সাহিত্যবাসর

রংধনুর রং কতটা স্তরে থাকতে হয়?

আহমদ সায়েম-এর গদ্য
Elancement IV (1971) by Shahabuddin Ahmed; Lithography; Image Credit – singulart.com

শিশু যখন জন্মপিতাকে অস্বীকার করে, তার পরিচয় কী দাঁড়ায় তখন? অতো সব বুঝতে চাই না, পরিবেশ, পরিস্থিতি, জাতীয়তা—নানান ভাবে নানান রেকর্ড ভেঙে এমন এক মাত্রায় পৌঁছায়,- নিরাপদ দূরত্বে থেকেও তার পালস নেওয়াটা সহজ হয় না।

এমনিতে বুঝাবুঝিতে আমার সমস্যা হয়, অদ্য লিখছি না; লিখছি না বলাটাও ঠিক হবে না, কারণ লেখা আসে না। ভাবনাগুলি হ য ব র ল হয়ে যাচ্ছে, কোনো শৃঙ্খলা নেই ভাবনার, চায়ে লিকার কম দেখলে অসহ্য লাগে, কঠিন হয় মেজাজ অথচ মুখে শব্দ করতে হয় বা করি—ঠিক আছে, হ্যাঁ, ঠিক আছে, চায়ের লিকার । সবাই যখন গুড নাইট বলে ঘুমাতে যায়, আমি মর্নিং বলে কাজ শুরু করি।

মনে করি ভুল হচ্ছে; আসলে যা হচ্ছে তা আমার কর্ম ছিল, যে-ব্যবহার আমার সাথে হচ্ছে তা আমি আরেকজনের সাথে করে এসেছি; অথচ মনে করছি ভুল হচ্ছে অঙ্ক? না, প্রকৃতির অঙ্ক ভুল হয় না। যা যা আমি হারিয়েছি, সব আমি ফিরে পেয়েছি শতগুণ বেশি করে; তবু সবাইরে জানান দেই—সূর্য দেখি না অনেক দিন। ভুলে যাই যখন সূর্য দেখার জন্য আব্বা ভোরে ডাকতেন, মা ডাকতেন, আমি খুব বিরক্ত হয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করতাম। পরদিন আনন্দচিত্তে গল্প করতাম—দশটা পর্যন্ত ঘুমাইছি! তাহলে ভোরের সূর্যটা তো আমার হওয়ার কথা নয়। মনে করি মন খারাপ করলে শাস্তি দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, আর মেনে নিলে পাপকে শৃঙ্খলায় ফেরানো হয়…

বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে কয়েকবার, প্রকৃতি শতগুণে ফিরিয়ে দিয়েছে। আজ ফেসবুকে দেখলাম বাচ্চারা একজন দেশপ্রধানের প্রতিকৃতিতে জুতা নিক্ষেপ করছে; দেখে শরীর যেন রক্তশূন্য মনে হচ্ছে, সারাটা শরীর কান্নায় ভেঙে পড়ছে, কারণ প্রকৃতির হিসাব এখন সামান্য কিছু বুঝি। আজকের এই দৃশ্য একজনের পাওনা বুঝিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতি, আর বাচ্চারা তাদের হিসেব তুলে রাখছে হালখাতায়। তাদের পাওনা যখন বুঝিয়ে দেওয়া হবে, সেই দৃশ্যে হয়তো আমার থাকা হবে না, দেখা হবে না, রংধনুর রং ঠিক কতটা লেয়ারে থাকবে…
. . .

পাঠ-সংযোজন

প্রকৃতির অঙ্ক ও কবির মনোবিভ্রম 
. . . 
ভালো বলেছেন কবি। কবিদের যেরকম বলা সাজে সেভাবে বলেছেন। তবে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে জুতা নিক্ষেপের ঘটনাকে প্রকৃতির অঙ্ক দিয়ে মিলানো যাবে কি? প্রকৃতির অঙ্ক বলতে আপনি কর্মফলকে মিন করছেন মনে হচ্ছে। আমরা কথাপ্রসঙ্গে হামেশা বলে থাকি,- যেমন কর্ম তার তেমন ফল মানুষের কপালে জোটে। ইংরেজি টিট ফর ট্যাট কথাটি আরো সরাসরি অর্থ প্রকাশ করছে সেখানে। আপনি যদি এমন কাজ করেন যেটি অন্যের ক্ষতির কারণ হয়েছিল, আজ-নয়-কাল তার বদলা আপনি অথবা আপনার ওয়ারিশান পাবে ইত্যাদি। সুতরাং লোকজন বলে থাকেন,- ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। আপনি এখন একে প্রকৃতির অঙ্ক উপমায় গদ্যবন্দি করেছেন। নিজ জীবনের টুকরো কোলাজ দিয়ে কর্মফলের ভালোমন্দ আপনার কাছে কেমন তার ব্যাপারে পাঠককে বার্তাটি জানান দিচ্ছেন। পড়তে বেশ লাগছে। ঠিকঠাক লাগছে বিলক্ষণ। গদ্যের শেষ প্যারায় এসে ছন্দপতন ঘটছে মনে হলো। কেন সেকথা আমার মতো বলার চেষ্টা করব। আশা করি ভেবে দেখবেন। 

বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে জুতা নিক্ষেপের ঘটনায় আপনার শরীর রক্তশূন্য বোধ করার কারণ আমার বুঝে আসেনি! অনুভূতির প্রকাশটি এখানে সুন্দর, তবে আগেপরে যা বলেছেন, তার সঙ্গে স্ববিরোধী মনে হলো। রক্তশূন্য বোধ করার অনুভূতি জানান দেওয়ার ঠিক পরের লাইনে আপনি লিখছেন : আজকের এই দৃশ্য একজনের পাওনা বুঝিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতি, আর বাচ্চারা তাদের হিসেব তুলে রাখছে হালখাতায়। মানে দাঁড়াচ্ছে,- বঙ্গবন্ধু যেমন কর্ম করে গেছেন, এখন সে-মোতাবেক ফল পাচ্ছেন; অথবা উনার কন্যা তাঁকে নিয়ে যেসব কাণ্ড করেছেন, প্রকৃতি এখন তার ফল সুদে-আসলে পুষিয়ে দিচ্ছে। তাই যদি হয় তাহলে বঙ্গবন্ধুর গালে জুতো নিক্ষেপের ঘটনায় আপনার আহত হওয়ার কারণ থাকে না। প্রকৃতির অঙ্কে এটি প্রাপ্যই ছিল এবং তিনি সেটি পাচ্ছে। যারা তাঁকে জুতা নিক্ষেপ করেছে, তাদের জন্য হয়তো সেরকম কিছু সামনে অপেক্ষা করে আছে। বিষয়টি যদি শোধ উধারের ঘটনা হয়ে থাকে তাহলে শরীর রক্তশূন্য টের পাওয়ার সঙ্গে প্রকৃতির পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার অঙ্কটা মিলানো যাচ্ছে না। 
ধরে নিচ্ছি, শেখ মুজিবের প্রতি গোপন সহানুভূতি আপনার মনে এখনো জীবিত। একটি ভূখণ্ডকে স্বাধীন করার লড়াইয়ে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেই সুবাদে বঙ্গবন্ধু ও পরে জাতির পিতা হিসেবে তাঁকে সম্মানিত করা হলো। আরো বহু বিশেষণে তাঁকে চিহ্নিত হতে দেখেছি আমরা নানান সময়। আপনার মনে এসব স্মৃতি সক্রিয় থাকায় তাঁর প্রতি আবেগ ও বিবেচনা মনে কমবেশি কাজ করছে। কাজ যদি করে থাকে তাহলে তাঁকে সরাসরি বঙ্গবন্ধু বা জাতির পিতা নামে ডাকতে আটকাচ্ছে কেন? 

গদ্যের শেষ প্যারায় এসে দেশপ্রধান বলে আপনি তাঁকে সম্বোধন করেছেন। কেন? দেশপ্রধান সুন্দর একটি শব্দ। ব্যবহারে মহাভারত অশুদ্ধ হচ্ছে না কিছু। কিন্তু প্রকৃতির অঙ্ক মিলানোর জায়গা থেকে যখন শব্দটিকে ভাবছি, দুঃখিত,- ব্যবহারটিকে নিছক সোজাসরল সম্ভাষণ ভাবা সম্ভব হচ্ছে না। এর মধ্য দিয়ে আপনি নিজের মনোভাব প্রকাশ করছেন। শেখ মুজিবকে নিয়ে নিজের দ্বিধা ও বিরাগ একসঙ্গে প্রকাশ্য করে দিচ্ছে শব্দটি। শেখ মুজিবুর রহমানকে যারা বঙ্গবন্ধু বা জাতির পিতা বলে মানবে না এই পণ করেছে, না মানার পেছনে নিজের মতো করে বয়ান ও যুক্তি দিচ্ছে হামেশা,- কবি যেন-বা জেনে অথবা না জেনে তাদের কথাগুলোকে মনের মণিকোঠায় সযত্নে পুষেছেন এতদিন! বেচারা শেখ মুজিবকে নিয়ে কাজেই দোটানায় পড়তে দেখছি তাঁকে। 

দেশকে স্বাধীন করার লড়াইয়ের শেখ মুজিবের ভূমিকা ও অবদানকে ফরহাদ মজহারের মতো সোজা নাকচ করার হ্যাডম কবি এখানে দেখাতে পারছেন না। অন্যদিকে যারা তাঁকে একশো যুক্তি খাড়া করে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে দিতে চাইছে, তাদের যুক্তিগুলোও নাকচ করা তাঁর পক্ষে কঠিন মনে হচ্ছে। তারা যা বলছে তার সারবত্তা যাচাইয়ের জন্য আরো যত বয়ান বিদ্যমান, এখন সেগুলো আমলে নেওয়ার মতো অবস্থায় কবিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। মাঝখান থেকে দোটানাবন্দি দেখাচ্ছে তাঁকে। দোটানা থেকে বের হতে অগত্যা যত দোষ নন্দ ঘোষের মতো বেচারা মুজিব ও তার কন্যা হাসিনার ঘাড়ে দায় চাপিয়ে নিজের দায়মুক্তি নিতে চাইছেন কবি। প্রকৃতির অঙ্ক দিয়ে হিসাব রফা করছেন। ঘটনা কি এতটা সরল? 

যারা আজ শেখ মুজিবকে জুতো মারছে তারা কারা? কী তাদের পরিচয়? দেশের আটারো কোটি মানুষকে কি তারা প্রতিনিধিত্ব করে? যদি করে থাকে তাহলে মানতে হবে, দেশের আটারো কোটি মানুষ শেখ মুজিবকে জুতাপেটা করার পক্ষে আছে। লোকটি বা তার মেয়ে এতদূর জঘন্য,- শাস্তি তাদের প্রাপ্য। বাস্তবতা কি সেরকম আসলেই? যেমন ধরা যাক, দেশের আটারো কোটি মানুষের মধ্যে বড়ো একটি অংশ পাওয়া যাবে যারা নানা কারণে শেখ মুজিবকে পছন্দ করে না। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি নিশ্চয় ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে ছিলেন না। ছোটবড়ো অনেক ভুলভ্রান্তি করেছেন বৈকি। ওসব কারণে অন্যায় ঘটনাও ঘটেছে সেইসময়। এর জন্য তাঁকে সমালোচনা করেছেন অনেকে। শেখ মুজিবের সমালোচনা অতীতে হয়েছে; এখনো হচ্ছে; এবং ভবিষ্যতেও হবে। যারা এই সমালোচনাগুলোকে যৌক্তিক গণ্য করে থাকেন তারা এজন্য তাঁকে অপছন্দ করতেই পারেন। আমি তাতে সমস্যার কারণ দেখি না। 

শেখ মুজিবের প্রতি বিরূপ লোকগুলোকে যদি বলা হয়,- আপনারা একজন-একজন করে তার ছবিতে জুতার বাড়ি মেরে আসেন। কি মনে হয়, সকলে তা করতে ছুটবে? না, ছুটবে না। কাউকে অপছন্দ করা ও তার ব্যাপারে সমালোচনা থাকার মানে এই নয়, তাকে যাচ্ছেতাই অপমান করতে হবে। অপছন্দ ও ঘৃণা সম্পূর্ণ পৃথক দুটি বিষয়। যুক্তিসংগত সমালোচনা আর বানোয়াট সমলোচনা যেমন কদাপি এক নয়। সুতরাং ওই লোকগুলো শেখ মুজিবকে কঠিন ভাষায় আক্রমণ করলেও তাঁকে প্রকাশ্যে অপমানের মহড়ায় অংশ নেবে না। 
Bangladesh nationalist poster depicting atrocities at the hands of the Pakistani army in 1971; Source: origins.osu.edu
এখন আসেন এই সিনটা আমরা ভাবি,- শেখ মুজিবকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে ঘৃণা করে এরকম লোকজনকে একই কাজ করতে বলা হলো। তারা কি সেটি করবে? ঠাণ্ডা মাথায় যদি সিনটা ভাবি তাহলে সেখানে দুটি প্রবণতা ঘটতে দেখার সম্ভাবনা থাকছে। ঘৃণায় ফুঁসছে এমন লোকজনের একটি অংশ তথাপি কাজটি করবে না। তারা ভাববে,- এর মধ্য দিয়ে তো শেখ মুজিবের কাতারে নিজেকে আমরা নামিয়ে দিচ্ছি। ঘৃণা থাকলে শোধ তুলতে হবে বা প্রকৃতির অঙ্কে কেউ শোধ তুলবে… এরকম নাও হতে পারে। 

তবে হ্যাঁ, বাকি অংশ কাজটি করবে। কেন করবে? পেছনের কারণ জটিল কিছু নয়। শেখ মুজিবকে তারা এমন এক শত্রু বলে জানে যার কারণে বাংলাদেশে তাদেরকে এখনো রাজাকার ভাবা হয়। এই দেশে তাদের আত্মপরিচয় যে-কারণে তারা ঠিকঠাক দাঁড় করাতে পারছে না। সোজা কথায় তারা বা তাদের পূর্বসূরীরা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ছিল তখন। ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতা ভাঙার খলনায়ক হিসেবে মুজিবকে তারা চিহ্নিত করেছে। সুতরাং পাকিস্তান ভেঙে যাক এটি তারা মেনে নিতে পারেনি। অখণ্ডতা রক্ষায় এমনসব কাজ তারা সেইসময় করেছিল, যা তাদের পিঠে রাজাকার ট্যাগকে মুছতে দিচ্ছে না। শেখ মুজিব সংগতকারণে তাদেরকে পরে মাইলেজ দেননি। আর মুজিবকন্যা তো পরে তাদের যারা মুরব্বি, সেগুলোকে শূলে চড়িয়েছেন। দমিয়ে রাখতে চেষ্টার ত্রুটি করেননি। 

দমন করা সঠিক না বেঠিক ছিল সে-আলোচনা সম্পূর্ণ আলাদা প্রসঙ্গ। তবে এটি মানতে হবে,- একটি দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে যারা পরিষ্কারভাবে বিরোধী ও ধ্বংসাত্মক ভূমিকা পালন করে তাদেরকে পৃথিবীর কোথাও মাইলেজ দেওয়া হয় না। শেখ মুজিবও দেননি। তাঁর কন্যা হাসিনাও তাই। এরকম লোকজনকে কী করা হয়? বিচারের জন্য আদালতে তোলা হয়। বিচার শেষে শাস্তি ভোগ করে তারা। যত ত্যানা প্যাঁচাই না কেন, এখানে কোনো রকেট সায়েন্স নেই। বাংলাদেশে সিম্পল কাজটি হিমালয় পাহাড় ডিঙানোর মতো কঠিন করতে দেখেছি আমরা। স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে এরকম লোকজন ও সমর্থকে ভরা দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের পরস্পবিরোধী সংঘাত কাজটিকে কঠিন করে তুলেছিল। এর জন্য দুল দুটিকে সমালোচনা সহ্য করতে হচ্ছে, এবং আগামীতেও সহ্য করতে হবে। লোকগুলো সেই সুবাদে দেশে জাঁকিয়ে রাজ করেছে সবসময়। আর এখন তো তারা ক্ষমতা দখলের পথে আছে। সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার ফায়দা উঠাচ্ছে ষোলআনা। 
Bangladesh Quota Protests – Who Were the Razakars? – 1971 Legacy; Source – News 9 YTC
মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বিজড়িত চিহ্নগুলো মুছে দিতে তারা দেরি করছে না। তাদের এই শোধ তোলাকে কবি এখন কোন আক্কেলে প্রকৃতির অঙ্ক দিয়ে মিলাচ্ছেন, সেটি মাথায় ঢোকেনি! কবিতার রসে চোবানো গদ্যে তাদেরকে সফট মাইলেজ দেওয়ার মানে হচ্ছে কবি এখন তাদের বানোয়াট বয়ানকে প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিচ্ছেন। সেইসঙ্গে বাদবাকি বয়ানের কোনো মূল্য তাঁর কাছে নেই। প্রকৃতির অঙ্ক দিয়ে মিলানোর অর্থ হলো কবি মেনে নিচ্ছেন,- একাত্তরে যারা জনযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তারা সঠিক। তাদের ওপর অন্যায় অপবাদ দেওয়া হয়েছে তখন। বানোয়াট বয়ান দিয়ে তাদেরকে পচানো হয়েছিল, এবং সেই সুবাদে প্রকৃতি তাদের হয়ে শোধ তুলছে। 

আওয়ামী লীগের জামায়াতকে নিয়ে রাজনীতির গুঁটি চালাচালি আর একটি আস্ত একাত্তর সন ও তার আগে-পরের ঘটনা তো এক নয়। কবি মনে করি সেটি ভুলে গেছেন এখানে। এভাবে অঙ্ক মিলানো মানে হচ্ছে ওই লোকগুলোকে মাইলেজ দিতে থাকা। কবি মন চাইলে সেটি দিতেই পারেন। এই স্বাধীনতা তাঁর আছে। তবে সেক্ষেত্রে জন্ম-পিতার যে-উপমা গদ্যের শুরুতে তিনি দিয়েছেন, সেখান থেকে তাঁর সরে দাঁড়ানো উচিত ছিল। অনুভব ও ভাবনার সঙ্গে এটি বৈপরীত্য তৈরি করছে। 

কথা পরিষ্কার,- শেখ মুজিবকে যারা জুতা ছুড়ে মারছে তারা কি আমাদের অচেনা? তাদের বাপদাদারা কী ছিল? কী করেছে তারা তখন? এখন কী করতে যাচ্ছে তারা? এসব কি আমরা জানি না? এসব বোঝা কি রকেট বানানোর মতো জটিল অঙ্ক? শেখ মুজিব বা হাসিনা যদি তাদের শায়েস্তা করেও থাকে, করাটা কি ভুল ছিল? কাজটি করে বিরাট কোনো অন্যায় কি তারা করেছেন? যদি করে থাকেন তাহলে মানতে হবে, বাংলাদেশের জন্ম ভুল, এবং এর জন্য শেখ মুজিবসহ বাকিদের শূলে চড়ানো উচিত ছিল। 

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি নিয়ে হাসিনাপার্টি চেতনব্যবসা করেছে, শেখ মুজিব স্বয়ং জাতিকে সঠিক দিকনির্দেশনায় এগিয়ে নেওয়ার মতো পরিস্থিতিতে থাকতে পারেননি... এসব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কমবেশি হয়েছে, সামনেও হবে। সেইসঙ্গে এটিও সত্য,- দেশবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণদের ষড়যন্ত্র থেকে আরম্ভ করে হাজার সব কূটচাল সবসময় দেশে সক্রিয় ছিল। এখন সেটি এতটাই পরিষ্কার, তারা কে বা কেন এসব করছে, সেটি বাচ্চাও বোঝে। কবি কি বোঝেন না? যদি বোঝে থাকেন তাহলে বেচারা মুজিবের ঘাড়ে সকল দায় চাপিয়ে তাদেরকে ছাড়পত্রটি দিচ্ছেন কেন? কথাটি অগত্যা আবার রিপিট করতে হচ্ছে এখানে। জামায়াত ও চিংকু বাম প্রযোজিত বয়ান দিয়ে শেখ মুজিবকে কবি দেখছেন। অন্য বয়ান হাতে নিয়ে যাচাইয়ের মানসিক অবস্থা তাঁর বা আরো অনেকের এই মুহূর্তে নেই। 
The conflict between 1971 and 2024; Source – ATN News
আমরা চাইছি, এসব ভুলেটুলে মার কাটকাট দেশকে সামনে এগিয়ে নেবো। পারবেন না ভাই, পারবেন না। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের জন্মের সঙ্গে যেসব জটিলতা ক্রমশ অকাট্য হয়েছে, তার একটি পরিষ্কার রাজনৈতিক মীমাংসায় ছাড়া দেশকে একপাও এগিয়ে নেওয়া যাবে না। কমন ঐক্যমত্য লাগবে সেখানে। এবং সেই কমনের মধ্যে যারা আজ পর্যন্ত নিজের ভূমিকার জন্য লজ্জিত হয়নি, উলটো নানা ছুতোয় একে জাস্টিফাই করেই যাচ্ছে, এবং যারা বিশ্ব কোনদিকে যাচ্ছে তার কিছু আমলে না নিয়ে পেছনের দিকে দেশকে ফেরত নিতে মরিয়া,- তাদের ব্যাপারে জাতিকে সুরাহায় পৌঁছাতে হবে। এটি বেসিক, এবং একে উপেক্ষা করে কোনো জাতি কখনো সামনে অগ্রসর হয়নি। 

আজ যারা শেখ মুজিবের গ্রাফিতিতে জুতো নিক্ষেপ করছে, তাদের ভ্রান্ত বয়ানকে চিনতে ও কঠিন ভাষায় প্রতিরোধের সবক আমরা নিতে ভুলে গেছি। মেরুদণ্ডহীন কবিলেখকের দলে ভিড়ে নাকিকান্না করছি সবাই। জামায়াতের প্রেত যেসব যুবাদের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে, তাদেরকে কড়া ভাষায় আঘাত হানার হ্যাডম আমাদের নেই। কড়া ভাষায় আঘাত হানলে সেটি কবিতা হবে না এমন তো না! অন্তত আমি সেটি মনে করি না। দেশের ক্রান্তিকালে সাহিত্যের ভাষাকে প্রয়োজনে মারমুখী হয়ে উঠতে হয়, এছাড়া ধাক্কা প্রবল হয় না। 
. . . 
Sheikh Mujibur Rahman and Siraj Sikdar – Graffiti Vandalism; Image Source – Google Image

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

2 Comments on “রংধনুর রং কতটা স্তরে থাকতে হয়?

  1. প্রয়োজনে সাহিত্যের ভাষাকেও মারমুখী হয়ে উঠতে হয়। একদম। ভীষণ ভালো লাগলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *