নেটালাপ - পোস্ট শোকেস

নিরীক্ষা ও বিনির্মাণে জীবনানন্দ দাশের অন্ধকার-২

Reading time 10 minute
5
(65)
@thirdlanespace.com

. . .

তোমার মহীনের ঘোড়াগুলো
হেলাল চৌধুরী

জীবনানন্দ, আজও আমি শুনি
ভোরে, তোমার ঘাইহরিণীর চিৎকার
দেখি অরুণিমা স্যান্যাল কাঁদে, বসে জোছনায় মাঠে;
তাই তোমার শেফালিকা বোস চায় আজ
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খাক কার্তিকের জোছনার প্রান্তরে…

এখনও তোমার সোনালি ডানার চিল
হায় চিল হয়ে উড়ে উড়ে কাঁদে ধানসিঁড়িটির তীরে
বেড়াল চিতারা হাঁটে তোমার সবুজ হেমন্তের মাঠে;
তাই তোমার শেফালিকা বোস চায় আজ
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খাক কার্তিকের জোছনার প্রান্তরে…

এখনও তোমার নবান্নের মাঠে
শিকারির গুলির শব্দে বাতাস কেঁদে ওঠে
হায়েনা শকুনেরা নেচে ওঠে আলোর আড়ম্বরে;
তাই তোমার শেফালিকা বোস চায় আজ
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খাক কার্তিকের জোছনার প্রান্তরে…

. . .

পাঠ নিছক তৃপ্তি বা বিনোদন নয়; পাঠ হচ্ছে রীতিমতো ধর্ষণ
Reading is not for fun or pleasure; it is for rape.

জীবনানন্দ দাশের টেক্সট নিয়ে আপনার নিরীক্ষা পাঠ করতে বসে অন্য একটি ভাবনা মনে উদয় হলো হেলাল ভাই। করোনা অতিমারি চলমান থাকার সময় রবি ঠাকুরকে নিয়ে গানপার-এ ধারাবাহিক একটি গদ্য লিখেছিলাম। রবীন্দ্রনাথের কবিতা বর্তমানে আমাদের জন্য কতখানি প্রাসঙ্গিক, তাঁকে এখন আমরা কীভাবে পাঠ করছি, এবং করে থাকলে তার অভিঘাত… ইত্যাদি ভাবিয়েছিল বেশ! কবির নিজ হাতে সাজানো সঞ্চয়িতার আলাপ আলাদা পরিসরে তুলেছিলাম সেই লেখায়।

রবির নিজ হাতে সাজানো সঞ্চয়িতার বাইরে আরো অনেকেই তাঁর কবিতা সংকলন আকারে বের করেছেন ফিরে-ফিরে। সঞ্চয়িতার কাউন্টার রিডিং বলা যায় এগুলোকে। যেমন, শঙ্খ ঘোষ করেছেন। হুমায়ুন আজাদ এখানে করেছেন। পছন্দের ক্রমানুসারে ঠাকুরের কবিতা বাছাই করেছেন প্রত্যেকে। এর পেছনে তাঁদের অনুভবে বহমান সময়চেতনার আলোয় রবীন্দ্রনাথের কবিতা বেছে নেওয়ার ভাবনাটি গুরুত্ব পেয়েছে।

আমার মনে তখন এই ভাবনা উঁকি দিয়েছিল,—সঞ্চয়িতাকে কবির প্রকাশিত বই ও কবিতা রচনার ক্রমানুসারে পাঠ করার প্রথা কেন ঘুরেফিরে সবাই মাথায় নিচ্ছেন! এর থেকে বেরিয়ে আসা সবার আগে দরকারি হচ্ছে না কেন? প্রত্যেকে নিজের পছন্দে কবিতা বাছাই করছেন, সেটি ঠিক আছে, কিন্তু সেখানে কবি বিরচিত সঞ্চয়িতার ক্রমবিন্যাস মোটের ওপর রেখে দিচ্ছেন তাঁরা! কেন? প্রতিটি বই থেকে কবিতা নিতে হবে, এমন কথা নেই। এই সময়ের পাঠ-অনুভবে যেগুলো অমোঘ মনে হবে, সেগুলো থাকবে, বাকিরা বাদ গেলে ক্ষতি নেই। হতে পারে, একটি বইয়ের সবগুলো কবিতা নতুন সঞ্চয়িতা-য় ঢুকবে। অন্য বইয়ের অল্প বা প্রয়োজনে পুরোটা বাদ দেওয়া লাগতে পারে। সেরকম ঘটছে না কী-কারণে!

অনুভূতির বিন্যাস অনুসারে রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে ভাগ করা যেতে পারত অনায়াস। যেমন, মৃত্যুভাবনা বিষয়ক কবিতারা পরপর স্থান পাবে নতুন সংকলনে। আবার ঋতু, প্রকৃতি বা সংসাররঙ্গ ইত্যাদি নিয়ে লেখা কবিতা এভাবে টানা যাবে সেখানে। তাতে করে রবি বিরচিত অনুভূতি প্রবাহের শক্তি, গভীরতা ও খামতির অনেকখানি পরিষ্কার বোঝা যাবে। যেমন ধরুন, প্রেমকে উপজীব্য করে লেখা কবিতাগুলো আমরা পরপর রাখলাম। প্রেমানুভূতির এই একটানা পাঠের ধকল সামলানোর পর বোঝা যাবে,—রবি কবির প্রেমযাতনার চাপ পাঠকের ত্বকে কতটা দাগ রেখে গেল!

যে-কোনো একটি অনুভবের ভিতরে একটানা গমন ও সেখানে জারি থাকা কঠিন কাজ। স্নায়ুর ওপর চাপ পড়ে। মন ক্লান্ত হয় দ্রুত। দেবেশ রায়ের টানা বর্ণনাধর্মী গদ্য এ-কারণে অনেকের সয় না। যেমন, বাঁশঝাড়ের বিবরণে তিনি ব্যয় করছেন পৃষ্ঠার-পর-পৃষ্ঠা! বিবরণটি আলাদা পরিসরও তৈরি করছে। এখন, পাঠক যদি চাপটি নিতে পারে, তাহলে বোঝা গেল,—তার দম আছে। না পারলে,—ওখানেই খতম তার পাঠবাসনা।

Debesh Ray; Image Source – Collected; Google Image

এর বড়ো উদ্দেশ্য হচ্ছে, পাঠককে স্মরণ করানো যে,—পাঠ বস্তুটি নিছক প্লেজার বা বিনোদন নয়, বরং অতিশয় বিরক্তিকর এক ভ্রমণ, যার মধ্য দিয়ে তার দেখা-বোঝা ও জানাশোনার জগৎ টলে উঠছে। ছারখার হয়ে যাচ্ছে সব! ওই গদ্যে তাই লিখেছিলাম, উদ্ধৃতি করছি :

বঙ্গ দেশে পাঠ এখনও প্লেজার বইলা গণ্য হয়। পাঠ বস্তুখানা অবশ্যই কোনো প্লেজার না! পাঠ হইতেছে নিজের ত্বকের ভিতরে অস্বস্তির নাম। পাঠককে ক্লান্ত করবে সে। অস্বস্তির দিকে তারে ঠেলতে থাকবে। তার পাছায় চুলকানির বেগ উঠাবে। সে সম্মোহিত হইতে বাধ্য হবে তাতে। পড়তে বসে ঘন ঘন হাই উঠবে তার। এবং, হাই তুলনের পর পুনরায় পাঠে ফেরত যাইতে বাধ্য বোধ করবে। বেরিয়ে যাওয়ার সময় আবার ঢুকবে সেখানে।

জার্নিটা একসময় শেষ হবে, আর তার তখন মনে হইতে থাকবে,—নিজেকে শূন্য, রিক্ত লাগতেছে! ক্লান্ত করলেও জার্নিটা দরকারি ছিল। এরকম জার্নির মধ্য দিয়া মরা টেক্সট নতুন জীবন ফেরত পায়। সম্পাদনা বা সংকলন হইতেছে সেইরকম একখান কাম। টেক্সটকে গার্ডেনিং করা সেখানে উদ্দেশ্য হইতে পারে না। সে সম্পাদনা করবে টেক্সটকে রেইপ করার জন্য।

কথাগুলো, আপনার জীবনানন্দ পাঠ ও বিন্যাসের সুবাদে ইয়াদ হলো মাত্র। আপনি বলেছেন, নিজের মৌলিক স্বর এখানে আপনি জুড়বেন না। জীবনানন্দের টেক্সট থেকে অবিরত লাইনের পর লাইন ও ক্যারেক্টার তুলে এনে সাজাবেন। এবং, এর বিন্যাস এমন হবে,—যেন পাঠের পর পাঠক বর্তমানে নেমে আসা বা অনেকদিন ধরে চলতে থাকা অন্ধকার টের পায়। কাজটিকে জীবনানন্দ দাশের টেক্সটকে গার্ডেনিং করার বাহানায় রেইপ বলতে চাইব আমি। সেক্ষেত্রে, এ-পর্যন্ত পঠিত কবিতায় রিপিটেশন পাচ্ছি। মানে, অন্ধকার তোলে ধরা যদি আপনার উদ্দেশ্য হয়, তাহলে আগে আপনার চোখে অন্ধকার কতভাবে ধরা পড়ছে,—তার ফয়সালা আগে হওয়া প্রয়োজন।

এটি হয়ে গেলে জীবনানন্দের টেক্সটে যাওয়া অধিক সুগঠিত ও লক্ষ্য সরবরাহে কামিয়াব হবে বলে আমার ধারণা। দেখে নেওয়া যাবে,—তিনি কতখানি সরবরাহ করতে পারছেন আপনাকে। জার্নিটা তাহলে শক্তি ও সংহতি পাবে। অন্যথায়, পাঠক ঢোকার পরেই বের হয়ে যাবে। আশা করি ভাববেন।
. . .

মিনহাজ, আমি জীবনানন্দ দাশের সবুজ ঘাসে বারবার অন্ধকার নেমে আসে—এ-প্রত্যয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তাঁর সময়ও এ-অন্ধকার ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এ-অন্ধকার যেন আমাদের যুগযুগ ধরে উড়ে চলা মেঘদূত-এর মেঘ।
. . .

আপনার উদ্দেশ্য শুরু থেকেই পরিষ্কার হেলাল ভাই। কবিতার পাঠেও আমরা পাঠক তা ধরতে পারছি। আমি আসলে সবুজ ঘাসে বিরাজমান অন্ধকারের ডাইমেনশন ও তার ব্যাপ্তি কীভাবে আপনি আনছেন, সেটি মিন করেছি।

জীবনানন্দের টেক্সট থেকে কবিতাগুলো আপনি সাজাচ্ছেন হেলাল ভাই, এখন এই সাজানোর মধ্যে অন্ধকারের সম্ভাব্য কতগুলো ডাইমেনশন আমরা পেতে পারি,—তার ওপর নির্ভর করছে সাজানোর সার্থকতা। যেমন ধরুন, দেশজুড়ে উগ্রপন্থার উত্থান ঘটেছে, এটি একটি ডাইমেনশন। নারীশক্তিকে পুনরায় পর্যদুস্ত করার প্রয়াস জোরদার হচ্ছে, তার মানে এদিকটায় অন্ধকার বিস্তার লাভ করেছে। আবার এই দেশের জন্মকে পালটা বয়ান দিয়ে বিপর্যস্ত করার চেষ্টা তীব্র হতে দেখছি;—অন্ধকার এখানেও ঘনীভূত হচ্ছে ক্রমশ। প্রযুক্তির নতুন পালাবদলের প্রভাবে আমাদের জীবনধারা ও ভাবনায় আমূল রদবদল ঘটে চলেছে। যুদ্ধ, সহিংসতা, স্নায়ুযুদ্ধ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও একাকীত্ব… এসব তো রয়েছেই।

এভাবে লম্বা তালিকা ফাঁদা যাবে। এগুলো এখন অন্ধকারের এক-একটি ডাইমেনশন যদি ধরি, জীবনানন্দের কবিতা থেকে সেইসব পঙক্তি, চরিত্র, সারার্থ আপনাকে বেছে নিতে হবে, বিন্যাস করতে হবে এমনভাবে, যেন প্রতিটি ডাইমেনশন নতুন অর্থ ও চমক আনে মনে। টেক্সটকে রেইপ করা বোঝাতে এটুকু মিন করেছি আমি।

আপনার বাছাই ও বিন্যাসের মধ্যে তা দেখার অপেক্ষায় আছি। যেখানে, জীবনানন্দকে আমরা এই সময়ের একজন কবির চোখ দিয়ে পুনরায় পাঠ ও পুনর্পাঠ করতে আগ্রহী। যেখানে, আপনি তাঁর টেক্সটকে এমনভাবে ব্যবহার করবেন, মনে হবে, এটি কেবল তাঁর হয়ে নেই, আপনার ও আমাদের হয়ে উঠছে।
. . .

Death and Dearkness – Jibanananda Das; Image Source – Collected; Google Image

হেলাল ভাই, ‘সবুজ ঘাসে বারবার অন্ধকার নেমে আসে’ প্রতীকী রূপ‌টি মানুষের অস্তিত্বগত যন্ত্রণার স্থায়ী ছায়া। জীবনানন্দের যুগে যেমন সামাজিক ও ব্যক্তিগত অস্থিরতা ছিল, আজও তেমনই আছে, আর ভবিষ্যতেও থাকবে। এই অন্ধকার কেবল ক্ষণিক নয়, চিরন্তন, যেন কালিদাসের মেঘদূতের মতো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছুটে চলেছে। আলো-অন্ধকারের এই দ্বন্দ্ব মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে তাঁর কবিতায় চিরায়ত রূপ পেয়েছে।
. . .

জীবনানন্দ অলওয়েজ ডার্ক। তাঁর কবিতা ও যাপনে বড়ো কোনো ব্যবধান ছিল না। সকলের মাঝে থেকেই নিজেকে পৃথক ও বিচ্ছিন্ন অনুভবের যন্ত্রণা তাঁকে কখনো ছেড়ে যায়নি। তাঁর একাকীত্বের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একাকীত্বের মিলন নেই, বরং বিচ্ছেদ রয়েছে। একইভাবে তা সুধীন্দ্রনাথের একাকীত্ব ও নিখিল নাস্তির বোধ থেকে আলাদা। জীবনানন্দের কবিতায় মাঝেমধ্যে যে-প্রচ্ছন্ন আশাবাদ আমরা পাই, সেটিও নিরাশা ও নির্বেদের নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়।

ডার্কনেসের এই জায়গায় তাঁর সঙ্গে অনেকটা মেলেন নরওয়ে দেশের ছবি আঁকিয়ে এডভার্ড মুঙ্ক, এবং পর্তুগিজ কবি ফার্নান্দো পেসোয়া। ঘন অন্ধকারের মধ্যেই বাংলার প্রাকৃতিকতায় কবি পুনরায় প্রকৃতি হয়ে ফেরত আসতে চেয়েছিলেন, মানুষ হয়ে নয়। আমাদের প্রথম কবি, যিনি এলিয়েনেশনের মধ্যে দেখেছিলেন সেই ভয় ও আতঙ্ক, স্ক্রিম বা চিৎকার ছবিতে যেটি তুলে ধরেছিলেন মুঙ্ক। জীবনানন্দ হয়তো সে-কারণে মানুষ না হয়ে সুদর্শন চিল হয়ে ফেরত আসার কথা লিখে গেছেন। তাঁর অন্ধকারকে হেলাল ভাই যখন ভিন্ন-ভিন্ন ডাইমেনশন থেকে ভাববেন ও ধরার চেষ্টা করবেন, সেটি আমাদের সময়পর্বে এসে যোগ করতে পারে নতুন মাত্রা।
. . .

হেলাল ভাই, জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বারবার ফিরে আসে অন্ধকারের প্রসঙ্গ। তাঁর নানান কবিতা একটি দোদুল্যমান দৃশ্য তৈরি করে—যেখানে প্রকৃতির সতেজতা ও স্নিগ্ধতা হঠাৎই অন্ধকারের আচ্ছাদনে ডুবে যায়। এই অন্ধকার নিছক রাতের ঘনছায়া নয়, বরং মানুষের অন্তর্গত নিঃসঙ্গতা ও সময়ের ভাঙনের প্রতীক। হ্যাঁ, জীবনানন্দের সময়েও এই অন্ধকার ছিল—যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, রাজনীতির অস্থিরতা, সমাজের টানাপোড়েন সবকিছুই তাঁকে ঘিরে ধরেছিল। তা তাঁর কাব্যভাষায় রূপ নিয়েছে প্রশ্ন হিশেবে—মানুষ কোথায় দাঁড়াবে? কোন আলো তার জন্য সত্যি?

এই সময়েও অন্ধকার আমাদের জীবনে বিরাজমান। প্রযুক্তির আলোকচ্ছটায় ঢাকা পড়লেও নিঃসঙ্গতার গভীর অন্ধকার মানুষকে ঘিরে রাখছে। ভবিষ্যতেও তা থাকবে। ন্ধকার মানবজীবনের চিরন্তন ছায়া। চাইলেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। কেবল তার ভিতর দিয়ে পথ চলতে হয়।

এই অন্ধকার যুগযুগ ধরে উড়ে চলা ‘মেঘদূতের মেঘ’। কালিদাসের মেঘদূত যেমন বার্তা বহন করে নিয়ে চলে অনন্ত আকাশে, তেমনই জীবনানন্দের অন্ধকার যুগে যুগে মানুষের মনে ভর করে থাকে। জীবনানন্দের কবিতায় অন্ধকার মানে কেবল ভয় বা বিনাশ নয়, তা এক রহস্যময় ছায়া, যা মানুষকে নিজের ভিতরে তাকাতে শেখায়, এবং শেখায় আলো ও আশার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে।
. . .

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বিমূর্ততার যে রূপ দেখা যায়, তা অনেকাংশে অ্যাবস্ট্রাক্ট চিত্রকর্মের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। তাঁর কবিতায় অন্ধকার, শূন্যতা কিংবা অলক্ষ্য পাখি—এসব চিত্র বাস্তবকে অতিক্রম করে এক অন্তর্লোকের অনুভূতি জাগায়। যেমন ভাসিলি কান্দিনস্কি বা পল ক্লি’র বিমূর্ত চিত্রকর্মে রং ও রেখা দিয়ে যে-অস্পষ্ট অথচ গভীর অনুভব ফুটে ওঠে, জীবনানন্দের কাব্যেও শব্দ ও চিত্রকল্পে তেমনই অনির্দিষ্ট অথচ গভীর সুর ধ্বনিত হয়। দৃশ্যমান বাস্তবতাকে ভেঙে তিনি নতুন অর্থ নির্মাণ করেছেন, ফলে তাঁর কবিতা আধুনিক শিল্পকলার বিমূর্ততার সঙ্গে মিলে যায়,—এক অনন্য শিল্পমাধুর্যে।
. . .

ভালো বলেছেন বাবুল ভাই, তবে বিনয়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। কারণ, এতে করে জীবনানন্দকে আমরা খামোখা রোমান্টিসাইজ করে ফেলছি। জীবনানন্দ কোনোভাবে রোমান্টিক কবি নন। তিনি এলিয়টদের সমগোত্র। আমার বিবেচনায়,—যুদ্ধ, মারী, মন্বন্তরের পাশাপাশি নগরায়িত অন্ধকারে আচ্ছন্ন বিংশ শতাব্দীর বলি। শহিদও বলতে পারেন। অসংখ্য তো আছে, তার মধ্য থেকে অতিচর্চিত দুটি ইমেজ ইয়াদ করুন। কবি দেখছেন, উটের গ্রীবার মতো অন্ধকার জানালায় গলা বাড়িয়েছে। আরেকটি ইমেজ, যেখানে ইস্পাতের কলের ওপর খড় ঝরে পড়ছে, কবির ভাষায় খড় এখানে বিষণ্ন! দুটি ইমেজ সাংঘাতিক শক্তিশালী। এলিয়টে যেমন পাই আমরা, সেরকম শক্তিশালী। তার সঙ্গে মিশেছে জীবনবোধ ও দার্শনিকতা;—যেটি আবার ত্রিশের কবিদের মধ্যে সর্বাধিক দার্শনিকতালগ্ন কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত থেকে পৃথক।

সুধীন্দ্রনাথ ধ্রুপদি, জীবনানন্দ মর্বিড। যার ফলে ওই-যে আলোর কথাটথা বলছেন, এই পথে আমাদের ক্রমমুক্তি হবে ইত্যাদি বাণী ঝাড়ছেন, মেঠো বাংলার সবুজে ফেরত আসার কথা আওড়াচ্ছেন ফিরে-ফিরে… এর সবটাই ম্লান আর মৃদু শোনায় কানে। একধরনের সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা, কিন্তু তিনি নিজেও জানতেন,—আশা করার মতো কিছু পড়ে নেই বিংশ শতকের দুনিয়ায়।

জীবনান্দকে আমরা কোনোভাবে ইতিবাচকতায় ভাষা দিতে পারব না। এখানে হুমায়ুন আজাদের ভাবনাটি বরং সঠিক,—তিনি পুরোদস্তুর বিমানবিক বিশ্বের কবি। এখন আমরা ডিস্টোপিয়ান যে-অর্থে বুঝি, সেই অর্থে নয় অবশ্যই; তবে শিখরস্পর্শী বিষাদের মধ্যে ধসের আওয়াজ তাঁর কবিতায় এতো তীব্র,—আশাবাদ সেখানে নিস্তেজ সান্ত্বনার মতো শোনায়।

Utpakhi – Documentary on Sudhindranath Dutta; Source – Rough Cuts from Udaya Narayana Singh YTC

সুধীন্দ্রনাথকে এটি করেছিল তর্কপ্রবণ ও উন্মত্ত। যেহেতু তিনি নাস্তিবাদে বিশ্বাসী ও দার্শনিকতায় সুতীব্র ছিলেন। জীবনান্দকে করেছে টাইম ট্রাভেলার। তিনি বারবার ফেরত যাচ্ছেন প্রাচীন ও পৌরাণিক পৃথিবীতে, নয়তো প্রকৃতিতে। যার সবটাই এখন বিকৃত চিৎকারে রূপান্তরিত। পলায়ন নয় তা। এটি হলো গন্তব্যহীনতার বিড়ম্বনা। কেননা, নজরুলের ঢংয়ে লেখা ঝরা পালক-এও নিজেকে আগন্তুক ভেবেছেন কবি, তবে এই আগন্তুক তখনো এটি ডিক্লেয়ার করছে কবিতায় :

আমি কবি—সেই কবি,—
আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি!

মৃদু আশাবাদ আছে ঝরা পালক-এসাতটি তারার তিমির-এ এসে সকল রোমান্টিকতা খতম। জন্ম নিচ্ছেন এক অতিশয় নিরাশা-দহনে জর্জরিত সন্ন্যাসী। নিটশের জরথুস্ত্র। যে-কারণে পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি-র মতো খটখটে গদ্যমার্কা লাইন অনায়াস লিখেছেন। বিজ্ঞানকে রেললাইনের মতো সমান্তরাল পড়ে থাকতে দেখছেন, এবং তা অকেজো। যে-কারণে তাঁর অন্ধকারকে আমাদের মানব-সভ্যতায় জমে থাকা জখম হিসেবে পাঠ করায় আমার ষোলআনা সায় থাকবে। আলোর প্রয়োজনীয়তা আপনি ত্রিশের পঞ্চকবির মধ্যে হয়তো অমিয় চক্রবর্তীর মধ্যে পাবেন অধিক। তিনি খানিকটা রাবীন্দ্রিক।

বিষ্ণু দে যেহেতু বামপন্থায় ছিলেন, তার মধ্যে দিনবদলের আর্তি ও আহবান পাবেন। জীবনানন্দ এসবের বাইরে। যেমন বাইরে সুধীন্দ্রনাথ। দুজনেই আশাকে প্রয়োজনীয় ভাবার চেয়ে নিরাশার মধ্যে খুঁজেছেন বেরিয়ে আসার সড়ক। যে-কারণে প্রজ্ঞার কথা এসেছে জীবনানন্দের কবিতায়। এই প্রজ্ঞা প্রকৃতপক্ষে মানুষের মধ্যে পাওয়ার নয়। কারণ, মানুষ আর নেই প্রাকৃতিক,—সে বিমানবিক। নিজ দোষে বিচ্ছিন্ন ও ধসের কারিগর। সুতরাং, তাঁকে রোমান্টিসাইজ করা মানে হেলাল ভাই যেটি চাইছেন ফুটিয়ে তুলতে, সেটি ধাবিত হবে ভুল পথে।
. . .

দুঃখিত হাসান, জীবনানন্দকে এভাবে দেখাটা আমাদের রোমান্টিসিজম ছাড়া কিছু নয়। তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত রূপক ও সাংকেতিক হেঁয়ালির মধ্যে বিমূর্ত চিত্রকলার কোনো ব্যাপার নেই। অ্যাবসট্রাক্ট পেন্টিং ক্যান্ডিনস্কিরা যে-পটভূমিকায় জন্ম দিয়েছিলেন, তার প্রেক্ষাপট ভিন্ন।

বিমূর্ত চিত্রকলা হচ্ছে ফিগারকে আর্টিস্ট ব্যাকরণ মেনে আঁকার সময় ভেঙে দিচ্ছেন। ড্রইংয়ের মধ্যে ঘটাচ্ছেন বিপর্যয়। পিকাসোরা কিউবিস্ট ফর্মে তাও ফিগার ধরে রাখতেন, ক্যান্ডিনস্কিরা জ্যামিতিক ফর্মে আঁকার সময় এর মাত্রা ও বিন্যাসকে বদলে দিলেন সম্পূর্ণ। পশ্চিমে জীবনধারার যান্ত্রিক পালাবদল আর আর্ট মুভমেন্টে নতুনত্ব মিলে এটি তখন জন্ম নিয়েছে। পরে জ্যাকসন পোলকের মতো পেইন্টার আমরা দেখেছি, বিরাট ক্যানভাসে রং ছিটিয়ে-ছিটিয়ে অ্যাবসট্রাক্ট আঁকতেন। খুবই দুর্ধর্ষ ব্যাপার!

সে যাকগে, জীবনানন্দে ভাষার বিমূর্তায়ন এর সঙ্গে খাপ খায় না। যেমন লাশকাটা ঘরের দুটি চরণ পড়ি একবার, কবি লিখছেন :

টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে
চারিদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা;
মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে।

এখানে ভাষার বিমূর্তায়ন আছে, কিন্তু তা বিমূর্ত চিত্রকলার মতো নন-ফিগারেটিভ নয়। কবিতায় এটি সম্ভবও নয়। এখানে পাচ্ছি ভাষার প্রতীকায়িত কনট্রাস্ট। ওই-যে যূথচারী বলছেন, এর সঙ্গে মিলে যাচ্ছে হাতির পাল যেমন সার বেঁধে চলে, সেই ইমেজটি। অন্ধকারকে এর সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন।

সঙ্ঘারাম নিয়ে যাচ্ছে বৌদ্ধ যুগে। মশাকে মিলাচ্ছেন এর সঙ্গে। মশা তো বাঁচবে রক্ত খেয়ে। এখন মশারিটা তার জন্য বিপত্তি। মানে মানুষ তাকে বাঁচতে দেবে না। তবু সে বাঁচার, এবং মশারির ফাঁক গলে ঢোকার চেষ্টায় বিরতি দেয় না। এটিও সাধনা। বাঁচার সাধনা। ভাষার এই অদ্ভুত কনট্রাস্টই জীবনানন্দের অপার শক্তি, এবং সে-কারণে বিশ্বের চিরমহান কবিদের একজন তিনি। কিংবা আলো পৃথিবীর রাত্রি কবিতা যদি পাঠ করি পুনরায়,—বিস্ময়কর নির্মিতি। অভবানীয় ও অদ্ভুত! কিন্তু নিজের ম্যাসেজ প্রদানে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার। জীবনানন্দ ইহজীবনে আর্ট ফর আর্ট সেক বা শিল্পের জন্য শিল্প লেখেননি। তিনি বিশুদ্ধ জীবনচাক্ষিক। কবিতার শেষ স্তবকটি পাঠ করি এবার, কবি লিখছেন :

আমার চোখের পরে রাত্রির প্রাঞ্জলতা ঢেলে;
কোথাও বাতাবী উষ্ণ হয়ে ওঠে- ঘুরে যায় মাকরসাপোকার লাটিম ,
ভাঁড় হাসে,—সম্রাজ্ঞীর অবয়ব হয়ে থাকে হিম ;
নদীরা শিশুর মত—শিশুরা নদীর মত দূর;
স্বর্গের কিনারে গিয়ে ভিড় আর ভিখিরির নীল আলো করে টিমটিম।
শিশুর কপাল থেকে বেজে ওঠে নরকের বিচিত্র ডিন্ডিম।

এখানে তাঁর চিরাচরিত স্বভাবে মিশিয়েছেন পুরাণ ও ইতিহাস। স্বর্গ-নরককে সাবজেক্ট করেছেন। ইমেজকে শক্তি দিচ্ছে বৈপরীত্য। ওই-যে বলছেন, নদী ও শিশু হচ্ছে শুদ্ধ প্রাকৃতিক, কিন্তু সময়ের সঙ্গে শিশু ও নদীর দূরত্ব হয়ে ওঠে অমোঘ। সেই চোরা নিরাশা। যে-কারণে শেষ লাইনে এসে দেখাচ্ছেন, শিশুর কপালেও নরকের ঢোল (ডিন্ডিম) বেজে ওঠে।

জীবনানন্দ দাশ প্রচণ্ড ভালো পাঠক ছিলেন। প্রচুর পড়তেন। তিরিশের সকল কবি তাই বটে। এর ফলে বিচিত্র উৎস থেকে ইমেজ তৈরির অতুল শক্তি তাঁরা ব্যবহার করতেন অকাতরে। এদিকটা খেয়ালে নিলে পরিষ্কার বোঝা হয়ে যায়,—জীবনানন্দ একটিও অর্থহীন অথবা স্বেচ্ছা বিমূর্ত পঙক্তি লেখেননি। তিনি প্রচণ্ড অর্থবোধক এক কবি;—যে-কোনো মহৎ কবির মতোই পাঠসঞ্চারী ও অর্থবহ।
. . .

Jibanananda – The Thinker – Episode 2 Season 1; Goutam Mitra; Source – Just Studio YTC

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 65

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

One comment on “নিরীক্ষা ও বিনির্মাণে জীবনানন্দ দাশের অন্ধকার-২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *