দেখা-শোনা-পাঠ - পোস্ট শোকেস

বেমানান থাকার লড়াই

Reading time 16 minute
5
(48)

দুনিয়ায় রয়েছেন সিদ্ধাচার্য কত
এ-মুহূর্তে তারাও কী আমাদের মতো
শীতের আমেজ নিয়া সুখে ও সহজে
বারান্দার ইজিরোদে রয়েছেন মজে?
নাকি তারা স্বভাবত কঠিন ও মেকি!—
সে-ভেবে কী লাভ, এসো প্রজাপতি দেখি;
[নিছক শীতের গান : জাহেদ আহমদ]

. . .
অনলাইন মুখপত্র গানপার সঞ্চালনায় নিরলস জাহেদ আহমদকে বাংলাদেশের লেখক-পাঠক মহলে কবি ও গদ্যকারের মার্কামারা পরিচয়ে অনেকে চেনেন-জানেন। ব্যাস এটুকুই! তাঁর সৃজন-বৈচিত্র্য ও স্বকীয়তার জায়গাজমির পরখ করার বাসনা কারো মধ্যে তীব্র হতে দেখলাম না আজো! তীব্রই যদি হতো, তাহলে কবিতা, গানরচনা, গদ্য, ছোটকাগজ, আর অনলাইনে টানা সাত বছর ধরে গানপার সঞ্চালনার সুবাদে পাওয়া সৃজন-বৈচিত্র্যের ভালোমন্দ নিয়ে দু-একছত্র লেখা ও আলাপ চোখে পড়ত নিশ্চয়।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় অবশ্য এরকম কিছু আশা না করাই সমীচীন। জাহেদের তা অজানা নয়। আগ বাড়িয়ে কেউ মুখ ফুটে কিছু বলবেন না জেনেও কাজ করে যাচ্ছেন নিরন্তর। লম্বা সময় ধরে একরোখা কারুবাসনায় তাঁকে দিবস-যামিনী পার করতে দেখছি। কবি-লেখক-গাইয়ে-বাজিয়ের ভিড়ে তাঁর বিচরণকে সুশীল-সুবোধ দেখালেও, বাস্তবতা ভিন্ন সাক্ষ্য দিচ্ছে সেখানে।

ভিড়কে যারা অ্যানক্যাশ করার মতলব মাথায় নিয়ে ঘোরেন,—এখন, এসব তালেবরের সঙ্গে জাহেদ আহমদকে মিলানোর সুযোগ নেই। ভিড় থেকে বরং সটকে পড়ার তালে থাকেন কবি;—যেখানে পালানোর কারণবিষ কবিতায় ও গদ্যে সমানে ঢালতে দেখি তাঁকে। তথাকথিত পরিচিতজন জাহেদ আহমদের লেখালেখিকে যদি আসলেও আমলে নিতেন, তাহলে সাংঘাতিক খাটনি দিতে অভ্যস্ত কলম-মজুর তাঁদের কাছে সুবোধ সামাজিক গণ্য হওয়ার কথা নয়। লেখক জাহেদ বেশ বিপজ্জনক প্রপঞ্চ;—যদি ভাবি দিয়া মন।

সাহিত্য ও গানবাজনার জগতে প্রতিষ্ঠিত ও সফলকাম অনেকের সঙ্গে গানপার সঞ্চালনায় ক্লান্তিহীন কবির রয়েছে ঘনিষ্ট সংযোগ। অনেকে তাঁর অনলাইন মুখপত্রে লেখা পাঠিয়ে কন্ট্রিবিউট করেন মাঝেমধ্যে। পরিচয়কে অ্যানক্যাশ করে ফায়দা উঠানোর সুযোগ তাঁর রয়েছে, যদিও এরকম কোনো তাড়না তাঁকে কখনো করেনি উতলা। প্রতিষ্ঠিতদের সঙ্গে সংযোগরক্ষার প্রশ্নে আড়াল ও দূরত্ব বজায় রাখার নীতি তিনি অনুসরণ করেন নীরব। সোজা কথায়, যেচেপড়ে প্রতিষ্ঠিত কারো কাছে ভেড়ার বান্দা এই লোক নয়। তাঁকে মুঠোবন্দি ও ব্যবহার করাটা কাজেই কারো পক্ষেই সহজ নয়।

নিজেকে এভাবে বেমানান রাখার একখানা ব্রহ্মাস্ত্র হাতে দেশের শিল্প-সাহিত্যের হালতকে জাহেদ প্রখর নজরে রাখেন, এবং স্বকীয়তা করেন উদযাপন। যেখানে, অন্যকে তাঁর ব্যাপারে ক্রিটিক্যাল হওয়ার সুযোগ দানে কবির আপত্তি আছে বলে যদি কেউ ধরে নেয়,তার এই ধারণার জন্য বেচারাকে দায়ী করা যায় না। জাহেদ স্বজ্ঞানে ও স্বেচ্ছায় ক্যামোফ্লাজটি সেখানে বজায় রাখছেন। ক্যামোফ্লাজের নেপথ্যে সক্রিয় কারণগুলো বুঝতে হলে গদ্যখানা ধৈর্য সহকারে শেষ পর্যন্ত পাঠ করার অনুরোধ থাকবে। শুরু, শেষ অথবা মাঝখান থেকে আধা চামচ তুলে নিয়ে পাঠের ফলাফল বিষম হতে পারে। ভুল বোঝার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে সেখানে।

Consciously incompatible Zahed Ahmed; Image Source – Collected

জাহেদ, আমার জানামতে কবিতা লিখে চলেছেন বিগত তিন দশকের কাছাকাছি সময় ধরে। ছোটকাগজ ও পরে অনলাইন প্লাটফর্মগুলোয় নিয়মিত লিখছেন। তিন দশক পার করলেও তাঁর কোনো কবিতার বই বাজারে ছেপে বের হয়নি। অগ্রজ, সমসাময়িক, এমনকি অনুজরা তাঁকে টপকে গণ্ডায়-গণ্ডায় কবিতার বই ইতোমধ্যে প্রসব করে বসে আছেন! কবিতাসমগ্রও বেরিয়েছে অনেকের। কবিতাবই ছাপানোর ভিড়ে জাহেদ এখনো দলছুট ঘুড়ি হয়ে আকাশে উড্ডীন! তাঁর প্রকাশিত কবিতাবই পাঠকের জন্য অধরাই থেকে গেছে!

কোনো কবিকে উত্তমভাবে পড়তে হলে মলাটবন্দি কবিতাবইয়ের প্রয়োজন অস্বীকার করা কঠিন। এক মলাটে (সেটি ছাপা অথবা ডিজিটাল ফরমেটেও হতে পারে) যখন কবিতারা বন্দি হয়,—একজন কবির সৃষ্টিশীল চালিয়াতির অলিগলি ঘুরে আসতে পাঠক কিছুটা হলেও সুবিধা ভোগ করে। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কবিতাপাঠের সাহায্যে যেটি নয় সম্ভব! ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কবিতাকে একত্র করে নিবিড় পাঠের দম সেলফিশাসিত যুগে দুর্লভ ঘটনা! জাহেদ আহমদের কবিতাযাত্রা যে-কারণে অনেকের কাছে এখনো অনাবিষ্কৃত ভূগোল! যারা তাঁকে অল্পবিস্তর পাঠ করেছেন, তারা সম্ভবত এই গাড্ডায় পড়ে কবিকে নিয়ে কিছু বলতে ইতস্তত বোধ করেন। বলি-বলছি করতে-করতে থেমে যান আকস্মিক। বলার মতো রসদ যদিও জাহেদ তাঁর কবিতাযাত্রার এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছেন বেশ।

রেখেছেন ভালো কথা। এখন, তাঁর কবিতাযাত্রার চড়াই-উৎরাই ও বাঁকগুলো পাঠক কী দিয়ে বুঝবে? গুগল মামা আর চ্যাট জিপিটির ওপর খুঁজে বের করার ভার চাপিয়ে কাহাতক আগানো সম্ভব! তাহলে কি পাঠক ধরে নেবে,—তিন দশকের কবিতাযাপনে কবি জাহেদ আহমদ কোনো চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আসেননি? বাঁকবদল ঘটেনি সেখানে! পাঠকের এই ধরে নেওয়া তার নিজের কানে হাস্যকর শোনাবে। লম্বা সময় ধরে লিখতে থাকার কারণে চড়াই-উৎরাই ও বাঁকবদল যে-কোনো কবির কবিতাকোষে কমবেশি সুলভ থাকে। আর, জাহেদ আহমদের মতো নিজের কবিতার ব্যাপারে তলে-তলে ক্রিটিক্যাল কবির বেলায় পাঠকের এমতো ধারণা ধোপে টিকবে না একদম।

কবি হিসেবে জাহেদ এখানে এসে বেচারা পাঠকের জন্য বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ান;—যে কিনা তাঁকে পড়তে আগ্রহী। কবিতা রচনার পদ্ধতি নিয়ে কবির মধ্যে ডুয়েল ফাইটে লিপ্ত থাকার প্রবণতা বেশ প্রবল। নিজের কবিসত্তাকে দ্বিখণ্ডিত করে বন্দুক হাতে ময়দানে নামিয়ে দিয়েছেন। একটি সত্তাকে সেখানে এ-পর্যন্ত রচিত কবিতার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসে টইটম্বুর দেখায়। অন্য সত্তাটি সন্দীহান মুখে বন্দুক তাক করে থাকে। চর্চিত কাব্যঘরানা ও কবিগণের নীরব আতশবাজি তাকে সেখানে বিচলিত ও সন্দীহান রাখে। নিজের কবিতায় এসব ছায়া-প্রচ্ছায়া অপসারণের ঝোঁক কাজ করে তার মধ্যে। এগুলোকে অপসারিত করার লড়াই শেষ করতে আত্মবিশ্বাসী কবিসত্তার দিকে কাজেই বন্দুক তাক করে রাখে সে।

কবিতায় স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠার জন্য বন্দুক হাতে দ্বৈরথ কবিদের জন্য মন্দ কিছু নয়, তবে অতিরিক্ত হলে বিপদ। জাহেদ আহমদের কবিতামীমাংসা এদিক থেকে সাংঘর্ষিক। একের-পর-এক গদ্যে কবিতাকে তিনি যেভাবে পাঠ করে চলেন সচরাচর, যেখানে অনুরাগ-বিতরাগ, বাহবা ও চপেটাঘাত শেষে উপসংহার টানেন হামেশা,—এখন, নিজের কবিতায় সেগুলোর উপস্থিতি কেন জানি তাঁকে বিব্রত রাখে! গদ্যের-পর-গদ্য লিখে যেসব শর্তকে কবিতার জন্য তোফা মানছেন ও পাঠককে মানানোর কোশেশ করছেন,—নিজ কবিতায় সেগুলোর বিচরণকে সদয় প্রশ্রয় দিতে তাঁর মন মানে না! ঘটনাটি আজব বটে!

এর বিষম ফলাফল,—কবিতাবই প্রকাশের মামলায় তাঁকে বারবার সরে আসতে দেখি। সরে আসাটা ইদানীং মনে হয় অন্তহীন হতে চলেছে! অন্য কারণ অবশ্য আছে সেখানে। বঙ্গদেশে যে-পন্থায় বইটই এসব বেরোয়, এর সঙ্গে খাপ খাওয়ানো সকলের কর্ম নয়। জাহেদ আহমদকে যতটুকু চিনেছি ও জেনেছি এতদিনে,—এসব পন্থায় গা ভাসানো তাঁর জন্য কঠিন। সুতরাং, প্রচলিত প্রকাশনা থেকে এই বান্দার বই বের হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য বলা যেতে পারে।

Self Portrait – Zahed Ahmed; Image Source – Collected

যে-জীবন দোয়েলের ফড়িঙের … যে-জীবন দগদগে ঘা আর দাঁতে-দাঁত-চাপা দহনের … যে-জীবন অবিরাম অসহায় অবনমনের … যে-জীবন অগত্যা আপোসের … যে-জীবন গনগনে ঘৃণা আর ফুঁসে-ওঠা রাগ আর রক্তবমনের … যে-জীবন কানাগলির কুকুরের … যে-জীবন সবেতন ক্রীতদাসের … যে-জীবন স্বপ্নাঢ্য রক্তিম বাসনা আর প্রেমদ্রোহবিষাদের … যে-জীবন আমার-আপনার-আমাদের … আমারাপনারামাদের … যে-জীবন মামুলি মানুষের, ময়ূরচূড়ায় ঝিমধ্যানস্থ অথবা জলকেলিবিলাসী রহস্যরসিক কবিদের সনে তার হয়নাকো দেখা বাইচান্স। হতো যদি, বাংলা কবিতা তাতে ধড়ে একটা মানানসই মুণ্ডু আর হৃদয়ে এক টুকরো দুর্দান্ত কলিজা ফিরে পেত। [ল্যুকিং থ্রু দ্য রিয়ার্ভিয়্যু মিরর : জাহেদ আহমদ]

. . .
ঢাকা থেকে বের হওয়া ছোটকাগজ কবিতাপত্র ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সংখ্যায় সম্পাদক হোসেন দেলওয়ার চারজন কবিকে নিয়ে পাণ্ডুলিপি সংখ্যা ছেপেছিলেন। জাহেদ আহমদের চুয়ান্নটি কবিতা একসুতোয় গেঁথে ছাপেন সম্পাদক। সবগুলো কবিতাই সুখপাঠ্য। তার মধ্যে একটি কবিতা দন-কিয়োৎ-এ কবি লিখছেন :

বাতাসেই ভেঙে পড়ে যাই
দেখো তবু বেরিয়েছি ভুবনাভিযানে
আমি পলকা সেপাই—
তালপাতার তলোয়ার হাতে
বিপজ্জনক কত হিমবাহ আর মালভূমি এড়ায়ে
একেকটা মহাদেশ হেলায় পারাই

দেখে মনে হবে যেন বাতাসেই ভেঙে পড়ে যাই!

নিমিষেই ঘুরে আসি কুঠুরি নয়-দরোজার
আসমানি আলোকের বেশি বেগ আমার ঘোড়ার—
দূর থেকে দেখে ভাবো কাছিমের গতি!

আমার যুদ্ধজয়ের ইতিহাস একমাত্র তোমাকে শোনাই

কবিতাটি তারা ভালো ধরতে পারবেন, যারা কবির তিন দশকি যাত্রাকে কাছে থেকে দেখেছেন;এবং তারাও ধরতে পারবেন এর মাহাত্ম্য, যারা দন-কিহোতের সঙ্গে নিজেকে অভিন্ন করতে থাকা লোকটার ব্যাপারে মনোযোগী ছিলেন। নিজেকে দুর্বলের কাতারে ফেলে চারপাশ দাপিয়ে বেড়ানো সবলকে টপকে যাওয়ার প্রত্যয় এই লোকের গদ্য ও কবিতায় ফিরে-ফিরে তারাই পাবেন,—যারা তা নজরে নিয়েছেন অতীতে ও নিচ্ছেন বর্তমানে।

প্রত্যয়টি এদিক থেকে কবি-কাম-লেখক জাহেদ আহমদের গন্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। গড্ডলস্রোতে খরগোশের মতো লাফিয়ে বেড়ালে চটজলদি লোকের নজরে পড়া যায়;সূত্রটি জানা থাকলেও কচ্ছপগতিকে বীজমন্ত্র ধরে এগিয়েছেন জাহেদ। দিনের শেষে হৃষ্টপুষ্ট মহাফেজখানা যে-কারণে গড়ে তুলতে পেরেছেন কবি। তাঁর এই মহাফেজখানার খবর অবশ্য অল্পলোকই জানে।

হতাশা ও ব্যর্থতার গ্লানিতে নিমজ্জিত হওয়ার কথা ছিল তাঁর! সুবিধে হলো,এরকম ঘটার সম্ভাবনা হিসাব করেই কচ্ছপগতিকে জীবনের সার করে কিছু মানুষ। মনের গভীরে তখন এই আত্মপ্রত্যয় ও অহং জন্ম নেয়,—নিজেকে ভিড়ের মধ্যে বেমানান ভাবাটাও কাছিমগতির মধ্যে পড়ছে। এই অহং তার আগানোর ও লেগে থাকার আয়ুধ হয়ে দাঁড়ায়। যেটি আবার ফ্যান্টাসিঘন আবরণে তাকে ভিড়ের মধ্যে পৃথক ও সুরক্ষিত রাখে। সোজা কথায়,—কারো কাছে কিছু দেখানোর দায় তার নেই; তবে অন্যের যদি দেখতে ইচ্ছে করে,সে আসতে পারে এই মহাফেজখানায়। ডালিমগাছের গান কবিতায় জাহেদ অনেক আগে কচ্ছপগতির সারমন্ত্র পরিষ্কার বলে দিয়েছেন :

তোতাপাখি উড়ে এসে বসিবার আগে
চোখ ভরে দেখে লই আতাগাছটিরে

সকলেই বড়ো বেশি তোতাপাখিপ্রিয়
আতাগাছ নিয়া কারো আতিশয্য নাই

আমি তাই আলগোছে বসি এইখানে
আতাগাছে দেখি তোতা আসে কোন টানে

ওপরে যে-দুটি কবিতা উধ্দৃত করেছি, সেখানে এই দৃশ্যত সুবোধ সামাজিক, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে দুর্বিনীত লেখকের কবিতা-গদ্য-গান-আলোকচিত্র ইত্যাদিতে একরোখা আবেগে লেগে থাকার সুবাস নিহিত। সুতরাং, He is tough for those who think themselves clever rabbits.

Photography – Friday Rhapsody by Zahed Ahmed; Image Source – Collected

নিজের লেখা জাহেদ কাউকে সেধে পড়তে দিচ্ছেন,—এই দৃশ্যটি আমার জানামতে সুলভ নয়। জানি না কী ছিল কারণ,—নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে কবিতাপত্র-এ ছাপানো পাণ্ডুলিপি অধমকে পড়তে দিয়েছিলেন। আমার মতো কবিতা-আকাটের জন্য ঘটনাটি বিস্ময়ের! আমাকে মূর্খ জেনে হয়তো দিয়েছিলেন জাহেদ। কারণ, যারা তা নন, তাদেরকে পড়তে বলার মধ্যে ঝুঁকি থাকে বিশদ। এক কবির কবিতা অন্য কবি অথবা কবিগণ সবসময় ভালো পড়তে পারবেন,—এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। অনেকসময় দুর্দান্ত হয় এই পারস্পরিক পঠন, আবার বিপরীত চিত্রের নেই অভাব। মন্দপাঠের উদাহরণ ইতিহাসে গমন করলে প্রচুর মিলবে। কবিতে-কবিতে ঠোকাঠুকির মামলায় জগৎ-সংসার বোঝাই-রে ভাই!

কথা চালাচালির সুবাদে মনে হয়েছিল,—কবিমনে কবিতার একখানা বই অবশেষে প্রকাশের ভাবনা কাজ করছে। নতুন-পুরোনো মিলে কিছু কবিতা বেছে নেওয়ার ইচ্ছে হয়তো উঁকি দিয়েছিল মনে। সিদ্ধান্ত ঠিক-না-বেঠিক,—এর একখান আন্দাজ সম্ভবত আমার মতো কবিতা-আকাটকে দিয়ে যাচাই করে নিতে চাইছিলেন কবি। আকাট হওয়া সত্ত্বেও কবিতাগুলো যদি আমাকে টানে,—তিনি তখন ধরে নিতে পারছেন,—মানুষকে সংযোগ করার মামলায় তাঁর কবিতারা গুণবান। জাহেদ আহমদের কবিতা বিষয়ক গদ্য যেসব পাঠক অল্পবিস্তর পাঠ করেছেন,—আমার বলা কথার মাজেজা তারা ধরতে পারবেন। তাঁর গদ্য যারা কখনো চেখে দেখেননি,—ওইসব পাঠকের কাছে কথাখান দুর্বোধ্য মনে হওয়ার ষোলআনা সম্ভাবনা রয়েছে।

কবিতাপাঠের মামলায় জাহেদ আহমদের মনোবীক্ষণ আমার কাছে জটিল ঠেকে মাঝেসাঝে। কবিতার নামে বেহুদা লেবু কচলানো তাঁর অতিশয় নাপসন্দ। কবিতার রচনার তরিকায় কোনো একটি প্রবণতার বাড়াবাড়ি উল্মফনেও তাঁকে বিরক্ত হতে দেখা যায়। অনাবশ্যক জটিলতায় নেই সায়; আবার লুতুপুতু সহজতাকে বরণ করতে মন আপত্তি জানায় সমধিক। জীবনকে ছেনেছুনে বেরিয়ে আসা কবিতা মানে এই নয়, তাকে অবধারিত নিয়মে কোনো একটি ফরমেটে বারবার পাক খেতে হবে। জাহেদ আহমদ একের-পর-এক গদ্য লিখে বিষয়টি ধরিয়ে দিতে কসুর করেননি।

অন্যদিকে,—ফরমেট ভেঙে বের হতে গিয়ে কবিতা যদি হয়ে ওঠে কবিতাহীন কোনো টেক্সট, যেটি হয়তো অভিনব, কিন্তু সেখানে কবিতা নামধারী একখান শিল্পকলাকে না পাওয়ার হাহাকার মনকে আতুর করছে তবু!—তখন কী হবে? কী দাঁড়াচ্ছে তাহলে? এরকম জিজ্ঞাসা তাঁর মধ্যে নেই বলা যাবে না। গান ও কবিতা শিরোনামে তাঁর লেখা একখানা গদ্যে কবিতার সীমানা ও সীমানা অতিক্রমের এসব দিগদারি নিয়ে চমৎকার লিখেছেন জাহেদ, এবং এরকম আরো-আরো গদ্য তাঁর রয়েছে বটে।

কোনো কবিকে ট্রেন্ডি হতে দেখলে কলম হাতে এর তদন্তে নামার জিহাদ জাহেদ আহমদকে সম্ভবত তাতিয়ে তোলে ভীষণ। যে-কারণে শামসুর রাহমান বা এরকম কবিগণকে সুযোগ পেলে গদ্যে পরিহাসবাক্য হানেন বেজায়। যতটা-না রাহমানের কবিতার কারণে হানছেন, তার অধিক রাহমানকে মিথ করে তোলার হট্টগোলকে আঘাত হানার তাড়নায় কাজটি তিনি করেন বলে ধারণা করেছি তখন। যেমন, কবি ইমরুল হাসানের কবিতাযাত্রাকে পাঠ করতে বসে জাহেদ গদ্যকবিতার ট্রেন্ড্রি বা বাজারচালু গৎকে একহাত নিচ্ছেন বেশ :

টানাগদ্যের কবিতা, বা রানিং-ফর্ম্যাটের কবিতা নামেও অভিহিত করেন কবিরা, চালু মাল কবিতাবাজারে আজকাল। অবশ্য পুরান খবর এইটা। যাহা নতুন, তা হচ্ছে এই, ইমরুল হাসানের গদ্যস্পন্দে একবর্ণও জোরাজুরি নিরুপস্থিত। গদ্যকবিতা মানেই যেন কল্পনা আর কবিকামনাবাসনার জাক্সটাপোজিং, উল্লম্ফন ও উল্লঙ্ঘনের বল্গাছাড়া ব্যবহার, টাওয়ার অফ ব্যাবেল বানানো ব্যতিরেকে যেন গদ্যকবিতার কোনো উদ্দেশ্য-বিধেয় নাই। ইমরুলকে এই মিথের বিপরীতে ছেনি-বাটালি হাতে বিশ্বকর্মার রূপে দাঁড়াতে দেখা যায়। এন্তার তৎসম-তদ্ভব আর উল্লম্ফন-উল্লঙ্ঘন এস্তেমাল করে কবিতাকে কেঠো ঘোড়া বানাতে হয় না তাকে, কেউ যদি সেথায় কাঠভাব খুঁজেও পান তবে খেয়াল করুন অভিনিবেশে সেই তুরঙ্গমের পায়ের দিকে, ঘুঙুর রয়েছে তার পায়ে, একদম গণেশ পাইন! [দ্য পোস্টম্যান : জাহেদ আহমদ]

A poet apart; Image Source – Collected

বলার ভঙ্গি থেকে বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না,—যেসব কবি টাওয়ার অব বাবেল বানানোর মতলবে কবিতায় শব্দের লোফালুফি খেলেন, তাদের কবিতা তাঁর পোষায় না। কবিতায় শব্দের ব্যবহার যদি তার সহজাত স্ফূর্তির জন্য হয়ে ওঠে হানিকর, সেটি কারোই পড়তে ভালো লাগার কথা নয়। সুতরাং এখানে জাহেদ আহমদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণের কারণ থাকছে না। পক্ষান্তরে সহজতা অতি স্পষ্ট হলে মরে যায় কবিতার আবেদন। কবিতা শ্লোগান নয়;—প্রবচনটির উদ্ভব সম্ভবত এখান থেকে ঘটেছিল। জাহেদ কাজেই সহজতার পক্ষে থেকেও সহজ না থাকার পক্ষে করেন ওকালতি। ইমরুল হাসানের কবিতা বিষয়ক গদ্যে যেমন বলছেন :

ইমরুল হাসানের কবিতা যেন ”উল্টানো নৌকার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা”, তোমার কথাগুলি আমি অনুবাদ করে দিতে চাই  পিঠমলাটে যেমনটা বলা হয়েছে, “একটা রহস্যময় স্পষ্ট অবলোকন”, কথাগুলোর অন্তর্নিহিত দাবি ভিত্তিহীন নয়। একইসঙ্গে রহস্যময় ও স্পষ্ট—রহস্যময় হয়েও স্পষ্টাক্ষর, অথবা আলোর মতন স্পষ্ট হয়েও রহস্যময়—বৈশিষ্ট্যই বলা যায় এই কবির কাজের। ধরা-অধরার মাঝামাঝি, কিংবা ছাড়া-ধরা বা সরমা-পরমা প্রভৃতির উর্ধ্বে, বিরাজ করে ইমরুলের কবিতা। [দ্য পোস্টম্যান : জাহেদ আহমদ]

কবিতার সঙ্গে বোঝাপড়ার ঘটনায় কবিরা এভাবে ভাবেন হয়তো। জাহেদও ভাবছেন। যেখানে, কাঠিন্য ও সহজতার মধ্যবর্তী রহসময়তা মনে হবে তাঁর বেশ পছন্দ। যে-কোনো শিল্পের এটি ভিত্তি বটে! যে-কারণে গণেশ পাইনের প্রসঙ্গ টানছেন। রামকিঙ্কর বেইজও টানতে পারতেন। সমস্যা হলো, ধরা-অধরা, সরমা-পরমায় রঙিন কবিতা বিরচনের তরিকা খোদ-বা-খোদ জাহেদ নিজের কবিতায় খুব-যে ফলো করেন,তা নয় কিন্তু! তাঁর কবিতার ভাষা কিংবা এর লয়তানের সবটাই আমার মতো কবিতা-আকাটের কাছে পরম সহজিয়া, কিন্তু ভিতরে ধাক্কা লাগার মতো অনুভব ভালোই পয়দা করে যায় তারা। বিষয়টি ধরিয়ে দিতে বালিশ শিরোনামে অনেকদিন আগে লেখা তাঁর একখানা কবিতা বরং তুলে দেই এখানে :

এত যে বৃষ্টির দিগদারী
এই টিনশেড ঘরে
আমি তন্দ্রাছেঁড়া তন্ময়তায় শুনি
পাশ-বালিশের গান
তার চোরা অভিমান
চৈত্রে ওড়া পেঁজা-পেঁজা শিমুল-শৈশব

মাঝে মাঝে আমিও শোনাই তাকে
মর্ম থেকে তুলে এনে
দুটো-একটা তির
বর্ম পরে বসে-থাকা বন্ধুদের মুখ

আর আলগোছে ঘাড় তুলে চেয়েছিল
ঘুমপাখি, পাতাচোখ [বালিশ : জাহেদ আহমদ]

