স্পাই থ্রিলার মাসুদ রানার ইন্ট্রোটা অদ্ভুত! এরকম একখান ইন্ট্রো দিয়ে স্পাই থ্রিলার শুরুর ভাবনা কাজী আনোয়ার হোসেনের মাথায় কীভাবে এসেছিল জানি না। সিরিজের প্রথম বই ধ্বংস পাহাড় বাজারে ছাড়ার সময় এই-যে ইন্ট্রো তিনি জুড়ে দিলেন,- এই ঘরানার সাহিত্যে ঘটনাটি ব্যতিক্রম। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের হয়ে দেশে-বিদেশে দুঃসাহসী মিশনে সক্রিয় মাসুদ রানা মৌলিক চরিত্র নয়। ইয়ান ফ্লেমিংয়ের জেমস বন্ডের জন্ম যদি না হতো তাহলে বাংলাভাষী পাঠক রোমাঞ্চঠাসা চরিত্রটির দেখা পেতেন বলে মনে হয় না। বিগত শতাব্দীর পঞ্চম দশকের গোড়ায় বন্ড সিরিজের পয়লা বই ক্যাসিনো রয়্যাল বাজারে আসে। পরবর্তী দশকের মাঝামাঝি সময়ে ধ্বংস পাহাড় সঙ্গে করে বাংলা ভাষায় রচিত রোমাঞ্চ সাহিত্যের বাজারে হাজির হলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। ক্যাসিনো রয়্যাল-এ প্রাণবন্ত জেমস বন্ড থেকে ধ্বংস পাহাড়-এ চিত্রিত মাসুদ রানার দূরত্ব কাজেই বেশি নয়।
স্পাই থ্রিলার শিরোনামে চিহ্নিত সাহিত্য ঘরানার সঙ্গে বাংলাভাষী পাঠকের হাতেখড়ি এর আগে হয়নি। ভিন্ন মেজাজের গল্প-আখ্যান বলতে পাঠক তখনো রোমাঞ্চ অভিযান আর গোয়েন্দা কহিনির আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছেন। ছবি এখনো খুব-যে বদলেছে তা কিন্তু নয়! একবিংশ শতকে দুইয়ের দশকে পা রাখলেও বাংলা সাহিত্যে বিচিত্র জনরা বা ঘরানা কিন্তু অধিক চোখে পড়বে না। আমাদের সাহিত্যে আজো কোনো টারজানের দেখা পাঠক পায়নি। এডগার রাইস বারোজের অমর সৃষ্টিকে বুদ্ধদেব বসু মহান টারজান নামে ডেকেছিলেন। চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে নিজের লেখায় টারজানকে স্মরণ করেন বুদ্ধদেব বসু। আফ্রিকার গহীন অরণ্যে অবিচ্ছেদ্য বনরাজার প্রতি ঝরে পড়েছিল মুগ্ধতা।
এডগার রাইস বারোজের টারজান এমন এক চরিত্র যে-কিনা পাঠককে সভ্যতার বাইরে নিয়ে যায়। বারোজের হাত ধরে পাঠক প্রবেশ করে আরণ্যিক সভ্যতায়। একদা এই সভ্যতায় সে একীভূত ছিল। টারজানের মতো অকৃত্রিম ছিল জীবন। আরণ্যিক সভ্যতার সঙ্গে বিচ্ছেদ তার রক্তে ঘুমিয়ে থাকা প্রাগৈতিহাসিক রোমন্থনকে উসকে দিয়ে যায়। এমন এই রোমন্থন, যেটি এখন দীর্ঘশ্বাসের সমতুল;- ইচ্ছে করলেও যেখানে ফেরত যাওয়া সম্ভব নয়। আরণ্যিক সভ্যতার সঙ্গে নগর-সভ্যতার চিরবিচ্ছেদের মধ্যবর্তী পরিসর বা মিডল লাইন জুড়ে টারজানের বিচরণ যে-কারণে অনন্য মনে হয় পাঠকের। বুদ্ধদেব বসু বিষয়টি অনুভব করে আর্দ্র হয়ে পড়েছিলেন।
এতো গেল টারজান। অন্যদিক থেকে যদি দেখি, আধুনিক সভ্যতার সর্পিল গতিকে অন্যমাত্রায় ধারণ করে যেসব ভৌতিক ও কল্প-বৈজ্ঞানিক রসদে বোনা কাহিনি, তার চল আমাদের সাহিত্যে কখনো ব্যাপক হতে পারেনি। আইকনিক কোনো ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, একখানা অদৃশ্য মানব অথবা ডক্টর জেকিল এন্ড মিস্টার হাইডের মতো দ্বৈতসত্তায় নাটকীয় চরিত্ররা বাংলা ভাষায় সৃষ্টির ভাবনা কারো মাথায় আসেনি। ইংরেজি সাহিত্য ততদিনে এইচ পি লাভক্রাফটের হাত ধরে মহাজাগতিক ভৌতিক চরিত্রের ভাবনায় গমন করছিল। জীবদ্দশায় পাঠসমাদর না জুটলেও মরণের পর ভৌতিক ঘরানার সাহিত্যে লাভক্রাফট বিশিষ্ট হয়ে উঠেন। ফিয়ার অব্য দ্য আননোন ও জীবদ্দশায় প্রায় লক্ষাধিক চিঠি লিখতে নিরলস লাভক্রাফটের রচনা যারা কিয়দংশ হলেও পড়েছেন, তারা আপনা-আপনি বুঝে যাবেন কেন এই লেখক এতটা গুরুত্ব পাচ্ছেন এখন। যাই হোক, লাভক্রাফটকে নিয়ে কোনো একদিন সবিস্তারে লিখব আশা করি, আপাতত মাসুদ রানায় ফেরত যাই বরং।
বিচিত্র সাহিত্যিক ঘরানায় বিকশিত হওয়ার দিক থেকে নাবালক বাংলা সাহিত্যে আমরা তখন গোয়েন্দা চরিত্রদের পাচ্ছি কেবল। শার্লক হোমসের মতো অতুল না হতে পারে, তথাপি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ বক্সী পড়তে চমৎকার। বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রাপ্তবয়স্ক গোয়েন্দা চরিত্র রূপে ব্যোমকেশ বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে সবচেয়ে পরিণত সৃষ্টি। নীহাররঞ্জন গুপ্তের কিরীটি একসময় জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, তবে বেশিদিন টিকতে পারেনি। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার জয়জয়কারে কিরীটি চাপা পড়ে গেছে। ফেলুদাকে মূলত শিশুসাহিত্যের আদলে সৃষ্টি করেন সত্যজিৎ। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে যেমন মজলিশি গপ্পোবাজ ও বেশ খানিকটা গুলের বাদশা টেনিদাকে পাঠক পেয়েছিল একসময়। পরাশর বর্মা আর ঘনাদাকে হাজির করেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। ফেলুদাসহ এসব অর্ধ শিশু অর্ধ বয়স্ক চরিত্ররা গোয়েন্দা সাহিত্যের একটি বাতাবরণ উন্মুক্ত করলেন। এর প্রভাবে একে-একে দেখা দিলেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের হাতে বোনা কর্নেল নীলাদ্রি সরকার, বুদ্ধদেব গুহর ঋজুদা বা সুনীল গাঙ্গুলীর কাকাবাবুর মতো চরিত্ররা।
বাংলা শিশু সাহিত্যের একপ্রকার প্রলম্বন তাতে সফলভাবে ঘটছিল। কিন্তু নিখাদ বড়োদের জন্য বিরচিত রোমাঞ্চ সাহিত্যে এসব চরিত্রকে পুরোপুরি ফেলা যাবে না। কাজী আনোয়ার হোসেন এখানে এসে অনন্য হয়ে উঠছেন। মাসুদ রানার হাত ধরে বাংলাভাষী পাঠক প্রাপ্তবয়স্ক রোমাঞ্চ সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করে। প্রায় পাঁচ দশক ধরে পাঠক রানা সিরিজের জালে সম্মোহিত আছেন। ভাবতেই মাথা বনবন করে চক্কর দিয়ে ওঠে! বাংলা ভাষায় জেমস বন্ডের মতো পৌরুষদীপ্ত চরিত্রকে পাঠক মনে-মনে খুঁজে ফিরছিলেন। মাসুদ রানাকে হাজির করার মাধ্যমে কাজী আনোয়ার হোসেন অভাবটি মিটিয়েছিলেন। ছয়ের দশকের মাঝামাঝি ধ্বংস পাহাড়, ভারতনাট্যম ও স্বর্ণমৃগ-র মতো জবরদস্ত রোমাঞ্চ উপন্যাস নামিয়ে বুঝিয়ে দিলেন বাংলা ভাষায় যারা এতদিন নানা আকৃতির রোমাঞ্চক গল্প-আখ্যান পাঠ করেছেন, বিদেশী লেখকদের অবিরত পড়েছেন, আর মনে-মনে আফসোস করেছেন,- আমাদের এরকম কিছু নেই কেন! তাদের ক্ষুধা মিটানোর রসদ এসে গেছে। মাসুদ রানা যারপরনাই আমাদের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত অদ্বিতীয় প্রাপ্তবয়স্ক রোমাঞ্চ-চরিত্র।
স্মরণ রাখা প্রয়োজন, কাজী আনোয়ার হোসেন যে-কালপর্বে মাসুদ রানাকে পাঠকের পাতে তুলে দিচ্ছেন তখনো বাঙালি মুসলমান লেখকদের বইপত্র খোদ মুসলমান পাঠক বিশেষ একটা পড়তে চাইতেন না। ওপার বাংলার হিন্দু লেখকদের বইপত্রের চাহিদা ব্যাপক ছিল। কাজী আনোয়ার হোসেন যখন জেমস বন্ডকে মাসুদ রানায় রূপান্তরিত করছেন, বাংলা আখ্যানের বাজারে শরৎচন্দ্র, সমরেশ বসু, বিমল মিত্র থেকে শুরু করে ওপার বাংলার লেখকদের একচ্ছত্র রাজপাট চলছে। হুমায়ূন আহমেদের আবির্ভাব ঘটার আগ পর্যন্ত যা কমবেশি বহাল থেকেছে।
বাংলাদেশের সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ ও মোহাম্মদ জাফর ইকবালের অবদান এই জায়গায় এসে অনন্য মানতে হবে। যেমন ধরা যাক, আর্থার সি ক্লার্কের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি পাঠের সুবাদে সৈয়দ শামসুল হক মহাশূন্যে পরান মাস্টার লিখেছিলেন। মন্দ ছিল না তাঁর প্রয়াস। কিন্তু সত্যিকার বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি আমরা হুমায়ূন ও জাফর ইকবালের হাত দিয়ে প্রথম হাতে পাচ্ছি। এইচ জি ওয়েলস, অ্যালডাস হাক্সলি থেকে আরম্ভ করে আইজাক আসিমভ, আর্থার সি ক্লার্ক, স্টান্সিলো লেম বা এরকম আরো গুচ্ছের কল্পকাহিনি রচয়িতারা যে-মানের সাহিত্য বিশ্বকে উপহার দিয়েছেন, সেখানে পৌঁছানো আমাদের জন্য আকাশকুসুম কল্পনা হলেও হুমায়ূন ও জাফর ইকবালে হাত দিয়ে সাইফাইয়ের প্রবেশপথটি আমাদের জন্য উন্মুক্ত হলো।
সায়েন্স ফিকশনের দুটি ধারা আছে। একটি নিখাদ ফ্যান্টাসি, যেমন সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কু। অন্যটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে ভর দিয়ে অগ্রসর হয়। এমন এক জগৎ সেখানে তৈরি হতে থাকে যেটি বিজ্ঞানের চিন্তন-পদ্ধতি ও বৈজ্ঞানিক প্রস্তাবনাকে নতুন আঙ্গিকে ভাবতে সাহায্য করে। হুমায়ূন আহমেদ ও কতকক্ষেত্রে জাফর ইকবালের রচনায় তার প্রাথমিক আভাস ছিল বৈকি। উচ্চমাত্রায় ছিল এমন নয়। তাঁরা মূলত বিদেশী কল্পআখ্যান থেকে প্লট বেছে নিতেন। এই অর্থে এগুলো হচ্ছে নিখাদ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি রচনার প্রাথমিক ধাপ। আমাদের জায়গা থেকে অভিনব হলেও বৈশ্বিক আবহে অতটা মূল্য ধরে না। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই বিষয়টি,- প্রাপ্তবয়স্ক কল্পকাহিনির স্বাদ পাঠক সেখানে পাচ্ছেন। কাজী আনোয়ার হোসেনের স্পাই থ্রিলার মাসুদ রানাও তাই। আমাদের প্রথম অ্যাডাল্ট ত্রিলার। দারুণ রোমাঞ্চক আর দুঃসাহসী সব মিশন নিয়ে দেশ-বিদেশে পাঠকরা যাকে বিচরণ করতে দেখছেন।
চিরসবুজ মাসুদ রানার সমান্তরালে মেজর রাহাত, গিল্টি মিয়া, পাগল বৈজ্ঞানিক কবীর ও সোহানার মতো দারুণ সব চরিত্রকে পাঠকের মনে গেঁথে দিচ্ছেন কাজী আনোয়ার হোসেন। প্রশ্ন হলো, মাসুদ রানা সিরিজে বাংলাদেশের হয়ে গুরুতর সব মিশন কাঁধে ঘুরে বেড়ানো রানার পরিচয় তুলে ধরতে এরকম কটি ইন্ট্রো কেন জুড়ে দিচ্ছেন তিনি কেনই-বা প্রায় সাড়ে চারশো বইয়ে ইন্ট্রোটা অবিকল রেখে দিলেন পরে? ডিটেকটিভ কিংবা স্পাই থ্রিলারে চরিত্রকে একনিমিষে পাঠকের চোখে সবাক করতে লেখকরা কিছু জেশ্চারে তাকে বিশিষ্ট করেন। ইয়ান ফ্লেমিংয়ের জেমস বন্ড, যার আদলে মাসুদ রানা জন্ম বাংলা ভাষায় জন্ম নিচ্ছে, এখন ফ্লেমিং কিন্তু আলাদা করে বন্ডের কোনো ইন্ট্রো বইয়ে জুড়ছেন না। কাহিনিছকে যেসব ঘটনা ঘটতে থাকে তার মধ্য দিয়ে জেমস বন্ডের নানান বিশেষত্ব পাঠকমনে অবিচ্ছেদ্য করেন ফ্লেমিং। রমণীমোহন, ক্ষিপ্র, ছদ্মবেশ ধারণে পটু… এবং সব মিলিয়ে ম্যানলি ও ড্যাশিং এক পুরুষকে পাঠক বন্ড বলে ক্রমাগত বুঝে নিতে থাকে। কোড নেম 007-এর অন্তরালে এমন এক চরিত্র যার ক্ষেত্রে কোনো সীমানা ও সমাজ স্বীকৃত টাবু খাটবে না।
ইয়ান ফ্লেমিংয়ের জেমস বন্ড একইসঙ্গে নমনীয় ও বেপরোয়া। নিজেকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে এবং ঝুঁকি এড়াতে চতুরভাবে অন্যকে ব্যবহার করতে কালক্ষেপণ করে না। জেমস বন্ড কি দেশপ্রেমিক? ইয়ান ফ্লেমিং সৃষ্ট কোড 007 বন্ডের বিবরণগাথা থেকে সেটি বোঝা দুষ্কর। জেমস বন্ড তার বৃটিশ ও স্কটিশ আত্মপরিচয়ে সংকর। ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতি তাকে যতটা নিবেদিত দেখে পাঠক, ওই অর্থে দেশ যেন তার ভিতরে সক্রিয় থেকেও থাকে না। বন্ড এক পেশাদার লড়াকু। গানফাইটে ভয়ডরহীন। পাহাড়, অরণ্য, সাগরে প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াইয়ে অকুতোভয়। এতটাই রমনীমোহন সে,- বন্ডজালে ধরা দিতে নারীকুল বাধ্য থাকেন। নিজেকে পরিচয় করানোর কায়দা বন্ডের ক্ষেত্রে একটাই,- একের-পর-এক বন্ড মুভিতে যেটি অবিকল রাখেন নির্মাতারা! দর্শক দেখে,- করমর্দনের পয়লা দফায় কোডনেম 007 নিজেকে এভাবে তুলে ধরে : Bond, James Bond। এটি হলো তার নিজেকে পরিচিত করানোর অকাট্য ম্যানারিজম। বন্ডমুভির ক্যলাণে যা এখন আইকনিক মহিমা লাভ করেছে।
মাসুদ রানাকে নিয়ে বাংলা ভাষায় এ-পর্যন্ত সাকুল্যে দু-তিন খানা ছবি তৈরি হয়েছে। প্রথমটি সেই আশির দশকের গোড়ায়। আর দ্বিতীয়টি বছর দুই আগে পর্দায় এসেছিল। চলচ্চিত্রে মাসুদ রানার ব্রান্ডিং গড়ে ওঠেনি। কাজটি কঠিন। কারণ কাজী আনোয়ার হোসেন তাঁর বইয়ের মাসুদ রানাকে যেরকম খোলামেলা পরিসরে হাজির করছেন, সোহানাসহ অন্যান্য নারী চরিত্রের সঙ্গে দৈহিক অন্তরঙ্গতার বিবরণ বইয়ে যেভাবে আসে, নারীফাঁদে ধরা দিয়েও পিছলে যাওয়ার চিরন্তন স্বভাবে দলছুট এই মাসুদ রানাকে পর্দায় খোলামেলা তুলে ধরার পরিসর বাংলা সিনেমায় এখনো কল্পনাতীতত ঘটনা। মাসুদ রানা টাবু বিধ্বংসী চরিত্র, অন্যদিকে বাংলা সিনেমায় যৌনতা আজোবধি সুড়সুড়ির অধিক আবেদন তৈরির শক্তি ধরে না। সুতরাং রানার ফিল্মি সংস্করণকে টপ-নোচ করা অতিশয় দুরূহ।
মাসুদ রানা অগত্যা এখনো আনোয়ার হোসেন ও শেখ আবদুল হাকিমসহ একাধিক ছদ্মলেখক বা গোস্টরাইটারের হাতে প্রাণবান টেক্সট হিসেবে বেঁচে আছে। গোস্টরাইটারের প্রসঙ্গে বলতে হয়, শেখ আবদুল হাকিমের সঙ্গে শেষবেলায় এ-নিয়ে ঝামেলা আদালত পর্যন্ত গড়ালেও কাজী আনোয়ার হোসেন আমাদের প্রথম ও আপাত শেষ লেখক, যিনি তাঁর হয়ে সিরিজ লেখার দায়িত্ব একাধিক লেখককে বণ্টন করতে পেরেছিলেন। গোস্টরাইটার তো সেই ব্যক্তি যার নামসাকিন কিছু পাঠক জানতে পায় না। কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে মাসুদ রানার নতুন কোনো পর্ব সে পড়ছে, যেটি আদতে রকিব হাসান বা শেখ আব্দুল হাকিম তাঁর হয়ে লিখছেন। প্লট হয়তো আনোয়ার হোসেন ভেবেছেন। চূড়ান্ত পাণ্ডুলিপি দেখেও দিচ্ছেন, কিন্তু লিখছেন অন্যজন।
কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে গোস্টরাইটারদের লিখনশৈলীর তফাত অবশ্য খেয়াল করলে টের পাওয়া যায়। ভারতনাট্যম বা মধ্যবর্তী কোনো পর্ব, যেমন পাগল বৈজ্ঞানিক, অগ্নিপুরুষ বা সেই উ সেন যখন আনোয়ার হোসেন লিখছেন, সেখানে যে-ফ্লেভার পাঠক পায় যেটি ধ্বংসপাহাড় বা স্বর্ণমৃগ পাঠ করতে বসে তারা একসময় পেয়েছে। মাসুদ রানার বাইরে কাজী আনোয়ার হোসেনের বেশ কিছু রচনা আছে। একটি সময় ছিল যখন মুসলমান নাম দিয়ে লেখা বাজারে কাটত না। বিদ্যুৎ মিত্র নামে প্রাপ্তবয়স্ক কিছু রচনা কাজী আনোয়ার হোসেন তখন লিখেছেন। যৌনতা বিষয়ক আলোচনায় গগমনের ক্ষেত্রে যেসব টাবু সমাজে বিদ্যমান সেগুলো ভাঙার লক্ষ্যে লিখেছেন লাগাতার।
এই ধারায় অমানুষ নামক আখ্যানটি প্রথম হুমায়ূন আহমেদকে দিয়ে লিখিয়েছেন কাজী আনোয়ার হোসেন। হুমায়ূনের হাতে যথারীতি দারুণ হয়েছিল সেটি। কিন্তু একই আখ্যান কাজী আনোয়ার হোসেন যখন পুনরায় লিখলেন, সেটি হুমায়ূনকে অতিক্রম করে অনন্য হয়ে উঠল। রোমাঞ্চ ঘরানায় আমিই প্রথম ও শেষ কথা;- কাজী আনোয়ার হোসেন সেটি যেন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন পুনরায়। এখন পর্যন্ত তাঁর মহিমা অটুট। যেমন অটুট সেবা প্রকাশনীর ব্যানারে সিরিয়াস থেকে লঘু সাহিত্যের পাঠক তৈরিতে প্রকাশিত বিচিত্র অঙ্গের প্রকাশনা। অটুট কিশোর ক্লাসিক, ওয়েস্টার্ন, কুয়াশা সিরিজ, তিন গোয়েন্দা আর রহস্য পত্রিকার আবেদন।
যাই হোক, গোড়ায় ফিরতে মাসুদ রানার ইন্ট্রো থেকে তিনটি প্রক্ষিপ্ত অংশ আমরা এখন পিক করি তবে। রানাকে পরিচয় করিয়ে দিতে কাজী আনোয়ার হোসেন লিখছেন : টানে সবাইকে, কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না। … দুর্ধর্ষ চির-নবীন যুবক…। এবং… সীমিত গণ্ডিবদ্ধ জীবনের একঘেয়েমি থেকে একটানে তুলে নিয়ে যাবে ও আমাদের স্বপ্নের এক আশ্চর্য মায়াবী জগতে। কাজী আনোয়ার হোসেনের হাত দিয়ে সৃষ্ট রোমাঞ্চ সাহিত্য এখনাবধি এই ইন্ট্রোকে একা বহন করে চলেছে। এখানে তিনি নিঃসঙ্গ শেরপা। মনোটোনাস জীবন থেকে নিমেষে অন্যবাস্তবে, ফ্যান্টাসিঘন রোমাঞ্চক জগতে নিয়ে যেতে সক্ষম মাসুদ রানার সমতুল কিছু কারো হাত দিয়ে আজো বের হয়নি। মাসুদ রানা এখানে চিরযুবা। ইন্ট্রো বলে দেয় তার বয়স কখনো বাড়ে না, বাড়বে না কোনোদিন। কাজী আনোয়ার হোসেন ও তাঁর গোস্ট রাইটার, বিশেষ করে শেখ আবদুল হাকিমের হাতে ভাষা পাওয়া এই রোমাঞ্চক সাহিত্য তাই চিরসবুজ। চিরতরুণ। চির মনোমুগ্ধকর। বাংলা ভাষা যতদিন আছে, ততদিন মনে হচ্ছে পাঠক তাকে পড়তে বাধ্য।
. . .
. . .