বই পরিচিতি : নিকট থাকো বৃক্ষ : হোসনে আরা কামালী

শুধু বিশেষণ যোগ করে একজন কবির প্রতিভাকে তুলে ধরা যায় না। তাঁর কাব্যভাবনা, কবিতাযাপন, কবিতা প্রণয়ন ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কবিকে মূল্যায়ন করা জরুরি। সেই সূত্র-ধরে বলছি—সমকালীন বাংলা কবিতার এক স্নিগ্ধ ও দীপ্ত স্বর হোসনে আরা কামালী। তাঁর কবিতায়—ঘুঘু পাখির গান, শিশির ঝরার শব্দ, নারীর বুকের পাঁজরে জমে থাকা কষ্টের গোঙানি—এসবের শব্দ শুনি।
হোসনে আরা কামালীর কবিতা কখনও যেন শূন্যে আলো ফেলার মতো—নিঃশব্দ অথচ দীপ্তিমান। তিনি নির্মাণ করেন এক গভীর সংবেদনশীল প্রতীকময় কবিতাভুবন। প্রেম, প্রকৃতি তাঁর কবিতার শরীরে লাউয়ের ডগার মতো জড়িয়ে-জড়িয়ে তরতর করে বেড়ে ওঠে! মানুষ আর প্রকৃতি তাঁর কবিতার পথে সহযাত্রী। তাই, নিকট থাকো বৃক্ষ এক আত্মগভীর যাত্রাপথের পথিকসঙ্গী। জীবনের পরতে-পরতে জমাটবাঁধা স্মৃতি-বিস্মৃতি, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহ কামালীর কবিতায় ফুটে ওঠে শরত-প্রভাতে শাপলাবিলের মতোই। একজন সমাজচিন্তকের ভাবনারাশিও তাঁর কবিতা-অক্ষরে জ্বলজ্বল করে। পাঠক-হৃদয়ে তারা বুনে দেয় নিকটতার বৃক্ষ। এই বৃক্ষ ছায়া দেয়, বাতাস দেয়, কখনও-বা কাঁপে নিঃশব্দ।
হোসনে আরা কামালী প্রণীত নিকট থাকো বৃক্ষ কবিতাবইয়ে ৫২টি কবিতা চার ফর্মার পেপারব্যাক মলাটে ঠাঁই করে নিয়েছে। কবি অত্যন্ত সচেতনভাবে কবিতাগুলোর জন্মকাল লিখে দিয়েছেন। ২০২২ থেকে ২০২৪—এই সময়ের মধ্যে সবগুলো কবিতা জন্ম নিয়েছে; শুধু ‘রেখা পালিত’ কবিতাটি ২০১৮ সনে লেখা।
কবিতাবইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন কবি ফজলুররহমান বাবুলকে, যিনি কবিতার পথে হেঁটেছেন বহুদূর! নান্দনিক প্রচ্ছদ এঁকেছেন আল নোমান। পরিচ্ছন্ন ও নান্দনিক বইটি প্রকাশ করেছেন নাগরী প্রকাশনী। নিকট থাকো বৃক্ষ পাঠক সাগ্রহে পাঠ করবেন আশা করি। সেইসঙ্গে চলুন পড়ে নেওয়া যাক কবিতাবইটি লিখে ওঠার নেপথ্যে কবির নিবেদন :
একটি বিলম্বিত নিবেদন
কবিতাবই নিকট থাকো বৃক্ষ
একটি কবিতা লিখব বলে অপেক্ষা কাটে না—
নিখোঁজ সংবাদে ঢেকে আছে পুরো জীবন
একটি কবিতা লেখার জন্যই!
বড়োমামা গর্জে উঠেছিলেন একদিন,
লেডি স্বাস্থ্যকর্মী শাহানা নির্দ্বিধায় বলে গেছেন—ইঁচড়েপাকা
একটি কবিতা লেখার জন্যই তো।
অথচ দেখুন কত ঠিকঠাক আছি
সবকাজ হোক অফিস কিংবা বাড়ি
করে যাচ্ছি সাধ্যাতীত কষ্টকর মেনে
তবু অপেক্ষা কাটেনা
কবিতাযাপনের তৃপ্তি ঘুচে না আমার।
নির্জনতায় ফেরারি আজ—
অথচ কত অগোচরেই না চলে ভীতসন্ন্যাস আমার
নিরিবিলি একজীবন চুরি করেছি বলে হুলিয়া চারিদিকে…
একটি কবিতা লেখার জন্যই তো!
. . .

সংলাপে সংরাগে কবি হোসনে আরা কামালী
[উৎস : সংলাপে সংরাগে : কবি নাজমুল হক নাজুর সঙ্গে কবি হোসনে আরা কামালীর সংকলিত কথালাপ]
. . .
নাজমুল হক নাজু : সাধারণ মানুষ ও একজন কবির মধ্যে পার্থক্য মূলত কোথায়?
হোসনে আরা কামালী : কবি নিজেকে কবি ভাবতেই পছন্দ করেন। সাধারণ বা অসাধারণ নিয়ে কবি মোটেই ভাবিত নন। কবিতাই তাঁর একমাত্র ধ্যান। কবিতাকে অসামান্যতায় উদযাপনই কবির আরাধ্য। তবে কবিকে সাধারণ থেকে আলাদা করে তাঁর কবিতা-যাপন, তাঁর কল্পনাশক্তি – মোট কথা কবির ভাবুক মন। এটা একটি সূক্ষ্ম অনুভবের বিষয়। আপাতদৃষ্টিতে কবিরও কাম-ক্ষুধা-প্রাতকৃত্যের প্রয়োজন হয়। এ ক্ষত্রে সাধারণ তো বটেই। তবে কবির ভালোবাসার ক্ষমতা অসাধারণ। নৃশংসতা, বর্বরতায় কবি কষ্ট পান। কারণ কবির জন্মই হয়েছে শুধুমাত্র ভালোবাসার জন্যই।
. . .
নাজমুল হক নাজু : কবি বা শিল্পীর পক্ষে বিচ্ছিন্নতা কি অপরিহার্য? কবিদের কি আপনার ‘রহস্যময়’ বলে মনে হয়?
হোসনে আরা কামালী : এক অর্থে অপরিহার্য। কবির নিমগ্নতাকে আমি বিচ্ছিন্নতা বলতে নারাজ। এই নিমগ্নতাই কবির অক্সিজেন! কবির কবিতাজীবন তাতে প্ৰাণবায়ু পায়। এটা এক ধরনের সাধনা বা তপস্যার মতই। নিরবিচ্ছিন্ন নিমগ্নতার মতোই মৃন্ময়। শব্দকে যিনি কবিতায় বিবিধ ব্যঞ্জনা দিয়ে খেলতে জানেন, রহস্যময় করে তোলেন তিনিই কবি। কবি নিজেও রহস্যস্রষ্টা বলে রহস্যকে ধারণ করবেন বলেই মনে হয়।

নিকট থাকো বৃক্ষ
প্রকাশক নাগরী জুলাই ২০২৫
পাওয়া যাবে বাতিঘর, সিলেট, নাগরী প্রকাশন, বারুতখানা, সিলেট
অনলাইন পরিবেশক রকমারি ডটকম
. . .

লেখক পরিচয় : ছবি অথবা এই লিংক চাপুন
. . .



