মহাবিশ্বের অজানা বার্তা পৃথিবীতে পৌঁছে দিতে এখন পর্যন্ত যতগুলো বৈজ্ঞানিক অভিযান নাসা পরিচালনা করেছে, তার মধ্যে ভয়েজার ১ ও ২ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। শনি ও বৃহস্পতি গ্রহের খবর জানতে ভয়েজার মিশন ১ সত্তর দশকের শেষ দিকে মহাকাশে যাত্রা করে। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে পথচলা অব্যাহত রেখেছে সে। অচিরে হয়তো পৃথিবীর সঙ্গে সকল সংযোগ টুটবে তার!
আজকের একটি সাধারণ কম্পিউটার প্রসেসরের যেসব সক্ষমতা থাকে, তারচেয়ে কম সক্ষমতা দিয়ে ভয়েজার ১-এর রোবটিক মস্তিষ্ক বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছিলেন। নকশা ও প্রকৌশল এতটাই নিখুঁত ছিল, ভয়েজার ১ এখনো নিজের সক্রিয়তা ধরে রেখেছে! ভয়েজার ২ সম্ভবত আশির দশকের মাঝামাঝি মহাকাশে ছেড়েছিল নাসা । চল্লিশ বছরের পথযাত্রায় কোটি-কোটি মাইল পাড়ি দিয়ে ফেলেছে সে। দুই যমজ যত ছবি প্রেরণ করেছে, সেগুলোর গুরুত্ব বলে বোঝানোর নয়। নাসার ওয়েবসাইটে চোখ রাখলে বোঝা যায়,—অজানা মহাবিশ্বকে জানতে ছবিগুলো কতটা সাহায্য করেছে বিজ্ঞানীদের!

নাসার সঙ্গে প্রোব দুটির সংযোগ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণ হয়ে আসছে। একসময় আর কোনো সংযোগ থাকবে না। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো দুর্ঘটনার শিকার না হলে মহাকাশে তারা আরো কিছুদিন ছুটবে। যন্ত্র বিগড়ে যাওয়ার চিরাচরিত নিয়মে একসময় আয়ু ফুরিয়ে আসবে;—নাসা যে-খবর জানতেও পারবে না হয়তো! ইতোমধ্যে যে-দূরত্বে তারা চলে গেছে, সেখান থেকে সংকেত আদান-প্রদান সময় সাপেক্ষ। ব্যয়বহুল আর জটিলও বটে। নাসা কাজেই নিজের থেকে সংযোগ ছিন্ন করবে অচিরে। কাটবে প্রোব দুটির সঙ্গে মমতার বন্ধন।
ভয়েজার ১ ও ২-এর প্রসঙ্গ উঠলে কার্ল সাগানকে মনে পড়বেই পড়বে। দুটি মহাকাশযানে সংযুক্ত সোনালি চাকতির নকশা ও সেখানে কী থাকবে তার পরিকল্পনায় এই পদার্থবিদ ও বিজ্ঞানলেখক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিভিয়েছিলেন তখন। কার্ল সাগান একসময় কসমস নামে জনপ্রিয় টেলিভিশন শো উপস্থাপনা করতেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনও সিরিজটি প্রচার করেছে ওইসময়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ আমরা পা রেখেছি। ভয়েজার ১ ও ২-এর নকশা ছাড়াও বিবিধ দায়িত্বে কাঁধে নেওয়া কার্ল সাগান মহাকাশযান দুটিকে সেইসময় বুদ্ধিমান সত্তা নামে ডেকেছিলেন। তাঁর কাছে তারা ছিল রোবটিক ব্রেন ও মানবমস্তিষ্কের এক অনন্য মেলবন্ধন।
ভয়েজার মিশনের লক্ষ্য কেবল আমাদের সৌরজগৎ ও মহাকাশের তথ্য সংগ্রহে সীমাবদ্ধ ছিল না। আরেকটি বড়ো লক্ষ্য ছিল,—মহাকাশে কোথাও যদি প্রাণের অস্তিত্ব থাকে, যদি ভিনগ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীরা থেকে থাকে,—তাদের কাছে পৃথিবীর বার্তা পাঠানো। বিষয়টি মাথায় রেখে কার্ল সাগান সোনালি চাকতিতে প্রাণচঞ্চল ধরিত্রীর বিবিধ নমুনা সংযুক্ত করেছিলেন। প্রকৃতিতে যেসব ধ্বনির সঙ্গে আমরা পরিচিত তার অনেককিছু রেকর্ড করা হলো। বৃষ্টি, ব্রজধ্বনি ও হাওয়ার ফিসফাস সোনালি চাকতিতে ঢোকালেন কার্ল সাগান। সাগরের গর্জন আর পাখির কূজন বাদ যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, সুতরাং সেগুলোও জায়গা নিলো সেখানে।
নীল তিমিরা পরস্পরকে যখন সংযোগ করে, অদ্ভুত সাংগীতিক ব্যঞ্জনা তৈরি হয়। সোনালি চাকতিতে সেই ধ্বনিব্যঞ্জনা যুক্ত করলেন কার্ল সাগান। মানবধরায় মানুষের আহার-বিহার ও মৌজ-মাস্তির ছবিও জুড়লেন বটে! ৫৫টি ভাষায় অজানা ভিনগ্রহীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে পাঠানো বার্তা জুড়তেও ভোলেননি। ৫৫টির মধ্যে আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলাও জায়গা করে নিয়েছিল। চাকতিতে আরো সংযুক্ত হলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচলিত সংগীতের নিদর্শন। বিথোভেনের পঞ্চম সিম্ফনি আর বাখের ব্রান্ডেনবার্গ কনচার্টোর অংশ বিশেষ। চাক বেরির জনি বি গুডও বাদ পড়ল না। উচ্ছল সুরেলা গানখানা সোনালি চাকতিতে সাগ্রহে সংযুক্ত করলেন সাগান।
ভয়েজার সময়ের সঙ্গে বিকল হয়ে যাবে। থেমে যাবে পথচলা। কিন্তু সোনালি চাকতিতে করে মানবধরার যেসব বার্তা সে মহাকাশে ছড়িয়ে দিলো, সেটি থামবার নয়। হতেও পারে ভিনগ্রহী কোনো প্রাণীর কাছে আচমকা পৌঁছে যাবে সেগুলো। পৌঁছাবে পাখির কূজন আর সাগরের গর্জন। আচমকা বেজে উঠবেন বিথোভেন নয়তো বাখ। চাক বেরির জনি বি গুড শুনে কি চমকে যাবে তারা? ৫৫টি ভাষায় পাঠানো শুভেচ্ছাবার্তার কোনো একটির অর্থ হয়তো ধরে ফেলবে, আর মানবধরায় পাঠাবে ফিরতি সংকেত। যেখানে কার্ল সাগান নামধারী এক স্বাপ্নিক মহাপ্রাণ সোনালি চাকতিতে পুরে মানবধরার বার্তা নিঃসীম মহানভে পাঠিয়েছিলেন একদিন।
. . .
. . .