অগ্নিঝরা দিনের শপথ
কবি-ভাষ্যকথা : সুমন বনিক

যাত্রাপথে রাত যদি নেমে আসে
যদি বা পথিক একা;
কেউ নেই আশেপাশে—
ধীমানপথিক শোনো, অনেক দূরের পথ
দিতে হবে তবে পাড়ি—
ধমনীতে আঁকা তোমার রক্তশপথ!
ভয়াল রাতের স্তব্ধ-চরাচর
পেঁচা-শকুনের—চিৎকার তুমি শোনো?
রাতের গভীরে দেহ-দেহাতীত স্বর
অরাজক এক ভূতুড়ে কফিনে মোড়া
হন্তারকের গোলা-বারুদ বহর!
শপথ তোমার, নতুন দিনের আলো
ফুলেফলেভরা সুশোভিত দিকপাশ
রক্তলেখা ইতিহাস ছায়া ফেলে
সোনালি ভোরের মহিমা জড়ানো ঝিলে।
স্বদেশ এখন পোড়ামাটি-কুঁড়েঘর
মিথ্যে দম্ভ প্রতারক-আস্ফালনে
মুক্তিযুদ্ধ শহিদনামতা—বেমালুম তারা ভোলে!
ইজারা নিয়েছে স্বদেশ আমার ওরা
দাসখত দিয়ে করছে উজাড়
রাতের স্বপন সুখশান্তি বাওয়া-ফসল মাঠ
প্রচণ্ড ষাঁড়ের আক্রোশ-তুফান
ধরাশায়ী করে সমূহ উদ্যান—
দেশজনতার শাশ্বত স্মৃতির অবিরল ধারা।
অন্ধকার আর অগ্নিস্রোতে পুড়ছে স্বদেশ-ভিটেমাটি-মানবহৃদয়
অন্ধকূপে সন্ত সেজে পোড়ায় আমার
স্বপ্ন রাশি রাশি—যুবচিত্ত করছে হরণ
হ্যামিলনের বাঁশির স্বরে।
তাইতো তোমার যাত্রাপথে অন্ধকার আর
কালাপাহাড় দাঁড়িয়ে আছে;
পরানপথিক! সামনে তাকাও তুমি,
ভোরের শিশির মেখে অসীম আকাশ আর
স্বদেশ-আঙিনা জেগে ওঠে, প্রাণশিহরনে!
স্মৃতির স্থাপনাজুড়ে সহস্র আলোর উৎসারণ—
দেশপ্রেমের উত্তাপ; আমাকে দেখায় পথ, শুনি—
রাতশেষে অগ্নিঝরা দিনের শপথ!
. . .
আবুল ফতেহ ফাত্তাহ
আকাশ-আঙিনা
আটাশ অক্টোবর দু-হাজার পঁচিশ
. . .

তাৎক্ষণিক পাঠালাপ : কবিভাষ্যকথা

কবিভাষ্য কি স্বয়ং কবির? নাকি কবিভাষ্যকে উপজীব্য করে আবুল ফতেহ ফাত্তাহ লিখেছেন? বিষয়টি ঠিক বোধগম্য হয়নি!
. . .

আবুল ফতেহ ফাত্তাহ লিখেছেন। আমার পোস্টের কমেন্টসে তিনি এই কবিতা লিখেছেন।
. . .

ফাত্তাহ ভাই মাঝেমধ্যে কবিতা লেখেন জানি। বইও বেরিয়েছিল কি? এখানে যারা অ্যাকাডেমিক লাইনে চলে যান, তাদের পিঠে শিক্ষক, গবেষক, প্রাবন্ধিক পরিচয়টি ক্রমে আমরা সেঁটে দেই। তাঁরাও সেই পরিচয়ে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। মননশীল কাজকর্মের বাইরে হয়তো গল্প-কবিতা-উপন্যাস ইত্যাদি লেখেন কখনো-সখনো, সেগুলো আর কেউ গোনায় ধরে না।
ফলাফল যেটি দাঁড়ায়,—তাঁরাও পরে ইস্তফা দিয়ে দেন। অনুপ্রেরণার অভাব দেখে হয়তো ভাবেন,—কেউ যখন পাত্তা দিচ্ছে না, বোধহয় কিছু হয়নি ওগুলো। ফাত্তাহ ভাই যেমন সিলেট অঞ্চলের লোকসাহিত্য, সৈয়দ সুলতান ইত্যাদি নিয়ে কিছু অ্যাকাডেমিক কাজ করেছেন। সম্ভবত পিইচডির জন্য। এটি এখন তাঁর পরিচয়কে এমনভাবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, সেখানে কেউ আর তাঁর কাছে দেখবেন কবিতা বা এরকম কিছু চাইতে যায় না।
তপোধীর ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রেও ঘটনাটি ঘটতে দেখেছি। প্রচুর গদ্য লিখলেও, কবিতা বেশ নিয়মিত লিখেছেন তিনি। বইও বেরিয়েছে একাধিক। তারপরেও দুই বাংলার ছোটকাগজ ও অন্যরা ঘুরেফিরে তাঁর কাছে গদ্য চেয়েছে সমানে। ইচ্ছে থাকুক বা না-থাকুক,—তাঁকে চাহিদা মিটিয়ে যেতে হয়েছে। এতে করে অনেকসময় গদ্যে তাঁর ধার ও স্বকীয়তা জখম হয়েছে মারাত্মক। ফাঁদে আটকানো প্রাণীর মতো লিখেছেন প্রতিনিয়ত। গদ্যে উনি-যে নিজের মননশীলতাকে ষোলআনা খাটাবেন, সেভাবে লিখবেন কিছু,—স্পেসটি তাঁকে ক’জন দিয়েছে বলেন?

আমার কেন জানি মনে হয়, আমাদের পাঠঅভ্যাস অত্যন্ত ক্লিশে। ইনফ্যাক্ট, আমরা মার্কা মারতে পছন্দ করি। মার্কার বাইরে একজন ভালোমন্দ অন্য যা-কিছু লিখুক-না-কেন, সেগুলো নিয়ে আলাপ করি না বা করার উৎসাহ বোধ করি না। আলাপ করা গেলে ভালো কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা হয়তো তৈরি হতো।
আবুল ফতেহ ফাত্তাহ বা তপোধীর ভট্টাচার্যের কবিতাকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠ করা যেত না, এমন তো নয়। সেগুলো তাঁদের ক্ষেত্রে মূল পরিচয় না-হতে পারে, কিন্তু একজন মননশীল লেখক কেন গল্প-কবিতা বা উপন্যাসের মতো শৈলীকে মাঝেমধ্যে বেছে নিচ্ছেন, এর কার্যকারণ বোঝার আগ্রহ কারো মধ্যে দেখবেন না। আজব লাগে এসব!
এই-যে মনোভাব, খেয়াল করলে দেখবেন,—এটিও কিন্তু মোটামুটি বিগত তিন দশকে এই দেশে তৈরি হয়েছে। ত্রিশ বছর পেছনে গেলে দেখা যাবে,—মননশীল লেখকরা অনেকে সৃজনশীলতার অনুশীলন বেশ নিয়মিত করেছেন, এবং তার একটি গুরুত্ব পাঠকমহলে থেকেছে। আমাদের সাহিত্যিক অধঃপতন মূলত গত তিন দশকের ফলাফল।
যাইহোক, কমেন্টে ফাত্তাহ ভাই কবিতার মতো করে যে-কথাগুলো বেশ সরাসরি বলেছেন, এভাবে বলাটা সময়-প্রাসঙ্গিক। তাঁর বয়সে অনেকে বলার সাহস করবেন না। তাঁর বয়স কেন, আমাদের বা পরবর্তী অনেকেও ইতোমধ্যে যথেষ্ট নপুংসক, তাদের ওই নপুংসক সাহিত্য নামক বাতকর্মের মতোই…
. . .

আবুল ফতেহ ফাত্তাহ’র একগুচ্ছ সনেট নিয়ে বহুআগেই একটি বই বের হয়েছে। তাঁর কবিতাবই সম্ভবত ২/৩টি বের হয়েছিল।
. . .

হ্যাঁ, আপনি বলায় মনে পড়েছে। মানে দাঁড়াল, ফাত্তাহ ভাই গদ্যের পাশাপাশি কবিতা লিখেছেন একসময়। সেগুলো নিয়ে যেহেতু লোকজন কথাটথা বলেনি খুব একটা, তিনিও পরে সরে গেছেন। আমরা গত তিন দশকে উত্তর-আধুনিক তরিকায় যে-কোনো বিষয়কে দেখা ও পাঠ রপ্ত করেছি বেশ। এটি দুধারী তলোয়ারের মতো দাঁড়িয়েছে এখানে। একে ব্যবহার করে, যেমন ধরেন, সত্যিকার অর্থে অখাদ্য বস্তুকেও আপনি প্রয়োজনীয় ও যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলতে পারবেন। কোনো ব্যাপার না! এটি হলো বিপদের দিক। অন্যদিকে, মনের সংস্কার কাটিয়ে উঠতে ও কোনো একটি বিষয়কে ভিন্ন দৃষ্টিকোণের সাহায্যে দেখতে ও ব্যাখ্যা করতে উত্তর-আধুনিক বিচারপদ্ধতি বেশ ভালো কাজে দেয়।
এই জায়গা থেকে ফাত্তাহ ভাই বা তপোধীর দা’র কবিতাকর্ম নিয়ে ভিন্নআঙ্গিকে বোধহয় পাঠভাবনা করা যেত;—যেটি, আমার জানামতে হয়নি। মননশীলতা ও সৃজনশীলতা যদিও একে অন্যের পরিপূরক। আমাদের এখানে গল্প-উপন্যাসে ওই-যে গৎবাঁধা কাহিনি ও চরিত্র চিত্রনের বাইরে বিচিত্র ন্যারেটিভ দাঁড় করাতে পারেনি, তার কারণ মূলত এখানে খুঁজলে পাওয়া যাবে।
কথার কথা, গল্প-উপন্যাসের বয়ানে আমরা চিন্তাধর্মী বা দার্শনিকতা তৈরি করে এরকম বিষয়বস্তু সহজে হজম করতে পারি না। কারণ, এখানে সৃষ্টিশীল বলতে আমরা মননগর্ভ বিষয়বস্তু থেকে দূরবর্তী কোনো এক বিন্দুকে বুঝি;—যদিও এরা সময়ের অনিবার্যতায় অনেকবেশি পরস্পরের মধ্যে ঢুকে বসে আছে।
. . .

. . .



