হেলাল চৌধুরীর কবিতা
আসপাশিয়ার পানপাত্র ও অন্যান্য কবিতা

আসপাশিয়ার পানপাত্র
আমাকে নাও
আমাকে পান করো
তোমার জন্য এই অনন্ত সন্ধ্যায় আমি একপাত্র সুরা…
তোমার জন্য আমার বিকাল
এখন অস্তিত্বসঙ্কটের কাল
তবু তোমার কাকপক্ষ ছোঁয়ার অদম্যে আমি বেহাল…
এই সন্ধ্যায় আমি বুঝি আজ
সক্রেটিসের চেরোফোন
হে পানপাত্র, হে আসপাশিয়া
তোমাকে প্রাণভরে আমি আরও আরও আরও চাই।
. . .
এক শাশ্বত মানুষের গল্প
ইলা সে তো নারী নয়—নয় শাশ্বতী কোনও;
শাশ্বত মানুষ-এক সে
পৃথিবীর অসুস্থ মগজে নিয়ত ছড়াতেছে সে সবুজ রঙের আলো…
আকাশের চাঁদ ডুবে গেলে
সে এসে দাঁড়ায় অন্ধকার আঙিনায়
তারপর তার অকৃপণ হাত ছিটিয়ে যায় বীজ আলোর আড়ম্বরে…
পৃথিবীর মানুষ
আজ অন্ধ আর খোঁড়া
তারা তারে দেখে না, তাই তারা হাঁটতে জানে না; তবুও
সে তাদের খয়েরি মাঠ রাঙাতেছে অন্ধকারে তার বিকীর্ণ প্রেমে।
. . .
কতদূর, মানবিক জাহাজ
আমার টাইটানিক ডুবে…
তুমি সীল ধরো বেআইনি মুখ ফিরিয়ে
কীকরে স্যাম্পসন তুমি অমানবিক চলে যাও দূরে…
আমার টাইটানিক ডুবে…
তুমি কুয়াশার দাপটে—ভয়ে
ক্যালিফোর্নিয়ান ক্যাপ্টেন হয়ে ঘুমাও অকাতরে…
কতদূর, বলো আর কতদূর…
কারপাথিয়ান্স মানবিক তুমি—কবে
আটলান্টিক পাহাড়ি দুঃশাসনে
জলমগ্ন আমার টাইটানিক উদ্ধার কাজে—তবে!
. . .

তেল
ঢেউ, আমার সঙ্গে তোমার
কেন এত অহমিকা বলো, হে বন্ধু আমার
আমি একফোঁটা তেল, ঠোঁট চুমে তোমার ছুঁয়ে নেব ডাঙা বেলার…
তুমি তাবৎ ডুবাতে পারো, পারো না কেবল আমাকে
তোমাকে ডিঙাতে আমার এক তিল পরিশ্রম নেই জেনো
তোমারই ঘাড়ে শুয়ে অনায়াসে আমি—তোমাকেই ডিঙাতে পারি…
তবে কেন
এত তোলপাড়
অহমিকা বুকে তোমার…! তোমার
অহমিকা নিয়ে যাবে তোমাকে অস্ফীতজলে নীরবতা যখন চাঁদের।
. . .
জলের উট
আমি ডাঙায় বসে থাকার জন্য নই কেউ
আমি ঢেউ কেটে কেটে জলপথ পাড়ি দেওয়ার সৈনিক
আমি জলবীর বিশাল জাহাজ-এক, আমি চির নির্ভীক…
আমি বুকে নিয়ে চলি
অজস্র অসহায় নাগরিক
ডাঙার ঠিকানা চেয়ে গাঙচিল ডানায় চলি এক অভীক…
জলের উট
গ্রীবায় তোলপাড়
চূড়ায় পিলসুজপ্রদীপ ঈগলের চোখ, অন্ধকারে
খুঁজে ফিরি আমি দারুচিনি দ্বীপ—আমি চিরসৌমিক।
. . .
চন্দ্রবিন্দু
আমরা দুজনে দুই নক্ষত্র—ধ্বনিতত্ত্বের চন্দ্রবিন্দু
তুমি চন্দ্রের বুকে যুগযুগ শুয়ে বিন্দু ফোঁটায়
আমরা দুজনে কেউ কাউকে ছাড়া কখনও নই পূর্ণ…
যদিও কেউ কাউকে আজও
স্পর্শ করতে পারিনি আঙুলে
তুমি-না, আমি-না—তবু জানি দুজনেই এক অঙ্গ, এক বর্ণ…
যদিও আমাদের
দুই পারে দুই অঙ্গ
তবু আমরা এক ধ্বনি এক বর্ণ
তুমি নক্ষত্র আমি চাঁদ তৃতীয়ার, এক বর্ণ এক তনু চন্দ্রবিন্দু।
. . .
পিস্তল
আবারও ধরলাম ঠোঁটে
আগুনের নল পিস্তল
দেশলাই জ্বেলে জ্বালাই কষ্টের কাঠি…
বাতাসে ছড়াই
হাওয়াই দুঃখ
ধোঁয়াজালে ওড়াই কষ্টের ছাইপাখি…
পুড়াই
দেশলাইয়ে
বুকের কষ্ট
আগুনের নল ঠোঁটে আমিই পিস্তল।
এমিলি শেঙ্কল
তুমি যদি ভালোবাসতে চাও
তবে এমিলির কাছে যাও
শিখে নিয়ো তার কাছে চিরায়ত প্রেম…
সাইত্রিশের সুভাষ পঁচিশের টানে
নিমজ্জিত টাইটানিক
এমিলি শেঙ্কল আটলান্টিক…
বিজ্ঞাপন নয়
প্রচার নয়
বিশুদ্ধ বিস্ময়! তাঁর
কাছে জেনেছি প্রেম আলছাড়া সবুজ মাঠ।
. . .
কাঠের তনু
এখন আর আমরা রোপণ করি না ঋতুগাছ
আতা পেয়ারা ডালিম জামরুল কিংবা লেবুর ঘ্রাণ
জিইয়ে যাই আমরা আজ বড়ো বড়ো টাকাগাছের প্রাণ…
আমাদের উঠোনে গ্রাম নেই তেঁতুলের গাছ নেই
আম জাম লিচু আর কাঁঠালের ছায়ায় মায়াভরা উঠোন নেই
আমাদের উঠোনে বেড়ে ওঠে অজস্র বুনোগাছ টাকার শরীর…
ছায়াবতী
মায়াবতী
মিষ্টিকায়া মানবিক গাছ নেই; আমরা চাই আজ দানবিক
আমাদের উঠোনে বেড়ে ওঠুক বেসাতির বুক কাঠের তনু।
. . .
আক্ষেপ
তোমাকে দিলাম জীবনানন্দের শঙ্খচিল
আমি নিলাম গাঙ্গুলির কুকুর
বোষ্টুমীর অন্তরার দুঃখ…
তুমি উড়ো আকাশে নীল মেঘে
আমি ভাসি নাদের আলীর নাওয়ে পদ্মবিল
বরুণার রুমাল চেয়ে…
কুকুরের
আজও দেখা হয়নি,
তার
শঙ্খচিলে আকাশ কিংবা তিন প্রহরের বিল।
. . .

. . .

কবি হেলাল চৌধুরী। সত্তর দশকের গোড়ায় তাঁর জন্ম। আদিনিবাস সিলেটের জৈন্তাপুর। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। পেশায় অধ্যাপনাকে বেছে নিয়েছেন। ছাতক শহরের জনতা কলেজে ছাত্র পড়িয়ে কাটে দিন। সম্পাদনা করেছেন ছোটকাগজ ফিনিক। ছবি আঁকা ও কবিতা লেখায় সক্রিয় নিয়মিত। প্রথম প্রকাশিত ইলার শিষে ভাঙে ঘুম ও আপাত সর্বশেষ প্যাপিরাসের নৌকা মিলে প্রকাশিত কবিতাবইয়ের সংখ্যা চারটি। সত্তা ও অস্তিত্বের আভাসঘন নিগূঢ়তা কবি হেলাল চৌধুরীর কবিতার মৌলসুর। প্রেম-নিসর্গ-নৈঃশব্দ্যের জলধ্বনিতে কান পাতেন নীরব। তাঁর কবিতা যেন-বা এক মৃদুভাষী দূরালাপ। যে-দূরালাপ কবি মগ্নচেতন তার নিজের মধ্যে ও যাপিত পরিপার্শ্বে।
