নেটালাপ - পোস্ট শোকেস

কার ভাষা কে বলে!

Reading time 5 minute
5
(46)
@thirdlanespace.com

. . .

সুফিবাদে নারীকে আত্মার প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা পিতৃতন্ত্রের লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের বিপরীতে অবস্থান করছে। সাধকরা এখানে প্রেম ও করুণার মাধ্যমে সম্পর্কের মহিমা তুলে ধরেছেন। নারী-পুরুষের মধ্যে ক্ষমতাগত কোনো বিভাজন এখানে রাখা হয়নি।

নারীর জ্ঞান, আধ্যাত্মিক শক্তি ও আত্মিক শুদ্ধতায় তার ভূমিকা সুফি সাধনায় গুরুত্ব পেয়েছে। সামাজিকভাবে নারীকে দুর্বল দেখানোর সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণা এটি। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকরা এসব নিয়ে যে-ভাষায় কথা বলেন,—তাকে অনেক দূরের কিছু বলে মনে হয়। ঔপনিবেশিক মনন ও পশ্চিম প্রভাবিত চিন্তাধারার খাঁচায় বসে ভাবনা করার মানসিকতা থেকে আমাদেরকে বের করে আনতে চাইছেন তাঁরা, কিন্তু সেখানে তাঁদের কথা বলার ধারা মনে উলটো সন্দেহ তৈরি করে বসে। নিজেরা সেই মানসিকতার প্রতিধ্বনি করছেন,—এরকম মনে হয় এক-একসময়! ভারতবর্ষকে তার নিজস্ব গুণাগুণের জায়গা থেকে ভাবনা ও ধারণ করবার মতো ভাষাপ্রণালী কি গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকরা আমাদেরকে উপহার দিতে পেরেছেন?

তাত্ত্বিক-দার্শনিক আলোচনার গুরুত্ব থাকলেও ঐতিহা‌সিক যোগসূত্রের আলোয় চর্যাপদ ও সুফিমার্গের ভাষাগত সাহিত্যিক গুরুত্ব সুকুমার সেন, আহমদ শরীফ প্রমুখরা একদা তুলে ধরেছিলেন। আমাদের আধুনিক মনন একে সঠিক পন্থায় ধারণ করতে পারেনি। ভাষাগত ও সাহিত্যিক দিক থেকে চর্যা-সুফি ইত্যাদির গুরুত্ব উপলব্ধি ও একে ব্যবহারের ঘটনা তাই বড়ো আকারে ঘটেনি। যদি ঘটত, তাহলে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকদের পশ্চিম-প্রভাবিত চিন্তাছকে নিম্নবর্গের জগৎ বোঝা ও ব্যাখ্যার সমান্তরালে বিকল্প কোনো দেশিপ্রণালী আমরা অবশ্যই পেতাম।
. . .

Had Anhad: Journeys with Ram & Kabir by Shabnam Virmani; Source – Ajab Shahar Kabir Project YTC

ভাবনা ও ধারণ করতে পা‌রেননি কথাটি সরলীকরণ হয়ে যাচ্ছে হাসান। আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশকে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকরা নিবিড় চোখে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ভারতবর্ষে ঐতিহ্য পরম্পরায় চর্চিত সুফি-বাউল ছাড়াও আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভাষা-বিশ্বাস-মূল্যবোধে নিহিত যত নিদর্শন বিদ্যমান, সেগুলোর মাহাত্ম্য তাঁরা ভালোই বোঝেন।

গায়ত্রীদের মূল উদ্বেগের জায়গা অন্যখানে নিহিত থেকেছে। সমাজে শোষিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই-যে হাজার-হাজার বছর ধরে নিজস্ব ভাষাপ্রণালীর ভিতরে চলাচলের মধ্য দিয়ে নিজের কথাগুলো অবিরত বলার চেষ্টা করলেন,—তাদের এই প্রকাশ-প্রণালীকে শিক্ষিতসমাজের হাতে গড়া রাষ্ট্র এখন কীভাবে ব্যাখ্যা করছেন?—প্রশ্নটিকে সবার আগে তাঁরা তলিয়ে দেখার তাড়না বোধ করেছেন। কলোনিয়াল মাইন্ডসেটকে এসব ব্যাখ্যা কীভাবে ধারণ কিংবা প্রতিফলিত করছে, এবং এর স্বরূপ ও পরিণাম তুলে ধরতে কমতি রাখেননি। গায়ত্রীদের করা ক্রিটিককে শিক্ষিতসমাজ যারপরনাই গোনায় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এটি হচ্ছে আমাদের এখানে তাঁদের বড়ো অবদান।

এই-যে সুফি, বাউল ইত্যাদি নিয়ে আমাদের এত-এত উচ্ছাস!—এখন এই উচ্ছাসটি কেন দেখাই আমরা? দেখাই এ-কারণে যে,—আমাদের কাছে প্রায় অচেনা সে-জগতে গমন করলে সকল প্রকার সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে অবস্থিত উদার-মানবিক অম্লযান শুষে নিতে সুবিধা হয়। ভালো কথা, কিন্তু ভারতবর্ষে যুগ-যুগ ধরে বিচরণে অভ্যস্ত সুফি-বাউল নামধারী লোকজন আসলে কারা? তাঁরা হচ্ছেন আর্থ-সামাজিক মানদণ্ডে বঞ্চিত, নিগৃহীত ও অবধারিত নিয়মফেরে ব্রাত্য জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। পিছিয়ে থাকা বললে কম বলা হবে, বরং বলা উচিত, সমাজে মানবিক অধিকার নামে যত কিছু বিরাজ করে,—আজো তারা সেগুলোর ওপর নিজের হক প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।

তারা তাহলে কী করেছে? প্রশ্নের উত্তর এককথায় দেওয়া মুশকিল। এটুকু হয়তো বলা যায়,—তারা কেবল চেয়ে-চেয়ে দেখছে,—সমাজের ওপরতলায় যারা বিচরণ করছেন, তারাই হলেন সর্বেসর্বা। আল্লা-খোদা-ভগবান স্বয়ং এই লোকগুলোর পোষা বিড়াল-কুকুর রূপে নিজের দায় পালন করে চলেন। নির্দয় এই বিভাজন ও বৈষম্যের সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব নয় বুঝে তারা বিকল্প পথ খুঁজে নিয়েছে। বিকল্প ভাষা ও প্রকাশ-প্রণালী গড়ে তুলেছে তারা;— আমরা এখন যার কাছে ছুটে-ছুটে যাই খানিকটা সতেজ হাওয়া বুকে টানার আশায়!

আমাদের এই ছুটে যাওয়ার মানে আবার এই নয়,—সুফি-বাউল-আদিবাসীর নিজস্ব প্রকাশ-প্রণালীর জগতে আমরা অবিচ্ছেদ্য হতে আগ্রহী! আমরা সেখানে যাচ্ছি হাঁসফাঁস অবস্থা থেকে একটু জিরান নেওয়ার জন্যরোমান্টিক ভাবালুতা ঝোলায় পুরে পুনরায় নিজের জগতে ফেরত আসি। সুতরাং আমরা যখন সুফি-বাউল-আদিবাসীকে নিয়ে কথার ফোয়ারা ছুটাই, সেখানে ভাবালুতার বদবু ছাড়া অন্য সুবাস পাওয়া কঠিন হয়। গায়ত্রী চক্রবর্তীদের ব্যাখ্যা আমাদের এই মজ্জাগত সমস্যাটি ধরতে সাহায্য করে!

সুফি-বাউল সদৃশ যত নিদর্শন ভারতবর্ষে যুগ-যুগ ধরে চর্চিত হয়ে আসছে, এর ষোলআনা সমাজে নিজের জায়গা করে নিতে না পারার যন্ত্রণা ও বিস্ফার থেকে জন্ম নিয়েছিল। সমাজের ভিতরে আরেকখানা সমাজ গড়ে নিজেকে তারা পৃথক করে নিয়েছেন। এখন এই-যে পৃথক হলেন তারা, মানবিক ও সংবেদী বাতায়ন গড়ে তুললেন, এবং সেখান থেকে যে-ভাষা ও প্রকাশ-প্রণালী জন্ম নিলো,—এখন এর স্বত্ব ও মালিকানা কার থাকছে? প্রশ্নটি রাজনৈতিক, এবং একইসঙ্গে সাংস্কৃতিকও বটে। গায়ত্রীর ক্যান সাবঅল্টার্ন স্পিক, আরো নির্দিষ্ট করে যদি বলি তাহলে বলতে হয়,—নারী ও আদিবাসী জীবনকে নিরিখ করার অভিজ্ঞতা থেকে প্রশ্নটি তিনি তুলেছিলেন। স্বত্বকে ঘিরে বিচিত্র গুঁটিবাজির খেলাকে যা ব্যাখ্যা করে উঠতে চেয়েছিল।

Gayatri Chakravorty Spivak explained the story and facts behind her statement on “Can the Subaltern Speak?”; Source – Banan YTC

. . .

ক্যান সাবঅলটার্ন স্পিক কথাটি যে-প্রেক্ষাপটে তুলেছিলেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক
(নিচের লিস্ট বাটনে ক্লিক করুন)

ক্যান সাবঅর্ল্টান স্পিক নিয়ে বাংলাদেশ সফরকালে গায়ত্রীর ব্যাখ্যা :

যে মহিলা নিজে লিখে গেল যে, দেখো-বুঝো, আমি একটা মানুষের জন্য নিজেকে মারছি না। অন্য কারণ আছে। এই লিখে গেলাম । তখন ১৯২৬ সাল। কবে দেশ স্বাধীন হবে তা তো জানা নাই কিছু। ফলে লিখেছিল ৬০ বছর বাদে খুলবে। এই ফ্যামেলির কথা। তখন আমি রেগে বলেছিলাম,—দ্য সাবঅলটার্ন ক্যান নট স্পীক। এটার মধ্যে সাবঅলটার্ন কোনো ভয়েস নেই । এটা সাবঅলটার্ন ক্যান নট টক বলিনি । ইংরেজি কথায় স্পিচ আর টকের মধ্যে তফাত আছে। সাবঅলটার্নের স্পিচ,—দেহ দিয়ে যে বলে গেল। সেটা কমপ্লিট করা গেল না! এডুকেটেড বাড়ির মধ্যে মহিলা—সে বলল ‘অবৈধ প্রণয়’! কমপ্লিট করা গেল না। কাজেই রাগ করে লোকে যেমন বলে,—দেয়ার ইজ নো জাস্টিজ। সেইভাবে বলেছিলাম। পড়তে না জানলে মনে হয় যেন আমি বলছি,—সাবঅলটার্ন কথা বলতে পারে না। গাধা নাকি! আমি কি গাধা? যে, আমি যদি সত্যি সত্যি তা মনেও করি, আমি কি এতো গাধা যে,—আমি সেটা লিখব?

. . .

সুফি, বাউল ইত্যাদির গুনগান শিক্ষিত সমাজ ব্যাপক আদর সহকারে করে থাকেন। আদরের পুরোটা তিনি যদিও নিজের কল্পনার ফানুস দিয়ে বানানো ফ্রেমে বসেই সারেন ঝটপট! এর ফলে সমাজে বাস্তবে বিদ্যমান জনগোষ্ঠীর বড়ো একটি অংশকে ব্রাত্য করে রাখার আর্থ-সামাজিক রাজনীতির ফাঁকফোকর চাপা পড়ে যায়।

আমরা তাঁদের মারিফত দেখে মুগ্ধ, বেচইন, পেরেশান হই কেবল! উদার ও সমন্বয়বাদী সংস্কৃতিকে ভালোবাসি আন্তরিক; কিন্তু এর পেছেনে লেগে থাকা দগদগে ক্ষত আর জখমকে মুগ্ধতা দেখানোর ধামাকায় নেমে লঘু করি মারাত্মক! মোদ্দা কথা হচ্ছে,নিম্নবর্গের জগতে ভূমিষ্ট সংস্কৃতি ও ভাষা আমাদের পাল্লায় পড়ে ব্যবহৃত হয় মাত্র! নিজের স্বত্ব যেখানে আমরা অবলীলায় আরোপ করে বসি। একে প্রতিরোধের সক্ষমতা তার নেই। প্রতিরোধ করার জন্য জরুরি রসদের কিছুই তার ছিল না কখনো;আজো নেই। গায়ত্রীর ক্যান সাবঅল্টার্ন স্পিক সমস্যাটি ভাবতে ও বুঝতে সাহায্য করে। তাঁর প্রাসঙ্গিকতা এই জায়গা থেকে ভেবে দেখলে অস্বীকার করা যাবে না।

ক্বারী আমির উদ্দিনের একটি গান আছে না, যেখানে ক্বারী সায়েব গাইছে :

তোমার চিন্তায় তনু হইল ক্ষীণ
তোমারে না পাইলে আমার ঘটিবে দুর্দিন
মাইনসে কইব আমির উদ্দিন তুইনু অতো গান গাইলে।

প্রতিকূল সমাজবিশ্বে নিজেকে অবরুদ্ধ দেখার আতঙ্ক থেকে আত্মরক্ষার উপায় হলো অসীম অনন্ত কিছুতে অবগাহন। আমির উদ্দিন কাজেই তাঁর ওপর ভরসা করে আত্মরক্ষার পথ খুঁজছেন। দেহতত্ত্ব আর বিচ্ছেদী গানের বুলিতে গুম রাখার মধ্য দিয়ে নিজের পাওয়া-না-পাওয়ার সকল জ্বালা জুড়াচ্ছেন ক্বারী সায়েব। সুতরাং ভারতবর্ষে জন্ম নেওয়া ভাববাদের লোকায়ত স্বরূপের সবটাই অবরুদ্ধতাভীতি ওরফে ক্লাস্ট্রোফোবিয়াকে চিনিয়ে দিয়ে যায়।

Boro Lojja paimure Bondhu by Kari Amir Uddin; Source – Amiri Jalsha YTC

দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদী ইত্যাদি বাঁধাবুলির চাপে খোদ বাউল মহাজন ভীতিকে ভুলে থাকার চেষ্টা করেন আকসার। আকাল ও দারিদ্র্যকে সাময়িক বিগার ভাবার মধ্য দিয়ে অবরুদ্ধতাভীতির মরণকামড় তাঁরা সইতে থাকেন। যখন পেরে ওঠা অসম্ভব হয় তখন করিম বা দুর্বিনের কণ্ঠে নিজের দুখীজীবন গমক দিয়ে ওঠে। মকদ্দস আলম উদাসীর গানের কলিতে ছলকে উঠে সংক্ষোভ :

সবে তোমার কাজ করতেছে আমি তোমার অকর্মা
থাকি আমি অনাহারে তারা খায় পোলাও কোরমা।

আমির উদ্দিন বিচ্ছেদী বুলির ওপর ভর দিয়ে যা ঢাকতে ব্যাকুল, উদাসী এইবেলা গোমর ফাঁস করে দিচ্ছেন। বুঝিয়ে দিচ্ছেন, বাউল মহাজনের অধ্যাত্মতরিকা আর রাধারমণের যুগে পড়ে নেই। সময় খন্নাসচক্রে পিষে মারছে দেহ। সে কেবল চতুর নয়, প্রকাশ্যও। উদাসী তাই বলতে রাখঢাক করছেন না :

যুগে যুগে কল ঘুরাইল শয়তানে
বিলাইয়ে ইঁদুর ধরে না কৌশল করে গোপনে।

উদাসীর পদ দুখানা নামে দেশের গান, আখেরে বঞ্চনাগাথা। অবরুদ্ধতাভীতিকে হানা বিদ্রূপ। সেইসঙ্গে এই মর্মবেদন যে,আজো তারা কথা বলে চলেছেন, কিন্তু তাদের কথাগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে অন্যদের হাতে;যেখানে তাঁদের মর্মবেদন বোঝার মতো কিছু আর অবশিষ্ট পড়ে নেই! সুতরাং তাঁরা কি সত্যি কথা বলতে পারেন? প্রশ্নটি আসলেও গুরুতর।
. . .

Duniya Dhandabaji by Mokoddos alom Udasi; Source – Shejul Hussen YTC

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 46

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *