শেখ হাসিনা সরকারকে গদিছাড়া করতে প্যারিসে বসে সক্রিয় পিনাকী ভট্টাচার্য ইন্টারেস্টিং কেস! জুলাই আন্দোলনের প্রসঙ্গ যদি ওঠে, তাকে বাদ দিয়ে আগানোর সুযোগ নাই। আওয়ামী সরকারের পতন পরবর্তী পরিস্থিতি দেশের জন্য কী ফলাফল আনতে যাইতেছে সেটা মোটাদাগে পরিষ্কার, তবে আখেরি পরিণাম নিয়া কথা বলার সময় সম্ভবত এখনো আসে নাই। কারো কাছে হাসিনাপতন নিছক রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। দেশের খোলনলচে বদলানোর মতো ঘটনা না সেটা। বিপরীত শিবিরের কাছে পতনটা গণআন্দোলন ও বিপ্লব। একদল ভাবতেছেন,- সরকার পতনের নামে ষড়যন্ত্র আর লাশ ফেলার রাজনীতি করা হইছে এখানে। ষড়যন্ত্রকে অন্যদিকে পিনাকীরা নিখাদ বিপ্লবে বইলা চিহ্নিত করতে মরিয়া। কেন বিপ্লব তার স্বপক্ষে বিচিত্র বয়ান নিয়মিত জাতির সম্মুখে দাখিল করতেছে তারা। পরিস্থিতি নিয়া যারপরনাই বিভ্রান্তি দূর হইতেছে না কোনোভাবে। সহসা দূর হওয়ার সম্ভাবনাও নাই। পিনাকী তার ইউটিউব চ্যানেলে যা বলতেছেন, সেগুলা তাৎক্ষণিক আবেদন তৈরি করতেছে। আওয়ামী-বিদ্বেষী একটি মব এভাবে উনি গড়ে তুলছেন;- তার হুকুম পাওয়ামাত্র যারা অ্যকশনে নামতে দেরি করে না।
যাই হোক, আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় জুলাই হইতে এ-পর্যন্ত যত ঘটনা ঘটছে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ যদি করা হয়, আর্গুমেন্ট সাজানো যায় ঠিকঠাক, সেক্ষেত্রে একটা বালকও বুঝবে এটা আসলে কোনো বিপ্লব ছিল না। এখন আমি পুটিমাছ কী ভাবতেছি তাতে কিছু যাবে আসবে না। পিনাকীর মতো প্রভাবশালী ব্যক্তি অবিরত যেসব বয়ান তৈরিতে গত দশ বছর ধরে সক্রিয়, তো এর সুবাদে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে তার আবেদন এই মুহূর্তে মারাত্মক প্রতীয়মান হইতেছে। জুলাই আন্দোলনে বিপ্লবী বৈশিষ্ট্য যে-আদৌ বিদ্যমান নাই সেটা বোঝায় অবস্থায় খুব মানুষ আছেন এখন।
পিনাকী ভট্টাচার্য কি সত্যি বিপ্লবী অথবা সে হইতেছে ভারতের ডাবল এজেন্ট? প্রশ্নটা আগেও ছিল, এখনো আছে, যদিও এর মীমাংসা পাইতে জাতিকে আরো কিছুদিন ওয়েট করা লাগতে পারে। জুলাই বিপ্লবে অংশীদারদের মধ্যে অনেকে এখন তাকে ভারতের এজেন্ট বইলা ভাবে বৈকি। বিপ্লবী বয়ান হাজির করার ছলে পিনাকীর একের-পর-এক উসকানি সন্দেহ দানা বাঁধার পেছনে ভূমিকা রাখতেছে সেখানে। অন্যদিকে তার কারণে দেশে যেসব ঘটনা ঘটছে, সেগুলাকে যারা বিপ্লব পরবর্তী অভিঘাত গণ্য করে,- এমতো ধারণা হইতে তাদেরকে বের করা আপাতত কঠিন কাজ। মব লেলিয়ে দিয়ে অরাজকতা ঘটানোয় পিনাকী যে-কারণে এখনো কামিয়াব। আখেরে এর পরিণাম কী দাঁড়াইতেছে সেটা দেখার জন্য কিছুদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে জাতিকে। পিনাকীর জন্য সেটা মনে হইতেছে না সুখকর হবে।
প্রভাবিত করার ক্ষমতা পিনাকী ভট্টাচার্যের আছে এবং সেটা উনি ভালোই কাজে লাগাইতেছে আপাতত। ঘৃণার মানসিক প্রভাব সচরাচর সাংঘাতিক হয়। কোনো বয়ান যখন ঘৃণা পয়দায় নিরন্তর সক্রিয় থাকে, তার প্রভাবে অনেকের বিচাবুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায়। পিনাকী ঠাণ্ডা মাথায় এই বিলোপকরণে সক্রিয় আছেন। দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় তাকে অপ্রতিরোধ্য বইলা আমরা ধরে নিতে পারি। আমার অবশ্য তাকে সাইকোপ্যাথ মনে হয়। সে একজন প্যাথোলজিক্যাল লায়ার। আমার মনে হওয়া ও না হওয়ায় অবশ্য তার কিছু যাবে আসবে না। লক্ষ-লক্ষ বোধশক্তিহীন মানুষ প্রতিদিন তার এসব ঘৃণায় ঠাসা মতলবি বয়ান গিলতেছেন। তার বিরুদ্ধে কথা বলার মতো পরিস্থিতি দেশে এখনো তৈরি হইতে দেরি আছে। বিরুদ্ধে বলা মানে পিনাকীর বয়ানজালে বন্দি অন্ধ লোকগুলার লাগাতার গালিগালাজ ও অশ্লীল হুমকি-ধামকি হজম করা। নিজেরা ফ্যাসিস্টের লক্ষণ বহন করায় অন্যকে সেই নামে ট্যাগ দিতে পিনাকীভক্ত গুণ্ডারা কাজেই একপল ভাবে না।
আনসাং হিরোর ফুলের মালা গলায় নিয়া তার চোখে ফ্যাসিস্টদের জয় বাংলা করায় লিপ্ত এই বিপ্লব-বেহুঁশ লোকটাকে মানুষ জুতোর মালা গলায় পরিয়ে লাত্থি দিবেন, নাকি সে ক্রমশ তাদের কাছে জীবিত কিংবদন্তি হইতে থাকবে ইত্যাদি নিয়া নিদান হাঁকার সময় বেশি দূরে নাই অবশ্য। নিজেকে নিয়া এই-যে ধাঁধা তৈরি করছেন পিনাকী, এটা তাকে সবসময় সিনে রাখতেছে, প্রাসঙ্গিক রাখতেছে প্রতিনিয়ত। লোকটা আসলে কী, তার মতলব কী… এসব প্রশ্ন যে-কারণে অনেকের মনে এখনো সেভাবে জাগ্রত হইতেছে না, তবে আজ-নয়-কাল জাগ্রত হইতে বাধ্য।
তর্কের খাতিরে ধরে নিতেছি পিনাকী ভট্টাচার্য বিপ্লবী। মেনে নিতেছি, বিপ্লবের সংজ্ঞায় পরিষ্কার ধরা না পড়লেও তার মতো অ্যাক্টিভিস্ট পৃথিবীর ইতিহাসে ব্যতিক্রম একখানা বিপ্লব বাংলাদেশে প্রসব করছেন। এমন সব বয়ান তৈরি করতে সক্ষম হইছেন যার থেকে অমাদের শেখার আছে অনেক। আম্রিকা যেমন ফলস ওয়ার করে অনেকসময়,- পিনাকীও বিপ্লব না ঘটিয়ে বিপ্লব ঘটাইছেন। জাতিকে বিপ্লবের বয়ান গিলতে বাধ্যও করছেন বেশ! তো এই সুবাদে চে গাভেরার কথা ইয়াদ যাইতে বাধ্য আমরা। দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরিজ আমার ধারণা অনেকে পাঠ করছেন। পাঠ না করে থাকলে এইটা নিয়া যে-চলচ্চিত্র তৈরি হইছিল, বিস্তর লোকজন সেটা মন ভরে এখনো দেখতে আছেন। দেখার মতো ছবিই বানাইছেন লাতিন সিনেমাকার ওয়াল্টার সেলেস। বই বা ছবি না দেখে থাকলে নেটে ঘাঁটাঘাঁটি কিংবা চ্যাট-জিপিটির সঙ্গে দুদণ্ড বাতচিত চে গাভেরার বিপ্লবী চরিত্র বুঝতে সাহায্য করে বৈকি।
চে নিয়া সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দীর্ঘ একখানা কবিতা লিখছিলেন। ওই, চে তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়… ইত্যাদি বইলা ট্রিবিউট দিছিলেন এই বিপ্লবীকে। বিপ্লবের ইতিহাসে চে এমন একখান চরিত্র যাকে বাদ দিয়া আপনি এক-পা সামনে অগ্রসর হইতে পারবেন না। এমন একজন মহান বিপ্লবী তাঁর ডায়েরি ও বক্তিমায় একজন বিপ্লবীর গুণ কী হওয়া উচিত এসব নিয়া কথা বলছিলেন বৈকি। তার মধ্যে কিছু পয়েন্ট মার্কামারা। মানে হইতেছে, এগুলা ছাড়া কারো পক্ষে বিপ্লবের পয়লা কদম রাখা সম্ভব না। আমি নিচে তার কয়েকটা তুলে দিতেছি।

সেইসঙ্গে এই প্রশ্নখানা থার্ড লেন-র পরিসরে তুলতে চাই,- চে গাভেরার দাগানো বৈশিষ্ট্যকে যদি আমরা ল্যান্ডমার্ক ধরি তাহলে পিনাকীর মধ্যে বিপ্লবী গুণের উপস্থিতি কি পাইতেছি আমরা? পাইতেছি বইলা যদি মনে হয় তাহলে এর কোনটা কী পরিমাণে তার মধ্যে দৃশ্যমান? যেসব গুণকে চে গাভেরা আবশ্যক বইলা গণ্য করতেছেন, তার মধ্যে কোনটা এখন চোখে পড়ার মতো পিনাকীতে সক্রিয় বইলা ধরা যাইতে পারে? আর, কোনটা নাই বইলা ধরা সম্ভব? জানার আগ্রহ থাকতেছে। কেউ যদি যোগ করেন তাহলে ঋদ্ধ হইতে পারি।
. . .
বিপ্লবীর জন্য জরুরি নসিহত : এর্নেস্তো চে গেভারা বিপ্লবী তার আদর্শে ইমান রাখবে। আদর্শের ওপর তার আস্থা, বিশ্বাস ও মনোবল অটুট থাকবে। বিপ্লবী লক্ষ্য অর্জনের ক্ষুধা ও আবেগে নিজেকে অটুট রাখবে সে। সাহসী ও অকুতোভয় হবে। কোনোকিছু যেন তাকে সংকল্প হতে বিচ্যুত না করে। বিপ্লব সংঘটনের বাইরে বিপ্লবীর কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ থাকা যাবে না। তার স্বার্থ একটাই,- বিপ্লব সফল করা। নিজের ব্যক্তিগত লাভক্ষতিকে সে গোনায় নেবে না। সে বিনয়ী হবে। অকারণে কাউকে আঘাত হানতে যাবে না। প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই মানে এটা নয়,- তাকে সারাক্ষণ জঙ্গি থাকতে হবে। সে হবে বিবেচক ও কৌশলী। বিপ্লবী মনোভাব মানে হলো মানুষকে শোষণ ও অবিচারের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা। একটি সুদীর্ঘ সংগ্রাম, যার জন্য বিপ্লবীকে দৃঢ় মনোবলে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়াই করতে হতে পারে। এই মনোভাবটা বিপ্লবের সারকথা। এছাড়া কিছু অর্জিত হওয়ার নয়। . . .
. . .