
. . .

প্রসঙ্গ : কবি আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী

ওগো সজনী গোয়াগাছো ট্যাক্সো লাগিলোনি
বাটার উফর ফইলো ঠাটা গাল ভরি ফান খায়তায়নি।
বহুল জনপ্রিয় ও কালোত্তীর্ণ গানটির রচয়িতা আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী। গুণী এই মানুষটি কবিতা ও সনেট লিখতেন। গান লেখার হাতটাও ছিল দারুণ! ছয়শতাধিক গান আর এক হাজারের অধিক সনেট লিখেছেন কবি। মর্মত, কবিতা ছিল তাঁর মূল চারণভূমি । কবিতার সৃজন-আনন্দ আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীকে গানের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তাঁর রচনারীতির বিশেষত্ব হলো,—কবিতা লেখার সময় প্রমিত বাংলা, আর বেশিরভাগ গান রচনায় আঞ্চলিক ভাষাভঙ্গি বেছে নিতেন। বিশ্বমানব ও লোকজমানব উভয় সত্তাকে কবি অন্তরে ধারণ করেছেন পরম মমতায়, এবং তা অত্যন্ত সচেতনভাবে।
গুরুসদয় দত্ত ও আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী ছিলেন অভিন্ন বংশধারার উত্তরাধিকার। কবিতা ও গান রচনায় গুরুসদয় দত্তের প্রেরণা ও দিকনির্দেশনা পাথেয় গণ্য করেছেন কবি। দেশকে স্বাধীন করার মন্ত্রে গঠিন ব্রতচারী আন্দোলনে যোগ দিতে গুরুসদয় দত্তই তাঁকে অনুপ্রাণিত করেন। শুধু তাই নয়,—সিলেট অঞ্চলে প্রচলিত লোকসংগীত সংগ্রহ ও সংকলনের ভার গুরুসদয় তাঁর কাঁধেই চাপিয়েছিলেন।
অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্বটি পালন করেছেন কবি আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী। সিলেটের প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরে সংগ্রহ করেন লোকগানের বিপুল সম্ভার। সংগৃহীত গানের সংকলন বই আকারে প্রকাশের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমাও করেছিলেন গুরুসদয় দত্ত। ১৯৪১ সালে তিনি দেহ রাখেন। গ্রন্থ প্রকাশে ঘটে বিঘ্ন। দীর্ঘদিন পর ১৯৬৬ সনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বইটি প্রকাশ করলেও সম্পাদক, সংকলক ও সাংগ্রাহকের নামপত্রে আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর কোনো নামনিশানা তাঁরা রাখেননি!
যদিও, সনেট ও গীতকবিতা রচনায় পারদর্শী কবি তখন এই কাজে হাত না-দিলে সিলেট অঞ্চল জুড়ে ছড়ানো লোকগানের খনি বিলুপ্ত হওয়ার শঙ্কা প্রবল ছিল। সুফি ঘরানার চিন্তক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়,—১৯২৮ সনে কাজী নজরুল যখন দ্বিতীয় দফায় সিলেটে ঘুরতে আসেন, তখন আবদুর রাজ্জাক ও আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর পাণ্ডুলিপি পাঠ করে দু-জনের কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন,—‘গফ্ফার ও রাজ্জাক তোমাদের উভয়ের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। চালাও কলম। তোমাদের সফলতার নিশ্চয়তার জন্য আমি দায়ী রইলাম।’
যাঁদের অনুরাগ, অনুসন্ধান ও ভালবাসায় কবি আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর কবিসত্তা ও সৃষ্টিসম্ভার আমাদের নাগালে এসেছে, সুযোগ করে দিয়েছে তাঁকে নিবিড় করে জানার,—তাঁদের নামোল্লেখ এখানে প্রয়োজনীয় মনে করি :
… কবি আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীকে নিয়ে এ-পর্যন্ত যেসব কাজ হয়েছে …
(গ্রন্থতালিকার খবর জানতে নিচের বাটন চাপুন)
আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী : শতবার্ষিক স্মরণগ্রন্থ : সংকলন ও সম্পদনায় শুভেন্দু ইমাম; ডিসেম্বর ৩১, ২০২১২।
নির্বাচিত গান : আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী : সম্পাদনা : ভীষ্মদেব চৌধুরী, লীনা তাপসী খান, আলী মোসতফা চৌধুরী; জুন ০১, ২০১৮।
আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর নির্বাচিত কবিতা : সংকলন ও সম্পাদনা : ভীষ্মদেব চৌধুরী ও মোস্তাক আহমাদ দীন; মে ২০২৪।
সনেট সমগ্র : আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী। ৯৭০টি সনেট সন্নিবেশ ও সম্পাদনা : আবুল ফতেহ ফাত্তাহ; ফেব্রুয়ারি ২০২৩।
বাংলাভাষার একজন প্রতিভাবান কবির স্বরূপ উন্মোচনে যাঁর অবদান অনবদ্য, তিনি হচ্ছেন কবি আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর সুযোগ্য পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী মোসতফা চৌধুরী। কৃতজ্ঞতা জানাই কবি বিমান তালুকদারকেও। বিমান দীর্ঘদিন যাবত আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী স্মৃতিপর্ষদ’ নিয়ে কাজ করছেন।
কতিপয় প্রস্তাবনা :
বিশ্বসাহিত্য জগতে কবি আবদুল গফ্ফার দত্ত চৌধুরীর সৃষ্টিসম্ভার পৌঁছে দেওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে তাঁর সৃষ্টি ও নির্মাণ ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হওয়া প্রয়োজন। এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে রাখছি।
কবি আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী রচনা মনিপুরি ভাষায় রূপান্তরিত ও অনুবাদ করা যেতে পারে। যেহেতু মনিপুরী জতিগোষ্ঠির সঙ্গে সিলেট অঞ্চলের রয়েছে নিবিড় আত্মিক সম্পর্ক।
আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী একজন লোকগান সংগ্রহক ছিলেন। তাঁর সংগৃহীত লোকগান বাংলাভাষার দুর্লভ সম্পদ। এই সম্পদ সংরক্ষণে সংগৃহীত গানগুলোকে সুচারুভাবে সম্পাদনা ও সংকলন আকারে প্রকাশ সময়ের দাবি মনে করি।
আমরা জানি, ছোটোকাগজের মূল কাজ হলো শেকড়ের সন্ধানে নিরত থাকা। সিলেটের মৃত্তিকাসংলগ্ন কবি আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর সৃষ্টি ও নির্মাণের ওপর আলো ফেলতে ছোটোকাগজে বিশেষ সংখ্যা ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ করার ভাবনায় গমনের সময় কি হয়নি এখনো?
. . .

আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর গুয়া গাছো ট্যাক্সো লাগিলোনি গানটির ব্যাপারে অনেক শুনেছি। অত্যাচারী ইংরেজ সরকার রাজস্ব আদায়ে করের হার অযৌক্তিক বাড়িয়ে দিয়েছিল। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে চাপ তীব্র হয় তখন। এর প্রতিবাদে সম্ভবত গানটি লিখেছিলেন তিনি। ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে তাঁর সম্পৃক্ততার ব্যাপারে অবশ্য আমার কোনো ধারণাই নেই! তিনি-যে বংশধারায় গুরুসদয় দত্তের সঙ্গে সম্পর্কিত,—এই খবরটিও জানা ছিল না। সনেট ও গান লিখতেন;—এটুকু জানতাম কেবল! সময়-সুযোগ করে তাঁকে পাঠ করার অবকাশ জোটেনি। এখন একথা ভেবে গ্লানি জাগছে মনে।
তাঁর রচিত গানগুলো বিজয় কান্তি রায় গাইছেন মনে হলো। অনলাইনে তাঁর গাওয়া তিনখানা গান পাচ্ছি। তিনি ছাড়া অন্য শিল্পীরা কি কবি বিরচিত গানগুলো গাইছেন এখন? কবি বিমান তালুকদারকে গানবাজনার লোক বলেই জানি। গানপার সঞ্চালক কবি, গদ্যকার ও গীত-রচয়িতা জাহেদ আহমদের গানের খাতা থেকে তুলে আনা কিছু গান তাঁর কল্যাণে আমরা শুনতে পেয়েছি। নিজের সৃষ্টিকে লোকনজরে আনার ব্যাপারে একশো টালবাহানায় ওস্তাদ জাহেদ আহমদের গীতিকারসত্তাকে বিমান তালুকদার তাঁর কণ্ঠে ধারণ না করলে তারাপুর চা-বাগানেই তারা কেবল গুমরে ফিরত মনে হয়! কবি আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর গান কী উনি গাইছেন এভাবে? জানার আগ্রহ বোধ করছি। আর, মণিপুরি ভাষায় তাঁর রচনা ভাষান্তরিত করার কথা আপনি লিখেছেন। মণিপুরি সম্প্রদায়ের সঙ্গে আবদুল গফ্ফার দত্ত চৌধুরীর সংযোটি যদিও আমি ঠিক ধরতে পারিনি!
বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের ইতিহাস, ভূগোল, জলবায়ু ও সাংস্কৃতিক চিহ্নসমূহ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজের সংখ্যা এখনো ব্যাপক নয়। এমনকি সিলেট শহরের বিবর্তনকে ধারণ করছে,—এরকম কাজের সংখ্যা বেশি চোখে পড়ে না। এই অঞ্চলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা গুণিজনকে নিয়ে গবেষণা ও লেখাপত্র নয় ধারাবাহিক! কৃতবিদ্য বলতে আমরা বাউল মহাজনেই কেবল পাক খেতে থাকি। তার বাইরে এখনো যেতেই পারছি না!
ইংরেজবিরোধেী আন্দোলনে যুগান্তকারী অবদান রাখা বিপিনচন্দ্র পাল, গুরুসদয় দত্ত, ফজলুল হক সেলবর্ষী, লীলা নাগ, অসিতরঞ্জন ভট্টাচার্য, সুহাসিনী দাসকে নিয়ে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা অতীতেও ছিল,—এখন অথবা দূর ভবিষ্যতেও তা অমলিন থেকে যাবে। সিলেট অঞ্চলে সংঘটিত কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস আর চা শ্রমিকদের সংগ্রামী জীবনালেখ্য-রচয়িতা কমরেড অজয় ভট্টাচার্যের নামটি ভুলে থাকার নেই সুযোগ। নানকার বিদ্রোহ ও অরণ্যানী-র মতো রচনাপাঠের খাতিরে হলেও তাঁর কাছে ফিরতে হবে সদা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রনায়ক ওসমানী, সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্তসহ আরো অনেকে রয়েছেন,—তাঁদের নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা ও প্রকাশনার খবর কি কানে আসে আমাদের? কতটা চিনিজানি আমাদের এই শ্রীভূমিতে বেড়ে ওঠা সন্তানদের?
অন্যদিকে, সৈয়দ মুজতবা আলী থেকে শুরু করে অশোকবিজয় রাহা, আবদুল গফ্ফার দত্ত চৌধুরী, মিরজা আবদুল হাই, শাহেদ আলী, দিলওয়ার, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ওয়াসি আহমেদসহ আরো অনেক-অনেক কবি-লেখক, চিত্রকর ও সংগীতকারদের নাম আসবে তালিকায়। বিশেষভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যার শিকার দর্শনচিন্তক গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও ইসলামপন্থী ভাবুক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফকে নিয়ে বলার মতো কোনো কাজের খবর আমার অজানা। হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও নির্মলেন্দু চৌধুরীর মতো ভারতমাতানো শিল্পী, খালেদ চৌধুরীর মতো নাট্যজনকে নিয়ে ওপারবাংলায় কাজকর্ম হলেও,—এঁনারা কিন্তু সিলেটমাটির কৃতি সন্তান ছিলেন। ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে দুর্বিন শাহর গান গাইলেন যে রণেন রায় চৌধুরী,—তাঁর নাম তো আমরা ভুলতে বসেছি!
ইতিহাসবিদ ও কপার প্লেট অব সিলেট-এর রচয়িতা কমলাকান্ত গুপ্ত, ব্রাহ্মীলিপির তন্নিষ্ট গবেষক ও সিলেট অঞ্চলের প্রবাদ-প্রবচন সংগ্রাহক দেওয়ান গোলাম মোর্তাজাকে নিয়ে কাজ করার সুযোগ রয়েছে যথেষ্ট। মাওলানা ভাসানী থেকে আরম্ভ করে বর্ণ ও লিপিতত্ত্ব… গোলাম মোর্তজা বিচিত্র বিষয় নিয়ে লিখেছেন। যদিও, তাঁর ওই প্রবাদ-প্রবচন বিষয়ক বইটির বাইরে বাকিগুলো সম্ভবত এখন আর সুলভ নেই।
সিলেট অঞ্চলে বনেদিয়ানার বিবর্তন ও হালচাল নিয়ে ছোটকাগজে কাজ করার আবকাশ ও প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। ইংরেজ থেকে পাকিস্তান আমল অবধি সিলেটের গোলাপগঞ্জ, বিশেষ করে ফুলবাড়ি ও রণকেলিকে কেন্দ্র করে একটি শিক্ষিত ও উচ্চবংশীয় এলিটসমাজের বিকাশ ঘটেছিল। পাকিস্তান আমল থেকে বাংলাদেশের আশি-নব্বই দশক অবধি সিলেটি যেসব দুঁদে সরকারি চাকুরীজীবী, সামরিক কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও অন্যান্য মাধ্যমে কৃতবিদ্য ব্যক্তির নামধাম আমাদের কানে আসে,—তাঁদের সিংহভাগ ফুলেবাড়ি, রণকেলি আর শ্রী চৈতন্যর আদি পিতৃভূমি ঢাকা দক্ষিণ থেকে উঠে এসেছিলেন। এঁনাদের বনেদিয়ানার বৈশিষ্ট্য ও বিবর্তন নিয়ে আমার জানামতে কোনো কাজ হয়নি। সাহিত্যিক বিবরণের তো প্রশ্নই আসে না!
অন্যদিকে চা শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা খান বাহাদুর কাপ্তান মিয়া আর হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীদের পুরো পরিবারকে নিয়ে কাজ করার প্রাসঙ্গিকতা আজো অমলিন। বিশেষ করে হ্যারল্ড রশীদের পিতৃদেব আমীনুর রশীদ চৌধুরীকে নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করা জরুরি। আমীনুর রশীদ তো কেবল যুগভেরীর প্রাণপুরুষ ছিলেন না,—বিচিত্র তৎপরতায় তাঁর সংযোগ নিবিড় ছিল। আকর্ষণীয় চরিত্র তিনি।
বনেদি পরিবারের ছেলে হয়েও ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে পুরোদমে সক্রিয় ছিলেন সেইসময়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে রেখেছেন অবদান। সরকার থেকে উচ্চপদের দায়িত্ব প্রত্যাখ্যান করেন এজন্য যে,—তাঁর পক্ষে প্রাণের সিলেট শহর ছেড়ে বেশিদিন থাকা সম্ভব নয়। আপদমস্তক প্রগতিশীল ও আধুনিক চিন্তাচেতনার মানুষ;—অন্যদিকে মরমি ও লোকায়ত। এগুলো আমরা কমবেশি জানি, কিন্তু এর বাইরে ছিলেন পড়ুয়া, সুলেখক, এবং চমৎকার গীত রচয়িতা ও শিল্প-সংগ্রাহক। আমীনুর রশীদ নিজে গান বাঁধতেন ও গাইতেন। হ্যারল্ডের স্ত্রী শম্পা রেজার কণ্ঠে তাঁর একটি গান শুনে দারুণ লেগেছিল।
বনেদি পরিবারে বেড়ে ওঠা আমীনুর রশীদের সত্য ও তথ্য অসম্পূর্ণ আত্মজীবনী বইটি একাধিক কারণে সময়ের দলিল হয়ে থাকবে। বইটির অংশ বিশেষ পাঠের সুযোগ হয়েছিল অনলাইনে। পুরোটা অনেকদিন ধরে খুঁজছি, কিন্তু সংগ্রহ করে উঠতে পারিনি। যেটুকু পড়েছিলাম, তাতে ভীষণভাবে সিলেট অন্তপ্রাণ এলিটের ব্যক্তিত্বের ধার ও ভার বুঝতে অসুবিধা হয়নি। একাধারে দাম্ভিক, মেজাজি, এবং একইসঙ্গে প্রখর ধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। এই মানের বনেদিয়ানা সিলেটে আরো অনেকে একসময় লালন করতেন, তাঁদের চিনপরিচয়ও তাঁর বইয়ে পাওয়া যাবে মনে হলো।
বড়ো কথা, হ্যারল্ড রশীদ এখনো বেঁচে আছেন ধরায়। তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে পারলে তাঁদের পরিবারের অনেক খুঁটিনাটি জানা সম্ভব। সেইসঙ্গে সিলেট শহরের এমনসব বৈশিষ্ট্যও আমরা জানতে পারব, যেগুলো শহরটির বিবর্তন ধরতে সহায়তা করবে অনেক।
হ্যারল্ড নিজেও বিচিত্র দিকে গমনের চেষ্টা করেছেন। গিটার বাদন, গ্রাফিক্স ও পেন্টিং, এমনকি যুবা বয়সে ইংরেজি গান গাইতেন। বাউলভাবিক ও মরমি। আমরা তাঁকে হাস্যকরভাবে শম্পা রেজার স্বামী ও তুখোড় গিটারবাদকের পরিচয়ে নির্দিষ্ট করে দিয়েছি! হ্যারল্ডের পাঠকসত্তা, তাঁর সংগীতজ্ঞান, বাংলাদেশের ব্যান্ডবাজ ও মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক, বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহের নেশা ও আঁকিবুঁকি,—এমনকি ঈশ্বরভাবনায় স্বকীয়তার খবর কখনো করিনি। না কখনো জানতে চেয়েছি,—তাঁর বেড়ে ওঠার পুরো পরিধি জুড়ে অঢেল সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সিলেট কীভাবে অবিচ্ছেদ্য জুড়ে গেল সত্তায়।
আমীনুর রশীদের মতো হ্যারল্ডও সিলেটকে অন্তরে ধরেছেন। বাপ-বেটার মধ্যে বিস্তর তফাত থাকলেও বনেদিয়ানার সঙ্গে স্থানিকতার সংযোগ দুজনের মধ্যে সুলভ। সুতরাং হ্যারল্ডকে নিয়েও কাজ করার সুযোগ থাকছে।
আমাদের কাজবাজে স্থানিকতার বিচিত্র রং প্রায়শ অনুপস্থিত থাকে। যে-কারণে এগুলো প্রাণের জিনিস হয়ে ওঠে না। বিশ্বযোগ সারতে হলে ওটা কিন্তু লাগবে। স্থানিকতা হচ্ছে সেখানে কাঁচামাল। বিশ্ব থেকে যা কুড়িয়ে-বাড়িয়ে পেলেন,—সেগুলোর সঙ্গে এই কাঁচামাল ঠিকঠাক জুড়তে পারলে সত্যিকার বিশ্বযোগ ঘটে। সাধ্য থাকলে আমীনুর রশীদের মতো আরো যাঁরা ছিলেন বা এখনো রয়েছেন, তাঁদের নিয়ে কাজে নামাটা বোধহয় জরুরি হয়ে উঠছে ক্রমশ।
. . .
. . .




