নিজের জীবনকে বিপন্ন করে মেরিনা আব্রামোভিচ এই-যে রিদম জিরোর পরীক্ষাটি নিয়েছিলেন, তার মধ্য দিয়ে আমরা মানব প্রজাতি চিরন্তন বিষবৃক্ষের নিকট ফেরত যাচ্ছি। আমরা ফলভক্ষণ করেছিলাম এই পরিণাম না জেনে,—এখন থেকে আমরা হয়ে উঠব এমন এক অভিশাপ, যার দিকে তাকালে মন ভালোবাসায় ভরে উঠবে তাৎক্ষণিক, এবং ভালোবাসা অচিরে মোড় নেবে ঘৃণায়। মানুষ তার নিজেকে ঘৃণা করে, যেখানে তার নিজের ও অন্যের প্রতি ভালোবাসা হচ্ছে নিছক অভিনয়। সে অবিনয়ী ও দুর্বিনীতি;—যেখানে পাশবতা হচ্ছে তার আদি চালিকাশক্তি। বাকিটা সমাজের বুকে বিচরণের সুবাদে সৃষ্ট, এবং সে-কারণে তারা মুহূর্তে বিপন্ন হয়ে পড়ে। মানুষকে কাজেই আইন ও শঙ্খলা দিয়ে বাঁধা ছাড়া স্ববশ রাখা কঠিন।
-
-
কিন্তু একই কবি যদি আমাদের মতো তুচ্ছতায় নিজেকে ক্ষয় করতে থাকেন, বিচিত্র বাহানায় সুবিধালোভী হয়ে ওঠেন, তখন তার কবিতায় এর ছাপ পাঠক টের পায়। আমার ধারণা, জাগতিক সুযোগ-সুবিধার প্রতি কবির লোভ তার কবিসত্তায় শায়িত শক্তিকে খাটো করে। তিনি হয়তো তখনো চমৎকার কবিতা লিখছেন, কিন্তু তা কবিতার চেয়ে বেশি কিছু আমাদের দিতে পারে না। সুবিধাবাদ কবির শিল্পসত্তাকে দুর্বল করে দেয়।
-
প্রযুক্তি-সামন্তবাদ ওরফে টেকনো ফিউডালিজম এভাবে রাষ্ট্রকে ধীরে ধীরে অকার্যকর করে দিচ্ছে। মধ্যযুগে রাজারা সামন্তবাদী ভূস্বামী ও বণিকদের ওপর নির্ভরশীল ছিল! ডিজিটাল সামন্তবাদের পুরোহিতচক্রকে অনেকটা সেরকম দেখতে! ইলন মাস্ক, জেফ বেজোস, স্যাম অল্টম্যান, বিল গেটসের মতো ব্যক্তিরা সেখানে আসল চালক। মধ্যযুগে বিরাজিত খ্রিস্টান চার্চের মতো সমস্ত ক্ষমতা তাঁরা কুক্ষিগত রেখেছেন। এসব কারণে ভারোফাকিস বলছেন, আমরা এমন এক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছি যেখানে কর্পোরেট ডিজিটাল লর্ডদের অধীনে আমাদের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। রাষ্ট্র এখন দুর্বল, এবং গণতন্ত্র হুমকির মুখে। আমরা একটি নতুন ডিজিটাল সার্ফডম-এর দিকে ধাবিত হচ্ছি।
-
এখানে আবার দুটি ভাগ দেখতে পাচ্ছি। শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবু জাফর শামসুদ্দীন বা রশীদ করীম উইরোসেন্ট্রিক বয়ানের মধ্য দিয়ে নিজেকে মুসলমানের গৎবাঁধা সংজ্ঞা থেকে বের করে আনতে তৎপর ছিলেন। এর বিপরীতে ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, শামসুদ্দীন আবুল কালামরা ইউরোসেন্ট্রিক বয়ানে গমন করলেও মোডারেট অথবা সেকুলার মুসলিম হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাদের মনে কস্মিনকালে জন্ম নেয়নি। মুসলমান সমাজকে তাঁরা ধারণ করছেন এবং এর উজ্জীবনের নিশান ইসলামি জাতীয়তাবাদে দেখতে পাচ্ছিলেন বেশ। অদ্য যে-বিষয়টিকে মর্মান্তিক পর্যায়ের প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন গত তিন-চার দশকে দেখা দেওয়া কবিলেখকের দল। এই জায়গা থেকে ভাবলে আবু জাফর শাসুদ্দীনের পদ্মা মেঘনা যমুনার বয়ানবিশ্বকে তাঁরা হয়তো প্রত্যাখ্যান করবেন এখন।
-
জনপ্রিয় সংগীতে চোখে পড়ার মতো গুণগত ও মৌলিক পার্থক্য না থাকায় এর কোনো কেন্দ্রীয় বার্তা থাকে না। তবে জনপ্রিয় সংগীত যে-দার্শনিক দৃষ্টিকোণ ধারণ করে, এর ভিতর দিয়ে অর্থ-সামাজিক প্রবাহের চিত্রখানা পাওয়া যায়, এবং এ-কারণে তার প্রভাব বাড়তেই থাকে। আধুনিক পুঁজিবাদে বিচ্ছিন্নতাবাদের সমস্যাকে সে প্রকট করে তোলে। জনপ্রিয় সংগীতে নিহিত ক্ষণিক আনন্দ হলো বিচ্ছিন্নতাবাদ থেকে একধরনের মুক্তি। সত্যিকার তৃপ্তি দিতে না পারায় অবিচ্ছিন্ন একটি চক্রে মানুষকে সে বেঁধে ফেলে। ভোগ, বিচ্ছিন্নতা, বিরক্তি ও বিক্ষিপ্ততাকে যেটি কিনা প্রলোভিত করে ।