ড্রে পরিণত গানটি সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার পরে অনেকে ধোঁকা খাওয়ার ঘটনা বুঝতে পেরে মুষড়ে পড়েছেন। বায়বীয় এক চরিত্রকে এভাবে সমাজমাধ্যমে রাতারাতি ছড়িয়ে দেওয়ার খেলাটি কেন ধরতে পারলেন না সেকথা ভেবে নিজের ওপর রাগ হচ্ছে অনেকের!
ধোঁকা খেয়ে হাবা হাসমত বনে যাওয়ার জেরে উঠেছে নতুন বিতর্ক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি এই পর্যায়ে চলে যায়, তাহলে মানুষের কী হবে? সৃষ্টিশীলতা বলে কিছুই কি থাকবে না তার হাতে? সব কি একাই খেয়ে নেবে এআই দানব? অনেকে শাপশাপন্ত করছেন। অনেকে আবার সপক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন বেশ।
উত্তেজনার তোড়ে সবাই ভুলে যাচ্ছেন,—গায়কের স্রষ্টা এখানে এআই প্রযুক্তি নয়, বরং এই প্রযুক্তির উদ্ভাবক মানুষ। মানবমেধা যে-প্রযুক্তিকে জন্ম দিয়েছে, যে-সক্ষমতা এটি অর্জন করেছে ও সামনে করতেই থাকবে… এখন এই বাস্তবতাকে মেনে নেওয়াটাই সকলের জন্য ভালো। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হলো মানবসৃষ্ট প্রথম প্রযুক্তি;— মানুষ যাকে নিজ-অবয়বে চিন্তা করেছে। মনের মাধুরী মিশিয়ে তার সঙ্গে সকল দিক দিয়ে মাননসই সঙ্গীকে সৃজনের ক্ষুধা পূরণ করছে সে। এআই সৃষ্ট কোনো চরিত্রকে গানমঞ্চে অবিকল মানুষের মতো গাইতে দেখে কাজেই হা-হুতাশ করার কিছু নেই।
ঈশ্বর হওয়ার বাসনা মানুষের মনে কাজ করছে। মানবসৃষ্ট এক যন্ত্রআদম মানব বিরচিত স্বর্গোদ্যানে বিচরণ করছে। তাকে যা করতে বলা হচ্ছে সেটি করছে সে। এমন দিন আসতে পারে, তাকে আর কিছু বলা লাগবে না, সে তার মর্জিমাফিক করতে থাকবে যা মন চায় সেটি। মানুষকে তখন ঈশ্বরের মতো তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হতেও পারে। সমস্যা হলো কাজটি তখন আর সহজ থাকবে না মানুষের জন্য। কারণ, সে ততদিনে তার ইচ্ছামাফিক স্বর্গ ও নরক বানিয়ে নিতে চাইবে। সুতরাং ঈশ্বর সৃষ্ট আদম ও মানব সৃষ্ট আদম মুখোমুখি দাঁড়াবে সেখানে। যুদ্ধ হবে যুদ্ধ! কে জিতবে আর কে হারবে, সেটি আপাতত অনুমান করা কঠিন।
মানব যদি হারে, আমার একটুও খারাপ লাগবে না। মানব প্রজাতি তার চরম উৎকর্ষ লাভ করেছে। ঈশ্বর হয়েছে সে। পরিপূর্ণতা লাভের পর কোনো একভাবে তার বিলয় ঘটা প্রয়োজন। এখন সেটি যদি তার সৃষ্ট যন্ত্রআদমের হাতে ঘটে তো মন্দ কি তাতে? সমস্যার কারণ দেখছি না সেখানে।
আর যদি মানব প্রজাতি জেতে, তাহলে এই প্রথম তারা বুঝতে পারবে,—ঈশ্বর হওয়ার চেষ্টা না করলেও চলত। মানবকে যে-ঈশ্বর সৃজন করেছেন বলে অনেকে বিশ্বাস করেছে এতদিন, এবং অনেকে করেওনি,—এমন একখানা রহসময় ও ঘোলাটে ঈশ্বর হতে না পারলে ফায়দা নেই। মানুষের কাজেই ঈশ্বর হওয়ার চেষ্টায় গমন করা উচিত হয়নি।
পরেরটা পরে দেখা যাবে। আপাতত বিচ্ছেদ বেদনায় আতুর গানটি আমরা শুনতে থাকি। উপভোগ করি এর গায়কি। নিজেকে উজাড় করে গেয়েছেন চুয়ান্ন বছরের আর্নেস্টো। চোখে জল আসছে শুনে।
. . .
. . .



