প্রাককথন

পৃথক কণ্ঠস্বরের দুজন কবিকে একসুতোয় গেঁথে সাহিত্যবাসর-এ প্রকাশের এটি প্রথম ঘটনা। এমন নয়, এখন থেকে নিয়মিত এরকম ঘটবে, তবে মাঝেমধ্যে ঘটানো যেতেই পারে, যদি মনে হয় স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেও দুই অথবা একাধিক কবি পরস্পরকে আভাসিত করছেন। ফজলুররহমান বাবুল-এর পাতাবাহার ও জওয়াহের হোসেনের একগুচ্ছ কবিতাকে একত্রে প্রকাশের মূল কারণ সেখানে নিহিত।
জওয়াহের হোসেনের অনতিদীর্ঘ কবিতারা তাঁর এতদিনকার রচনারীতির সঙ্গে অভিন্ন। অন্তত আমরা যারা কবির এ- পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতাবই নগরমুসাফির ও মোনাজাত এবং একাকী, শব্দ নৈঃশব্দ্য, আর ছোটকাগজে বেশ নিয়মিত লিখতে-থাকা কবিতার খবর রাখি, তারা কিন্তু জানি,—কবিকণ্ঠ হিসেবে জওয়াহের হোসেন নিভৃতচারী। যেসব কবিতা পাঠ করলে মনে হবে,—কবির কোনো তাড়া নেই; বরং আছে অবসর, যেটি পেলে নমিতস্বরে নিজসঙ্গে আলাপে মগ্ন থাকা যায়। মগ্ন হওয়ার ছলে আবার অন্যকে লক্ষ করে কলমে কার্তুজও মজুদ করা যায় খানিক।
জওয়াহের হোসেনের কবিতা-যাপন সূচনাকাল থেকে এই অভ্যাসের বশীভূত। অনুভূতির তীব্রতা সেখানে ধ্রুপদি কোনো রাগের শুরুয়াত হয়ে কবিতাভাষায় আলাপ করে। প্রলম্বিত লয়তানে কবি অতঃপর বিস্তারে যাবেন মনে হলেও মজাটা এখানে যে,—আলাপকে প্রলম্বিত করার আভাস রেখে জওয়াহের তাঁর কবিতায় যতি টানেন। সোজা কথায়,—অনুভূতি-শরীরে লগ্ন থাকতে ভালোবাসেন এই কবিবর; যেখানে বিস্তারে গমন তাঁকে দিয়ে যেন কিছুতেই হওয়ার নয়।
কবীর সুমনের গানের কলি ধার করে বলা যেতে পারে,—ছোট দুঃখ ছোট সুখকে ঘিরে তাঁর কবিতাভাষা ব্যক্তিকবির অনুভূতি প্রকাশক সড়কটি খোঁজে। কবিতা রচনার পদ্ধতি অথবা রহস্য বলতে কবি এখানে মিতব্যয়ী। ভান নেই;—আন্তরস্বভাব থেকে উঠে আসা ছোট-ছোট উদ্ধৃতিখণ্ডে জওয়াহের হোসেনের কবিতারা সম্পূর্ণতা পেতে আকুলান। বাড়তি পরিসর জুড়বে এই ভয়ে উদাহরণ টানা থেকে আপাতত বিরত থাকা সমীচীন মনে করছি। সাহিত্যবাসর-এ মুদ্রিত গোটা পাঁচখান কবিতা থেকে পাঠকরা আশা করি আমরা যা বলছি এখানে,—তার সারকথা বুঝতে পারবেন।
জওয়াহের হোসেন নিজালাপি। তাঁর কবিতাকে যে-কারণে নিজসঙ্গে কথোপকথন বললে কি কবির প্রতি অবিচার হবে? প্রশ্নের উত্তর পাঠভেদে ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। আমরা কেবল আমাদের পাঠ-অভিমত বলছি মাত্র। সময়-সমাজ আর বিচিত্র রূং-রূপ-রস মিলে তৈরি মধুবিষের ভাণ্ডারে নিতনব রূপান্তরিত সংসার মহারণ্য কি তা-বলে মিসিং তাঁর কবিতায়? বিনয়ের সঙ্গে বলি, ঘটনা সেরকম নয় একটুও। জগতের কোনো কবি আজোবধি এই মধুবিষের প্রকোপ থেকে মুক্ত নয়; আগামীতেও মুক্ত থাকবে না; তবে প্রকাশরীতির কারণে কেউ সেখানে উচ্চকিত, আর অনেকে জওয়াহের হোসেনের মতো প্রচ্ছন্ন।

প্রচ্ছন্নতার কারণে নগরমুসাফির এই কবির কবিতাভাষায় মুদ্রিত লয়তানের সবটাই মৃদুভাষী। বাস্তবের মানুষটি বেশ শক্তপোক্ত সুঠামদেহী হলে কী হবে, কবিতাভাষায় তিনি মৃদু; প্রায়শ বিষাদঘন; এবং সময়-সময় তাঁর উচ্চারণকে মনে হবে মর্বিড;—কবি যেখানে আচমকা তাঁর ব্যক্তিসত্তার সারকথা উগড়ে দিচ্ছেন বলে পাঠকের মনে হবে :
ঘোর অব্যক্ত মর্ম ধূসরতায় আমার বিলাপ
নরম স্মৃতি উর্বরতা-জড়িত আরো শূন্যতা
আরো দূর অস্ত চাঁদের মতো এক অন্ধকার
মেপে যাচ্ছে জীবনের—দৈর্ঘ্য প্রস্থ মোহময়
[ব্রতচারী : নগরমুসাফির ও মোনাজাত]
উদ্ধৃত মৃদুভাষে কবির নিজস্ব দশকসীমায় গুরুত্বপূর্ণ হতে থাকা কোনো-কোনো কবির নেপথ্যছায়া প্রলম্বিত থাকতে পারে, তবে উচ্চারণভঙ্গি আন্তর-মৌলিক হওয়ার কারণে নগরমুসাফিরের আজোবধি বিবর্তিত কবিসত্তাকে এটি দখলে রেখেছে। জওয়াহের হোসেন সংগতকারণে তাই প্রেমের আলাপে মৃদু। যৌনতার আভাস জাগানিয়া উচ্চারণে মৃদু। জৈববাসনার টানাপোড়েনে মৃদু। একান্ত চাওয়া ও একান্ত না-পাওয়ার হাহাকার জানিয়ে দিতে সদা ওই মৃদুলয়ে মৃদঙ্গ বাজান। প্রেমানুভূতির শিকার হতে দেখি তাঁকে, যদিও সেখানে প্রেমের রং জাপানি রীতিতে আঁকা হালকা ধূসর চালচিত্রের আভাস জাগিয়ে ইতি টানে ত্বরিত।
এই অঙ্কনরীতি কবি জওয়াহের হোসেন তাঁর তিন দশকি কাব্যযাত্রায় ধরে রেখেছেন। যেসব কবিতাপাঠক তাঁর প্রকাশিত কবিতাবইয়ের খবর রেখেছেন, যারা চেখে দেখেছেন বই দুখানি,—তাদের ক্ষেত্রে বাড়তি কথা যোগ না করলেও চলবে মনে করি। আগেই বলেছি, কবির দুটি বই বেরিয়েছে সাকুল্যে। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থে মুদ্রিত ব্যঞ্জনা নিয়ে পৃথক পরিসরে আলাপ হয়তো আমরা করব একদিন। আপাতত এটুকু বলা কাফি,—প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মৌলসুরের সঙ্গে সাহিত্যবাসর-এ বেছে নেওয়া নাতিদীর্ঘ কবিতারা নয় ভিন্ন।
কবিজীবনের তিন দশকি যাত্রায় জওয়াহের হোসেন একটি অনুভূতিতে প্রগাঢ়, আর সেটি হলো,—চারপাশের অস্থির বেগের মধ্যে নির্লিপ্ত নয়ন ফেলে ধীরতার বয়ান তিনি কলমে ধরছেন। আয়নায় তাকানোর ছলে সময়মুদ্রায় নিজের মনমুদ্রাকে আভাসিত করাতেই তাঁর যত স্বস্তি। আপাত সর্বশেষ কবিতাবইয়ে তাই হয়তো লিখেছেন কবি :
তোমার স্মৃতিকে ফের করেছি সাধন—অমৃত তৃষ্ণায়
সে সত্য এসে আমারে ভাসালো দূরে—ঘোর মাতালের মতো চিরযায়ী
আমি ওই আয়ুষ্কালে আজ রক্তাক্ত, পরাজিত মৌন
আর ওরা দ্বিধায় জড়ানো ভিন্ন-ভিন্ন তাড়নায়
অথচ আমি শুয়ে-শুয়ে দেখি নিদ্রার ভিতরে গুপ্ত গোরস্তান
চারদিকে অবশিষ্ট পোড়া-হাড় আর উষ্ণ
অতল মেঘ নির্জন মিশে আছে বিরহ-বিষাদ এই কলিকালে কেউ-না-কেউ আধাশোয়া বরফের ভিতর
বিস্তৃত কেটে-কেটে কমাতে চেয়েছিলাম আয়ু—কালো-কালো হয়ে ওঠে মাটি—
আমি তখনও চোখ বন্ধ করে
দেখি দ্বৈততায় পৃথিবীর বয়স সত্যিই কমে যাচ্ছে।
[কাব্যাশ্রয়ী ও নিশাচারগণ : একাকী, শব্দ নৈঃশব্দ্য]

প্রতিতুলনা অনাবশ্যক, তথাপি মাঝেমধ্যে তার দরকার হয় বটে। ফজলুররহমান বাবুল এদিক থেকে জওয়াহের হোসেনের সঙ্গে ঐক্য রাখেন। বাবুলের কবিতা অতখানি মৃদুলয়ে বহে না, অতখানি নির্লিপ্ত বিষাদ ও নৈরাশ্যে নয় তারা দগ্ধ, উচ্চারণ ও সময়-অনুভবে বিশ্বনাথ টু সিলেটে সবিরাম যাতায়াতে অভ্যস্ত কবিবর বেশ উচ্চকিত;— স্পষ্টভাষী ও ইতিবাচক ঢের। তা-সত্ত্বেও অন্তর্লীনতায় তিনিও নিজমধ্যে নিমগ্ন সাগ্নিক।
দুজনের মধ্যে আরো নিবিড় সব মিল বোধহয় আমরা একবার নিরিখ করলেও পারি। সিলেট অঞ্চল জুড়ে ছড়ানো নিসর্গে তাঁরা সাবালক হয়েছেন। কবিতালেখার বয়স বিচারে একে অন্যের মিতে। সাকুল্যে তিন দশক ধরে লিখছেন পাশাপাশি। রচনারীতি ভিন্ন হলেও পাঁচালি সেখানে অনেকসময় মনে হবে অভিন্ন। পরিচিতজনরা সাক্ষী দুজনের গাঢ় বন্ধুতার;—যেখানে সখ্য ও মাঝেমধ্যে খুনসুটিভরা বিবাদ উপভোগ্য বেশ!
ফজলুররহমান বাবুলে সক্রিয় সহজাত আবেগপ্রবণ হৃদয়। তাঁর কবিতায় যেটি দিব্যি মানায়। জওয়াহের হোসেন আবেগলগ্ন, তবে প্রকাশে শামুকস্বভাবী। কবিতায় এর প্রতিফলন নেই,—এমন যাবে না বলা। ব্যক্তিত্বে পৃথক, তবু তাঁরা অভিন্ন সুহৃদ। বাবুল নিরন্তর সক্রিয় কবিতায়। ছোটকাগজ সম্পাদনা ছাড়াও শত কাজে তাঁকে জড়িত দেখে অভ্যস্ত পরিচিতজন। বিশ্বনাথ টু সিলেটে চলে নিত্য যাতায়াত। জওয়াহের হোসেন কবিতালেখার বাইরে নিপাট পেশাদার। সিলেট যাপনের পালা চুকিয়ে পাড়ি দিয়েছেন সাত সমুদ্র তেরো নদীর দেশ। লন্ডনি হয়েছেন বলে কি দুজনের মধ্যে ঘটেছে বিচ্ছেদ? ঘটনা নয় সেরকম। কবিতায় আর ব্যক্তিত্ব যাপনে দুজনের বন্ধুতা এখনো অটুট। ফজলুররহমান বাবুলের পাতাবাহার আর জওয়াহের হোসেনের এখানে মুদ্রিত কবিতাগুচ্ছে পাঠক তার রেশ খানিক হলেও পাবেন আশা করি।
. . .

পাতাবাহার-এর টানা গদ্যে লিখিত বিবরণকে মনোলোগ ভাবা যেতেও পারে;—যেখানে কবি ফজলুররহমান বাবুলের কবিস্বর ভালোই প্রতিধ্বনিত। পাতাবাহারের জীবনচক্র এঁকেছেন কবি। উদ্ভিদকুলে বিশিষ্ট ও নান্দনিক প্রজাতির জীবনজার্নি ও বিবিধ সক্রিয়তার বিবরণ দিয়েছেন অকৃপণ হস্তে। পাশাপাশি এঁকেছেন তার স্বাভাবিক পরিণতি, আর মমিকৃত পরিণাম। ফাঁকতালে আভাসিত পাতাবাহারের কত-না ছলে জখম হওয়ার ঘটনা ও তার জের ধরে ভিতরে জমতে থাকা সংক্ষোভ ও প্রতিবাদ।
সংগতকারণে ভাবাটা অসংযত নয়,—কবি এখানে স্বয়ং সেই পাতাবাহার। এই পাতাবাহার একখানা নৈসর্গিক ঘটনা, যদিও তার জীবনচক্র আর নয় নৈসর্গিক। নিয়তি ফেরে মমিকৃত হওয়া থেকে প্লাস্টিকে বানানো উদ্ভিদ রূপে জীবনমঞ্চে অভিনীত হচ্ছে বেচারি! কবির ভাষানির্মাণে যে-আবেগ এখানে সঞ্চারিত, সেটি সংগতকারণে বিষাদ ও দ্রোহে দ্রবীভূত। স্পষ্টভাষী এই কবি তাঁর অনেকানেক রচনার মতো এখানেও উচ্চকিত সবাক। কবিঅন্তরে জমাট সংক্ষোভ তাঁকে এভাবে সবসময় সময়লিপ্ত রাখে।
কোন সময়? আমরা বলতে পারি, বলা বোধহয় যায় এখন,—পাতাবাহার রচনার নেপথ্যে সক্রিয় সময় আমরা যাপন করছি অদ্য। একপাল হায়েনা মিলে চেটেপুটে খাচ্ছে দেশ ও মানচিত্র। পাতাবাহার সুতরাং প্রাকৃতিক জীবনচক্রে জন্ম নেওয়া উদ্ভিদ থেকে আরম্ভ করে কবি ও স্বদেশে রূপান্তরিত হয়েছে। আবছা হ্যালুসিনেশন বা স্বপ্নবিভ্রম কি আছে টানা গদ্যতালে লিখিত এ-বয়ানের ভিতর? হয়তো আছে। জওয়াহের হোসেনের নাতিদীর্ঘ কবিতাগুচ্ছে যেমন হ্যালুসিনেশন গোপন নেই মনে হচ্ছে।
চ্যাটজিপিটিকে দুই কবির রচনা দাখিল করে জিজ্ঞাসিলাম, বলো দেখি ওহে যান্ত্রিকমন,—কী-কারণে দাখিলকৃত রচনাযুগলকে অভিন্ন প্রতিধ্বনি ভাবা সম্ভব? প্রতি-উত্তরে জিপিটি জানালেন তিনটি কারণ :
প্রথম কারণ, দুই কবির রচনায় ভাষার গঠনসৌকর্য প্রতীকায়িত। বাবুলের পাতাবাহার-এ প্রতীকায়ন স্পষ্ট। জওয়াহের হোসেনে তা জলরংয়ে আঁকা ছবির সদৃশ;—অস্পষ্ট, কিন্তু গভীর।
দ্বিতীয় কারণ, মনোবেদনার রাজনীতি দুজনের রচনায় প্রতিফলিত। পাতাবাহার কেবল প্রেমের নয়, নিঃশব্দ প্রতিবাদের প্রতীক; যেমন, ২১৫০-র গণকবরে দাঁড়িয়ে থাকা পাতাবাহার। জওয়াহের হোসেনের লাঞ্ছনা, কলঙ্ক, জলনিবাস এই সমস্ত কবিতায় দেহ ও জল একত্রে গলেমিশে আত্মবীক্ষণ, ব্যর্থ প্রেমের বিষাদ, আর আত্মসংঘর্ষের মনোদৈহিক টানাপোড়নকে বেশ খোলাসা করে যায়।
তৃতীয় কারণ, উভয়ের রচনায় অতৃপ্তি যেন-বা ক্রমাগত মগ্নতার উৎস হয়ে ওঠে। দুজনকে যুগলবন্দি ভাবার বড়ো বিন্দুটি এখানে সক্রিয়।
জিপিটির পাঠরীতি যান্ত্রিক অ্যালগরিদমে চললেও, মানতে হবে, যন্ত্র যেটি এখানে ধরছেন, আমরা মানবকল সেরকম টের পাই পাতাবাহারের প্যারালাল জওয়াহের হোসেনের কবিতাগুচ্ছ পাঠ করতে বসে। বিস্তারিত আলোচনায় আর না যাই। এটুকু শুধু বলার, দুই অমায়িক কবি লেখো আয়ুর বশীভূত হয়ে লিখছেন হয়ে গেল তিন দশক। আয়ুর শেষ বিন্দু নিংড়ে দুজনে যেন লিখতে থাকেন অবিরাম। যুগলমুদ্রায় বন্দি দুই কবির পাঠ- উদযাপনে পাঠককে জানাই সাদর নিমন্ত্রণ।
. . .

জওয়াহের হোসেনের কবিতা
অতৃপ্ত
বস্তিসন্ধ্যাকালে সর্বস্ব দেখে দেখে এই বিভ্রমে আমি খুব প্যারালাইজড!
অতৃপ্তবিবর ছুঁতে আজ চণ্ডীদাস সেজেছি
তবুও জেগে ওঠে ক্রোধ
এই পরিভ্রমণ শুধু অচিনদেশে ভাসে
অসংখ্য ধুলিপৃষ্ঠায় …
. . .
রোগশয্যা
বুঝে গেছি—বাতাসের সতীনেরা মিশে বিষাদময় করে তোলে পথ
সেও নিত্যদিন
দুপাশে রাখা বৃষ্টিহ্রদে
সূর্য নামছে রোগশয্যায়
. . .
লাঞ্ছনা
সে-ও তো লেগেছিল দেহে অভদ্র মাতাল—
নগ্ন আদিম
আর্ত জলের বিস্তারে
জলেই লুকিয়ে আছে জীবন
. . .
কলঙ্ক
ঘৃণা করে করে আবার তোমার প্রেমে পড়ে যাই আমি
কত কলঙ্ক মেখেছি শরীরে, আরও কত শতশত অপবাদ
মনে রাখি না
ভুলে যাই সব রক্তাশ্রু নিয়ে—
তোমার প্রেমেই প্রথম পড়ে ছিলাম
মজেছিলাম একা
. . .
জলনিবাস
কেউ কেঁদেছিল বিনোদিনী—
কারা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ব্যথাভার?
লেগে আছে আমার শরীরে
অর্থহীন কেউ—
আঁকছে উঁচু ফ্লাইওভারে যাত্রার অন্ধ
দৃশ্যরোহ—
আমি জেনেছিলাম কৃষ্ণকীর্তন থেকে ভোরের
বনপথ হাওয়ার নীল ছকে মুঠোয় স্মৃতিধার্য সন্ধ্যায়…
কেউ কেঁদেছিল বৃষ্টির বনে—
চোখে মরুঝড়
. . .

ফজলুররহমান বাবুল
পাতাবাহারের গল্প
রাতে যখন আমি ঘুমাই। মাঝে মাঝে আমার জানালার বাইরে একটি পাতাবাহার জেগে ওঠে। তার রং বদলায়-লাল থেকে সবুজ, সবুজ থেকে কালচে বেগুনি। কেউ বলে, ও কেবল আলো-আঁধারের খেলা, কিন্তু আমি জানি—ও একটা ভাষা, যেটা চোখ বোঝে না, মন বোঝে। আমি তাকিয়ে থাকি। পাতাগুলোর নাচের মাঝে কোনও বর্ণমালার মতো কিছু খুঁজে পাই।
যখন আমি শিশু ছিলাম, আমার ঘুমের ভিতরে একবার পাতাবাহার এসে দাঁড়ায়। সে তখন বৃক্ষ নয়—এক রঙিন, নীরব বন্ধু। আমি বলি, ‘তুমি কি দুঃখ চিনতে পার?’ পাতাবাহার তার পাতার শিরায় একটি শব্দ ভাসিয়ে দেয়—‘হ্যাঁ।’ তখন স্বপ্নজুড়ে পাতার বৃষ্টি নামে, প্রতিটি পাতায় লেখা থাকে এক-একটা গোপন ইচ্ছা : ‘আমি কান্না পছন্দ করি না’, ‘আমি বন্ধু হতে চাই’, ‘আমি তোমার সঙ্গে বর-কনে খেলতে চাই’—এইরকম আরও কত কথা। আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি জানালার পাশে পড়ে আছে একটি রঙিন পাতা-তাতে লেখা: ‘তুমি ঘুমোলে আমি জেগে থাকি।’
আর, এখন রাতে, ঘুমের ভিতরে আমি দেখি এক নির্জন বাগান। সেখানে কোনও বৃক্ষ নেই, কেবল পাতাবাহার। তারা হাঁটে, কথা বলে, হাসে-আর একটি পাতাবাহার আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, ‘তোমার কি মনে আছে, কবে প্রথম কান্না চেপে রেখেছিলে?’ কোনও কথা বলি না আমি। পাতাবাহার হালকা বাতাসে একটানা নড়ে—সেই দুলুনিতে আমার হারানো দিনগুলো গুনে ফেলি।
একদিন পাতাবাহার চলে যায় শহরে। ট্রাফিক-লাইটের পাশে দাঁড়িয়ে তার এক-একটি পাতা লাল, হলুদ আর সবুজ হয়ে ঝলকে ওঠে। পথচারীরা ভাবে বিজ্ঞাপন। কিন্তু এক পাগল বলে ওঠে, ‘ও কাঁদছে… রঙের মধ্যে ওর কান্না লুকানো।’ কেউ শোনে না। আমি শুনি। আমি দেখি, পাতাবাহার আর বাতাসের ভিতর দিয়ে এক অতৃপ্ত প্রেমের দীর্ঘশ্বাস বয়ে চলে স্রোতোবহা নদীর মতো।
একদিন পাতাবাহারকে এক আলো-ঝলমলে টিভি স্টুডিওতে রাখা হয়। হোস্ট জিগ্যেস করেন, ‘আপনি কী বার্তা দিতে চান মানুষকে?’ পাতাবাহার চুপ করে থাকে। তবে তার একটি পাতায় ভেসে ওঠে—‘আমি প্রচার নই, প্রতিবাদ। আমি সবুজ নই, বদলে যাওয়া সবুজের চিৎকার।’ দর্শকরা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর আবার করতালি। কেউ বোঝে না, কেউ ভাবেও না-কেবল ক্যামেরা জুম ইন করে রঙের উপরে।
এরপর, বছর ২১৩৯। যখন বন মানে B.I.O.N v3.9—Botanical Illustration of Nature। পাতাগুলো বায়োচিপ, বাতাস নেই, শুধু কোড আর ইমিটেশন। তবে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা পাতাবাহারকে কেউ প্রোগ্রাম করে না। তার শরীরের রঙের ভিতরে শুধু জেগে রয় প্রাচীন শোক। সে নিজেই এক জীবিত প্রত্নতত্ত্ব। একটি পাতা, যা স্ক্যান হয় না, শুধুু অনুভব হয়।
এরপর, ২১৫০-এ পাতাবাহার দাঁড়িয়ে থাকে এক নির্জন গণকবরে। কোনও নাম নেই, সংখ্যা ছাড়া কিছু নেই। পাতাবাহার কোনও ভাষা বলে না, তবু বাতাসে তার শরীর দুলে ওঠে—একটি মৌন প্রতিবাদে। এক বৃদ্ধা তাকে ছুঁয়ে বলেন, ‘তুই কি আমার ছেলেটাকে দেখেছিলি?’ পাতাবাহার কিছু বলে না, শুধু হালকা হাওয়ার শব্দ হয়। একটি শিশু এসে পাতা কুড়িয়ে নেয়-তাতে লেখা: ‘আমাকে মনে রাখো না, কিন্তু ভুলেও যেয়ো না।’
বছর ২১৩০ থেকে আজ অবধি, রাতে যখন সবই ঘুমায়। আমার জানালার বাইরে একটি পাতাবাহার জেগে ওঠে। আমি দেখি তার রং বদলায়—লাল থেকে সবুজ, সবুজ থেকে কালচে বেগুনি। আমি জানি-ও একটা ভাষা, যেটা চোখ বোঝে না, কেবল মন বোঝে।
. . .

ফু ট নো ট :
১. পাতাবাহার একটি বৃক্ষ নয়, একটি স্মৃতি নয়—সে এক রঙিন প্রহরী। সে দাঁড়িয়ে থাকে সেইসব জায়গায়, যেখানে মানুষ আর দাঁড়ায় না। তার রং শুধু রং নয়, তা সময়ের প্রলেপ, প্রতিরোধের চিহ্ন, এবং ভবিষ্যতের কাছে রেখে যাওয়া একটি বার্তা।
২. পাতাবাহার একদিন জানিয়েছিল: নির্বাক, কিন্তু রঙিন, প্রেমের ছুঁইছুঁই আলোয় রাঙিয়ে রাখে তার প্রতিটি পাতা। সে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে, তবু বদলায় প্রতিটি প্রহরে, যে-কোনও স্পর্শবিন্দুর অভিপ্রায় বুঝতে পারে সে। মানুষের প্রেম তার মধ্যে রেখা হয়ে ভাসে। মানুষের হাসি দেখে সে হালকা সবুজ হয়-মুখর, স্নিগ্ধ, কোমল। সে পাতাবাহার—ফুল না-হয়েও প্রেমের ভাষা জানে। ভালোবাসা না-পেলেও রঙিন হয়ে বাঁচে।
. . .
দেখে দেখে পেরিয়ে যাচ্ছি মানজীবনের স্থিরতা কেবল নিজেরন দিকে এই ক্লান্তি সকল প্রার্থনাময়

এরপর, বছর ২১৩৯। যখন বন মানে B.I.O.N v3.9—Botanical Illustration of Nature। পাতাগুলো বায়োচিপ, বাতাস নেই, শুধু কোড আর ইমিটেশন। তবে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা পাতাবাহারকে কেউ প্রোগ্রাম করে না। তার শরীরের রঙের ভিতরে শুধু জেগে রয় প্রাচীন শোক। সে নিজেই এক জীবিত প্রত্নতত্ত্ব। একটি পাতা, যা স্ক্যান হয় না, শুধুু অনুভব হয়।
. . .




One comment on “যুগলমুদ্রায় দুই কবি”