মানুষ চিরকালের গোল্ডফিশ। কোনো ঘটনা বেশিদিন সে ইয়াদ রাখতে পারে না। ঘটনা যতই হাড়হিম হোক, এর চক্কর হইতে রেহাই পাওয়ার তাগিদ তারে খোঁচায়। দ্রুত ভুইলা যাইতে প্রাণিপাত করে। অন্যদিকে একই মানুষ ওল্ড ইজ গুড-এ ভীষণ বিলিভ করে। এই দিনের চেয়ে আগের দিন ভালো ছিল;- তুলনাখান অবিরত কপচায়। এ-সমস্ত কারণে আমরা ধইরা নিতে পারি,- মানুষ হইতেছে চরম দ্বৈততার অন্য নাম। অতীতকে সে বিস্মৃত হইতে চায় আবার বর্তমানে বিলং করতে তার মন মানে না। সে বিলং করে এমন এক টাইমলাইন বা সময়রেখায়, ইচ্ছা করলেও যারে ফেরত আনা সম্ভব নয়। ফেরত আনতে হইলে স্টিফেন হকিংসহ মহাবিশ্ব নিয়া মহাচিন্তিত বিজ্ঞানীরা সময়ের তীর ধরে পেছনে যাওয়ার যেসব থিয়োরি হাজির করেন, সেগুলার কোনো একটাকে পসিবল করতে হবে। পসিবল যদি করা না যায় তাহলে মাইনা নেওয়া ভালো,- মহাবিশ্বের ন্যায় অন্তহীন সময়রেখার তির ধরে আমরা সামনে যাইতেছি। আসন্ন বা পরবর্তী মুহূর্তগুলাকে জায়গা ছেড়ে দিতে অদ্য সক্রিয় মুহূর্তরা অজ্ঞাত সময়রেখায় বিলীন হইতেছেন।
বিলীন হইতেছেন কিন্তু হারাইয়া যাইতেছেন কি? মনে হয় না। মুহূর্তরা মহাবিশ্বের কোথাও-না-কোথাও স্থান করে নিতে থাকে। আমরা যদি এখনকার সময়রেখাকে অতিক্রম করে দ্রুতগতিতে সামনে অগ্রসর হইতে থাকি, তখন সামনে আগানোর পথে হয়তো দেখবো মহাবিশ্বের কোনো এক স্থানে বিথোভেনকে দেখা যাইতেছে। অন্ধ সুরস্রষ্টা সপ্তম সিম্ফনির মেজর-মাইনরগুলা ঠিকঠাক জুড়তে প্রবলভাবে পিয়ানোর বোতাম চাপতেছেন। বাইরে মিষ্টি রোদ। প্রজাপতিরা উড়ে-উড়ে শুঁড় ডুবিয়ে ফুলের মধু খাইতেছে সেখানে। অনুরূপ গতিতে যদি পেছনে ফেরত যাই তাইলে মার্টিন লুথার কিংয়ের আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম কানে আসা বিচিত্র না। তখন হয়তো দেখা যাবে, রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিতেছেন। জেনারেল ইয়াহিয়ার দিকে তর্জনী তাক করে জানান দিতেছেন, স্বাধিকার আদায়ে ঘরে-ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে বাঙলিরা প্রস্তুত।
টি. এস এলিয়ট হয়তো এসব কারণে সময়কে স্মারক বইলা ভাবতেন। এমন একখানা স্মারক যেইটা কিনা কখনো হারায়া যাবে না। সময়ের সঙ্গে যত কিছু তামাদি হইতেছে বইলা আমরা ভাবি তারা তামাদি হয় না। সাগর অথবা অন্যত্র জায়গা নিতে থাকবে। সময় হইলে সাগরতটে যার সিংহভাগ পুনরায় ফেরত আসবেই আসবে। আগের রূপে হয়তো আসবে না কিন্তু ফেরত আসবে তারা। Time the destroyer is time the preserver;- ড্রাই স্যালেভেজেস-এ এলিয়ট পঙক্তিখানা লিখছিলেন বটে! সমুদয়কে সংহার করে যে-সময়, সে আবার সমুদয়কে সংরক্ষণ করে। সময় হইতেছে একাদিক্রমে হন্তারক ও সংরক্ষক। সে মা কালী;- চিরন্তন সময়প্রতীক বইলা আমরা যার বন্দনা গাই। মিনিটে প্রসব করে, মিনিটে সংহারে। আদি কালী তাই সদা নাঙ্গা। গায়ে বসন জড়ানোর টাইম নাই মায়ের। সময় এখানে এসে কুলকিনার নাই এমন একখান জাদুঘরে রূপ নিতেছে। সেই জাদুঘরে ফারাও তুতেনখামেনের মতো আমরা মমি হইতেছি।
একটা ঘটনা গতকাল ঘটছিল। পেইনফুল ছিল সেইটা। পেইনটা আজ আর তীব্র মনে হইতেছে না। আরো কিছুদিন গেলে মনেই থাকবে না কতটা পেইন ছিল সে-ঘটনায়! পেইন লঘু হইতে থাকার কারণে আমরা মানব প্রজাতি হইতেছি গোল্ডফিশের সোদর। গোল্ডফিশ বেশি হলে মাসখানেক বা তার কিছু বেশি একখান ঘটনা ইয়াদ রাখে, তারপর ভুইলা যায়। আমরা অবশ্য তার মতো শর্টমেমোরি না। অনেক ঘটনা মরণের আগে অবধি ইয়াদ রাখি, কিন্তু মনে রাখার মধ্যে চাঙ্গা অথবা মনমরা ভাবের কোনোটাই সুতীব্র থাকে না। কেমন জানি গোল্ডফিশ লাগে সবটা! তার মতো রিকল করি নিজেকে, এই ইয়াদ বিলানোর জন্য,- আমরা আসলে কিছু ইয়াদ করতে রাজি না। এই চাতুরি ছাড়া মানুষের পক্ষে নির্বিচার সব নিধন আর হত্যার উৎসবে জীবিত দেহ নিয়া করে খাওয়া বড্ডো কঠিন!
থিওডোর অ্যাডর্নোর উক্তি মনে পড়েতেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাজিবাহিনির নারকীয় কাজকারবারে বিপর্যস্ত ছিলেন কবি। আউশভিৎসের ভয়াবহ ইহুদিনিধন যজ্ঞ খতম হওয়ার পর কবিতা রচনা বর্বরতা বইলা ঘোষণা দিতে কালবিলম্ব করেন নাই। সেখানে ক্ষান্ত হইলে কথা ছিল। অ্যাডর্নো তখন বলছিলেন বটে,- এইসব যুদ্ধ ও নির্বিচার জীবনিধন সংস্কৃতি আর বর্বরতার মধ্যখানে পরিষ্কার সীমারেখা টাইনা দিতেছে। বর্বরতা স্বয়ং আমাদের সাংস্কৃতিক সত্তায় অর্জিত জ্ঞানকে ধ্বংস করায় কবিতা লেখা অবান্তর বইলা প্রতীয়মান হইতেছে এখন। কোনো মানে নাই কবিতার পঙক্তির তালাশে মাথার চুল ছেঁড়ার।
জীবনিধন শব্দখানা অ্যাডর্নো তাঁর বক্তব্যে সরাসরি ব্যবহার করেন নাই। আমি ব্যবহার করতেছি এ-কারণে,- প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অথবা মানবসভ্যতার যাত্রালগ্ন থেকে এ-যাবত যত যুদ্ধ-লড়াই-খুনাখুনি হইছে সেখানে খালি মানুষ মারা যায় নাই। বেশুমার জীব-জানোয়ার মারা পড়ছে। ইসরায়েল আজ যখন গাজায় কিংবা উইক্রেনে রাশিয়া যখন অবিরাম হামলা করে, তখন কি খালি মানুষ মারা পড়ে? নিশ্চয় না। মানুষের সঙ্গে সেই মুহূর্তে কয়েকশো বা হাজার প্রজাতির জীব-জানোয়ার ও পক্ষীকুল সাবাড় হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এক কোটির উপ্রে ঘোড়া মারা পড়ছিল। কে তার হিসাব মনে রাখছে এখন!
মানুষ বড়ো বিস্ময়কর জীব! তার এক হাত রক্তে ডোবানো, অন্যহাতে গোলাপ। উর্দু ভাষার কবি শওক বাহরাইসির একখানা বিখ্যাত নজম কোথায় জানি পড়ছিলাম! কবি সেখানে বলতেছেন : বরবাদ গুলিস্তান করনে কো বাস এক উল্লু কাফি থা/ হার শাখ পে উল্লু বৈঠা হ্যায়, আনজাম-ই-গুলিস্তান কো কিয়া হোগা। উনি বলতে চাইতেছেন,- সাজানো ফুলবাগান তছনছ করতে একটা উল্লু বা বান্দরই যথেষ্ট। বাগানের প্রতিটা গাছের ডালে যদি একটা করে উল্লু বইসা থাকে তখন সে-বাগানের পরিণতি কী হইতে পারে একবার ভাবেন। যেসব উল্লু সাজানো বাগান তছনছের কারণ তারা কী দিয়া গড়া তবে? তারা কি মানুষ অথবা অন্য ধাতু দিয়া তৈরি জীব? মানবসুরতে যেহেতু প্রকাশিত এখন তাদেরকে মানুষ বইলা আমরা ধরে নিতে বাধ্য। তার মানে একজন খুনি মানুষের পাশে আরেকজন নিরীহ মানুষ পাশাপাশি বিলং করতেছে। তারা একসঙ্গে চলেফিরে। একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়ায়;- এই অনিশ্চয়তা সঙ্গে নিয়া,- খুনি মানুষটির হাতে নিরীহ মানুষটি আজ-নয়-কাল খুন হইতে পারে। উল্টো ঘটার সম্ভাবনাও থাকতেছে সেখানে। নিরীহ আদমসুরত কোনো কারণবশত উন্মাদ হয়ে খুনি আদমকে খুন করতেও পারে।
জন্মলগ্ন থেকে মানুষ তাই সন্ত ও ঘাতক। হাবিল-কাবিলের কাহিনি ইয়াদ যাইতে পারি আমরা। আদম ও হাওয়ার দুই সন্তান ছিল তারা। ধরণী তখনো নিষ্পাপ। বেহেশত না হইতে পারে কিন্তু অকারণ হত্যায় নয় কলুষিত। নিষ্কলুষ ধরায় পছন্দের নারীকে পাওয়া নিয়া যে-সংঘাত জন্ম নিলো তার জের ধরে কাবিল আপন সহোদর হাবিলের জান কবজ করছিল। জান কবচের মুহূর্তে এইটা নির্ধারিত হইল,- ধরায় মানুষ একমাত্র জীব যার ব্যাপারে আগাম অনুমান কভু খাটবে না। আলো ও অন্ধকারকে কলবে ধরে আগামীপানে সে বিবর্তিত হইতে থাকবে। তার মধ্যে অমাবস্যা থাকবে। পূর্ণিমাও উদয় হবে সেই মানুষমধ্যে। সে বসরাই গোলাপ। মশহুর সুগন্ধে মাত হবে দুনিয়া। এমন একখান গোলাপ যার সুগন্ধে লুকিয়ে থাকবে বিষ। গোলাপ যে হাতে নেবে, নাকের কাছে নিয়া শুঁকবে, সুগন্ধ তার মরণের কারণ হবে তাৎক্ষণিক।
মানুষ হইতেছে বিস্মৃতিপ্রবণ অন্ধ দেবদূত। সে হত্যা করবে। হতাকে বৈধতা দেবে। বাকিরা সেইটা মেনে নেবে নয়তো বিস্মৃত হবে দ্রুত। কারণ, এখন যে-হত্যাগুলো ঘটতেছে সেগুলোর তুলনায় অতীত-হত্যা তার নিকট মামুলি মনে হইতে থাকবে। মানুষের সাজানো বাগানের আনাচ-কানাচে কেবলই হত্যার উৎসব। ফোয়ারার মতো রক্তের উদগীরণ। জ্বলন্ত লাভাস্রোতের মতো লেলিহান সুন্দর এইসব হত্যা, রক্তারক্তি ও খুনোখুনি! এর সবটাই বিস্মৃত হয়ে নতুন হত্যার উৎসবে মেতে উঠবে সে।
টেড হিউজ কি এজন্যই কাক নিয়া গুচ্ছের কবিতা লিইখা গেলেন? তাঁর কাছে মনে হইছিল, কাক হইতেছে স্বর্গ ও পৃথিবীর সংযোগস্থলে উড়তে থাকা আজব পক্ষী! জ্ঞানবৃক্ষে ঝুলন্ত গন্দম ভক্ষণের দোষে ঈশ্বর আদম ও হাওয়াকে মাটির পৃথিবীতে নেমে যাওয়ার আদেশ জারি করছিলেন। কারণ, তারা এমন একখান ফলে কামড় দিছে যার কারণে তাদের পক্ষে নিষ্পাপ থাকা অসম্ভব। নিষ্পাপ শিশুর জীবন তারা কাটাইতে পারবে না। তাদের মধ্যে ক্রিয়াশীল হবে শুভ ও অশুভ। তারা অদ্য থেকে সমানভাবে বুদ্ধিমান ও আহাম্মক প্রমাণ করবে নিজেদের। জ্ঞানী ও মূর্খ হবে একত্রে। এখন হইতে তারা সচেতন এবং সে-কারণে অভিশপ্ত। দুর্ভোগ তাদের ললাটলিখন।
জীবন অমৃত ও বিষের ভাণ্ড;—স্বাদটি বুঝাইতে মাটির পৃথিবীতে আদম ও হাওয়াকে নামিয়ে দিলেন ঈশ্বর। ফলভক্ষণের কারণে তারা কি স্বয়ং বিপন্ন করে নাই ঈশ্বরকে? কাকের পাখসাট গুনতে বসা টেড হিউজ কবিতায় এর উত্তর খুঁজছেন। মানুষ যখন কাঁদবে মনে হবে ঈশ্বর কাঁদতেছেন। ঈশ্বরের রক্তক্ষরণকে মনে হবে মানুষের রক্তক্ষরণ। মানুষ কখনো ঈশ্বরের প্রতিরূপ হইতে পারবে না। ঈশ্বরও মানুষকে ভাবতে পারবেন না সরলতার প্রতীমায়। দুর্গন্ধে আবিল সেতুর কিনারায় দাঁড়িয়ে ঈশ্বর ও মানুষ, তারা দুজন একে অন্যকে দেইখা দীর্ঘশ্বাস ফেলবে।
নিরাময়-অযোগ্য এই সহাবস্থান;—ঈশ্বর ও মানুষ…; শুভ ও অশুভ…; ক্রন্দন ও রক্তক্ষরণ…; মরণ অথবা স্বেচ্ছামরণ! কাকের পাখসাট কেবল জানাইতে থাকবে,- মানুষকে ঈশ্বর তাঁর শত্রু বইলা সাব্যস্ত করছেন। প্রিয় সৃষ্টিকে নিয়া মোহ আর জীবিত নাই। তাকে তিনি ভালোবেসেছিলেন। এখনো বাসেন, কিন্তু সেই ভালোবাসায় সারল্য নাই বরং বিতৃষ্ণা সমধিক। সত্যটি জগৎজুড়ে রাষ্ট্র করতে স্বর্গ ও পৃথিবীর সংযোগস্থলে কাকের পাখসাট চলবে। মানবজাতি যতদিন ধরায় আয়ুষ্মান থাকতেছে, ততদিন সৃষ্টির বিলয় ও সংস্থিতির উপমা তিমিরবরণ কাকের পাখসাট থামবে না!
গানের সন্ত বব ডিলান এইটা বুঝতে পারছিলেন বইলা হার্ড রেইন গানখানা গাইছিলেন সেই সময়। তিনি ঠার করতে পারছিলেন, দ্বৈততা নতমস্তকে মাইনা তবে গান করতে হবে। যত হাহাকার করেন-না-কেন, মাটিতে বৃষ্টি কিন্তু সহজে ঝরবে না। মাইনা নিতে হবে, তিনি এমন মানুষ দেখবেন যাগো হাত খালি। তিয়াস মিটাইতে তারা যে-জল পান করতেছে সেইটা বিষের বড়ি দিয়া ভরতি। উপত্যকায় ছবির মতো সাজানো বাড়িগুলা কয়েদশালা। দন্ডিতের মুখ দেখা গেলেও জল্লাদের মুখ সেখানে দেখার উপায় রুদ্ধ। জল্লাদ তার নিজেকে আড়াল করে কোপ বসাবে কারো ঘাড়ে। গানের সন্ত ডিলান এমন আদমসুরতের সাক্ষাৎ পাইবেন যার হৃদয় ভালোবাসায় ভরা আবার এমন লোকের দেখা মিলবে, যে কিনা ঘৃণা নিয়া তার দিকে তাকায়া থাকবে!
ভালোবাসা ও ঘৃণার সহমিলনের মধ্য দিয়া বব ডিলানকে পার হইতে হবে বিষাদমগ্ন বনভূমি, মৃত মহাসাগর, আর হাজার মাইল জুড়ে বিস্তারিত গোরস্তান। যত পার হইবেন ততই বিস্মৃত হবেন তার সবখানি। মানুষ জন্মদোষে গোল্ডফিশ। তার সভ্যতাযাত্রা মানে হইতেছে মহা বিস্মরণের পানে যাত্রা। বিস্মরণে সহজাত হওয়ার কারণে সে নিষ্পাপ। শত হাজার আউশভিৎস, অগণিত গণকবরকে নিমেষে বিস্মৃত হয়ে কবিতা লিখতে পারে। সকল হত্যা ও নারকীয়তা তার কাছে মমিকরা তুতেনখামেন। তুতুনেখামেনকে সে তাই আদর জানাইতে চুম্বন করে। মৃত ফারাওর মুখচুম্বনের ক্ষণে তার দেহে দ্যুতি দেখা যায়। বড়ো সুন্দর দ্যুতি! যেমন সুন্দর তার এই অনায়াস রোমন্থন,- ওল্ড ইজ অলওয়েজ গুড। এখন যেমন আছি তারচাইতে তখন ভালো ছিলাম;- এই বিস্মরণ ছাড়া তার পক্ষে মানুষ থাকা সুকঠিন।
. . .
. . .