ঘুমপাখি, পাতাচোখ ইত্যাদি শব্দ জাহেদ এখন লিখবেন না জানি। ইচ্ছে থাকলেও লিখতে চাইবেন না। যেহেতু. নব্বইয়ের গোড়ার দিকটায় এরকম সব শব্দের চল পরবর্তী দশকে বেশ বিস্তারিত হতেছিল। যেখানে তথাকথিত মিথ-পুরাণ ও লোকায়ত শিকড়ে ফেরার তাগিদে জন্ম নেওয়া অঞ্জন সেনদের উত্তর-আধুনিক ক্যাচালের ভূমিকা থাকতেও পারে কিছুটা। যেটি পরে বিবর্তিত ও বিবর্ধিত হতে-হতে ইমরুল হাসানদের কালে এক ধরনের জাতীয়তাবাদকে ধরছে বক্ষে, যার সঙ্গে আমার মতো অধম খাপ খাওয়াতে নাচার।

বালিশ কবিতাটির শেষ চরণ বাদ দিলে জাহেদকে যাত্রালগ্ন থেকে তাঁর অগ্রজ, সমসাময়িক ও অনুজ অনেকের মতো ধরা-অধরা, সরমা-পরমায় কবিতাকে বাঁধার আকুলি-বিকুলিতে পেরেশান দেখিনি। এবং, তাতে আটকায়নি কিছু। কবিতার যেটি অন্তর্গত কাজ, কোনো একভাবে পাঠকের চৈতন্যে ঘাই তোলা, সেটি এখানে মিলছে বেশক। আমাদের মতো কবিতা-আকাট একে যথেষ্ট ভাবলেও, নিজের কবিতায় এই সহজতা কেন জানি জাহেদকে অসন্তুষ্ট করে বলে মনে হয়। যে-কারণে তিনি সরমা-পরমার চক্করে কবিতাবই বাজারে আনতে নারাজ থাকেন। জাহেদ রুষ্ট হলে হতে পারেন, তবে বিষয়টি এভাবেই দেখি আমি।

কবিতা-আকাট হওয়ার কারণে হবে হয়তো,—শামসুর রাহমানকে আমার ভালোই লাগে পড়তে। যেমন লাগে বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথের ঘরানায় লিখতে থাকা কবিগণকে। জীবনানন্দ, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে যেমন লাগে ভালো;—আল মাহমুদ, আবুল হাসান থেকে আরম্ভ করে হেলাল হাফিজ কিংবা রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহও পড়তে মন্দ লাগেনি কভু। কেন, তার ব্যাখ্যা নিজের কাছেও ধাঁধা মনে হয়! কিছু একটা সারবস্তু হয়তো পাই, তাই সব্বাইকে লাগে কমবেশি ভালো।

সারবস্তু, সেটি হতে পারে শব্দ ও ছন্দের দুলুনী, মর্মরিত সাংগীতিক অনুরণন, সময়-সমকালের ছাপচিত্র অথবা বিবিধ। সুতরাং জাহেদের পঠনরীতির সঙ্গে নিজের পার্থক্য টের পাই তাঁর গদ্য পড়তে গিয়ে। এবং, তখন মনে হয়,—কবিতা পাঠের যোগ্য আমি তো নই! সুতরাং, আমাকে ওই-যে তাঁর কবিতা পড়তে দিলেন,কবির সিদ্ধান্তটি এদিক থেকে অতিশয় পচা ছিল। মুই যদি সত্যি কিছু বলতে যেতাম, সেখানে মজাক পয়দা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। ভাগ্যিস, কবিতাগুলো গছিয়ে দেওয়ার পর ফিরে কখনো জানতে চাননি সমাচার। আমিও ঠোঁটসেলাই পার করেছি ফাড়া।

এতদিন পর মনে হচ্ছে, দু-এক কথা বোধহয় যায় বলা। পাণ্ডুলিপির ছকে সাজানো কবিতাগুলো পাঠশেষে এটি হয়েছিল,—এখানে মর্মরিত কবিসত্তার সঙ্গে পরবর্তী সময়ে বিবর্তিত কবিসত্তার মোটামুটি পরিষ্কার তফাত ধরা পড়ছে। পাণ্ডুলিপির কবিতাগুলোয় তাঁর অগ্রজ ও সমসাময়িক কবিগণের প্রচ্ছন্ন প্রতিধ্বনি নেই, সে-কথা বলা যাচ্ছে না। তা-বলে কবিতাগুলোর পাঠ-অনুভব ও আবেদনে খামতি ঘটেনি। কবি জাহেদ আহমদের স্বকীয়তাকে তারা ধারণ করতে করেনি কসুর। সেখান থেকে পরবর্তী আরো দুটি ধাপ বোধহয় নিষ্কাশন করা সম্ভব। একটি ধাপে পৌঁছে জাহেদ আহমদের কবিতাভাষায় বদল ঘটতে দেখছি। রূপক ও অলঙ্কারের খোলসে জারি থাকছেন, কিন্তু কবিতার ভাষায় হয়ে উঠেছেন ডিরেক্ট। এবং, এর সাম্প্রতিক ধাপটি বোধহয় গানপার-এ গ্রাসরুটসের গান কবিতা সিরিজে গমন করলে পাঠক পাবেন।

শেখ হাসিনা সরকারের শেষ দিকটায় এসে সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপর নিজের ক্ষোভ ও বিদ্রুপ উগড়ে দিয়েছেন কবি। আমাদের শিল্প-সাহিত্যের জগতে চলতে থাকা ভণ্ডামির বিরুদ্ধে পরিহাস যেখানে কবিতাগুলোর মূল শর্ত পূরণ করেছে। আপাতভাবে পরিস্থিতি তাড়িত কবিতা মনে হতে পারে, কিন্তু রচনাবিন্যাসে শব্দের ব্যবহার, বিদ্রুপের ভঙ্গি, ক্ষোভের তীব্রতা জাহেদ আহমদের স্বভাবসুলভ কবিসত্তার বিপরীতে সক্রিয় এক সত্তাকে পাঠকের কাছে নগ্ন করে যায়। এখন, এই তিনটি ধাপে বিবর্তিত কবিকে পাঠ ও অনুভবের বড়ো বাধা হলো,—এর সবটাই তিনি রেখে দিয়েছেন অবিন্যস্ত। অনলাইনে যদি পাণ্ডুলিপি আকারে রাখতেন,—পাঠকের পক্ষে তাঁকে পাঠ ও অনুভব করা সহজতর হতো।

Photography – Like A Humming Bird by Zahed Ahmed; Image Source – Collected

ভাবা যায় নিশ্চয়, ভাবা তো যায়ই বিস্তর জিনিশ নিয়া, কিন্তু অত ভাবাভাবির কি দরকার? বানাইতে থাকো বরং কবিতার-পশ্চাদ্ধাবন-করা বাংলা গান। তর্ক করো কবীর সুমনের কাব্যমূল্য বেশি, নাকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। বাংলাদেশের ব্যান্ডগানগুলার হাবাগোবা কাব্যহীনতা নিয়াও ট্রল করতে ভুলিও না। তারপরও সত্যিকার অর্থে আধুনিক বাংলা গানের উড্ডয়ন যে এই নিষ্কাব্য পথে, এই সত্য কথাটা হাজার বোমা মারলেও গোবরমগজে ঢুকবে না তোমার। কবিতার করুণ অনুকরণ-অনুসরণ ছেড়ে বেতোয়াক্কা বেপরোয়া বাংলা গানের বোধন সমকালে বেশি লোকে চেয়েছে এহেন নজির কোনোকালেই গণ্ডায় গণ্ডায় পাওয়া যায় না। পাওয়া যাইত যদি, বাংলায় লালন-রাধারমণ-হাসন-করিম শতকে শতকে দু-দশজন তো কম- স্যে-কম মিলত। [গান ও কবিতা : জাহেদ আহমদ]

. . .
কবিতার জাহেদ আহমদকে শেষাবধি কতখানি ধরা গেল জানি না, তবে তাঁর বিচরণ কেবল কবিতায় নয় সীমিত। কবিতার চেয়ে বরং গদ্যের পরিধি সেখানে ব্যাপক। বিরামহীন গদ্য লিখেছেন একসময়। লিখছেন এখনো। করোনা অতিমারির সময়ে টানা গান লিখেছেন ও সুর দিয়ে গেয়েছেন বন্ধুমহলে। গানপার সঞ্চালনার কাজটিও নাই-নাই করে সাত বছরে পা রাখতে চলেছে। গদ্যে জাহেদ আহমদের কুশলতা নিয়ে একমাত্র কবি মুজিব মেহদী ছাড়া দ্বিতীয় কোনো বান্দাকে আমি কখনো কিছু বলতে শুনিনি। কোনো এক কথালাপে মুজিব মেহদী তাঁর নাম মুগ্ধ আন্তরিকতায় নিয়েছিলেন। জাহেদ আহমদের গদ্যকুশলতা নিয়ে কবি পরে কিছু লিখেছেন কি-না তা অবশ্য অজানা থেকে গেছে। বাংলাদেশের গদ্যসাহিত্যে জাহেদ আহমদ একাধিক কার্যকারণে গুরুত্ব রাখেন :

প্রথম কারণ,—বাংলাভাষায় গানবাজনা নিয়ে লেখালেখির চর্চা হয়নি এমন নয়। ওপার বাংলায় চর্চাটি বরাবরই বেশ হৃষ্টপুষ্ট ছিল। বাংলাদেশেও লেখালেখি হয়েছে কমবেশি; কিন্তু তার সবটাই অ-ধারাবাহিক মানতে হবে। সর্বোপরি, সাব-কালচার বা সোজা বাংলায় আমজনতার জীবন-মানচিত্রে ছাপ রাখতে থাকা দেশিবিদেশি গানবাজনার বিচিত্র স্কুলিংয়ের প্রভাব ও বিবর্তন নিয়ে লেখার চল আজ পর্যন্ত জনপ্রিয় কোনো ধারা হয়ে ওঠেনি। জাহেদ আহমদ সেই কাজে নামলেন একা।

দেশিবিদেশি গানবাজনার খবর করতে বছরের-পর-বছর একটানা লিখেছেন জাহেদ। বাংলা ব্যান্ড সংগীতের বিবর্তনরেখা ধরার তাড়না থেকে লিখেছেন। পাশ্চাত্য সংগীত, বিশেষ করে রক-পপ ও মার্কিন লোকসংগীতের জগতে ঘুরান দেওয়ার খায়েশ থেকে ক্লান্তিহীন লিখেছেন গদ্য। সমালোচক ওরফে ক্রিটিকের চোখ দিয়ে নয় অবশ্য়ই;—বরং যেসব গানবাজনা তাঁর বেড়ে ওঠা ও যাপনের অনেকখানি জুড়ে ছড়িয়ে আছে,—এখন, এর সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া পাকাপোক্ত করার দায় মিটিয়েছেন লিখে-লিখে।

লেখার প্রসাদগুণে সাংগীতিক ঘরানার স্বকীয়তা, জনমনে তার প্রভাব, এবং আমাদের জায়গা থেকে এসবের প্রাসঙ্গিকতা সেখানে আভাসিত। গানবাজনা নিয়ে রচিত জাহেদ আহমদের গদ্যগুলো একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরকে উদযাপন করলেও পটভূমিটি সেখানে নিছক ব্যক্তিগত থাকেনি। গদ্যগুলোর ভিতরে তাঁর যাত্রা বরং শাহরিক শ্রোতাদের বিবর্তনরেখা বুঝতে কাজে লাগে। দেশিবিদেশি গানবাজনার সঙ্গে নগর সংস্কৃতির সম্পৃক্ততা ও এর প্রভাব-পরিণামের ছবিখানা আমরা এই সুবাদে পাচ্ছি। বোঝাপড়ার একটি একলা পরিসর এভাবে জাহেদ তৈরি করে দিয়েছেন আমাদের জন্য। বাংলাদেশে এর আগে কাণ্ডটি কেউ ঘটিয়েছেন বলে আমার জানা নেই।

বাংলা ব্যান্ড গানের আদি, মধ্য ও সাম্প্রতিক কাণ্ডারিগণকে নিয়ে জাহেদ লিখেছেন। শ্রোতা হিসেবে এর সঙ্গে তাঁর নিজের বেড়ে ওঠার স্মৃতিকাতর বিবরণ সেখানে পাচ্ছি। রকস্টার জেমস ছাড়াও একাধিক ব্যান্ডবাজের গানযাত্রাকে তিনি বয়ানে ধরেছিলেন। এখান থেকে বাংলা ব্যান্ড গানের বিবর্তনরেখার ছবি পাঠকের ধরতে সুবিধে হয়। বেচারা জেমস হয়তো মনে-মনে অপেক্ষায় ছিলেন এতদিন,—তাঁদের নিয়ে দেশে কিছু লেখাটেখা হোক এবার। জাহেদকে দিয়ে চাহিদার কিছুটা মিটেছিল বলা যায়। লেখার খবর জেমসের কানে যাওয়ার পর রকস্টার সাগ্রহে সেটি পাঠ করেন তখন। ঘটনাটি বুঝিয়ে দেয়,—আমাদের এখানে গানবাজনা ওই বিনোদন আর ব্যবসায় আছে আটকে। লেখালেখির মধ্য দিয়ে গান ও গায়কির দেহ-ব্যবচ্ছেদ ও ভাবনার খোরাকি সরবরাহের কাজে আমরা এখনো মরুভূমি সাহারা! জাহেদের লেখাগুলো সেখানে মরুদ্যান বটে!

পপুলার কালচারে এসব গানের জন-আবেদন, গানের দেশ বাংলাদেশে তাদের নতুনত্ব ও ঘাত-প্রতিঘাতের চিহ্নগুলো জাহেদ তাঁর গানগদ্যে ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। পাশ্চাত্য রক-পপ আইকনদের নিয়ে এজন্য তাঁকে লিখতে হয়েছিল। বব ডিলান, লিওনার্ড কোহেন, জন ডেনভার, মাইকেল জ্যাকসন, ম্যাডোনা থেকে বিটলস অবধি হৃষ্টপুষ্ট লেখ্যভাণ্ডার তিনি কলমে ধরেছেন। গানের ভাষান্তর করতেও খেটেছেন বিস্তর। এভাবে, গানগদ্যের একখানা ধাঁচ গড়েপিটে নিয়েছেন জাহেদ। এককলম লেখার মুরোদ নেই এমন অনেকে অবশ্য বলতে ছাড়েননি,—এখানে তো খালি নস্টালজিয়ার ছড়াছড়ি! গানের বিশিষ্টতা ও গান তৈরির পেছনে যেসব ব্যাপার-স্যাপার সংগোপন থাকে,—সেই সাংগীতিক পরিসর কোথায়! ওটা তো মিসিং! ভালো কথা মিসিং,—আপনারা কেন তা ভরাট করতে লিখছেন না জনাব? আটকাচ্ছে কোনখানে!

কথা সত্য, গানবাজনার কারিগরি দিকগুলো জাহেদ মোটের ওপর বাদ দিয়ে এগিয়েছেন, এবং সেটি কোনো অপরাধ নয়। কারো পক্ষে একলা গানের সকল খুঁটিনাটি দিক ধারণ করা সম্ভব নয়। সেই দায় তাঁর ওপর চাপানো অর্থহীন। অন্যরা দায়িত্ব নিলে জায়গাটি ভরাট হতে থাকবে। বাংলাদেশে গানের কারিগির দিকগুলো নিয়ে আব্দুশ শাকুর ছাড়া অন্যরা ধারাবাহিক লিখেছেন বলে শুনিনি কখনো!

আব্দুশ শাকুর মূলত ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে লিখেছেন। পঞ্চকবির (রবি-নজরুল-রজনীকান্ত-অতুলপ্রসাদ-দ্বিজেন্দ্রলাল) গান নিয়ে অনেকের অবশ্য বইপত্র রয়েছে। লোক ও বাউলগানের পাশাপাশি আধুনিক বাংলা গানের ওপর লেখালেখির চর্চা আগের তুলনায় বেড়েছে অনেক। তথাপি, আবারো পুনরাবৃত্তি করি কথাখান,—এর সবটাই অ-ধারাবাহিক। জাহেদ আহমদের গানগদ্য এখানে এসে সরাসরি পপুলার কালচারে নিজেকে কানেক্ট করেছিল;—প্রেক্ষাপট বিবেচনায় যার গুরুত্বকে খাটো করে দেখার নেই সুযোগ।

আমরা তো জানি, একটি সাংগীতিক ঘরানা রূপে ব্যান্ড মিউজিককে এই দেশে স্বীকৃতি লাভের জন্য কী পরিমাণ স্ট্রাগল করতে হয়েছিল! বাংলা Rap গানকে যেমন করতে দেখছি অদ্য। তার বাইরে বাংলা সিনেমায় ব্যবহৃত গান, সুমন-অঞ্জন-নচিকেতার পরোক্ষ প্রভাব থেকে জন্ম নেওয়া গান, এবং আমাদের লোকায়ত পরিসরে এখনো হেলায় পড়ে থাকা গানের বিচিত্র ধারা নিয়ে জম্পেশ লেখার পসরা সাজানোর মতলবে গানপার চালু করেন জাহেদ। এখানে তাঁকে ব্যর্থ হতে দেখছি। পরিতাপের সঙ্গে বলতে হচ্ছে,—তিনি নিয়ম করে লিখছেন, কিন্তু গানবাজনার বিচিত্র শাখা-প্রশাখা নিয়ে লেখা ও লিখিয়ের সম্ভার গানপার-এ অতি নগণ্য।

রোলিং স্টোন-এর মতো গানপত্রিকা এই দেশে সম্ভব নয় সে আমরা জানি। আকাশকুসুম কল্পনা করে লাভ নেই। কাছাকাছি কিছু অন্তত দাঁড় করানো উচিত ছিল। দুই বাংলার কোথাও সেটি ঘটেনি। এই জায়গা থেকে জাহেদ আহমদ গানবাজনা নিয়ে কলম চালানোর মতো একটির পরিসর অন্তত তৈরি করেছেন। গানের জন-আবেদন ও স্বকীয় হওয়া-না-হওয়ার জায়গাজমি চেনার দায় কিছুটা পূরণ হয়েছে। বাকি সব বিষয়াদি নিয়ে কলমচির পসরা বসানো তাঁর একলার পক্ষে পাহাড় ঠেলার চেয়ে দুরূহ কাজ হতে দেখছি ক্রমশ। বাংলাদেশে বাক্যনবাবের অভাব নেই, কিন্তু কাজের বেলায় সব ব্যাটাই ফুট্টুস।

Photography – Farfari by Zahed Ahmed; Image Source – Collected

দ্বিতীয় কারণ,—দুই বাংলা জুড়ে ছড়ানো-ছিটানো সাংস্কৃতিক উপাদানের সঙ্গে চেনাজানার অভিজ্ঞতাকে জাহেদ তাঁর গদ্যে ধারণ করেছেন; এবং সেটি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। মেলা নিয়ে লিখেছেন। বইপত্র নিয়ে লিখেছেন। আশপাশে টহল দিয়ে বেড়ানো পশুপাখির সংসার নিয়ে লিখেছেন মনবিধুর কড়চা। ছোটকাগজ ও সাহিত্যপত্রের আবর্তন-বিবর্তন ও আবেদনকে সমালোচকের জায়গা থেকে বাণ হানতে ছাড়েননি। কবি-লেখক-আঁকিয়েদের সঙ্গে যাপনের অভিজ্ঞতা কবিতা ও গদ্যে নিয়মিত ধারণ করছেন। সবটা একত্র করলে সময়-মানচিত্রের বিবর্তনরেখা পাঠক পাবেন অনায়াস।

বাংলা ভাষায় এই ধাঁচে নিয়মিত লিখে যাওয়ার ইতিহাস অধিক নেই। এটি পাশ্চাত্যে রয়েছে। ওপার বাংলায় মিলবে কিছুটা। বাংলাদেশে এসব নিয়ে লেখার ভাবনা লেখকসমাজকে তাড়িত করে না। বলে রাখা ভালো,—জাহেদ আহমদের এসব লেখা কোনো মাইলস্টোন রচনা হতে চায়নি। সে-উদ্দেশ্য লেখাগুলোয় খোঁজার তাই মানে হয় না। এই রচনারীতির সঙ্গে বরং সৈয়দ মুজতবা আলী কিয়ৎ পরিমাণে সাদৃশ্য রাখেন। পরিহাসরসের ভিতর দিয়ে নিজের চারপাশকে বুঝে নেওয়ার তাড়না যার ভিত্তি। কড়চাধর্মী নয় পুরোপুরি; নয় হুতোমপ্যাঁচার নকশা; নিখাদ বিশ্লেষণে নয় তারা বিশ্বস্ত;—রকমারি পাঁচন মিশিয়ে তৈয়ার এক রচনারীতি বলা যায় একে। এই গদ্য পড়তে বেশ! কাজেও লাগে অনেকসময়। জাহেদ আহমদের গদ্যরচনাকে তারা পৃথক আয়তনে বিস্তারিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। এদিকটা নিয়ে কেউ ভেবেছেন বা লিখেছেন,—তার কোনো নজির আজো চোখে পড়েনি!

তৃতীয় কারণ,—জাহেদ আহমদের গদ্যশৈলীতে নিহিত। বাংলা ও ইংরেজি শব্দের যুগলবন্দি একটি ভাষাপ্রণালীর জন্ম সম্ভব করেছে তাঁর রচনায়। বাংলা ভাষার প্রবাহকে যেটি বিঘ্নিত করছে বলে আমার মনে হয়নি কখনো। সেখানে আবার ফাঁকফোকর বুঝে আঞ্চলিক ও অন্যান্য ভাষার শব্দ করেছেন ব্যবহার। এরকম গদ্যভাষায় গল্প ও আখ্যান কি লেখা সম্ভব? জাহেদ নিরীক্ষাটি করেছেন কিনা জানি না!

Song and Music- Adore Adore Zabe Raat by Zahed Ahmed; Artist : Biman Talukder; Source – Shams Shamim YTC

আমারে কবরে নেবে কারুবাসনারা, আমার অপরূপ অবলীলা কারুবাসনারা! হেন বিধ্বংসী আনন্দের ভার বিধাতা আমারে দিয়াছেন, অপার বেদনা নিয়া বক্ষে আমি পাথর বেঁধে দমবন্ধ বেঁচে আছি। একটুখানি তৃণফুলে রোদফড়িঙের ফুরফুরানি দেখে আমি হৃষ্টডানায় বাড়ি ফিরি রুটিগৃহ-গমনের মাঝপথ থেকে—এটুক আমার মাত্র জাগতিক ত্রুটি। এই তৃষ্ণা রসদ আমার—তিরতির শ্বাস—এই শাপ! অভিশাপ জন্মগত! অভিশাপ অতিমানবীয়! আমি এক কারুকর্মকার, ধার্য ভবিতব্য যার, সামাজিক ও সর্ববিধ নিষ্ফলতার। [কাঠঠোকরার কাজ : জাহেদ আহমদ]

. . .
কবিতা-গান-গদ্যে এই-যে বিচিত্র পন্থায় জাহেদ আহমদের যাতায়াত গত তিন দশক ধরে চলছে,—এর কিছুই বাংলাভাষী কবিলেখক সমাজের চোখে পড়েনি বলে ধরে নিতে হচ্ছে! গানপার-এ তাঁর লেখালেখির বড়ো সংগ্রহ এতদিনে গড়ে উঠেছে। সেগুলো, এমনকি সেখানে যাঁরা লিখছেন নিয়মিত, যাঁদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিতজনরাও রয়েছেন;—তাঁরা আসলে কতটা কী লক্ষ করেন, তার কিছু মাথায় পশে না!

সমস্যাটি জাতিগত। আমরা আশা করি,—আমার লেখা অন্যরা পাঠ করবে; ভালোমন্দ দুকথা তারা বলবে; কিন্তু বেচারা অন্যকে স্বয়ং পাঠ ও তাকে নিয়ে দু-কথা বলার দায় আমার নেই! এরকম আজব দেশে জাহেদ আহমদের গানযাত্রা ও ইম্প্রোভাইজেশনের পরিসরটি সংকীর্ণ হতে বাধ্য। বাস্তবে সেটিই ঘটছে!

এখানে পৌঁছে জাহেদ স্বয়ং হয়ে উঠছেন বেমানান। একরোখা ও নিঃসঙ্গ হতে হচ্ছে তাঁকে। একে এখন বেঁচে থাকার পন্থা হিসেবে পোষ মানাতে হচ্ছে। লেডি গাগার বর্ন দিস ওয়ে গানের সারবস্তু ধার করেই বলি না-হয় : দিস ওয়াজ মাই ওয়ে। আই লিভ দিস ওয়ে, বিকজ গড মেইকস নো মিসটেক। লিভ দিস ওয়ে-র ইশতেহার হয়তো গ্রাসরুটসের পরিহাসমুখর কবিতা সিরিজে রেখে দিয়েছেন জাহেদ। তার একটি নমুনা এখানে তুলে রাখছি। বেমানান বিশ্বে যারা বেমানান,—তাদের করকমলে কবিতাটি নিবেদন করেছেন কবি;—যে-দলে তিনি রয়েছেন সগৌরব!

Photography – Indomitable by Zahed Ahmed; Image Source – Collected

গ্রাসরুটসের গান, অনিয়মিত অসাহিত্যিক অবদমনাখ্যান
জাহেদ আহমদ

(তু লালপাহাড়ের দেসে যা… রাঙামাটির দেসে যা….
হেথাক তুকে মানাইছে নায় গো, ইক্কেবারে মানাইছে নায় গো)

যারা বেমানান
এই ছদ্মভূষা বাঘ-হরিণ-সিংহদের দেশে
এই কৃমিস্বভাব লেখকদের লীলায় আমপিঁপড়ার কামড় ভালোবেসে
চিলতে এই লেখাটা তাদেরে উৎসর্গিত
তাহাদেরি তরে এই গান

যারা খাপ-না-খাওয়া মানুষ
সর্বত্র অস্বস্তিপীড়িত দশা যাদের এ-স্বস্তিকারাজ্যে
পরিব্যাপ্ত ঝলমলানিজীর্ণ নগরতোরণে একাকী-বিবিক্তবোধে আক্রান্ত যারা
মায়াভালুকের আফিমনৃত্যে একদম অতিষ্ঠ ও রোরুদ্য অবস্থা যাদের
ছেড়ে-দে-মা-কেঁদে-বাঁচি কিন্তু পরিত্রাণহীন পর্যুদস্ত রোজ-গুজরান যাদের
যারা কাঠবণিক না-হয়ে চেয়েছে হতে অরণ্যসখা
বাগানমালকিন না-হয়ে চেয়েছে বনমালি হতে
এই জনমেই যারা রাধা হতে চেয়েছে
এবং পরজনমের প্রবৃত্তিপৃথুলা পানশালাবাসনা যারা পোষে নাই হৃদয়ে

তাদের জন্যই নিঃসুর এই গান
খলবলে মাছের কোলাহলে ভেসে যেতে শেখে নাই যারা
ভিড়ের সুযোগে ঠেলাঠেলি কনুইচালনায় তৎপর হয় নাই যারা
অথবা মনিবের বানোয়াট বুদ্ধিবিদঘুটেপনায় মজে নাই যারা
অথবা যারা যায় নাই তিড়িংবিড়িং তোতলা ফড়িঙগিরিতে

তারা, যারা খাপ-না-খাওয়া, যারা আগন্তুকপ্রতিম সবিস্ময় সন্ত
যারা বাউলবর্ণিল, সহজিয়া, যারা আগডুম-বাগডুম পণ্ডিতির পানে পিঠ-ফেরা
যারা গানপোকা কিন্তু ওস্তাদজির পশমিনা শালের প্রশংসায় কৃপণ
যারা আস্ত গাছটাই ভালোবাসে, কেবল ফুলপসন্দ খণ্ডিত দর্শনে সায় নাই যাদের
যারা মুড়িপ্রিয়, মুড়কিও পছন্দ, তবে মুড়ি ও মুড়কি পৃথক স্বাদের বলে জেনেছে

তাদের জন্যই এই পৃথিবী তৃণতরকারিময় স্নিগ্ধ-সুসহ এখনো
তাদের জন্যই এ-গান
তারা শুনুক না-শুনুক তবু তারাই উদ্দিষ্ট শ্রোতা এই গানের
তাদেরই কর্ণকমলে এই সুরসম্মান
যারা বেমানান…
. . .

Portrait of a poet by Sattyazit Chakrabarty; Image Source – Collected

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 48

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

One comment on “বেমানান থাকার লড়াই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *