প্রথাবিরোধী ও প্রতিমাভগ্নকারী (Iconoclast) শব্দদুটির প্রতি হুমায়ুন আজাদের এক ধরনের অন্ধ মোহ ছিল। দুটি শব্দ নানান উপলক্ষ্যে হামেশা ব্যবহার করতেন আজাদ। প্রথার ভালোমন্দ রয়েছে বটে! কিছু প্রথা এমন হয় যাকে ছেটে ফেলা দুষ্কর হয়। ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচারকে কেন্দ্র করে এরকম শত-শত প্রথা ধরায় জন্ম নিয়েছে, যার অনেকগুলো সময়টানে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠী বা সমাজ নিজের জন্য অকাট্য ভাবেন। প্রথা এভাবে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে মোড় নিতে থাকে। কথার কথা, আরববিশ্বে বিবাহ ও খৎনাকে ঘিরে আয়োজিত আচার-অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে মেয়েরা উলুধ্বনি দিয়ে থাকেন। ইসলামিশাস্ত্রে স্বীকৃত আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে এর কোনো যোগ নেই। তা-বলে উলুধ্বনি নিয়ে সেখানকার মুসলমান সম্প্রদায় কখনো আপত্তি তুলেছেন বলে শুনিনি। এমনকি মোল্লাসমাজ এটি নিয়ে হইচই বা এর ওপর ফতোয়া জারি করেননি বলেই জানি।
গোত্রশাসিত আরববিশ্বে বিবাহ ও খৎনা বড়ো উৎসবে রূপ সবসময় বড়ো উৎসবে রূপ নেয়। গানবাজনা ও উলুধ্বনিকে যেখানে নিছক সাস্কৃতির স্মারক রূপে গণ্য করেন তারা। তিউনিসিয়ার মেধাবী চলচ্চিত্রকার ফেরিদ বৌগেদিরের একটি ছবির (Halfaouine: Child of the Terraces) কথা প্রসঙ্গত মনে পড়ে যাচ্ছে। বয়ঃসন্ধিতে সদ্য পা রাখা এক বালকের শারীরিক পরিবর্তন ও অবদমিত যৌনবাসনাকে উপজীব্য করে ছবিটি তৈরি করেছিলেন ফেরিদ। নিজের শরীর ও বিপরীত লিঙ্গকে ঘিরে বালকমনে সক্রিয় দুর্নিবার কৌতূহল ও যৌনবাসনার টানাপোড়েন ক্যামেরায় ধরেছিলেন পরিচালক। বালকের খৎনাকে ঘিরে আয়োজিত উৎসবের সবটাই উঠে এসেছিল সিনেপর্দায়। তিউনিসিয়ার সমৃদ্ধ সংস্কৃতির সঙ্গে খৎনা প্রথা ও তাকে ঘিরে আয়োজিত উৎসব যদিও ইসলামিশাস্ত্র হাতে নিলে টিকবে না। তিউনিসিয়ার লোকজন তা জানে, কিন্তু পরোয়া করে না।
এমনকি কোরানে হজের আচার-আনুষ্ঠানিকতার যেটুকু বিবরণ, তার সবটুকু যুগ-যুগ ধরে পালিত হয়ে এসেছে। মক্কায় হজ পালনের মূল আচার-আনুষ্ঠানিকতা যদি ভালোভাবে আমলে নেই, তাহলে কাবা শরিফে তাওয়াফ, হাজরে আসওয়াদে চুম্বন, শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপ, সাফা-মারওয়ার পাহাড় বেয়ে উঠানামা… এর কোনোটাই কোরান নতুন প্রথা হিসেবে ঘোষণা করেনি। প্রথাগুলো প্যাগানরাও অতীতে পালন করেছে। নবি মোহাম্মদের উম্মতরাও সেগুলো পালন করছেন। পরিবর্তন বলতে এটুকু,—কাবা শরিফের ভিতরে কোনো মূর্তি বা প্রতিমা রাখা হয়নি। নিরাকার স্রষ্টার সঠিক প্রতিরূপ যেহেতু মানবের অজ্ঞাত, সূরা নূর-এ যার আভাস দানের পরেও স্রষ্টার প্রতিরূপ মানব-আকলের পক্ষে বোঝা দায়, সুতরাং প্রতিমা নামধারী বিগ্রহকে উপলক্ষ্য বানিয়ে তাঁকে আকৃতি দানের কল্পনাকে কোরান ছাটাই করছে কেবল।
হজের তাৎপর্য প্রাচীন আরবে একাধিক। হজ একদিক থেকে মিলনমেলা এবং সে-কারণে উৎসব হিসেবে পরিগণিত হয়েছে একদা। অন্যদিকে তার বাণিজ্যিক গুরুত্ব কেবল সাম্প্রতিক ঘটনা নয়। নবিজির আমল বা তার আগে থেকে হজকে কেন্দ্র করে চলমান সওদাপাতি মরুবাসী গোত্রগুলোর আয়-রোজগারের বড়ো উৎস ছিল। হজকে উপলক্ষ্য করে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনে গোত্রপ্রধানরা সমাবেশে মিলিত হতেন। স্রষ্টার প্রতি নিজের ভক্তি ও আনুগত্য যেমন সেখানে মুখ্য থেকেছে,—বাণিজ্য ও সম্মিলনও সমান গুরুত্ব পেয়েছে তখন, যার প্রচ্ছন্ন স্বীকৃতি কোরানে মিলবে বৈকি। ঈদ উৎসব তো কোরানে গমন করলে সেভাবে পাওয়ার উপায় নেই। বিশ্ব জুড়ে ঈদ যেভাবে পালিত হয় তার মধ্যে হাজার বছরের প্যাগান প্রথাচারের প্রচ্ছন্ন আভাস ভালোভাবেই মিলে। হাদিসকে কাজেই আমলে নিয়ে একটি প্রথা চালু করেছেন মুসলমান সম্প্রদায়। দেশভেদে যেটি বিচিত্র এবং যার অনেককিছু তথাকথিত ইসলামি শরিয়া হাতে নিলে টিকানো যাবে না।
এখন এই প্রথাচারগুলোকে উচ্ছেদের প্রয়োজন পড়ছে না, যেহেতু তারা একটি বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক রসদে পরিণত হয়েছে এতদিনে। এটি হলো প্রথার স্বাভাবিক ও ইতিবাচক স্বরূপ। পক্ষান্তরে এমন সব প্রথা জাতি-বর্ণ নির্বিশেষ ধরায় বিভিন্ন সময় চালু ছিল অথবা এখনো বজায় রয়েছে, যেগুলো ক্ষতিকর স্থবিরতার প্রতীক। প্রথাগুলোকে উচ্ছেদ বিনা ওই জাতি-সম্প্রদায় বা সমাজের যুগ-উপযোগী প্রগতি সম্ভব নয়। সুতরাং এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও লড়াইয়ের ইতিহাস সকল জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে কমবেশি পাওয়া যায়।
কথার কথা, আফ্রিকার মুসলমান প্রধান দেশগুলোয় মেয়েদের ভগাঙ্কুর খৎনার মধ্য দিয়ে তাদের যৌনচাহিদাকে ছেটে ফেলা ও সতীচ্ছদ অটুট রাখার মাধ্যমে নারীর কুমরিত্ব প্রমাণের মতলব ভয়ানক তো বটেই! ইসলামিশাস্ত্রে এর সমর্থন না থাকলেও উভয় প্রথা হাজার বছর ধরে পালিত হয়ে আসছে। মুমিনকুল দেশাচারের বাহানায় প্রথা দুটিকে হালাল করতে চেষ্টার কমতি করেনি। এ-ধরনের প্রথাকে কাজেই উচ্ছেদ করা ছাড়া নারীকুলের প্রতি ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। যে-কারণে এর বিরুদ্ধে বিস্তর ন্যারেটিভ আফ্রিকার মুসলমানপ্রধান রাষ্ট্রে অবিরত তৈরি হয়েছে। আফ্রিকান চলচ্চিত্রের প্রবাদপুরুষ উসমান সেমবেন তো ছবিও তৈরি করেছেন, আর নারীবাদীরা এটি নিয়ে বলে আসছেন অবিরত।
এর থেকে বোঝা গেল, প্রথা যদি বিড়ম্বনা ও দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, সেক্ষেত্রে তাকে নির্মূল করার মধ্যেই সামাজিক প্রগতির সারকথা নিহিত। বঙ্গভূমি এরকম শত-শত প্রথায় সয়লাব ছিল, যার অনেকগুলো সাংস্কৃতিক স্মারকে পরিণত হলেও সমাজের জন্য বৈনাশিক। সুতরাং এগুলোর উচ্ছেদ সময়ের প্রয়োজনে অনিবার্য হয়েছে বা এখনো হচ্ছে। যেমন, যিনি নিজেকে মুসলমান দাবি করেন ও ইসলামিশাস্ত্রের বিধান আমলে নিচ্ছেন, তার জন্য মাজারে পীর-আউলিয়ার উদ্দেশে ভক্তি প্রদানকে জায়েজ ভাবা কঠিন। কোরানে বর্ণিত তাওহিদ বা স্রষ্টার একত্বের সঙ্গে প্রথাটি এখানে সাংঘর্ষিক। সুফিবাদের বয়ান কাজে লাগিয়ে মাজারপ্রেমীরা যত যুক্তিই হাজির করুন-না-কেন, ইসলামিশাস্ত্র মোতাবেক তাদের ভক্তি নিবেদনের পন্থা বুৎপরস্তি বা আরো সরাসরি বললে শিরকের দিকে বিপজ্জনকভাবে ঝুঁকে থাকছে। যার ফলে এটিকে কেন্দ্র করে ফিতনা এখনো চলমান।
একইভাবে নবিজিকে শরিয়তপন্থীরা যে-আঙ্গিকে বন্দনা করে থাকেন, তার কতখানি কোরানসম্মত,—সেটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। নবির শানে কোরানে সংকলিত প্রশংসাসূচক আয়াত ও তাঁকে অনুসরণ করতে বলার অর্থ কিন্তু এই নয়,—স্রষ্টা এই-যে কাতারে-কাতারে বার্তাবাহক ধরায় পাঠালেন, তাঁদের মান-মর্যাদা ও উচ্চতায় তিনি কমিবেশি করছেন। চারজন বার্তাবাহক ঐশ্বরিক কিতাব পেয়েছেন। দিকনির্দেশনার খাতিরে তাঁদের ওপর ওহি নাজিল হয়েছিল। বাকিদের ওপর সরাসরি ওহি নাজিল করা হয়নি, কিন্তু কী করতে হবে ও তাঁদের আচরণ ধরায় কেমন হবে ইত্যাদি নির্দেশনায় স্রষ্টা স্বয়ং ভিন্নতা আরোপ করেননি। সকলেই স্রষ্টার একত্বের বাণী বহন ও প্রচারে অনুগত ছিলেন। ওহিবাহক ও ওহিবিহীন নবিগণ কীভাকে এক আল্লাহর বাণী সমাজে প্রচার করেছেন তার উদাহরণ অগত্যা কোরানে ফিরে-ফিরে এসেছে। লক্ষ্য একটাই ছিল সেখানে,—শিরক প্রতিরোধে স্রষ্টার একত্ব বা তাওহিদের প্রচার।
এখন কোরান যিনি মানছেন তার ক্ষেত্রে নবি মোহাম্মদের প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসার ডালি উজাড় করতে গিয়ে তাঁকে প্রকারান্তরে ডেমিগডে রূপান্তরিত করার সুযোগ নেই। বাস্তবে যদিও সেটি হামেশা ঘটছে। ঘটনাটি এখানে বিশ্বাসের মর্মমূল ছাপিয়ে প্রথা ও সাংস্কৃতিক স্মারকে রূপ নিয়েছে বারবার। হাদিসকে যেখানে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন ইসলামি শাস্ত্রবিদগণ,—যে-হাদিস নিয়ে আবার প্রশ্ন ও বিতর্ক রয়েছে হাজার। এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী ধর্মগুলোর মধ্যে ইসলাম দল-উপদলে বিভক্ত সেক্টেরিয়ান রিলিজিয়ন হওয়ার কথা ছিল না। কোরানের মূল জিহাদটি সেখানেই প্রেথিত।
বাস্তবে খ্রিস্টান, ইহুদি ও অন্যান্য ধর্মের মতো ইসলামও অসংখ্য মতবাদ আর দল-উপদলে বিভক্ত। মানে দাঁড়াচ্ছে, স্রষ্টার বিধান সেখানে যথাযথ অনুসৃত ও কার্যকর থাকেনি। প্রথাচার স্বয়ং স্রষ্টা বর্ণিত প্রথাকে ধসিয়ে দিয়েছে, যার বিবরণ কোরানে গমন করলে বিস্তর পাওয়া যাবে। ধর্মে যারা বিশ্বাস করেন না বা যারা অজ্ঞেয়বাদী, তাদের সঙ্গে এখানে এসে বিশ্বাসীদের বিবাদ আমরা তীব্র হতে দেখছি। এবং বলাবাহুল্য, বিশ্বাসদের যুক্তি সেখানে প্রায়শ খেলো ও দুর্বল হয়ে থাকে। প্রতিমা উপাসনা কাজেই খোদ সকল ধর্মে প্রচারিত মূল বাণীর বিরোধী। বাস্তবে অবশ্য ওই প্রতিমা উপাসনাই চলে সর্বত্র।
এই যখন অবস্থা, সেখানে একজন সন্জীদা খাতুনকে রবীন্দ্রনাথের গানে বিদায় জানানো নিয়ে মুমিনকুলের ঘৃণা ও বিদ্বেষকে হাস্যকর বলা ছাড়া উপায় থাকে না। সন্জীদা তো এই দাসখতে সই করেননি কখনো,—তিনি নিখাদ ধর্মনিষ্ঠ মুসলমান। মুসলমান পরিবারে তাঁর জন্ম হয়েছে। ওই সুবাদে মুসলমানি সংস্কৃতির অনেককিছু তিনি ধারণ করেছেন। কিন্তু তাঁর নিজস্ব কাণ্ডজ্ঞান ও যুক্তিবোধ তাঁকে পৃথক পথে নিয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও গানে আত্মিক মুক্তির আলো খুঁজে পেয়েছেন তিনি। একে আঁকড়ে ধরে শেষ নিঃশ্বাস অবধি যাপন করেছেন ধরায়। তাঁর এই অতি রবীন্দ্রমুগ্ধতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় দোষের কিছু নেই, কিন্তু এর জন্য তাঁকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে কেন? তিনি কি রবীন্দ্রনাথকে দ্বিতীয় কোনো ঈশ্বর হিসেবে ধরায় প্রচার করেছেন এতগুলো বছর? রবীন্দ্রধর্ম নামে কোনো ইশতেহার রচনা ও সেটিকে প্রথায় পরিণত করার জন্য কি খেটেছেন প্রাণপণ? মানুষকে প্ররোচিত করেছেন এই বলে,—তাদের উচিত রবীন্দ্রধর্ম গ্রহণ করা ও এর আলোকে যাপন করা জীবন? সন্জীদাকে আমরা এতোগুলো বছর এসবের কিছু করার জন্য প্রাণিপাত করতে দেখিনি।

রবীন্দ্রনাথের গানের মর্মবাণী ও দর্শনকে মানুষের কাছে পৌঁছ দিতে ছায়ানট প্রতিষ্ঠার যজ্ঞে কামলা খেটেছেন সন্জীদা। সেইসময় কাজটি তিনি করেছেন, যখন দেশ থেকে রবীন্দ্রনাথকে সমূলে উৎপাটিত করার জিহাদ চলছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছে এমন এক সাংস্কৃতিক প্রতীক, যাঁকে উচ্ছেদের মধ্যে বাঙালি ভাষা ও সংস্কৃতির অবলোপ ঘটার সম্ভাবনা পড়তে পেরেছিলেন তিনি। রবির গান আঁকড়ে পড়ে থাকার পেছনে সন্জীদার লড়াইকে বহুল পরিমাণে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গণ্য করা যেতে পারে। এর সঙ্গে বিশ্বাস, অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব মোটেও প্রধান ছিল না।
কথার কথা, দ্বন্দ্ব ছিল বলে যদি ধরেও নেই, যদি ধরে নেই রবীন্দ্রনাথকে তিনি ঈশ্বর গণ্য করতেন, তাতে বেশি কিছু যায় আসে কি? একজন ব্যক্তি কীভাবে সবকিছুকে দেখবেন ও বিচার করবেন সে তার নিজস্ব এখতিয়ার। চিন্তার স্বাধীনতাকে সেখানে রুখে দেওয়ার আমরা কে? রুখে দেওয়াটা যৌক্তিক হয়, যখন তা সমাজে ক্ষতিকর প্রভাব ও আবেদন ছড়াতে শুরু করে। মানুষকে সম্মুখগামী করার পরিবর্তে পশ্চাদপদ করে। তাকে আলোকসন্ধানী মানব করে তোলার পরিবর্তে অন্ধকার কূপে আটক রাখতে মরিয়া হয়। সন্জীদার অতি রাবীন্দ্রিক ভাবনা-বলয় ও একে ঘিরে জন্ম নেওয়া রাবীন্দ্রিক প্রথাচার কাজেই ক্রিটিক ও তর্কের বিষয় হতে পারে বড়োজোর। এমন কোনো অপরাধ শিল্পী করে বসেননি যে এর জন্য তাঁকে শূলে চড়াতে হবে। উপহাস ও অভিসম্পাতের হুমকি জারি ছায়ানটকন্যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ভাবাটা কি যৌক্তিক হচ্ছে? উচিত কাজ করছেন কি দেশের মুমিন মুসলমান?
এমন তো নয়,—রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও গানের ব্যাপারে তাঁর ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তোলার পথ রুদ্ধ করতে ছায়ানটকে তিনি ব্যবহার করেছেন। যারা এরকম ভেবেছেন, তাদের পথ কি রোধ করেছেন সন্জীদা? সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে ছায়ানটকে তিনি যেভাবে গড়তে চেয়েছিলেন, সেখানে তাঁর সঙ্গে কারো মতের বনিবনা না হওয়া অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। যাদের পোষায়নি, সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ তো বন্ধ করেনি ছায়ানট। অনেকে বেরিয়ে গেছেন বলেও জানি। রবীন্দ্রচর্চার নামে ছায়ানট দেশে রবীন্দ্রকাল্ট তৈরিতে লিপ্ত;—মুমিন-মুসলমানদের এই অভিযোগটি বহু পুরাতন। এমন মুমিন-মুসলমানও আছেন বটে, ইসলাম ধর্মে নাড়া বাঁধার সুবাদে পাওয়া প্রথাচারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক গণ্য করে যারা এই সংগঠন থেকে বেরিয়ে গেছেন। তাদের এই বেরিয়ে যাওয়া অযৌক্তিক নয় হয়তো, কিন্তু এর জন্য সন্জীদাকে বিষোদগার করে কি ফায়দা? অনেক ভেবেও কিছু কুলকিনারা করা গেল না! ইসলামসম্মত রবীন্দ্রচর্চার ঠিকাদারি নিতে তো ছায়ানটের জন্ম হয়নি। রবীন্দ্রনাথ যদি সেখানে কাল্ট হয়ে থাকেন, তবে সেটি সাংস্কৃতিক কাল্ট;—এখন একে উচ্ছেদের লড়াইয়ে ইসলাম কোনো কাজে আসবে না।
ওপারবাংলায় রবীন্দ্রনাথ শিক্ষিতসমাজের বৃত্তে আটকে আছেন দীর্ঘদিন। বাঙালির ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তাঁর অবদানকে যে-কারণে সর্বজনীন করা সম্ভব হয়নি। রবিচর্চা সেখানে বরং একটি স্ট্যাটাস ক্যু তৈরি করে বসেছে। নিজেকে সংস্কৃতিমনস্ক প্রমাণের বাহানা হিসেবে বাঙালিরা তাঁকে স্রেফ ব্যবহার করেন সেখানে। রবির অবদানকে বহুমাত্রিক উপায়ে যাচাই ও কাজে লাগানোর সাংস্কৃতিক তৎপরতা যারপরনাই স্থবিরতার চোরাবালিতে আটকে আছে। নতুন প্রজন্মের সিনমোকার অদ্বৈত বিক্রম সেনগুপ্ত তাঁর ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন ক্যালকাটা ছবিতে এই অবক্ষয়ের স্বরূপটি ভালোই তুলে ধরেছিলেন। এর বিরুদ্ধে লড়াই মানে হচ্ছে কাউন্টার কালচারের উপকরণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার, যেটি অনেকে করছেন এখন।
বাংলাদেশে রবীন্দ্রকাল্ট প্রতিষ্ঠার নামে ছায়ানট যদি সেরকম স্থবিরতার জন্ম দিয়ে থাকে, লড়াইয়ের পন্থা সেখানে ওপারবাংলা থেকে ভিন্ন হওয়ার কথা নয়। বাস্তবে সেটি ঘটেনি। রবীন্দ্রনাথ এখানে এমন এক রাজনৈতিক হাতিয়ার, যাকে গুঁড়িয়ে দিতে পারলে হিন্দু প্রাধান্যের অবসান ঘটবে বলে অনেকে ভেবে থাকেন। রবিপ্রভাবকে বিপন্ন করতে ওই ফিরে-ফিরে ধর্ম নিয়ে টানাটানি চলে বেদম! সন্জীদার লড়াইটি মূলত সেখানে নিহিত ধরা যেতে পারে। তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ এমন এক সাংস্কৃতিক প্রতীক, যাঁর মধ্যে তিনি বাঙালি ও বিশ্বসংস্কৃতির সংরাগ একত্রে অনুরণিত হতে দেখছেন। রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচেতনা হয়তো এই জায়গা থেকে তাঁকে নাড়া দিয়েছিল। তিনি একে ধারণ ও লালন করতে অধীর ছিলেন। সাংস্কৃতিক সম্পূর্ণতার প্রতীক হিসেব রবিকে আত্মস্থ করেছেন সন্জীদা;—যাঁকে বাদ দিয়ে বাঙালিত্ব প্রস্ফুটিত নয় বলে তিনি মানতেন। রবীন্দ্রনাথকে সুতরাং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম ও বিকাশের ইতিহাসে অবিচ্ছেদ্য করতে তাঁর একটুও আটকায়নি।
সকল প্রকার সংকীর্ণতা ও কূপমুণ্ডুকতার বিরুদ্ধে শানিত তলোয়ার হিসেবে রবীন্দ্র সাহিত্য ও গানকে ব্যবহার করেছেন সন্জীদা খাতুন। তাঁর এই রাবীন্দ্রিকতা তাদের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে উঠেছে, যারা এরকম ভাবছেন,— মুসলমান হিসেবে একজন মানুষের বিদায়যাত্রা ইসলামি আচার মেনে সম্পন্ন হওয়া উচিত ছিল। কলেমা পড়ে শেষ নিঃশ্বাস তিনি ত্যাগ করতে পারতেন। সন্জীদা ওভাবে বিদায় নিতে ইচ্ছা করেননি। কেন করেননি সেটি বরং অগে অবধান করা প্রয়োজন। মুসলমানিত্ব নিয়ে তাঁর সংজ্ঞা ও দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো ভিন্ন ছিল। তিনি হয়তো ধর্মীয় পরিচয়ে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে ইচ্ছুক ছিলেন না মোটেও। হয়তো অবিশ্বাসী ছিলেন। হয়তো অজ্ঞেয়বাদী ছিলেন। হতে পারে ঠাকুরের উপনিষদ আশ্রিত মহাবৈশ্বিক ঈশ্বরকে মরমে লালন করেছেন আজীবন। তাই ঠাকুরের গানে জীবনদেবতার যে-মর্মবাণী শ্রোতারা অহরহ প্রতিফলিত হতে শোনে, এখন তার দুকলি দিয়ে ধরাকে বিদায় বলাটা সমীচীন ভেবেছেন।

প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস কে মানবে আর কে মানবে না সেটি তার একান্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছার স্মারক। এখানে জবরদস্তি স্বয়ং ওইসব প্রচলিত বিশ্বাসের মূল মর্মবানীর সঙ্গে খাপ খায় কি? সন্জীদাকে আচমকা মুসলমান হিসেবে আবিষ্কার করা ও মাতন উঠানো কাজেই হাস্যকর। তিনি ওসব ছাপিয়ে অন্যরকম হতে চেয়েছেন, এবং এই চাওয়ার স্বাধীনতা সমাজ তাঁকে দিতে বাধ্য। কারণ, তিনি কোনো হিযবুতি সমাজে বিলং করতে সম্মতি দেননি, যেখানে ধর্মীয় প্রথা ও প্রতিমা তাঁকে মানতেই হতো। সমাজ সেদিকে গমন করছে দেখে অতি রাবীন্দ্রিক সন্জীদা তাঁর একমাত্র ব্রহ্মাস্ত্র ঠাকুরের গানকে সম্বল করে ধরা থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাঁর রবিভক্তির পরিণাম কতটা যৌক্তিক সেটি পৃথক তর্কের বিষয় হলেও রবির গান দিয়ে শেষযাত্রার মাধ্যমে প্রথাবিরোধীতার নতুন নজির গড়লেন। কলেমা ও তাওহিদকে যারা জোর করে অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে মরিয়া, যেটি আবার খোদ কোরান হাতে নিলে ধোপে টিকবে না, এখন ওইসব প্রথাঅন্ধ প্রতিমা পূজারীদের আঘাত হানতে সন্জীদা স্বয়ং তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত রবিপ্রতিমাকে শেষবার ব্যবহার করেছেন।
হুমায়ুন আজাদের সংজ্ঞা অনুসারে এটি প্রতিমাভগ্ন করা হলো কিনা জানি না, কিন্তু মোল্লাতন্ত্রে সয়লাব বাংলাদেশের শিক্ষিত মোল্লাদের গালে তাঁর শেষযাত্রা চপেটাঘাতের শামিল। তিনি বুঝিয়ে দিলেন,—এই অতি উন্নত রাষ্ট্রের অতি শিক্ষিত সমাজে মোল্লা যে-পরিমাণ বিরাজিত, স্রষ্টার অসীম করুণা ও বিভূতির লেশমাত্র নেই তাদের অন্তরে। না আছে সহিষ্ণু উদার কোনো ছায়াপথ। তারা কূপমণ্ডুক। ধার্মিক হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
. . .
. . .