পোস্ট শোকেস - বিবিধ ও বিচিত্র

বাংলার খেত, কৃষি : ফজলুররহমান বাবুল

Reading time 5 minute
4.7
(26)
Paddy Field, Bangladesh; Photo Credit : Ariful Haque; Source : pixels.com

মানুষের ইতিহাসে যদি কোনও আদিম আশ্রয় খুঁজতে হয়, তবে সেটা হল খেত—মৃত্তিকার বুকজুড়ে ছড়িয়ে থাকা নৈঃশব্দ্যের সেই মহামঞ্চ, যেখানে প্রথম মানুষ শিখেছিল বেঁচে থাকার কলা। ক্ষুধার বিরুদ্ধে সংগ্রামে যখন প্রকৃতি ছিল অনিশ্চয়তার আরণ্যক, তখনই খেত মানুষকে শিখিয়েছে নিরাপত্তার ব্যাকরণ—বীজ বোনা, পরিচর্যা করা, আর অপেক্ষা করতে জানা। খেতের জন্মেই যেন জন্ম নিয়েছে মানবসভ্যতার প্রথম আলো। শিকার ও সংগ্রহের অস্থির জীবন থেকে স্থির বসতি—এই রূপান্তরের কেন্দ্রে ছিল নরম কৃষ্ণ-মৃত্তিকার বুকে ফোটা প্রথম শস্যচারা। মানুষ দেখল—মাটি দিতে পারে জীবনের ভরসা। মানুষ প্রথম দেখল পরিশ্রমে ফল আসে। খেতের চারপাশে গড়ে উঠল গ্রাম। গ্রাম থেকে নগর, নগর থেকে সভ্যতা। এক-একটি ঋতুর চলাফেরা খেতের শরীরে—বৃষ্টি এসে বীজকে জাগিয়ে তোলে, ভিন্ন ভিন্ন ঋতুয় ভিন্ন ভিন্ন ফসলের বর্ণমালা। ঋতুচক্রের সঙ্গে মানুষের অনুভূতির মিলনক্ষেত্র এই কৃষিভূমি।

কিন্তু, বর্তমান বাস্তবতায় বাংলার কৃষকের আর্থিক বাস্তবতা কিংবা সামাজিক মর্যদা সুখকর নয় কোনওভাবেই। কৃষকের আর্থিক অবস্থা/বাস্তবতা বহুকাল থেকে আজ অবধি এক কঠিন দ্বন্দ্বের গল্প। যে-কৃষক অন্ন উৎপাদনকারীর ভূমিকায়, সেই কৃষককেই নুয়ে পড়তে হয় অনিশ্চয়তার চাপে। শস্যউৎপাদনখরচ—বীজ, সার, কীটনাশক, শ্রম, সেচ—সবকিছুর দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে, কিন্তু বাজারে ফসলের ন্যায্য মূল্য সে পায় না; মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতেই লুট হয় কৃষকের ঘামের ফল। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা প্রায়ই ঋণের চক্রে আটকা পড়ে— কখনও এনজিও, কখনও মহাজনের সুদের বোঝা তাঁর জীবনকে করে তোলে আরও জটিল। আধুনিক যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তি ব্যবহারের সামর্থ্য অনেকেরই নেই; জমির পরিমাণও ক্রমশ কমছে ভাগ-বাটোয়ারা ও নগর-সম্প্রসারণে। কৃষকের আয়ের দিকটা স্থির নয়—এক মৌসুম ভালো গেলে আরেক মৌসুমে ঘূর্ণিঝড়-খরা-বন্যা-লবণাক্ততা সব হিসাব ওলটপালট করে দেয়। বাজারে দাম কম; আবার নগদে বিক্রির প্রয়োজন বেশি; ফলে কৃষক বাধ্য হন কমদামে ফসল বিক্রি করতে। নানান দুর্বিপাকে জীবনের মূল লক্ষ্যই যেন শুধু বেঁচে থাকা।

আর, সামাজিক মর্যাদা? বাংলার কৃষকের সামাজিক মর্যাদা আজও প্রত্যাশিত উচ্চতায় পৌঁছায়নি। সমাজে বহুলপ্রচলিত ধারণা—শিক্ষিত ও আধুনিক পেশায় যারা, তারাই উন্নত; আর ‘কৃষক’ মানেই কষ্টক্লিষ্ট ও দারিদ্র্যগ্রস্ত জীবন—এমন সংকীর্ণ চিন্তা কৃষকের পেশাকে অবমূল্যায়নের পথে ঠেলে দেয়। অথচ একজন কৃষক যখন ঘাম ঝরিয়ে খাদ্য ফলান—তখন শুধু একটি পেশা-ই পালন করেন না—রাষ্ট্রের প্রাণধারাও রক্ষা করেন। তবু তাঁর ভাগ্যে জোটে সমাজের অবজ্ঞা।

শিক্ষার জন্য, জীবিকার সন্ধানে, কিংবা নতুন স্বপ্নের টানে কৃষকের সন্তান যখন শহরে-মহানগরে গিয়ে কংক্রিট-দালান, বর্ণচ্ছটা, চাকরি-বাণিজ্যের প্রতিযোগিতায় ডুবে যায়, তখন প্রশ্ন ওঠে—তার জন্মের প্রথম পরিচয় কি আর তাকে স্পর্শ করে? খেতের মৃত্তিকা-গন্ধ, পিতার হাতের কড়া-ধরা ছাপ, ভোরের শিশিরভেজা ধানপাতা—সব কি ফেলে যায় সে শহরের প্রথম বাসে চেপে? এই অভিযোগের পেছনে আছে বাস্ততার এক তিক্ত ছায়া। শহর অনেকটাই নির্মম; সফলতার মানদণ্ড সেখানে অন্য। সেখানে অর্জন মানে উচ্চতর বেতন, ফ্ল্যাট, গাড়ি—কৃষকের ঘামের গল্প নয়। ফলত, অনেকে লজ্জা পায় স্বীকার করতে—সে কৃষকের সন্তান। কৃষিতে দেখে পশ্চাৎপদতা, দেখে দারিদ্র্য। অথচ, সে নিজেই ওই কৃষকের রক্তে বড়ো হয়েছে।

Man Walking with Hoe on Shoulder; Photo Credit : Rejaul Karim; Source : pixels.com

তবে, বিপরীত ঘটনাও ঘটে। শহরের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, অনেকে নতুন কৃষি-প্রযুক্তি, ব্যাবসায় জ্ঞান নিয়ে ফিরে গ্রামে। ভূমিকে ভালোবেসে, কৃষিকে পুনর্জাগ্রত করতেও চায়। তাদের চোখে কৃষি শুধু জীবিকা নয়—এটি দেশগঠন, খাদ্যনিরাপত্তা, গৌরব। তারা বুঝে শহরের চাকরি শূন্য হলে কেউ ক্ষুধার দায় নেয় না; দায় নেয় খেত।

এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়—ভুলে যাওয়াটা কি ব্যক্তি-স্বার্থের বাঁচার পাঠ, নাকি সমাজের শেখানো সংকীর্ণ মনোভাব? যদি কৃষিকে অবহেলা করা হয়, তবে শহরগুলোকেই তো একদিন রুটিভাতশূন্য টেবিল সাজাতে হবে। তাই, কৃষকের সন্তান শহরে গেলেই কৃষক-পরিচয় হারায়—এটা অবশ্য চির-সত্য নয়; বরং সমাজই তাকে ভুলিয়ে রাখতে চায়। কৃষির মর্যাদা ফেরাতে হলে কৃষকের মর্যাদা ফিরিয়ে আনা জরুরি—যত্ন, সম্মান, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সামাজিক শ্রদ্ধার মাধ্যমে। কৃষকের সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত হলে খেতের প্রতিটি শস্যদানা হয়ে উঠবে আরও উজ্জ্বল, আরও সম্মানের ফসল।

কৃষক কেবলই শ্রমিক নয়— মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির মিতালি রক্ষাকারী এক নিবেদিত জ্ঞানী। এই পৃথিবীতে তথ্য-প্রযুক্তির প্রবাহ শুরুর বহু আগে থেকেই প্রকৃত কৃষক জানতেন মেঘের গায়ে কোন রং এলে বৃষ্টি নামবে, বাতাস কোনদিকে গেলে নদী ফুলবে। ঋতু তাঁকে শিখিয়েছে গণিত, গ্রহ-তারার আলো দেখিয়েছে সময়ের ক্যালেন্ডার। তব—এই কৃষককেই হতে হয়েছে ক্ষমতার রাজনীতির শিকার। মগ, পোর্তুগিজ, ইংরেজ—সব শাসকই হাত বাড়িয়েছে তাঁর খেতের দিকে। খাজনার নামে রক্ত চুষেছে জমির মালিক। খেত তখন শুধু আশীর্বাদ নয়—বঞ্চনার গোপন গাথা। আজও কত কৃষকের কাছে নিজের উৎপাদিত ভাত-ই মাঝে মাঝে অগম্য বিলাস! প্রকৃতি আর শোষণের দ্বৈত ঘূর্ণিতে ঘুরপাক খায় কৃষকের জীবন। কিন্তু—খেত ছেড়ে যাওয়া তাঁর স্বভাবে নেই। কৃষক জানেন—খেত মানে আত্মার গান। যেখানে তাঁর জন্ম, যেখানে তাঁর কবর। দুটোই একই মাটিতে।

খেত মানুষকে শুধু খাদ্য দেয়নি—প্রতিজ্ঞাও দিয়েছে। অতিরিক্ত উৎপাদন মানুষকে পরিচিত করিয়েছে বাণিজ্যের সঙ্গে। শস্য-বিনিময়ের পথে এসেছে সমৃদ্ধির পথ, আর সমৃদ্ধি ডেকেছে সমাজগঠন ও প্রতিষ্ঠান সৃষ্টিকে। রাজস্ব, মুদ্রা, মালিকানা—সবকিছুর সূচনা যেন এই জমির ওপর দাঁড়িয়ে। তবু খেতের বুকে দ্বৈরথও জন্ম নিয়েছে—যেখানে কৃষক ঘাম ঝরায়, সেখানে জমির অধিকার নিয়ে সংঘাত; যেখানে ফসলের গন্ধ, সেখানেই শোষণের ধূসরতা। ভূমির প্রশ্ন—এখনও সভ্যতার যুদ্ধক্ষেত্র। কিন্তু এসবের বাইরেও খেতের একটি অন্যরকম ভূমিকা আছে। মানুষ মৃত্তিকাকে মা বলে—কারণ মৃত্তিকা সন্তানকে ধারণ করে, প্রতিপালন করে, আর শস্যের রূপে ফিরিয়ে দেয় ভালোবাসা—জীবন। মানুষ যখন একটি শস্যভরা খেতের দিকে তাকায়—সে দেখে নিজেরই প্রতিচ্ছবি—মৃত্তিকার সন্তান হয়ে আকাশপানে ওঠার সংগ্রাম।

Man Walking with Cow in Water; Photo Credit : Shahadat Hossain; Source : pixels.com

মৃত্তিকার গন্ধে লুকিয়ে আছে মানবজাতির ইতিহাস। বাংলার কৃষক যেন ইতিহাসের এক অবিচল প্রহরী—কত বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাসেও দাঁড়িয়ে থাকে। বাংলার খেত শুধু ধানের ঢেউ নয়; এটি শস্য, ডাল, গম, ভুট্টা, আলু, পাট, তিল, সরিষা, নানা ফল—তরকারি ও ফুলের বর্ণিল সোনার আঁচল—যেখানে ঋতু বদলালে বদলে যায় রং, বদলে যায় পরিশ্রমের ছন্দ। বর্ষায় নদীর স্নিগ্ধ বুকে জন্ম নেয় মাছের সমারোহ; শীতে মাটির কোলে উঁকি দেয় বাঁধাকপি-ফুলকপি-বাঁধা লাউ, টমেটো-গাজর-শাকপাতার রঙিন বাহার; গ্রীষ্মে সূর্য-তপ্ত মাঠে পাকা আম-কাঁঠাল-তরমুজের মিষ্টি গন্ধ। এই বহুবর্ণ দ্রব্যের জন্মদাতা কৃষক-প্রথম ভোরের আলোয় যার দিন শুরু হয়, অন্ধকার ঘনিয়ে এলেও যার শ্রম শেষ হয় না। জীবনের প্রতিটি ফোঁটা ঘাম মিশে যায় জমির প্রতিটি দানায়, অথচ বাজারে ন্যায্যমূল্যের হিসাব কাটতির খাতায় লেখা থাকে কৃষকের পরিশ্রমের অসম পরিণতি।

পৃথিবীর খেত মানে বহুমাত্রিক জীবনজ্যোতি; বাংলার কৃষক মানে খাদ্যশস্যের জোগানদাতা, অর্থনীতির শক্তি, স্বাধীনতার শিকড়—যাকে ভুললে আমরা নিজেদের অস্তিত্বই ভুলতে বসি। খেত কেবলই আমাদের অতীতের স্মৃতি নয়; বর্তমান জীবনের ব্যাকরণ; ভবিষ্যতেরও জীবনরেখা। কিন্তু এই জীবনরেখা আজ বিপন্ন। যখন আকাশ ছুঁয়ে যায় প্রযুক্তির তেজ, তখন মানুষ কি ভুলে যাবে তার পায়ের নিচের মাটিকে—যা তার সত্যিকারের আশ্রয়

আমরা দেখছি-ক্রমশ নগর বড়ো হচ্ছে, কৃষিজমি কমছে, কংক্রিট ক্রমশ গ্রাস করছে সবুজের দিগন্ত। কৃষিজমির জায়গা দখল করছে বিলাসবহুল প্রাসাদ, শপিংমল, রাস্তা-আর কত কী! আমাদের বুঝতে হবে—জমির ওপর যখন এক-একটি ইট বসে, তখন এক-একটি বীজেরও সম্ভাবনা হারিয়ে যায়। রাসায়নিক সার ও বিষাক্ত কীটনাশক খেতের প্রাণবিন্দু, মাটির জৈবতা ছিনিয়ে নিচ্ছে ক্রমশ। নদী কাঁদছে, ভূগর্ভস্থ জল শুকিয়ে যাচ্ছে, শস্যের দানা হচ্ছে অবিশ্বস্ত, দুর্বল। এই কি উন্নয়ন—যেখানে পেট ভরে না, মাটির বুক শূন্য হয়ে যায়?

মানুষকে নিশ্চয় মৃত্তিকার কাছে থাকতে হবে—প্রকৃতিবান্ধব কৃষি, জৈব চাষাবাদ, বীজের উপর কৃষকের সার্বভৌম অধিকার, এবং কৃষকের শ্রমের ন্যায্য মূল্য—এসবকে বানাতে হবে নতুন প্রজন্মের লড়াই। মৃত্তিকার প্রতি ভালোবাসা ফেরাতে হবে হৃদয়ে—কারণ মৃত্তিকা হারালে আমরা শুধু জমি হারাই না, হারাই সভ্যতার শেকড়, আর আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বপ্ন।

প্রযুক্তি কৃষকের শত্রু নয়; শত্রু তখনই হয় যখন মানবিকতার বিপরীতে দাঁড়ায়। মানুষ ও প্রকৃতির সমান স্বার্থে—খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ সংরক্ষণ, এবং টেকসই কৃষি-উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে, খেতের সঙ্গে প্রযুক্তির হাতকে যুক্ত করা সময়ের দাবি। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টি-চাহিদা পূরণ করতে হলে প্রচলিত কৃষি-পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা জরুরি; সেইসঙ্গে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষাও আবশ্যক। উন্নতির পরিমাপে যদি আমরা মানবতার সঙ্গে পৃথিবীর ভবিষ্যৎকেও বিবেচনায় রাখি, তবে টেকসই কৃষির এই পথ আমাদের সামনে খুলে দিতে পারে এক সমৃদ্ধ, নিরাপদ ও সবুজ আগামী।

. . .

লেখক পরিচিতি : ওপরের ফটো অথবা এই লিংক চাপুন

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 26

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *