নেটালাপ

কার্ল মার্কস – ইতিনেতি সমাচার

Reading time 10 minute
5
(6)

লেখাটি এলোমেলো; তবে এই প্রশ্নটি মাথায় ঘুরছে—মার্কসের এতোগুলো সন্তান কেন? সারা পৃথিবীর মানুষ নিয়ে যিনি ভাবলেন, তিনি মনে হয় নিজের জীবন-সংসারে সামঞ্জস্য নিশ্চিত করার দিকে নজর দিতে পারেননি! মার্কসের সময় পরিবার পরিকল্পনার বালাই ছিল না মনে হচ্ছে!
. . .

কার্ল মার্কসে পরিবার নিয়ে একটি জনপ্রিয় কৌতুক হলো—মার্কস শোষণমুক্ত সমাজের কথা বললেও তাঁর নিজের ঘরে ‘বৈপ্লবিক শাসন’ চলত! সন্তানরা খেলনা ভাগাভাগি না করলে মার্কস বলতেন, ‘আমার তত্ত্বে সবকিছু সবার জন্য।’ আর স্ত্রী জেনি বলতেন, ‘প্রিয় মার্কস, আগে বাজারের বকেয়া মিটিয়ে আসো, তারপর বিপ্লব করো যত খুশি।’ কেউ কেউ মজা করে বলেন, মার্কসের পরিবার যদি সত্যি তাঁর তত্ত্ব মেনে চলত তাহলে হয়তো কেউ রাতের খাবারের জন্য ‘সমান অংশের’ দাবি নিয়ে বিপ্লবে নামত। বাস্তব জীবনের আর্থিক টানাপোড়েন আর তাত্ত্বিক আদর্শবাদ নিয়ে এরকম হাস্যরস আজো জনপ্রিয়।
. . .

কারো ব্যক্তিজীবন তার চিন্তার প্যারামিটার নয়

বড়ো মাপের কোনো ভাবুকের চিন্তা বা দর্শন বোঝার ক্ষেত্রে তার বেড়ে ওঠা ও জীবনধারার ওপর ধারণা নেওয়া অবশ্যই সাহায্য করে, তবে জাজমেন্টাল হওয়া উচিত নয়। নাজিউর রহমান নায়িম কার্ল মার্কসের ব্যাপারে যে-তথ্যগুলো হাজির করেছেন, সেগুলো বাসি খবর। কার্ল মার্কসের ব্যাপারে আগ্রহীরা অনেক আগে থেকে জানেন এসব। মার্কসের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন নিয়ে একাধিক তথ্যচিত্র ও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। রাউল পেক বোধহয় ছয়-সাত বছর আগে মার্কস ও এঙ্গেলসের যুবাকালের দিনগুলো নিয়ে সিনেমা বানালেন। মার্কসের ব্যক্তিজীবনের টুটাফাটা প্রসঙ্গ সেখানে ছুঁয়ে গেছেন নির্মাতা।

The Young Karl Marx (2018) by Raoul Peck; Source – 1091 Pictures YTC

যে-তথ্যগুলো এখানে পাচ্ছি, তার জন্য কষ্ট করে সাড়ে চারশো পাতার ঢাউস বই অথবা আড়াই ঘণ্টার লেকচার শোনা সময়ের অপচয়। চ্যাটজিপিটি বা জেমিনিকে পুছতাছ করা যথেষ্ট হতে পারত। গড়গড় করে সব বলে দিতো তারা। কথাগুলো বলছি তার কারণ আছে। যে-ভদ্রলোকের ভিডিও শুনে তিনি পয়েন্টগুলা পেশ করেছেন, এখন হয় সেই ভদ্রলোকের কাণ্ডজ্ঞানের অভাব ছিল, নাহয় শ্রোতা নিজে মার্কসের একটি অক্ষর পড়েনি। না পড়ার সমস্যায় যাওয়ার আগে উনার বেসিক কয়েকটি ভুল নিয়ে কথা বলা যেতে পারে :

নয় নাম্বার পয়েন্টে উনি লিখেছেন, মার্কসকে অনেকে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ব্যাখ্যা করেন। অনেকের নাম মেনশন করা উচিত ছিল তার। বস্তুনির্ভর সমাজের চরিত্র ও বিকাশ-ইতিহাস বোঝা বা তাকে ব্যাখ্যার পেছনে কার্ল মার্কস জীবনের পুরোটা সময় খর্চা করেছেন। সমাজে ধর্মীয় ও নানাপ্রকার অতীন্দ্রিয় ভাববাদী চিন্তাধারার প্রভাবকে আমলে নিতে কুণ্ঠিত হননি। নিজস্ব ভাবনাছকে সেগুলো খণ্ডনও করেছেন তিনি। এসবের সঙ্গে তাঁর লেনদেন এর বেশি নয় বা ছিল না কখনো। জার্মান ভাববাদ বিষয়ে মার্কসের কিতাব বিষয়টি বোঝার জন্য যথেষ্ট। অন্যত্রও এসব নিয়ে কমবেশি প্রাসঙ্গিকতা বুঝে আলোচনা করেছেন মার্কস। কাজেই ভারতবর্ষের সন্ত সাধক কবীরের সঙ্গে মার্কসের তুলনা অপ্রাসঙ্গিক ও হাস্যকর।

এসব তুলনা মানুষকে বিভ্রান্ত করে। সন্ত কবীরের মহিমা যেমন তাতে খর্ব হয়, মার্কসকেও অনাবশ্যক অপমান করা হয়। ধর্ম হচ্ছে আফিম;—মার্কসের বিখ্যাত উক্তিকে আমরা যেভাবে প্রয়োগ ও ব্যাখ্যা করি, তার মতো এটিও ভুল বার্তা দিয়ে যায়। মানুষ কী বিশ্বাস করবেন অথবা করবেন না ইত্যদি মার্কসের কাছে গুরুতর ছিল না কখনো। তিনি চার্বাকচেলা ছিলেন না। আস্তিকতা ও নাস্তিকতার আলাপ, আমার যৎসামান্য মার্কসবীক্ষণে কখনো গুরুতর মনে হয়নি। বিশ্বাসের প্রয়োগ ও তার পরিণাম নিয়ে মার্কস আগ্রহী ছিলেন। সমাজ-বিকাশের ইতিহাসে চোখ রাখার সময় ধর্মীয় বিশ্বাস কীভাবে কাজ করে ইত্যাদি বুঝে নিতে চেয়েছিলেন এই তাত্ত্বিক। ধর্মীয় বাতাবরণ ও প্রাতিষ্ঠানিকতা যেখানে তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এগুলো যে আখেরে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সক্রিয় শোষণমূলক উপকরণের মতোই ক্ষতিকর তার আগাপাশতলা তিনি তদন্ত করেছেন বৈকি।

Christopher Hitchens on Karl Marx; Source – TheRationalIndian YTC

ধর্ম হচ্ছে আফিম;—কথাটি সেই সুবাদে এসেছিল। এর সঙ্গে বিশ্বাস, অবিশ্বাস, আস্তিকতা-নাস্তিকতা ইত্যাদির বিশেষ সম্পর্ক নেই। মার্কসবাদীরা পরে সেদিকে গেছেন বা তাদের গায়ে ট্যাগটি সেটে দিয়েছে বাদবাকিরা। বস্তুর বিকাশ-ইতিহাস ও আন্তঃসম্পর্ককে যেহেতু একজন মার্কসবাদী অন্তিম গণ্য করছেন, কাজেই তিনি অবিশ্বাসী ও নাস্তিক;—এই ধারণা সমাজে মান্যতা পেয়েছিল। মার্কস আদতে ওই দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মকে বোঝার দায় অনুভব করেননি। তিনি সামাজিক বিকাশ ও বিবর্তনের জায়গা থেকে এটি কীভাবে শোষণের হাতিয়ার হয় তার চমৎকার ব্যখ্যা হাজির করেছিলেন। মার্কসের এ-সংক্রান্ত মনোভাব বুঝতে জার্মান ভাববাদ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা অবশ্যপাঠ্য। হেগেলকে তিনি কোন জায়গা থেকে গ্রহণ করছেন এবং কোথায় গিয়ে খারিজ করছেন… এসব না বুঝে তাঁর ব্যাপারে আবালের মতো কথা বলা অনুচিত। এটি অশোভন ও দৃষ্টিকটু।

. . .

নাজিউর রহমান নাইম (স্বনির্মিত নাম অবশ্য সাইকি) ফেসবুক পেজে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন এভাবে—ফিলোসফিক্যাল কাউন্সেলর, দার্শনিক, কবি, লেখক, অনুবাদক, ক্রিটিকাল থিঙ্কার, এন্টিনাটালিস্ট, রহস্যবাদী। এছাড়াও তার নিজস্ব জীবনবৃত্তান্ত উনি তুলে ধরেছে। প্রফেশনাল কাউন্সিলর হিসেবে নাকি কাজ করেন তিনি। দর্শন মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি নিয়ে জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। একাধিক বই রচনা ও অনুবাদ করেছেন। এরকম বহুগুণে গুণান্বিত মানুষ যখন কথা বলে, তখন এককথায় তাকে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দেওয়া আমার মতো অতিশয় কম জানা মানুষের পক্ষে কঠিন। তিনি যে-আলোচনা করেছেন সেদিকে নজর দেওয়া যাক। নাইম সাহেব কার্ল মার্কসের আত্মজীবনীকে কেন্দ্র করে তৈরি সমালোচনামূলক ভিডিও দেখেছেন। সেই সুবাদে কিছু প্রশ্ন তার মনে এসেছে। পাঠকের কাছে ফেসবুক পোস্টে তার বিবরণ তুলে ধরেছেন ভদ্রলোক।

সারসংক্ষেপ করলে প্রশ্নগুলো এমন : মার্কসের মানি ম্যানেজমেন্ট স্কিল দুর্বল, এপিকিউরিয়ানদের মতো ছিল তাঁর জীবন, সবসময় দেনার ওপর থাকত ইত্যাদি। দুর্বল মানি ম্যানেজমেন্টের কারণে সে বুর্জোয়াদের বিরোধিতা করেছে, ওদিকে জীবনযাপন করেছে বুর্জোয়া পরিবেশে। ছোটবেলা থেকে অগোছালো জীবনে অভ্যস্ত।মদ, সিগারেট টানত, আর গোসল করত না। মার্কসের আর্থিক অবস্থা যদি খারাপ হয়ে থাকে, তাহলে এতোগুলো বাচ্চা নিলো কেন? তার ওপর অনেকে আধ্যাত্মিকতা আরোপ করে থাকেন অথচ বাস্তবে সে ছিল ভোগবাদী;—আধ্যাত্মিকতার লেশমাত্র তাঁর মধ্যে ছিল না… ইত্যাদি… ইত্যাদি। এখন এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর কি হয় আসলে? এভাবে বিচার করা কতটা যুক্তিসংগত?

The REAL ‘life’ of Karl Marx; Source – TIKhistory YTC

প্রথম কথা হলো কার্ল মার্কস হচ্ছেন সেই চিন্তক যাকে দিয়ে পৃথিবীকে অনায়াসে দুভাগে ভাগ করা যায়। এর একটি হলো মার্কস পূর্ব আর অন্যটি হচ্ছে মার্কস উত্তর পৃথিবী। মার্কসের পর পৃথিবীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে গেছে আমূল। কেউ স্বীকার করুক অথবা না করুক, অদূর ভবিষ্যতেও তাঁর চিন্তার প্রভাব টিকে থাকবে। এমন একজন মানুষ, তিনি মানি ম্যানেজমেন্টে দুর্বল ছিলেন, মদ-সিগারেট খেতেন ও বুর্জোয়া পরিবেশে পড়ে থাকতেন সর্বক্ষণ… ব্যক্তিগত এসব কর্মকাণ্ড দিয়ে তাঁর চিন্তাকে যাচাই করা প্রচণ্ড মূর্খতার পরিচয় বহন করে। সংবেদনশীলতায় ঘাটতি থাকলে কেবল এভাবে তাঁকে বিচার করা সম্ভব।

কার্ল মার্কস যখন একের-পর-এক জায়গা থেকে নির্বাসিত হচ্ছেন, তখন শেষ ভরসা বলতে ছিল ওই লন্ডন। জ্ঞানের নেশায় বুঁদ, বিশ্বকে বদলে দেওয়ার তাড়নায় যাঁর সময়জ্ঞান লুপ্ত বলা চলে। স্বাভাবিক জীবন তিনি যাপন করবেন, তাঁর কাছে সেটা আশা করা অন্যায়। প্রেমময়ী স্ত্রী আর বন্ধু ও সহযোদ্ধা এঙ্গেলস ছাড়া যুদ্ধটি মার্কস চালিয়ে যেতে পারতেন না। তাঁর ওপর আধ্যাত্মিকতার যে-আরোপন সেটা স্বয়ং মার্কস স্বীকার করবেন না। এটা লেখকের উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনার ফসল। ভুলভাবে পাঠ করেছেন নাইম, আর সেটা প্রকাশ করে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় রেখেছেন। মার্কস এভাবে বিচার্য হতে পারেন না।

. . .

Who Was Karl Marx? And Why Is Everyone Still Talking About Him?; Source – CrashCourse YTC

কারো ব্যক্তিজীবন তার চিন্তার প্যারামিটার নয়

কার্ল মার্কসের বুর্জোয়া পরিসরে বিচরণ ও দায়িত্বজ্ঞানহীন খরুচে জীবন আর তাঁর প্রস্তাবিত শোষণমুক্ত সাম্যবাদ বা প্রলেতারিয়েতের সচেতন রাজনৈতিক উত্থান এক বিষয় নয়। মার্কস এমন এক সমাজে বসে প্রস্তাবনাটি পেশ করছেন, যেখানে তিনি স্বয়ং এর শিকার। এমন এক সামাজিক পরিসরে তাঁকে বিচরণ করতে হচ্ছে যার সঙ্গে তাঁর তাত্ত্বিক প্রস্তাবনা ছিল সাংঘর্ষিক। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বা ডায়ালেকটিক্যাল হেজিমনি কীভাবে সমাজে তৈরি হয় সেটি এখানে মার্কস নিজের জীবনে প্রতিপদে টের পাচ্ছিলেন। এদিকটা বুঝতে হলে নায়িম সায়েবকে আরো ভিতরে ঢুকতে হবে। ফেসবুকে এসে লোকজন ইউটিউব ছাড়া কিছু দেখে না বলে নিজে ইউটিউব লেকচার শুনে ফট করে বাণী ঝাড়লে হবে না। কিতাবের অহংকার মন থেকে আগে দূর করা প্রয়োজন।

বুর্জোয়া পরিধির মধ্যে বসবাস কোনো অপরাধ হতে পারে না। বুর্জোয়া সমাজকে বুঝতে হলে তার ভিতরে আপনার গমন করা উচিত। এঙ্গেলসের সুবাদে মার্কসের সেই সুযোগ জুটেছিল। এঙ্গেলস পরিণত বুর্জোয়া সমাজের শীর্ষে ছিলেন বলে সমাজতন্ত্রের চিন্তায় যেতে পেরেছেন। এই বুর্জোয়ার সঙ্গে এস আলম টাইপের বুর্জোয়ার আকাশ-পাতাল ফারাক রয়েছে। এসব আমলে না নিয়ে রায় দেওয়ার মানে হচ্ছে আপনি এখনো মার্কসের অ আ ক খ বোঝেননি। দেবীপ্রসাদ পাঠ করেন গিয়ে, তারপর বিস্তারে গেলে বুঝবেন মার্কস ও এঙ্গেলস কোন কাণ্ডটা করে গেছে সেইসময়।

বুর্জোয়া সমাজের উচ্চকোটিতে বিচরণ বরং মার্কসের চিন্তার বনেদকে সুগঠিত হতে সাহায্য করেছে। মার্কস নিজে কবিতা লিখলেও সাহিত্যকে সচরারচর রেফারেন্স হিসেবে কম টেনেছেন। এঙ্গেলস ও পরে লেনিনকে আমরা সাহিত্যের নানা রেফারেন্স টানতে দেখি। যেমন, এঙ্গেলস বালজাকের লেখাপত্রকে প্রচণ্ড মূল্যবান বলে মত দিয়েছেন। বালজাক ফরাসি অভিজাত সমাজ নিয়ে সবিস্তারে লিখে গেছেন। এখন তাঁর বয়ান, এঙ্গলসের মতে বুর্জোয়া ও অভিজাত সমাজের চরিত্র বুঝতে দারুণ সাহায্য করে। লেনিন একইভাবে তলস্তয় বা দস্তয়েভস্কি ও চেখভকে হীরা গণ্য করতেন। তাঁদের লেখাপত্র সমাজের মানসগঠন বোঝায় সহায়ক। বড়ো কথা, মার্কস যখন নিজের প্রস্তাবনার মুসাবিদা করছেন, তখন তার আশপাশে কোথাও এমন কোনো সমাজ ছিল না যেটি তাঁর চিন্তা-অনুকূল। তিনি একটি বিকাশমান বুর্জোয়া সমাজে বিচরণ করতে কাজেই বাধ্য ছিলেন। ইংল্যান্ডে গমন না করলে আমরা মার্কসকে পেতাম কিনা সন্দেহ।

Karl Marx Poem – Recited by Abdullah Al Hadi; Source – Abdullah Al Hadi YTC

পুঁজিবাদের পরিণত বিকাশ প্রক্রিয়া তখন সেখানে ক্রমশ ঘটছিল। যে-কারণে ভারতবর্ষে ইংরেজদের গমন ও সিপাহী বিদ্রোহ ইত্যাদি নিয়ে মার্কস এতটা উচ্ছসিত ছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, ভারতবর্ষের উদ্ভিদসুলভ স্থবির জীবনে ইংরেজদের আগমন পুঁজির বিকাশ ঘটাবে, এবং এর অবধারিত প্রতিক্রিয়ায় যে-বুর্জোয়া সমাজ সেখানে দেখা দেবেন, তার পাল্টা অভিঘাতে শ্রেণিসচেতনার ক্রমবিকাশ ও একসময় বিপ্লবী রাজনীতির বিকাশ ঘটতে বাধ্য। তাঁর অনুমান ভুল ছিল, কারণ ভারতবর্ষের ব্যাপারে মার্কসের জানাশোনার পুরোটাই ছিল পুঁথিগত।

মার্কস চিন্তার ইতিহাসে কোনো দার্শনিক নন, হতেও চাননি কখনো। তিনি আপাদমস্তক একজন অর্থশাস্ত্রবিদ। তাঁর মেধা ও চিন্তার পুরোটা তিনি পুঁজি ও শ্রমের আন্তঃসম্পর্ক অবধানে ব্যয় করেছেন। অনেকে তাঁকে দার্শনিক বলেন বটে, কিন্তু মার্কসের ভাবনা-পদ্ধতি দার্শনিকতার কোটায় পড়বে না। তিনি প্রশ্ন ও ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট থাকতে ইচ্ছুক ছিলেন না কখনো। এবং সেটি বোঝার জন্য মার্কসের বিখ্যাত উক্তিই যথেষ্ট : দার্শনিকরা অনেকভাবে পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু তাকে পাল্টানো হচ্ছে আসল কথা।

গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো যুগপ্লাবি চিন্তার বনেদ যিনি তৈরি করছেন, যার ওপর দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা জন্ম নেবে, পুঁজিবাদী বলয়ের বাইরে প্রবল শক্তিশালী এক তরঙ্গের উত্থান ঘটবে, এর সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে আমরা তর্ক করতেই থাকব… এরকম প্রস্তাবনা যে-ব্যক্তির মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে আসছে, তার পক্ষে মি. নাজিউর রহমান নাইমের মতো জীবন যাপন তো সম্ভব নয়। মার্কস ইকোনমি ম্যানেজমেন্টের যে-প্রস্তাবনা রেখেছেন, সেটির ওপর ভর দিয়ে লেনিন রুশ দেশে বিপ্লবের জন্ম দিলেন। আরো কত দেশে এসব নিয়ে অন্তহীন পার্টিলাইনে তর্ক চলেছে। কারণ, তাঁর এই প্রস্তাবনা ছিল সমাজকে লক্ষ্য করে, ব্যক্তিকে নয়।

তিনি বিয়েশাদি না করলে হয়তো ভালো করতেন, কিন্তু তাতে করে এর যন্ত্রণা ও মাধুর্যের কোনোটাই আসলে বুঝতে পারতেন না। বঞ্চিত থাকতে হতো। কোনো মানুষ তার সময় ও দেশকালের ঊর্ধ্বে নয়। মার্কস যে-সময়ের মানুষ তখন গণ্ডায়-গণ্ডায় বাচ্চা পয়দা গুরুতর কোনো বিষয় ছিল না। এজন্য তাঁকে অবিবেচক বলা যেতে পারে, কিন্তু তাতে তাঁর চিন্তার মূল্য কমে না। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, পৃথিবীর ইতিহাসে বিরাট পরিবর্তন যারা সাধন করেছেন, তাদের কারোই ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে চিন্তা ও কাজের ভারসাম্য বজায় থাকেনি। সম্ভবও নয়। মার্কস একজন মানুষ ছিলেন, কোনো নবি বা ফেরেশতা না। তাঁর চিন্তনপদ্ধতি হচ্ছে সভ্যতার কাছে মার্কসের বিরাট নিবেদন। এর জন্য স্ত্রী-সন্তানকে সাফার করতে হয়েছে বিস্তর। এটি মার্কসের সীমাবদ্ধতা;—শূলে চড়ানোর মতো কোনো অপরাধ নয়।

Why Intelligent People Don’t Worry About Social Life – Schopenhauer; Source – Spiritual Spark YTC

মার্কসের জীবদ্দশায় কোনো দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাধিত হয়নি। যদি হতো, এবং তিনি সেটি দেখে যেতে পারতেন, নিজের চিন্তায় হয়তো নতুন সংশোধন নিয়ে আসতেন। সেই প্রাখর্য তাঁর মধ্যে ছিল। ব্যক্তজীবনে মার্কস কতটা কী পরিমাণে ব্যর্থ বা স্ববিরোধী ছিলেন, সেটি দিয়ে যদি কেউ সিদ্ধান্ত নেয় যে, মার্কসের দাজ ক্যাপিটাল পড়বে না, এরচেয়ে হাস্যকর কিছু হতে পারে কি? ফ্রয়েডকে পড়া তাহলে সবার আগে বাদ দিতে হবে। কারণ ফ্রয়েডের কারণে বহু রোগীর জীবনসংশয় ঘটেছিল।

শোপেনহাওয়ারকে তো পড়াই যাবে না। মেয়েলোকদের উনি দুই চোখে দেখতে পারত না। এর পেছনে মায়ের সঙ্গে পুতের দ্বন্দ্ব বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। শোপেনহাওয়ারের মা নভেল-টভেল লিখতেন। গ্যোটের বান্ধবী ছিলেন তিনি। শোপেনহাওয়ার তখন মাত্র কৈশোর পার করছেন। এক অপরাহ্নে মায়ের সঙ্গে আলাপরত গ্যোটের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। গ্যোটে ছেলেটির ধীশক্তি দেখে মুগ্ধ হয়ে মন্তব্য করলেন,- এই ছেলে তো বিরাট প্রতিভা রাখে! মায়ের সেটি সহ্য হয়নি। ছেলে ও মায়ের মানসিক বিরোধ লেগে থাকত। শোপেনহাওয়ার একদিন মাকে বলে বসেন,—পৃথিবী একদিন আমার কারণে তোমার নাম মনে রাখবে, এছাড়া তোমার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না কোথাও। তো এই ঘটনা শোপেনহাওয়ারের নারীকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে গুরুতর প্রভাব ফেলেছিল। প্রতিভা বিষয়ে তাঁর যেসব ভাবনাকে আমরা এখন ভীষণ গুরুত্ব দিয়ে থাকি, সেখানে নারীর কোনো জায়গা নেই। বাড়িওয়ালীকে রাগের মাথায় দোতলা থেকে ছুড়ে ফেলার কাণ্ডও ঘটিয়েছেনশোপেনহাওয়ার।

এখন এর জন্য কি লোকে শোপেনহাওয়ার পড়া ছেড়ে দেবে? তিনি ওরকম করেছেন বিধায় তার চিন্তাকে বাতিল করতে হবে? এগুলো শিশুসুলভ ধারণা। পিকাসোর কোনো ছবি তাহলে দেখা উচিত নয়। বান্ধবীকে সিগ্রেট দিয়ে মাঝেমধ্যে ছেকা দিতেন এই শিল্পী। ভয়াবহ নয় কি? রণজিৎ দাশ পিকাসোর এই খাসলতকে উপজীব্য করে ভালো কবিতা লিখেছিলেন। যাইহোক, মার্কস আজোবধি প্রাসঙ্গিক এবং আগামীতেও তাই থাকবেন। অনন্য সব স্ববিরোধিতা নিয়ে এক উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক তিনি। সভ্যতার সৌভাগ্য যে তিনি দেখা দিয়েছিলেন। তাঁকে না পড়া বা তাঁর ব্যাপারে বালখিল্য ধারণা পোষণ কেবল নির্বোধের পক্ষে সম্ভব।

. . .

উনি বহুগুণে গুণান্বিত হইতে পারেন, কিন্তু কথাবার্তা ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চার মতো লাগতেছে এখানে। আপনার দেওয়া তথ্য পাঠ করে সেরকম ভাবতে বাধ্য হইতেছি জাভেদ। এপিকিউরিয়ান বইলা মার্কসকে উপহাস করতেছে উনি! এপিকিউরাসের কিছু বোঝে বইলা তো মনে হইল না। গ্রিসে দাসের জীবন ছিল ভদ্রলোকের। ভারতবর্ষে বর্ণপ্রথার পীড়ন সম্পর্কে আমরা অল্পবিস্তর জানি। গ্রিস বা মিশরে দাসপ্রথা যে-পরিমাণে নির্মম ছিল তার কাছে বর্ণপ্রথা কিছুই না। এপিকিউরাস যে-মালিকের অধীনে কাজ করতেন সে তারে খুব খাটাইত। তার মধ্যে আবার সর্বংসহা লোক ছিল। জীবনে সাফারিংকে সহ্য করতে পারাটা এপিকিউরানদের বিশিষ্ট করে তুলছিল। আমাদের কাছে আজব, তাদের কাছে এটা ছিল মোক্ষ।

গৌতম বুদ্ধ যে-কারণে ঘর ছাড়লেন, এবং সর্বংসহা হওয়ার দীক্ষা নিলেন প্রকৃতির নিকট থেকে, এপিকিউরানরা এককাঠি সরেস ছিল। সাত চড়েও রা না করাটা ছিল তাদের কাছে প্রতিরোধের হাতিয়ার। আবার মন যাতে সুখ বা তৃপ্ত বোধ করবে সেটা করতে শরম-ভরমের তোয়াক্কা করত না তারা। এপিকিউরাস যেমন মন চাইলে যখন-তখন মাস্টারবেট করতেন। যুক্তি,—মনকে নিবৃত্ত রাখার অর্থ হইতেছে দুঃখ পয়দা করা। অন্যের অনিষ্ট না করে যথাসম্ভব সকল উপায়ে নিজেকে সুখী রাখাটাই কাম্য। টাকার জন্য পাগল হওয়ার দরকার নাই, আবার যেটুক না হলে দেহের খিদে মিটবে না সেটুকুর জন্য কামলা খাটো।

মারাত্মক মাইন্ডগেমটা এপিকিউরানদের আজব প্রাণীতে পরিণত করছিল। শান্তভাবে তারা সমাজকে এভাবে প্রত্যাখ্যান করত। সমাজে যারা অত্যাচারী, তাদেরকে এটা আদতে বিব্রত ও বিপন্ন করে দিত। তো সেই এপিকিউরাস ভাবের খেয়ালে ডুবে থেকে কাজে গলতি করলেন। মালিক তারে বেদম পিটান দিলো। রাগ মাথায় চড়লে যা হয়, এপিকিউরাসের হাঁটু লক্ষ্য করে সে ডাণ্ডা দিতেছিল। পেইনটা একবার চিন্তা করেন! এপিকিউরাস তথাপি শান্তমনে মালিককে বলতেছে,—মারেন, অসুবিধা নাই, কিন্তু আপনাকে সাবধান করা প্রয়োজন মনে করতেছি,—আমার পাখানা কিন্তু ভেঙে যেতে পারে। মালিকের ওসব শোনার টাইম নাই তখন। মট করে পাটা ভাঙছিল এপিকিউরাসের। অকথ্য যন্ত্রণা সহ্য করে আদমি তখন তার মালিককে বলতেছে,—আপনাকে আগেই সাবধান করছিলাম, দিলেন তো পাখানা ভেঙে।

Philosophy Epicurus; Source – The School of Life YTC

এখন এই আজব সাফারিং সহ্য করাটা আমাদের কাছে ছাগলামি মনে হইতে পারে, কিন্তু বিশদে ভাবলে বোঝা যায়,—মানুষকে কেন নির্যাতন সইতে হবে। শান্তচিত্তে সব হজম করে জীবনের দিকে ফিরতে কী-কারণে বাধ্য সে! আপাতভাবে এটা পরাজয়, আখেরে এর মধ্যে সংগোপন থাকতেছে মানবচরিত্রকে বোঝার নানান রসদ। শোপেনহাওয়ার যেমন এই জায়গা থেকে সাফারিং কেন অনিবার্য ও ইচ্ছাশক্তির জোরে কীভাবে তারে জয় করা যায় সেই ভাবনায় গমন করছিলেন। যেখানে বুদ্ধ ও এপিকিউরানদের অবদান ছিল বৈকি।

মার্কস এপিকিউরাসের দর্শন মোটেও ধারণ করতেন না। শোপেনহাওয়ার প্রণীত জিনিয়াসের সংজ্ঞায় পড়তেছেন তিনি। নিজের ভাবনায় যে-পরিমাণ মানসিক খাটনি তাঁকে দিতে হইছিল তখন, তাঁর পক্ষে পারিবারিক জীবনে ব্যালেন্স বজায় রাখা সহজ ছিল না। এই ভদ্রলোক সার্ত্রে এবং মার্কসের তফাত বোঝে না। সার্ত্রে প্রভাবশালী চিন্তক। মেধাবী ও বিচক্ষণ। সিজোফ্রেনিক ছিলেন অনেকটা, যে-কারণে বেভোয়ার তাঁকে পাহারায় রাখতেন।

জিনিয়াসদের ব্রেনসেল জাগতিকতার সঙ্গে সবসময় ভালো কন্ট্যান্টে নাও যাইতে পারে। সার্ত্রে, কামু, কাফকা… তাঁরা কেউ শতভাগ স্বাভাবিক মানুষ না। সুবিধা এই ছিল যে, ছিটলামি সত্ত্বেও মোটের ওপর চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স করে চলার পরিবেশ ততদিনে ইউরোপে তৈরি হইছিল। আমাদের এখানে হলে বিনয় মজুমদারের মতো শেকল দিয়া বেঁধে রাখা লাগত। সমাজবিকাশের কোন পর্যায়ে আপনি আছেন, তার সঙ্গে ছিটলাদের কীভাবে টলারেট করা হইতেছে ইত্যাদি জড়িত।

প্রতিভা ভীষণ সুগঠিত হইতে পারে, যেমন ধরেন রবি ঠাকুর। আবার অসংগঠিত হইতে পারে, যেমন নজরুল। এখন দুজনের কেউ আদতে সামাজিক প্রাণী ছিলেন না। ঠাকুর ও নজরুলকে যতই আমরা সমাজের মধ্যে দারুণভাবে সক্রিয় দেখি না কেন, বিস্তর সাফারিং তাঁরা সহ্য করছেন জীবনভোর। লেখায় সেটা মোক্ষণ করছেন দুজন। দুর্ভোগ সইতে পারার ক্ষমতা মানুষকে বিরাট ভাবনার দিকে অনেকসময় নিয়া যায়। মানি বা না মানি এটা চিরসত্য। 
. . .

What Marks actually said about – Javed Husen; Source – SUST Literature Society YTC

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 6

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *