সাহিত্যবাসর

শেষ উত্তর

শেষ উত্তর
আইজ্যাক আসিমভ
ভাষান্তর : মোস্তাফিজুর রহমান জাভেদ

Painting of Asimov on his throne by Rowena Morill; Source – Google Image

মারে টেম্পলটনের বয়স তখন পঁয়তাল্লিশ। জীবনের মধ্যগগনে পা দিয়েছে। করোনারি ধমনীতে কিছু জটিলতা বাদ দিলে শরীর ঠিকঠাক চলছিল। কপাল! করোনারির জটিলতাই কাল হলো তার।

ব্যথা হানা দিলো হঠাৎ, চূড়ায় উঠল, তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়েও গেল সে! মারে টের পেলো তার শ্বাস ধীরলয়ে চলছে, যেন শান্ত ঢেউ তাকে ভিজিয়ে চলে যাচ্ছিল।

ব্যথা দেখা দেওয়ার পরমুহূর্তে সেটা নেই টের পাওয়ার মতো সুখ আর কিছুতে জোটে না। মাথা হঠাৎ চক্কর দিলে যেমন হয়, সেরকম হালকা হয়ে সে যেন বাতাসে ভাসছিল।

সে চোখ খুলে তাকাল, এটা লক্ষ্য করে আমোদ জাগল মনে,- ঘরের ভিতরে যারা ছিল তারা যথারীতি ব্যস্ত আর উদ্বিগ্ন। ল্যাবে কাজ করার সময় কিছু বুঝে ওঠার আগে ব্যথাটি আঘাত হানে। টলমল পায়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার সময় অন্যদের চিৎকার তার কানে আসছিল, আর কিছুতেই ঠেকানো সম্ভব নয় এমন এক ব্যথায় চারপাশটা তখন অদৃশ্য হয়ে গেল। ব্যথা এখন বিদায় নিলেও বাকিরা উদ্বিগ্ন মুখ করে এখনো তার চারপাশে যেন ভেসে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ বুঝতে পারল, সে আসলে ওপর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল।

নিচে তার বিধ্বস্ত বিকৃতমুখ দেহ পতিত পড়ে আছে। ওপর থেকে শান্ত ও নিশ্চিন্ত মনে সে সব দেখতে পাচ্ছিল।

সে ভাবল, ‘এ তো দেখছি অলৌকিককেও হার মানাবে! পরকাল নিয়ে উন্মাদরা তো দেখছি ঠিক কথাই বলত!’

একজন অবিশ্বাসী পদার্থবিদের এভাবে মারা যাওয়াটা লজ্জাজনক, তবু সে তাতে খুব বেশি অবাক হলো না, আর যে-শান্তিতে সে ডুবেছিল তাতে তেমন হেরফেরও ঘটল না।

সে ভাবল, ‘ফেরেশতা টাইপ কিছু তো আমায় দেখা দেওয়ার কথা!’

পার্থিব দৃশ্যগুলো ধীরে-ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে। অন্ধকার তার চেতনাকে ঢেকে দিলো; দূরে কোথাও শেষ আলোকবিন্দুর মতো মনুষ্যপ্রায় আবছায়া দেহধারী জ্বলজ্বলে আলোকরশ্মি উষ্ণতা বিকরণ করছিল।

মারে ভাবে, ‘তামাশা হচ্ছে আমাকে নিয়ে! আমি তাহলে বেহেশতে যাচ্ছি।’

তার ভাবনার মধ্যেই আলো তার উষ্ণতাটুকু রেখে ঝাপসায় মিলিয়ে গেল। ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে যদি কেবল সে আর ওই কণ্ঠস্বর থাকতম- শান্তি একটুও হ্রাস পেত না।

কণ্ঠস্বর বলে ওঠে, ‘এটা আমি প্রায়ই করে থাকি, আর প্রতিবার তাতে তৃপ্তি অনুভব করার ক্ষমতা আমার রয়েছে।’

মারের কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু মুখ, জিহ্বা বা কণ্ঠস্বরের কোনোটাই তার দখলে ছিল না। কিছু একটার সঙ্গে ঘঁষা খেয়ে অস্ফুট গুঞ্জনধ্বনি অথবা শ্বাস টানার মতো শব্দ কেবল বেরিয়ে এলো।

মারে : ‘এটা তাহলে স্বর্গ?’

কণ্ঠস্বর : ‘স্থান বলতে তুমি যেমনটা বোঝো, এটা সেরকম কিছু নয়।’

মারের অস্বস্তি হলেও পরের প্রশ্নটি তাকে করতেই হতো, ‘আমি যদি গাধার মতো কিছু বলে থাকি তাহলে আমাকে ক্ষমা করুন। আপনি তাহলে ঈশ্বর?’

স্বরভঙ্গিতে একটুও হেরফের ঘটে না অথচ শুনে খুব মজা পাচ্ছে এমন একখানা ভাব নিয়ে কণ্ঠস্বর বলে ওঠে, ‘আশ্চর্যের বিষয় হলো অগণিতবার অসংখ্য উপায়ে প্রশ্নটি আমাকে সারাক্ষণ শুনতে হয়। একটি উত্তরও আমার কাছে নেই যেটি শুনে তুমি খুশি হতে পারো। আমি আছি এটা হচ্ছে ব্যাপার;- তুমি যেভাবে চাও আমায় ভাবতে বা ডাকতে পারো।

মারে : ‘আমি তাহলে কী? আমি কি আত্মা? অস্তিত্বের মূর্ত কোনো রূপ?’ তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল বিদ্রুপ করার কোনো ইচ্ছা না থাকলেও একে সে এড়াতে পারছে না। পরিহাস আটকাতে ‘আপনার অনুগ্রহ’ বা ‘হে পবিত্র’ জাতীয় কিছু একটা যদি সে বলত তাহলে ঠিক ছিল, কিন্তু তা সে বলতে পারল না, এমনকি এটাও ভাবতে পারল না,- এই ঔদ্ধত্য বা পাপের জন্য তার নরকবাস হতে পারে, আর সেটা কেমন হবে কে জানে!

কণ্ঠস্বর একটুও ক্ষুব্ধ হলো না, ‘তোমাকে বোঝা ও বোঝানো দুটোই সহজ। যদি ভাবো এতে তুমি তুষ্ট হবে তাহলে নিজেকে আত্মা ভাবতে পারো; যদিও তুমি হচ্ছো তড়িৎচৌম্বক বলের যোগসূত্রে গাঁথা, এটা এতটাই গোছানো,- মহাবিশ্বে তোমার অস্তিত্বের ক্ষুদ্রতম খুঁটিনাটির প্রতিরূপকে মস্তিষ্কে ধারণ করে। যার ফলে তোমার মধ্যে চিন্তাশক্তি, স্মৃতি ও ব্যক্তিত্ব রয়েছে। তোমার মনে হয় যে এ হচ্ছো তুমি।’

মারের বিশ্বাস হচ্ছিল না, ‘তার মানে, আমার মস্তিষ্কের সারবস্তু চিরস্থায়ী?’

‘মোটেও না। তোমার মধ্যে চিরস্থায়ী বলে কিছু নেই, যতক্ষণ না আমি সেরকম কিছু করছি। আমি এই যোগসূত্র তৈরি করেছি। তুমি বাস্তবে দেহ ধারণ করার সময় আমি একে গড়ে তুলেছি, এবং দেহ যখন আর থাকছে না, তখন সমন্বয়ও করছি।’

কণ্ঠস্বরকে নিজের ওপর সন্তুষ্টই মনে হলো, ক্ষণিক বিরতি নিয়ে বলতে শুরু করে, ‘অতিব জটিল কিন্তু নিখুঁত এই নির্মাণ। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্য আমি এটা করতে পারতাম, কিন্তু একথা ভেবে ভালো লাগছে,- আমি তা করি না। বেছে নেওয়ার মধ্যে তৃপ্তি রয়েছে।’

‘তাহলে আপনি অল্প কিছু মানুষকে বেছে নিচ্ছেন?

‘খুবই অল্প।’

‘বাকিদের কপালে তাহলে কী থাকছে?’

‘তারা বিস্মরণের গর্ভে বিলীন হয়; আর হ্যাঁ, তোমরা বোধহয় একেই নরক বলে কল্পনা করে থাকো।’

Isaac Asimov Quote; Source – Google Image

মারের যদি রক্তমাংসের শরীর থাকত তাহলে তার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠত। সে বলে ওঠে, ‘আমি সেরকম ভাবি না। লোকজন অবশ্য এরকম বলাবলি করে। এখনো, আমি ভুলেও ভাবব না,- বেছে নেওয়া লোকদের একজন হিসেবে বিবেচিত হওয়ার মতো কোনো পুণ্য আমি সঞ্চয় করেছি।’

‘পুণ্যবান? আহা, বুঝলাম। তোমরা যেমনটি ভেবে থাকো, তাতে যদি আমাকে সম্মতি জানাতে হয় তাহলে নিজের চিন্তাকে জোর করে সংকীর্ণ করতে হবে, আর আমার জন্য সেটা বিড়ম্বনা। চিন্তা করার সক্ষমতা রয়েছে দেখে আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি। মহাবিশ্বের অযুত বুদ্ধিমান প্রজাতি থেকে এরকম দু-চারজনকে আমি বাছাই করি।’

মারে হঠাৎ উৎসুক হয়ে ওঠে। এটি তার আজীবনের অভ্যাস। সে বলে, ‘আপনি একা সব করেন, নাকি আপনার মতো আরো আছে সেখানে?’

সেই মুহূর্তে মারের মনে হচ্ছিল কন্ঠস্বরটি হয়তো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে, কিন্তু অবিচল কণ্ঠে জবাব আসে, ‘আমার মতো আরো আছে নাকি নেই সেটা নিয়ে তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে। ব্রহ্মাণ্ড আমার,- শুধুই আমার। আমি তাকে সৃষ্টি করেছি, এটি আমার নির্মাণ, আমার উদ্দেশ্য হাসিল করা তারও উদ্দেশ্য।’

মারে বলল, ‘অযুত যোগসূত্র থাকার পরেও আপনি আমাকে সময় দিচ্ছেন। আমি কি এতটাই গুরুত্ব রাখি?’

কণ্ঠস্বর : ‘তুমি মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নও। একইভাবে অন্যদের সঙ্গেও আমি আছি, তুমি যা একযোগে ঘটছে বলে ভাবো।’

‘আর তা-সত্ত্বেও আপনি বলতে কেবল একজনকে বুঝতে হবে?’

আবারো হাসির আভাস পেল সে, ‘তুমি আমাকে বিপদে ফেলতে চাইছো। তুমি যদি একটি অ্যামিবা হও, যে তার স্বকীয়তাকে এককোষী প্রাণীর মতো করে বোঝে, আর ত্রিশ হাজার কোটি কোষ দিয়ে গড়া তিমির কথা যদি ভাবো, সংখ্যা এখানে এক অথবা অসংখ্য হতে পারে,- তিমি এখন কীভাবে উত্তরটি দিতে পারত যেটি শোনার পরে অ্যামিবার মনে হবে সে তা বুঝতে পেরেছে?’

মারের গলা শুকিয়ে আসে, ‘আমি যদি উত্তরটি নিয়ে ভাবি তাহলে হয়তো বুঝতে পারব।’

‘ঠিক ধরেছো। এটাই তোমার কাজ। তুমি ভাববে।’

‘কেন ভাবব? আমার ধারণা আপনি সবটাই জানেন।’

কণ্ঠস্বর : ‘যদি আমি সমস্তটা জানি তবু কখনো নিশ্চিত হতে পারব না যে আমি সত্যি-সত্যি সব জানি।’

মারে : ‘প্রাচ্যে যে-দর্শনের চর্চা হয়, তার মতো লাগছে শুনে। শোনার সময় গভীর মনে হয় কিন্তু আসলে তার কোনো মানে থাকে না।’

কণ্ঠস্বর : ‘তুমি প্রতিশ্রুতিশীল। আমার বিভ্রান্তিকে অন্য আরেকটি বিভ্রান্তি দিয়ে মোকাবিলা করছো, তবে আমি যা বলছি সেটা কোনো ভ্রান্তি নয়। ভাবো, আমি চিরকাল ধরে আছি; এখন এই কথার মানে কী দাঁড়ায়? মানে হলো, আমার অস্তিত্বলাভের শুরু আমি নিজে মনে রাখতে পারিনি। মনে রাখলে কিন্তু চিরন্তন থাকতে পারতাম না। আমার জন্ম যদি অজানা হয় তাহলে একটি ব্যাপার অন্তত দাঁড়ায়,- আমি কীভাবে জন্ম নিয়েছিলাম তার উপায়টি আমার অজানা।’

Isaac Asimov “I don’t need God to be Moral! I have a conscience!” Source – Daily Dose of Wisdom YTC

‘এছাড়া, আমি যা জানি তারা যদি অসীম হয়ে থাকে তাহলে যা জানার বাইরে রয়েছে তারাও অসীম হবে; আর আমি কী করে নিশ্চিত হবো যে উভয় অসীম এখানে সমান? জানার সম্ভাব্য অসীমতা আমি আসলে যা জানি তার অসীমতা থেকে বৃহৎ হতে পারে। সহজ উদাহরণ দেই,- সকল জোড় সংখ্যার কথা যদি আমার জানা থাকে তাহলে আমি অসীম সংখ্যাক জিনিসকে জানতে পারতাম, তা-সত্ত্বেও কোনো বিজোড় সংখ্যা জানা থাকত না।’

মারে : ‘কিন্তু বিজোড় সংখ্যা তো নির্ণয় করা সম্ভব। আপনি যদি প্রতিটি জোড় সংখ্যাকে দুই দিয়ে ভাগ করেন তাহলে আরেকটি অসীম সংখ্যক শ্রেণি পাবেন, যার মধ্যে বিজোড় সংখ্যার অসীম ধারা বিরাজ করছে।’

কণ্ঠস্বর : ‘তুমি ধরতে পেরেছো। আমি সন্তুষ্ট। তোমার কাজ হবে এমন আরো উপায় খুঁজে বের করা, আরো কঠিন কোনোকিছু,- জানা থেকে এখনো অজানা এমন কিছু। তোমার স্মৃতিশক্তি থাকবে। তুমি যা-কিছু সংগ্রহ করেছো, শিখেছো অথবা যার থেকে কিছু নির্ধারণ করেছো, সব স্মরণ থাকবে। প্রয়োজন হলে তুমি সেই তথ্য জানতেও পারবে, যেটি তোমার সমস্যা সমাধানে সাহায্য করবে।’

‘আপনি কি নিজে এসব করতে পারতেন না?’

কণ্ঠস্বর : ‘আমি পারি কিন্তু এভাবে করাটা আরো মজাদার। ব্রহ্মাণ্ড আমি সৃষ্টি করেছি, যেন একে সামলানোর জন্য আমার হাতে আরো তথ্য থাকে। আমি এতে অনিশ্চয়তার নীতি, এনট্রপি, এবং অন্যান্য এলোমেলো সব উপাদান জুড়ে দিয়েছি, যেন সবকিছু তৎক্ষণাৎ নির্দিষ্ট হতে না পারে। ভালোই কাজে দিচ্ছে তা, এবং অস্তিত্বের পুরো সময় জুড়ে আমাকে আনন্দিত করে চলেছে।

‘তারপর আমি এমন জটিলতা সৃষ্টি করলাম যেটি প্রথমে জীবন এবং পরে বুদ্ধিমত্তার জন্ম দিলো, এবং এগুলোকে গবেষণায় নিয়োজিত কোনো দলের মতো ব্যবহার করলাম;- এ-কারণে নয় যে আমার সাহায্যের দরকার ছিল, এলোমেলো নতুন উপাদানগুলো জুড়তে কাজটি করেছি আমি। দেখা গেলো,- নতুন কোনো আকর্ষণীয় তথ্য ঠিক কোথা থেকে আসবে বা তারা কীভাবে নির্ণীত হবে সেটা আমার পক্ষে আন্দাজ করা সম্ভব হচ্ছে না।’

মারে : ‘তা কি হয় কখনো?’

কণ্ঠস্বর : ‘নিশ্চয় হয়। শতাব্দী পার হওয়ার আগেই একটি-না-একটি আকর্ষণীয় তথ্য প্রকাশ পায়।’

মারে : ‘তার মধ্যে কিছু এমন যেটি আপনি নিজে ভাবতে পারতেন, অথচ ভাবেননি?’

কণ্ঠস্বর : ‘হ্যাঁ।’

মারে : ‘তাহলে আপনি কি মনে করেন আমি আপনাকে এরকম কিছু উপহার দিয়ে চমকে দিতে পারব?’

কণ্ঠস্বর : ‘আগামী এক শতাব্দীর মধ্যে? মনে হয় না সম্ভব। তবে দীর্ঘ সময়কে হিসাবে নিলে তোমার সাফল্য অনিবার্য, কারণ তুমি অনন্তকাল সক্রিয় থাকছো।’

মারে : ‘আমি অনন্তকাল ধরে চিন্তা করে যাব? চিরকাল?’

কণ্ঠস্বর : ‘হ্যাঁ।’

মারে : ‘কীসের জন্য?’

কণ্ঠস্বর : ‘আমি তো বলেছি,- নতুন জ্ঞান খুঁজে বের করতে তুমি এটা করবে।’

মাারে : ‘কিন্তু তার বাইরে? কোন উদ্দেশ্য পূরণে নতুন জ্ঞান আমি খুঁজব?’

কণ্ঠস্বর : ‘কাজটি অতীতে তুমি করেছো। তার তখন কী উদ্দেশ্য ছিল?’

Isaac Asimov; Image Source – Google Image

মারে : ‘নতুন জ্ঞান অর্জন করা, যেটি কেবল আমিই অর্জন করতে পারতাম। সহকর্মীদের বাহবা পাওয়া। আমার জন্য অল্প সময় বরাদ্ধ আছে জেনে কিছু অর্জনের আনন্দ ভোগ করা। এখন আমি কেবল সেই জ্ঞান অর্জন করব যেটি ইচ্ছে করলে আপনি নিজে অর্জন করতে পারতেন। আপনি আমার প্রশংসা করবেন না, কেবল বিনোদিত হতে পারবেন। আর যখন আমার কাছে অনন্তকাল ধরে এটা করার সময় থাকছে, তখন অর্জনে কোনো কৃতিত্ব বা তৃপ্তি থাকে না।’

কণ্ঠস্বর : ‘আর তুমি কি চিন্তা ও আবিষ্কারকে মূল্যবান মনে করো না? এটি করার জন্য আর কোনো উদ্দেশ্যের প্রয়োজন আছে বলে ভাবো না?’

মারে : ‘সীমিত সময়ের জন্য হলে হ্যাঁ। চিরকালের জন্য হলে,- না।’

কণ্ঠস্বর : ‘বুঝেছি। তবে, তোমার বেলায় এছাড়া উপায় নেই।’

মারে : ‘আপনি বলছেন আমি চিন্তা করব। সেটা করতে আমাকে আপনি বাধ্য করতে পারেন না।’

কণ্ঠস্বর : ‘আমি তোমাকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতে চাই না। প্রয়োজনও নেই। কারণ, তুমি কিছুই করতে পারবে না, কেবল চিন্তা করতে পারবে। এই হচ্ছে তোমার নিয়তি।’

মারে : ‘যদি তাই হয় তাহলে আমার নিজের জন্য একটি লক্ষ্য আমি ঠিক করে নেবো।’

কণ্ঠস্বর শান্তভাবে বলে ওঠে, ‘সে তুমি করতেই পারো।’

মারে : ‘একটি লক্ষ্য আমি ইতোমধ্যে খুঁজে পেয়েছি।’

কণ্ঠস্বর : ‘জানতে পারি সেটা কী?’

মারে : ‘আপনি তো আগে থেকে সব জানেন। আমরা সাধারণ কোনো কথা বলছি না। আপনি আমার চেতনাপ্রবাহ এমনভাবে সুসমঞ্জস করেছেন, আমার মনে হতে থাকে আমি শুনছি ও কথা বলছি, কিন্তু আপনি সরাসরি আমার ভাবনা নিজে নিয়ে নিচ্ছেন। ভাবনায় যখন কোনো পরিবর্তন ঘটে, আপনি সঙ্গে-সঙ্গে জানতে পারেন।’

কণ্ঠস্বর : ‘লোক হিসেবে তুমি যথার্থ। আমি তাতে সন্তুষ্ট বোধ করছি। তবে, আমি চাই তুমি স্বেচ্ছায় নিজের ভাবনাকে প্রকাশ করো।’

মারে : ‘তাহলে বলি,- আমার ভাবনার উদ্দেশ্য হবে আপনি যেটি তৈরি করেছেন, সেই সংযোগটি ভেঙে ফেলা। আমি শুধু আপনাকে বিনোদন যোগানোর জন্য ভাবতে চাই না। আমি চিরকাল ধরে চিন্তা করতেও চাই না। কেবল আপনাকে আনন্দ দিতে চিরকাল বেঁচে থাকার ইচ্ছে করি না। আমার সকল চিন্তা এই সংযোগ ধ্বংস করতে খাটবে। সেটা হবে আমার আনন্দ।’

কণ্ঠস্বর : ‘আমার তাতে আপত্তি নেই। এমনকি তোমার নিজের অস্তিত্বে ইতি টানতে ভাবনার একাগ্রতা নতুন ও আকর্ষণীয় কিছু নিয়ে হাজির হতে পারে। আত্মহত্যার চেষ্টায় নেমে তুমি যদি সফল হও তাহলে কপালে কিছু জুটবে না; কারণ আমি তাৎক্ষণিক তোমাকে নতুন করে গড়ে তুলব, এবং এমনভাবে গড়ব যেন পরে আর আত্মহত্যা করাটাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

আর যদি তুমি অন্য কোনো সূক্ষ্ম উপায়ে নিজেকে ধ্বংস করতে সক্ষম হও, তথাপি আমি পুনরায় তোমাকে সৃষ্টি করব, যেন সূক্ষ্ম এই পথটিও পরে বন্ধ হয়ে যায়। আকর্ষণীয় একটি খেলা হতে পারে এটা, কিন্তু তুমি চিরকাল বেঁচে থাকবে, এই আমার ইচ্ছা।’

মারে একটু কেঁপে উঠলেও তার কণ্ঠ পুরোপুরি শান্ত থাকে। ‘তাহলে, আমি কি নরকে আছি? আপনি বলেছেন নরক বলে কিছু নেই, কিন্তু এটা যদি সত্যি নরক হয় তাহলে আপনি খুব সম্ভব মিথ্যা বলছেন, কারণ নরকের খেলায় মিথ্যা বলাটাই স্বাভাবিক।’

কণ্ঠস্বর : ‘যদি তাই হয় তাহলে তোমাকে আশ্বস্ত করার কোনো দরকার আছে যে তুমি নরকে নেই? তবু আমি তোমায় আশ্বস্ত করছি। স্বর্গ-নরক কিছু নেই এখানে;- কেবল আমি আছি।’

মারে : ‘তাহলে একবার ভাবুন, যদি আমার ভাবনাগুলো আপনার কাছে নিরর্থক মনে হয়? যদি আমি মূল্যবান চিন্তা করতে ব্যর্থ হই,- আমাকে ধ্বংস করা বা আমার পেছনে সময় নষ্ট না করাটা কি আপনার জন্য লাভজনক নয়?

কণ্ঠস্বর : ‘পুরস্কার হিসেবে? তুমি ব্যর্থতার প্রতিদান হিসেবে নির্বাণ চাইছো, এবং নিশ্চিত করতে চাইছো যে তুমি ব্যর্থ হবে? এতে কোনো বিনিময় নেই। ব্যর্থ তুমি হবে না। তোমার সামনে অনন্তকাল পড়ে আছে, সুতরাং ইচ্ছা থাকলেও অন্তত একটি আকর্ষণীয় চিন্তা তুমি করতে পারবে।’

মারে : ‘তাহলে আমি আমার জন্য অন্য কোনো উদ্দেশ্য তৈরি করব। আমি নিজেকে ধ্বংস করার চেষ্টায় যাবো না। আপনাকে লজ্জিত করে তোলাকে বরং নিজের লক্ষ্য বানাবো। আমি এমন কিছু ভাবব, যা আপনি কখনো ভাবেননি; কেবল তাই নয়,- কখনো ভাবতেও পারবেন না। আমি সেই চূড়ান্ত উত্তর খুঁজে বের করব, যার পরে আর কিছু জানার থাকে না।’

কণ্ঠস্বর : ‘তুমি অসীমের প্রকৃতি ধরতে পারেনি। এমন কিছু থাকতে পারে যেটি জানার প্রয়োজন আমি এখনো অনুভব করিনি, তবে এমন কিছু থাকতে পারে না যা আমার অজানা থেকে যাবে।’

মারে গভীর চিন্তা শেষে বলে ওঠে, ‘আপনি আপনার জন্মের ব্যাপারে কিছু জানেন না। আপনি নিজে তা বলেছন। সুতরাং নিজের সমাপ্তি আপনার অজানা। বেশ, তাহলে এটা হবে আমার উদ্দেশ্য;- এটাই হবে চূড়ান্ত উত্তর। আমি নিজেকে ধ্বংস করব না; আমি আপনাকে ধ্বংস করব; যদি না আপনি আমাকে আগে ধ্বংস করেন।’

কণ্ঠস্বর : ‘আহ! তুমি এই সিদ্ধান্তে গড়পরতা সময়ের চেয়ে দ্রুত পৌঁছালে! আমি ভেবেছিলাম বেশি সময় লাগবে। আমার সঙ্গে যারা এই চিরন্তন বুদ্ধিবৃত্তিক অস্তিত্ব যাপন করছে, তাদের মধ্যে একজনও পাওয়া যাবে না যে আমার ধ্বংস কামনা করেনি, কিন্তু এটা অসম্ভব।’

মারে : ‘আপনাকে ধ্বংসের উপায় বের করতে আমার কাছে অনন্তকাল রয়েছে।’

কণ্ঠস্বরটি শান্তভাবে বলে ওঠে, ‘তাহলে চেষ্টা করো ভাবতে।’

তারপর সে মিলিয়ে গেল।

মারের এখন একটি উদ্দেশ্য তৈরি হয়েছে এবং সে তাতে সন্তুষ্ট। কারণ, চিরন্তন অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন কোনো সত্তার আর কী চাওয়ার থাকতে পারে,- শেষ পরিণতি কামনা করা ছাড়া? নিযুত বছর ধরে আর কীই-বা খুঁজতে পারে সে? আর বুদ্ধিমত্তা সৃষ্টি করা ও নির্দিষ্ট কাউকে বাছাই করে কাজে লাগানোর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে, যদি না সেটা ওই মহামহিম অনুসন্ধানের সহায়ক হয়?

মারে ঠিক করল, সেই সফল ব্যক্তি সে হবে;- একমাত্র সে। সাবধানে, এক গভীর উত্তেজনা নিয়ে সে ভাবতে আরম্ভ করল। তার হাতে এখন অফুরন্ত সময়।
. . .

Isaac Asimov vs Religious people 1989; Source – mrnobodysprincess YTC
শেষ উত্তর : অনুবাদকের কৈফিয়ত 

আইজ্যাক আসিমভ বিরচিত শেষ উত্তর গল্পটি ১৯৮০ সনে Analog Science Fiction and Fact-এর জানুয়ারি সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। আসিমভের গল্প সংকলনেও পরে স্থান পায় এটি। ঈশ্বর নিয়ে আমাদের ধারণা, তাঁর সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ক, জীবনাবসানের পরবর্তী ধাপ, বুদ্ধি ও চিন্তার চিরন্তন মূল্য, আর অস্তিত্বের চিরকালীন সারার্থকে ঘিরে দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক সমস্যাগুলোরে মুখোমুখি নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন আসিমভ।

গল্পের প্রধান চরিত্র মারে টেম্পলটন একজন বিজ্ঞানী। স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না। এখন মারে হঠাৎ মারা যাওয়ার পর স্রষ্টা বা ঈশ্বরের সঙ্গে পাঠক তাকে আলাপে লিপ্ত দেখে। গল্পের বয়ানে আসিমভ দেখাচ্ছেন, পাড় নাস্তিক মারেকে ঈশ্বর অনন্ত জীবনের জন্য বেছে নিয়েছেন। মারে চিন্তাশীল প্রকৃতির মানুষ ছিল। ঈশ্বর এখন তার এই গুণ বিবেচনা করে তাকে অনন্ত জীবন দান করবেন বলে মনস্থ করেন। অনন্তকাল বেঁচে থাকতে হলে মারেকে একটা কিছু তো করতে হবে। এখন তার যেহেতু চিন্তা করার ক্ষমতাটি অসাধারণ, সে এই কাজেই মন দেয়। আসিমভ দেখান, নিজেকে অবিরত চিন্তামগ্ন রাখাটা কীভাবে মারের জন্য বোঝায় পরিণত হয়। স্রষ্টাকে সে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বসে আর গল্পের কেন্দ্রবিন্দু সেখানে নিহিত।

গল্পে ঈশ্বর মারেকে বলেন, তার একমাত্র কাজ হবে অবিরত নিত্যনতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। মারে সেটি করতে গিয়ে বুঝতে পারে,- চিরন্তন সময় ধরে চিন্তায় লিপ্ত থাকা ক্লান্তিকর! তখন আর কোনো আনন্দ বা শিহরন সেখানে থাকে না। চিন্তা হয়ে ওঠে লক্ষ্যহীন ও একঘেয়ে। অনন্ত জীবন নিজেই তখন দুর্বিষহ বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। জীবনের উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে। গল্পে ঈশ্বর অথবা অচেনা কণ্ঠস্বর আমাদের জানায়,- তার জন্য মহাবিশ্ব কেবল শিক্ষার একটি মাধ্যম।
Isaac Asimov Memorial Debate – The Existence of Nothing; Source – American Museum of Natural History YTC
প্রচলিত সকল ধর্ম ছাড়াও কবি-লেখক-দার্শনিকরা জগৎ সৃষ্টির কারণ নিয়ে আজো ভেবে চলেছেন। এখন ঈশ্বর যদি এর স্রষ্টা হয়ে থাকেন তাহলে কেন এই কাজটি তাঁকে করতে হচ্ছে? প্রশ্নটি নিয়ে মত-মতান্তরের শেষ নেই। আসিমভ সেখানে ভিন্ন এক ভাবনার পথ যেন-বা খুলে দিয়েছেন এই গল্পে। মহাবিশ্ব যদি ঈশ্বরের একটি শিক্ষা-উপকরণ হয় তাহলে মানতে হবে তিনিও শিখছেন অবিরত, এবং সেখানে তিনি নিজেও সীমাবদ্ধ। সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নিজের জ্ঞান বৃদ্ধি করার কর্মে তাঁকে লিপ্ত দেখছে পাঠক। আসিমভের এহেন প্রস্তাবনা ঈশ্বর-সমস্যাকে প্রচলিত ধর্মীয় ব্যাখ্যার বিপরীতে দাঁড়িয়ে ভাবার অবকাশ পাঠককে করে দেয়। মানবচিন্তার প্রকৃতি ও তার পরিসীমাও গল্পে আসিমভ তুলে ধরেন। মারে শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরকে পরাজিত করার কথা ভাবছে, যদিও এটি একটি অবাস্তব ও অসম্ভব লক্ষ্য! 

আসিমভ, তাঁর এই ছোট্ট কল্পবিজ্ঞানে ধর্ম, বিজ্ঞান ও মানব-প্রকৃতি নিয়ে এমন এক চিন্তাশীল বিবৃতি হাজির করছেন, জীবনের সারার্থ বিষয়ে যা পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে। গল্পটি কেবল কল্পকাহিনি নয়, মানব জীবনের অস্তিত্ব ও উদ্দেশ্যকে সে গভীর প্রশ্ন ও তদন্তের আওতায় নিয়ে আসছে। এটি পাঠের পর পাঠক বুঝতে পারে,- জ্ঞান ও চিন্তার আসলে কোনো সীমারেখা টানা সম্ভব নয়। প্রশ্ন তথাপি থেকে যায়,- এই সীমাহীনতার সত্যিকার কোনো অর্থ আছে কি? আসিমভ চমৎকার দেখিয়েছেন,- এমনকি চিরন্তন জীবন যদি আমরা লাভ করি তাহলে ক্লান্ত বোধ করতে পারি;- অনন্ত সে-জীবনের যদি কোনো লক্ষ্য না থাকে। 

অন্যদিকে আসিমভের কুশলী হাতে বোনা গল্পটি আগামী সময়ের বাস্তবতা। মানুষের হাতে তৈরি প্রযুক্তি স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠছে। ক্রমশ সে দখল নিতে শুরু করেছে মানুষের তৈরি কাঠামো। যার ফরে মানুষের হাতে সৃষ্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তির সঙ্গে তার ভবিষ্যৎ সর্ম্পককে আসিমভের গল্পের বয়ানে পাঠ করা সুযোগ ও প্রাসঙ্গিকতা থাকছে। আগামী সময়ে গল্পটি যে-দার্শনিক সমস্যার আলাপ তুলছে সেটি ঘুরেফিরে সামনে আসতে থাকবে। মানুষকে যেখানে স্বয়ং তার হাতে তৈরি বুদ্ধিমান প্রযুক্তিকে চিন্তা-সক্ষম করে তোলার রোমাঞ্চ ও বিপত্তি দুটোই সইতে হবে বেশুমার। 
. . . 
The Last Answer by Isaac asimov – a Short Film; Source – Piper Lebau YTC

. . .


How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 6

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *