লোকনাথ ভট্টাচার্যকে আমরা পাঠক অধিক চিনি তাঁর ভিন্নস্বরে বোনা গল্প ও আখ্যানের জন্য। ফরাসি ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় সংযোগের সুবাদে আর্ত্যুর র্যাঁবো ও অঁরি মিশোকে তিনি বাংলায় পেশ করেছিলেন। নরকে এক ঋতু ও মাতাল তরণীর মধ্য দিয়ে র্যাঁবোকে আমরা চিনেছি তখন। এই লোকনাথ আবার পাশ্চাত্য দর্শনের অন্যতম কুলপুরোহিত দেকার্তেকে বর্ণনা করেছিলেন দেশ-দেশান্তর জন্ম-জন্মান্তর-এর চমৎকার গদ্যভাষায়। তবু সব ছাপিয়ে তিনি পাঠকমনে জায়গা করে নিয়েছেন তাঁর ব্যতিক্রমী আখ্যানগুলোর জন্য।
বাবুঘাটের কুমারী মাছ, অশ্বমেধ, গঙ্গাবতরণ যারা পড়েছেন তারা জানেন আখ্যান রচনার প্রকৌশলে লোকনাথ কতটা পৃথকস্বর ছিলেন। চিন্তাপ্রধান অনুষঙ্গ ব্যবহার করে গল্প-আখ্যান রচনা নতুন ঘটনা নয়। পাশ্চাত্যে যেমন নতুন নয়, এমনকি আমাদের এখানে উক্ত ছকে আখ্যান দাঁড় করানোর চেষ্টা অনেকে করেছেন। ধূর্জটিপ্রসাদের অন্তঃশীলা কাহিনি ও চরিত্রনির্ভর রেখা ধর অগ্রসর হলেও আখ্যানের সারবস্তুতে ভাবনাশ্রয়ী অনুষঙ্গের দাপট প্রবল ছিল। লোকনাথ তাঁর নিজস্ব ছকে বোনা শৈলীর সাহায্যে যাকে পূর্ণতা দিয়ে গেছেন।
ফরাসি দেশটির সঙ্গে সাক্ষাৎ সংযোগ ও জীবনের লম্বা সময় সেখানে বসবাসের কারণে পাশ্চাত্য দর্শন ও সাহিত্যে যেসব ভাবনা ও শৈলীর চর্চা তীব্র ছিল ওইসময়, লোকনাথ ভট্টাচার্য এর অনেকখানি আত্মস্থ করেছিলেন। সত্তা ও অস্তিত্বের দার্শনিক অনুধ্যান যে-কারণে তাঁর গল্প-আখ্যানের বয়ানে আমরা বড়ো আকারে পাই। ভারতবর্ষের সঙ্গে নাড়ির যোগকে যেখানে তিনি অস্তিত্বিক সংকটে দ্রবীভূত করেছেন আগাগোড়া। চরিত্র ও অনুষঙ্গরা স্থানিক হলেও তাদের জীবনজার্নি স্থানিকতার রং ছাপিয়ে গভীরসঞ্চারী বোধের উন্মেষ ঘটায় সেখানে।
Lokenath Bhattacharya’s Novel in translation of English and French; Source – Google Image
লোকনাথ মস্তিষ্ক দিয়ে লিখতেন। কবিতার সঙ্গে নিবিড় ঐক্য রাখে অথচ কবিতা বলা যাবে না এরকম এক ভাষায় দার্শনিকবোধির সঙ্গে বোঝাপড়ায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন সবসময়। গল্প-আখ্যান ও নাটকের বয়ানশৈলী যে-কারণে প্রচলিত রীতি মেনে অগ্রসর হয়নি। তাঁকে পড়তে বসে পাঠককে নিজের মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে হচ্ছে;—চ্যালেঞ্জটি এখানে যে-পাঠক নিতে পারবে, তার জন্য লোকনাথ হচ্ছেন পরম উপাদেয়। যিনি পারবেনা, তার তাঁকে পাঠ না করেই শ্রেয়তর।
বাবুঘাটের কুমারী মাছের কথা ধরা যাক। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের প্রতীকায়ন আখ্যানের আরাধ্য বিষয়। প্রতীকায়নের ভিতর দিয়ে বয়ান সামনে এগিয়েছে। একে এখন কবিতায় যুতসই করে বলতে পারতেন লোকনাথ, কিন্তু তিনি বেছে নিলেন গদ্যের চাল, যেখানে আবার কবিতার সঙ্গে সংযোগ তা-বলে ব্যাহত হচ্ছে না। রচনাশৈলীর ধারা সুতরাং পাঠককে টানে। মার্গারেট অ্যাটউডের দ্য হ্যান্ডমেইড’স টেল নারীজীবনকে নির্যাতনকক্ষের গোলকধাঁধায় প্রতীকায়িত করেছিল। লোকনাথ মানজবীবনকে প্রতীকায়ন করেছেন অ্যাটউডের আগে। পাঠকের হাতে হ্যান্ডমেইড’স টেল তখনো পৌঁছায়নি।
ভাবনাকে উসকে দেওয়া লোকনাথ ভট্টাচার্যের লক্ষ্য বলে কখনো মনে হয়নি। তিনি বরং একে বিপন্নতার সম্মুখে দাঁড় করাতেন। সার্ত্রের সঙ্গে এখানে তাঁর তফাত লক্ষণীয়। সত্তা কী আর কেনই-বা নিজেকে সে যাপন করছে, এর উত্তর খুঁজতে নেমে নিজের গল্প ও আখ্যানের কাহিনিছকে অবিরাম প্রশ্ন তুলেছেন সার্ত্রে। দার্শনিক প্রস্থানবিন্দু থেকে বিশ্লেষ করেছেন সমগ্র বিষয়। লোকনাথের রচনায় এর আভাস পাঠক পায়। তবে লোকনাথ সেখানে সার্ত্রের মতো বিশ্লেষণাত্মক হওয়ার পরিবর্তে বিবরণের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত এগিয়েছেন।
Why should you read The Handmaid’s Tale? – Naomi R. Mercer; Source – TED-Ed YTC
দুয়েকটি ঘর দুয়েকটি স্বর হচ্ছে তাঁর প্রথম দিককার রচনা। আখ্যানটি যারা পড়েছেন তারা ওপরে মাত্র যে-কথাগুলো আমরা বলেছি, আশা করি সেটি ধরতে পারবেন। আখ্যানের প্রারম্ভে রাখাল নামে এক লোকের কাহিনি বলতে থাকেন লোকনাথ। সদাগরী অফিসে মাস মাইনের চাকুরে সে। কবিতা লেখার বাতিক আছে বেশ। তো সেই রাখাল বেচারার মাথায় কবিতা ভর করেছে আকস্মিক। ঘরের দেরাজ বন্ধ করে লিখতে বসেছিল। এমন সময় দরোজায় টোকা পড়ে। রাখাল তাতে বিরক্ত হয়। এখন এই বিরক্তিকে উপজীব্য করে বয়ান সাজাচ্ছেন লোকনাথ। যার মধ্য দিয়ে লোকজনের যাওয়া-আসায় সদা মুখর রাখালের অফিস সামলানোর ঝক্কি, এবং দৈনন্দিন যেসব পেরেশানি কবিতা লেখার কাজকে তার জন্য কঠিন করে তোলে, তার সবটা উঠিয়ে এনেছেন তিনি।
লঘু মেজাজে ও কিঞ্চিৎ মজাকঘন ভাষায় রাখাল বেচারার বিড়ম্বনার বয়ান দিতে গিয়ে লোকনাথ বুঝিয়ে দিচ্ছেন,— দরোজা না খুলে রাখালের উপায় নেই। অনাবশ্যক ভারী গলায় সে তাই বলে ওঠে,—‘আসুন’। এখন দরোজায় টোকা আর রাখালের ‘আসুন’ বলার মধ্যে সময়ের ব্যবধান মাত্র তিন সেকেন্ড। তিন সেকেন্ডের ফ্রেমে একটি লোকের বেঁচেবর্তে থাকার পেরেশানি ও কবি হওয়ার বিড়ম্বনাকে লেখক বিবরণে গেঁথে নিচ্ছেন, যেখান থেকে কাহিনি ক্রমশ খোলস ছাড়ছে পরবর্তী অধ্যায়গুলোয়।
চরিত্রের ভিতরে সক্রিয় মনোজগতে যেহেতু আলো ফেলা তাঁর লক্ষ্য, সংগতকারণে বিবরণে আলাদা করে গল্প থাকছে না। গল্প সেখানে রাখালের তার নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়। বাদবাকি চরিত্ররা ফোড়নের দায় মিটায়। ন্যারেটিভের এই কৌশল আরো গভীরসঞ্চারী হয়েছে বাবুঘাটের কুমারী মাছ ও গঙ্গাবতরণ অথবা আপনার কীর্তির মতো রচনায় এসে। আফসোস, লুই আরাগঁর মতো নোবেলজয়ী বিশ্বখ্যাত লেখক যাঁর রচনার অনুরাগী ছিলেন, সেই লোকনাথ এসব রচনা ফরাসি ভাষায় লিখলে অনেকবেশি বাহবা কুড়াতেন।
বাংলা ভাষায় বৈশ্বিক পরিসীমাকে ধারণ করেছিলেন লোকনাথ ভট্টাচার্য। কাহিনির ফ্রেমিং সেখানে স্থানিক কোনো অনুষঙ্গ হতে পারে আবার এমন পটভূমি তিনি বেছে নিয়েছেন যেটি স্থানিকতা ছাপিয়ে প্রতীকী ও সর্বজনীন মনে হবে পাঠকের। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর চাঁদের অমাবস্যায় এরকম ছক আমরা পাবো। উত্তর আধুনিক চশমা দিয়ে দেখলে ওয়ালীউল্লাহ যে-গ্রামীণ ছকে আখ্যানটি সাাজিয়েছিলেন, তাতে করে গ্রামটিকে পাঠকের অচেনা মনে হবে। বাংলাদেশের কোনো-কোনো লেখক, যেমন আবু রুশদ এর জন্য ওয়ালীউল্লাহকে অভিযুক্তও করেছিলেন। ভদ্রলোক ধরতে পারেননি,—ওয়ালীউল্লাহর কাছে আখ্যানের স্থানকাল মুখ্য ছিল না। তিনি একটি অজপাড়াগাঁকে বেছে নিচ্ছিলেন কেবল। যেখানে স্কুলমাস্টারকে দিয়ে অস্তিত্বিক সংকটের গভীর ফাঁদে পা রাখছেন তিনি। নৈতিক সংকটের সম্মুখীন চরিত্রকে কোণঠাসা করছেন সত্তা ও অস্তিত্বের গভীরতম প্রদেশে।
Lokenath Bhattacharya and Syed Waliullah; Source – Google Image
দারিদ্র্য, ধর্মান্ধতা আর শ্রেণিবিভাজনের সুতোয় গাঁথা আখ্যানে অস্তিত্বিক সংকটের মোকাবিলা চাঁদের অমাবস্যার বড়ো লক্ষ্য ছিল। ওয়ালীউল্লাহ স্বয়ং লোকনাথ ভট্টাচার্যের মতো ফরাসিসঙ্গে নিবিড় ছিলেন। লোকনাথ ফরাসি নারীকে বিয়ে করেছেন। ওয়ালীউল্লাহও তাই। ফরাসি ভাষায় লোকনাথ নিয়মিত গদ্য ও কবিতা লিখতেন। নামকরা লেখকদের সঙ্গে ওঠবস আর ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত অভিজাত সাহিত্য সংকলনে তাঁর রচনা সংকলিত হয়েছে। এখনো ফরাসি ভাষায় তাঁকে নিয়ে চর্চা থেমে নেই। তাঁর আগ্রহের জায়গা শুরু থেকে ব্যতিক্রম ছিল। ফ্রান্সে পিইচডি থিসিসের বিষয়টি স্মরণ করা যেতে পারে। বৌদ্ধ ধর্ম ভারতব্যাপী প্রসারলাভের ক্ষণে ডাকিনীতন্ত্র নিয়ে লেখা পুঁথিপত্রকে থিসিসের বিষয়বস্তু করেছিলেন গুণী। সেগুলো আবার ফরাসিতে অনুবাদও করেছেন সেইসময়।
মস্তিষ্কপ্রধান লেখকের মনোজগৎ এরকম হয়। লোকনাথের পক্ষে যে-কারণে বাংলা ভাষাভাষী পাঠপরিমণ্ডলে সেলিব্রেটি হওয়া সম্ভব ছিল না। তিনি অবশ্য এর পরোয়াও করেননি বড়ো একটা। ফরাসি দেশের সাহিত্য পরিমণ্ডলে সুনাম ও সম্মানের সবটুকু পেয়েছিলেন লোকনাথ। এটি বরং আমাদের ব্যর্থতা,—আমরা তাঁকে অবশ্যপাঠ্য করে তুলতে পারিনি। আমাদের কবি-লেখকরা লোকনাথের শৈলী নিয়ে গভীরে যাওয়ার তাড়না বোধ করেনি আজো। সাহিত্যের বিচিত্র ঘরানার মধ্যে লোকনাথ-ব্যবহৃত ঘরানাটি পাশ্চাত্যে বহুচর্চিত। আমরা অবশ্য সেটি এখনো শুরু করতে পারিনি ভালোভাবে। গল্প বা আখ্যানের জন্য লেখক কী বেছে নিচ্ছেন সেটি বড়ো কথা নয়। একে নিয়ে তিনি কোন পথে আগাচ্ছেন,—এই বিষয়টি সেখানে মুখ্য। আন্তন চেখভ যেমন বলেছিলেন,—একটি ফুলদানি নিয়েও জমিয়ে গল্প লেখা যায়। লোকনাথ এমনটি ভাবতেন, এবং লিখতেনও। যে-কারণে তাঁর গল্প বলার ধরন বর্তমানে অধিক যুগ-প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে।
যাইহোক, লোকনাথকে হঠাৎ মনে পড়ার কারণ বলব বলে ইন্ট্রোয় যেতে হচ্ছে। তাঁকে আমরা গল্প, আখ্যান আর অনুবাদের ভিতরে কেন জানি নির্দিষ্ট করে দিয়েছি। যদিও লোকনাথ কবিতা লিখেছেন, এবং সেখানে তাঁর স্বরের ভিন্নতা পাঠক টের পায়। তাঁকে পাঠ যাওয়ার সময় ভিন্নতার বিষয়টি যদিও আমাদের তাৎক্ষণিক মনে পড়ে না। আজ হঠাৎ তাঁর হাঁটুতে হাঁটুতে নহবৎ-এ সংকলিত কবিতা পড়তে বসে মনে হলো,—এখানে তিনি যে-বীজ বপন করছেন সেগুলো আদতে অশ্বমেধ বা গঙ্গাবতরণ-এ গিয়ে আখ্যানে বিস্তার লাভ করেছিল।
ছোট ছোট কাহিনিছাদে কবিতাগুলো লিখেছেন লোকনাথ। কাহিনি বলতে মুহূর্তিক অনুষঙ্গকে গদ্যছাদে লেখা কবিতা-শরীরে ধারণ করেছেন কবি। কোথাও বাহুল্য নেই। আলাদা করে উজ্জল আবিষ্কার হিসেবে পাঠক বেছে নেবে, সেরকম পঙক্তির ঠেলাঠেলি ভিড় নেই। চেতনাপ্রবাহ রীতি মেনে যেমন ভার্জিনিয়া উলফ লিখতেন এবং সেটি তাঁকে বিশিষ্ট করেছিল, জেমন জয়েস যেমন চেতনাপ্রবাহকে তাঁর নিজানুগ করে ভিন্নমাত্রায় উদ্ভসিত করেছিলেন,—এখন লোকনাথে এসবের অনুরণন পায় পাঠক।
এবং মুশায়েরা বড়ো যত্ন করে তাঁকে গ্রন্থিত করেছিলেন। ওপারবাংলায় ছোটকাগজের শক্তি তাতে টের পাওয়া যায়। লোকনাথকে ভাবতে হয়নি,—বাংলা ভাষায় তাঁর এসব লেখালেখি কারা পড়বেন! কারা টের পাবেন এর মাহাত্ম্য। কারা বুঝবেন,—বাংলা ভাষায় একটি স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর অবশেষে তিনি সংযোজন করতে পেরেছেন। এবং মুশায়েরার প্লাটফর্ম তাকে সেই নির্ভয় আকাশ দিয়েছিল। নিয়মিত লেখা পাঠাতেন সেখানে। সে যাকগে, হাঁটুতে হাঁটুতে নহবৎ থেকে একটি আস্ত কবিতা আগে বরং পাঠ যাই আমরা। এ-গ্রামে একদিন শিরোনামে কবি লিখছেন :
Lokenath Bhattacharya poetry book; Source – Google Image
. . .
এ-গ্রামে একদিন মানুষের বসতি হবে, গাছপালা অর্থ পাবে, যে-কথা বলব তুমি-আমি, আমরা তোমরা, হবে তার দ্যোতনায় কোনো এক-অনেক অন্ধকার রাত্রি মুখর।
কিছু কম অভিমান এ নয় যে আমি কোণের, ময়লা কাপড়ের, আজো পেলাম না স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে একটা বসার জায়গা, একটি বটের বেদী, চিনিনি নিশ্চিত করে কোনো তীর্থের পথ ।
তবু আমায় কথা বলাবে বলেই বলি, ততটা তোমার মন রাখার জন্য নয়, যতটা তোমার প্রেমের প্রতি আমার এক অবশ অভ্যাসে ।
হোক না অভ্যাস, প্রেম শব্দটা আওড়াতেও ভালো লাগে, বলি বলেই কে জানে হয়তে৷ আজো বেঁচে আছি—বাঁচতে চাই আরো কত সদ্য-জাগা ভোরে—জপের মন্ত্রের মতো ‘এ-গ্রামে একদিন মানুষের বসতি হবে।’
. . .
ওই-যে অবশ অভ্যাসের কথা লোকনাথ বলছেন এখানে, সেটি এখানে সমগ্র কবিতাটির চাবি। মনোবিধুর গল্পের অনেকখানি যেখানে লুকিয়ে আছে। কবিতায় এখন গল্পটি বলার প্রয়োজন পড়ছে না। বলতে গেলে সেটি আর কবিতা থাকবে না। গদ্যের শাসনে বসে কবিতার সংগোপন আদরা মেনে চলছেন কবি। জীবনের দেনাপাওনা, চাওয়া-পাওয়ার শত টানাপোড়েনে শেষে এরকম কোনো জনশূন্য প্রান্তরকে আমরাও ভাবি বোধহয়,—যেখান থেকে নতুন করে যাত্রা শুরু হতে পারে, সেটি ভাবতে খুব মন চায়! মনে পড়ছে, গঙ্গাবতরণ ও অশ্বমেধ-এর বয়ানে এরকম যাত্রার আভাস ধ্বনিত হতে দেখেছি। এলিয়ট যেমন বিরানভূমি থেকে নিষ্ক্রমণ নিয়ে ভারততীর্থে পৌঁছালেন, গীতামন্ত্র জপ করলেন আচম্বিত,—লোকনাথের রচনায় সত্তা ও অস্তিত্ব যাপনের টানাপোড়েনে এরকম চোরাটান গভীর দ্যোতনা পেয়েছিল। আপাত সহজ বয়ানের মধ্যে ধারণ করেছিলেন বোধিসত্বের বিস্ফার। লোকনাথের কবিসত্তার স্বকীয়তা ও গভীরতা ঠার পেতে এবং মুশায়েরায় সংকলিত কবিতা সুমদয় থেকে পড়তে চাই একখানা কবিতা। প্রৌঢ়া প্রেয়সী শিরোনামবন্দি কবিতায় তিনি লিখছেন :
এ-ব্যাধি বহুকালের । তাই ছেলেবেলায় যখন কবিতা লিখতাম, মাঝে মাঝে বিশ্বাসের কথা বলেছি । আজ আর বলি না, কারণ হয়তো বয়স হয়েছে, পৃথিবীর ক্রূর পাঠশালায় শিক্ষিত হ’য়ে বুঝেছি, বিশ্বাস ব’লে জিনিস নেই । তাই অবিশ্বাসও নেই ।
আর সবই আছে, আমাদের সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, বৃষ্টি-ঘাম-রোদ্দুর, তোমার চোখের চাওয়া, খাওয়া আর পায়খানায় যাওয়া–দিনের পথে ঘোড়দৌড়, রাত্তিরের ঘুম । পায়খানার নিত্য নৈমিত্তিক কোঁৎ পেড়ে চালান দেওয়া বিশ্বাস-অবিশ্বাসের যত তর্ক, গতকালের খাবার–আর আজকের খাবারের জন্যে প্রস্তুত হওয়া।
ছেলেবেলাকার সেই বটগাছটা যদিও আজও সমৃদ্ধ, জানি আর বিশ্বাস নেই সে- বুড়োটারও । আমরা পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ঝিমোই ।
মনে কোরো না এ কোনো সাবেকী দুঃখবাদী বক্তব্য–ঐ দুঃখটাও যদি থাকত তো হয়তো বেঁচে যেতাম । আসলে বক্তব্যই নেই । আর–মনে পড়ে ? সেই মানুষী করুণার দুটি গোলাপ আমার দুই হাতে দেবে বলেছিলে একদিন, তখন আমরা কিশোর কিশোরী, দাওনি কেন ? না প্রৌঢ়া প্রেয়সী, তুমিও সমানই অসমর্থ?
তবু পৌঁছোতে হবে মন্দিরে, পৌঁছোতে যে হবেই রাণী, কেন এই অকথ্য অবোধ্য অভীপ্সা আজো আমার হাঁটুর অন্ধকার থেকে থেকে আকুল করে !
Lokenath Bhattacharya novel; Source – Google Image
মানবজীবন এমনধারা যাত্রাই বটে! সুখ-দুঃখের সঙ্গে যত লেনাদেনা, যত শোধবোধ, তার সবটা ছাপিয়ে মৌনমূক দুটি মানুষ তবু ভাবে,—একটি গন্তব্য আছে এবং সেখানে পৌঁছাতে হবে সকলকে। নৈরাশ্যের অন্তিম পরিণতি নিস্পৃহতায়। নিস্পৃহতার পরিণতি তাহলে কী? নির্বিকার কোনো অবশ অভ্যাসে মন্দিরে পৌঁছানো? নাকি নির্বেদে সমাধি গ্রহণ? কবি এর কোনোটাই বেছে নিচ্ছেন না এখানে। তিনি বেঁচে আছেন স্মৃতিমধ্যে। দেহটা সক্রিয় রোমন্থনের ভিতর। যদিও সেই রোমন্থনের ব্যাপারে আবেগ ফিকে হয়ে এসেছে। কোনো বক্তব্য রাখার প্রয়োজন নেই, তথাপি অভীপ্সা রয়েছে। কেন রয়েছে? উত্তর কি জানে মানুষ? পাঠকরা কি জানে? না,—কেউ তা জানে না।
এরকম সব কূটাভাস যে-দার্শনিকবোধি নগ্ন করে যায়, লোকনাথে তার বাড়-বাড়ন্ত বড়ো বেশি। কাজেই তাঁকে পাঠ যাওয়া মানে আগে এটুকু বুঝে নেওয়া,—জীবনের চরৈবেতি কারো জন্য কোনো বক্তব্য অবশিষ্ট রাখেনি। সব বলা হয়ে গেছে। আমরা কতভাবে কতটা যেতে পারি, কী তার পরিণাম,—এসবের কিছু অজানা নাই কারো। না কোনো বাছাই পঙক্তি নয়, বরং নেংটি ইঁদুর কবিতাটি আস্ত পড়তে চাইব লোকনাথের শক্তির জায়গাটি ঠার পেতে :
এ-ঘরে যে বাস করে, যার নাম আমি, সে আর ইওনেস্কোর গণ্ডার নয়, মানুষ তো নয়ই, সে একটা নেংটি ইঁদুর তার কোন সাহস নেই।
তাই কবিতা লিখতে আজো লজ্জা নেই তার—বিশেষত কবিরা তো জাত-ইঁদুর, মুষিকরাজচক্রবর্তী—ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে আকাশ প্রেম আর ভাই-এর প্রসঙ্গে সে আজো পঞ্চমুখ। কিন্তু নিদারুণ সত্যটা স্পষ্ট করে তাকে বলাতে চেয়েছে। কি সে পালালো—ধরো ধরো, ঐ দ্যাখো পালায়—লেজটি উঁচু করে।
একটা সান্ত্বনা, ঘরে-বাইরে এই ধূসর সভ্যতার দেশে আজ আমরা সবাই ইঁদুর, সকলেরি লেজ। আমাদের পুঁচকে বুকের মধ্যে যে-জিনিসটা কেবলি দুর দুর করে কাঁপে, তা ফুসফুস নয়, ভয়। তাই আকাশের কথাটা পাড়লে চোখ রাঙিয়ে থামিয়ে দেবার মতো বিড়াল যদিও ধারে-কাছে নেই, আমরা পরস্পর পরস্পরকে ভয় পেয়েই খালাস, পালিয়ে মুক্তি।
দেখলে তো এখানেই, এই কটি পঙক্তিতেই, কী করে কৌশলে এড়িয়ে গেলাম, বললাম না যেটাকে সত্য বলে বিশ্বাস করি ভিয়েতনামে বা অন্নহীন কলকাতায়—একটা গূঢ় ভয়াবহ সত্য, যা বলতে না পারার অনুশোচনায় আমার নীরবতার সমস্ত দিনরাত্রি বহ্নিমান।
আরো এক প্রমাণ, কত বড় অর্থাৎ কত ছোট, হীন, মলিন, চতুর—এই ইঁদুর আমি।
Lokenath Bhattacharya; Source – Google Image
নিজেকে ইঁদুর প্রতিপন্ন করে লোকনাথ যেন-বা বুঝিয়ে দিলেন আমরা হচ্ছি ধরা খাওয়া পাখি। সুতরাং এ-জীবন না নিরাশার, না আশার, না নিস্পৃহতার। এটি কেবল বয়ে চলা নদী। চলার পথে যে তার নিজেকে ভাঙে-গড়ে। অন্যভাবে ভাবলে এই আশা মনে জাগায় বটে,—আমাদেরকে তথাপি চলতে হবে। কবি বলছেন,—`আমি ক্ষীণকন্ঠ বহুদূর হতে, সঙ্গী তোমার। যেন যা বলছি শুনতে পাও;/ হে সন্ধ্যার মানুষ, আশা রাখো এই বিধ্বস্ত প্রান্তরে, যেখানে প্রাণ বলতে তুমিই আজ—একটি ফুলও জীবন্ত নেই, একটি শিশুও না, হাওয়া কাঁদে গুমরে-গুমরে কত মানসীর স্মৃতিতে।’
লোকনাথে এরকম একলা যাত্রার ধ্বনি পাঠক কান পাতলে টের পাবেন। দিন শেষে মানুষ রিক্তপ্রাণ অবধূত। জীবনারণ্যে দীক্ষিত হতে-হতে তার জন্য কেবল সে নিজে থাকে। তাঁর সকল রচনা যে-কারণে ওই একলাকথনের সংবেদে ভরাট। সত্তা যেখানে আরো অনেকানেক সত্তার ভিড়ে নিজের সঙ্গে কথা বলছে। যেখানে সে নিজের অবসন্নতার পাশাপাশি আসন্ন আগামীকে মুকুরিত দেখে। প্রেম ও বিচ্ছেদ, অনুরাগ ও বিরাগ, ভালোবাসা ও প্রতারণা, বেঁচে থাকা ও মরণ,—এরা সব পাশাপাশি চলেছে। একদিকে জীবনফুল ফুটছে, তার পাশে জীবনফুল শুকিয়েও যাচ্ছে। নিজেকে সেখানে চিহ্নিত করা কাজেই দুষ্কর। সে কেবল তার মধ্য থেকে চলার প্রেরণা শুষে নিতে পারে। কবি তাই বলছেন,—আমি কী হয়েছি জানি না, শরতের সোনালি রোদ্দুর আমার পাশের মেয়েটাকে দুগগা প্রতিমা করেছে—আমরা হাঁটছি, শিরায় শিরায় হাঁটুতে-হাঁটুতে নহবৎ ৰাজছে।[দুগগা প্রতিমা]
জীবনের ভার টেনে চলার অপার ক্লান্তি সয়ে এই-যে যাত্রা, চলতে থাকা নিরন্তর, একান্ত স্বকীয় স্বরে লোকনাথ তা অবিরত লিখে রেখে গেছেন। আমরা বোধহয় তাঁর এই বলার ভাষাটিকে আজো রপ্ত করতে পারিনি। যদিও র্যাঁবো থেকে অঁরি মিশো এই আমরাই পাঠ করি। আমাদের ঘরের ছেলে নরকযাপনের মধ্যে উপনিষদের চরৈবেতির মন্ত্র জপছেন, অথচ তাঁকে চিনতে পারছি না! আমাদের সাহিত্যিক অধঃপতনের এও এক কারণ হয়তো!
. . .
Chhoto Pakhi by Shohojia; Source – shohojia official YTC