আসুন ভাবি

বিশ্বাসের উৎস – পাঠ-সংযোজন

শর্ট ইন্ট্রো-২ : থার্ড লেন-এ ১০ ডিসেম্বর প্রকাশিত বিশ্বাসের উৎস রচনার এটি দ্বিতীয় বা শেষ কিস্তি। প্রথম কিস্তিতে দর্শন-চিন্তক ও গবেষক জোশুয়া দিপাওলো-র (Joshua DiPaolo) দ্য ওরিজিন অব বিলিফ-এর মুখবন্ধসহ বাংলা ভাষান্তর থার্ড লেন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ-এ দাখিল করেছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান জাভেদ। রচনাটি নিয়া গ্রুপে তাৎক্ষণিক আলাপ হয়েছিল কিছু। তার মধ্য থেকে আহমদ মিনহাজের বক্তব্যকে আমরা এখানে পাঠ-সংযোজন হিসেবে পেশ করছি। আশা করি পাঠকরা জোশুয়া দিপাওলো-র আদি রচনায় এই সুবাদে আলো ফেলবেন।

. . .

পাঠ-প্রাসঙ্গিক একখানা উৎস পেশ করার জন্য ধন্যবাদ জাভেদ। লেখাটির ভাষান্তরে আপনার গাড্ডায় পতিত হওয়ার কারণ ভালোই টের পাইতেছি। বাংলা জবানে দার্শনিক আলোচনার সূত্রপাত ঘটানো কঠিন। তার উপ্রে যদি ফরেইন হয় তাহলে বাংলায় বোধগম্য করতে জান বাহির হওয়ার উপক্রম করে। এর বড়ো কারণ হইতেছে পরিভাষা। বিজ্ঞান-দর্শন ইত্যাদির আলোচনায় বাংলা জবানে লাগসই পরিভাষা আমরা তৈরি করতে পারি নাই। সরদার ফজলুল করিম উক্ত কাজে হাত দিলেও উনার পরে দ্বিতীয় কেউ এই ব্যাপারে আগ্রহ দেখান নাই। যার ফলে বাংলায় দর্শন পড়ানোর ধারা কলেজ-ভার্সিটির সুবাদে চালু থাকলেও বিদেশে যেমন তাকে কেন্দ্র করে বিচিত্র স্কুল বা ঘরানা আমরা বিকশিত হইতে দেখি, পোড়াকপাল এই দেশে সেই বুনিয়াদ কবে গড়ে উঠবে, তার অপেক্ষায় আমরা এখনো দিন গুনতেছি।

ঐতিহাসিকভাবে ভারতবর্ষে সংস্কৃত ও পালি ভাষাকে কেন্দ্র করে ভাববাদী দর্শনচর্চা একসময় প্রবলভাবে বিদ্যমান ছিল। স্রষ্টা ও সৃষ্টির কার্যকারণ নিয়া গুরুতর দার্শনিক বাহাসকে উপলক্ষ করেই কিন্তু ভারতীয় বস্তুবাদী ও ভাববাদী দর্শনচিন্তার বুনিয়াদ তৈরি হইছিল। মোটা দাগে যা থিওলোজি বা ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক দার্শনিক মীমাংসায় ব্যবহৃত হইতেছে এখন। কেবল তাই নয়, এইটাকে কেন্দ্র করে ব্যাকরণশাস্ত্রের অসাধারণ বুৎপত্তি ঘটছিল সেই আমলে।

ভিটগেনস্টাইন থেকে দেরিদা অবধি বহমান পরম্পরা দার্শনিক ভিত্তির উপ্রে দাঁড়িয়ে যবে ভাষাদর্শনকে পল্লবিত করলেন, তার হাজার বছর আগে থেকে গোটা ভারতবর্ষের টোল কেন্দ্রিক গুরুমুখী বিদ্যাচর্চায় ভাষাদর্শন প্রাণবন্ত একখান জিনিস রূপে সচল ছিল। সময়ের পটপরিবর্তনে সংস্কৃত ও পালি ভাষার সঙ্গে বিচ্ছেদ আর প্রত্নভাষায় তাদের মমি হয়ে পড়াটা উক্ত ধারায় বিচ্ছেদ ঘটায়। সংস্কৃত ও পালি থেকে বাংলা বা অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় তর্জমার অপরিহার্যতা আমাদের বিদ্যালয় কেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় সিরিয়াস ম্যাটার হিসেবে কখনো বিবেচনা করা হয় নাই। যার ফলে সংস্কৃতে পড়ে থাকা বিপুল দার্শনিক সামগ্রী মোটের ওপর এখনো অব্যবহৃত এবং অধুনা অকার্যকর। এগুলার ভাষান্তর এখন বাংলায় কমবেশি আছে, কিন্তু তার মধ্যে দার্শনিক ব্যাখ্যা ও নতুন চিন্তনের উদ্ভাস নাই। নিছক তফসির টাইপের কাজ হইছে;- না পড়তে আরাম, না গিলতে। ওজু করে নামাজ পড়ার মতো এসবের ব্যবহেরে ধর্মের পুরোহিত ও পৃষ্ঠপোষকরা লিপ্ত আছেন।

Bimal Krishna Matilal Image Source – Google Image

যাই হোক, যাজ্ঞবাল্ক্য, বাদ্রায়ন, কুমারিল, কণাদ, শঙ্কারাচার্য, রামানুজ, মাধাবার্য, ভর্তৃহরী এবং আরো যারা আছেন… উনারা পশ্চিমে বিকশিত আধুনিক দর্শনশাস্ত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখছিলেন একসময়। যার ধারণা আপনি বিমল কৃষ্ণ মতিলালের ইংরেজিতে রচিত কিতাবগুচ্ছ, বিশেষভাবে ন্যায় বৈশেষিকাThe Character of Logic in India নামক দুখানা ঢাউস কিতাবে গমন করলে পাবেন। উনি বাংলায় বিশেষ একটা লেখেন নাই। যৎসামান্য যা লিখছেন সেগুলাকে আমরা প্রাথমিকা ধইরা নিতে পারি। মতিলালের প্রখর অ্যনালিটিক্যাল পাওয়ার তার মধ্যে অল্পই প্রতিভাত হইছে। কেন লেখেন নাই;- প্রশ্নটি উনাকে করা যাইত বোধহয়। আমার ধারণা সেখানে বাংলাসহ ভারতীয় প্রাদেশিক ভাষার সঙ্গে পালি-সংস্কৃতির বিরাট বিচ্ছেদ, যার পেছনে বর্ণপ্রথাশাসিত রাজনীতির ভূমিকা মর্মান্তিক ছিল, উনি সেইটা তুলে ধরতেন।

যাই হোক, পশ্চিমা বিশ্বে কেবল ম্যাক্সমুলার না, হেগেল-শোপেনহাওয়ার-নিটশে… সকলেই ভারতীয় দর্শন তথা সমগ্র প্রাচ্যবিদ্যা বা ওরিয়েন্টাল ভাষাপদ্ধতির সঙ্গে নিবিড় ছিলেন। ম্যাক্সমুলার বাদ দিলে বাকিরা সংস্কৃত বা পালি জানতেন এমন না, কিন্তু ওসব উনাদের মাতৃভাষায় সেই আমলে অনূদিত হইছিল। পালি ও সংস্কৃতের মতো ধনাঢ্য দুইখান ভাষায় পড়ে থাকা Etiology বা কারণবাদ বিষয়ক দার্শনিক আলোচনা ও প্রস্তাবনার সঙ্গে বিচ্ছেদ আমাদের চিন্তাকে গাঠনিক উপায়ে বিকশিত হইতে দেয় নাই। যে-কারণে এই দেশে আপনি আচমকা বড়ো মাপের দার্শনিক, দর্শনব্যাখ্যাতা বা ইন্টারপ্রেটার, এমনকি এর সাহিত্যিক নির্যাস তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, জেমস জয়েস, প্রুস্ত ধাঁচের লেখকের আবির্ভাব আশা করতে পারেন না। ভাবুকতা বলতে আমরা এখন লোকায়ত দর্শন ও লোকসংস্কৃতির মধ্য দিয়া যেটুকু যা প্রাপ্ত হইছি সেগুলাকে ধরতেছি। বাস্তবে ভারতীয় দর্শন প্রসূত ভাবুকতার শিকড় অনেক গভীর, যদিও সেখানে গমনের সড়ক সুগম নাই আর। নিজেকে স্বনির্ভ র করার পথে অন্তরায় এখানে এসে আজো তীব্র বটে।

ফরহাদ মজহার যেমন এই লোকায়ত দর্শন ও লোকসংস্কৃতির সুবাদে পাওয়া ভাবুকতাকে অ্যাসেট ধরে ভাবান্দোলনের একখান পলিটিক্যাল সিনথেসিস বা রাজনৈতিক সংশ্লেষণ খাড়া করছেন। উনার পক্ষে কিন্তু বেদ-উপনষিদ থেকে আরম্ভ করে সেকালের উচ্চকোটির ব্রাহ্মণসমাজ বিরচিত অতিকায় কারণবাদ ও কার্যকারণবাদ বিষয়ক দার্শনিক প্রস্তাবনায় যাওয়া গমন করা সহজ হইতেছে না। ঘুরপথ ধরে যাইতেছে উনি। পশ্চিমের দার্শনিকরা এই ধারায় যেসব প্রস্তাবনা রেখে গেছেন, সেগুলোর সঙ্গে আমাদের এখানে প্রবাহিত ভাববাদী কার্যকারণবাদের মিল তিনি টের পাইতেছেন, কিন্তু ধরতে পারতেছেন না। ফলে চিন্তার বীজ বপণ হইতেছে মানলাম, কিন্তু এর গোড়ায় জল ঢালার জন্য ভারতীয় দার্শনিকতার ব্যাপারে পাশ্চাত্য ভাবুকদের মতামত ও রায় আমাদেরকে প্রবলভাবে নিতে হইতেছে। 

Gayatri Chakravorty Spivak speaking about her initiative on translating Bengali Classics for the world; Source Prohor YTC

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের কথাই ধরেন, উনি জাক দেরিদাকে ফরাসি থেকে ইংরেজিতে নিয়া আসলেন। দেরিদার সঙ্গে সারা বিশ্ব পরিচিত হইল। দেরিদামনিষার সাক্ষাতে আমরাও ঋদ্ধ হইলাম। কলকাতা লিটারারি মিটসএ গায়ত্রী একবার অতিথি হয়ে আসছিলেন। সেখানে বলছিলেন,- আম্রিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ যাইবার পর তিনি প্রথম টের পান দেশে থাকতে পরীক্ষা ক্যামনে পাস দিতে হয় সেইটা উনার জানা ছিল, কিন্তু চিন্তা ক্যামনে করে তার কিছু জানতেন না। গায়ত্রী যদি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের পাঠ সমাপ্ত করে আম্রিকায় পাড়ি না দিতেন তাইলে আমরা দেরিদাকে পাইতাম কিনা সন্দেহ। 

গায়ত্রী এই-যে বলতেছেন, চিন্তা ক্যামনে করে সেইটা কলকাতা উনাকে শিখাইতে পারে নাই এখানেই আমাদের পতনের কারণ নিহিত। চিন্তা কীভাবে করে তার তরিকা যদিও প্রাচীন ভারতের পালি ও সংস্কৃত ভাষার গুদামে অঢেল মজুদ আছে। যার প্রতিফলন সেকালের গুরুমুখী পাঠশালায় ছিল। এর সবটাই সময়ের সঙ্গে নবীকরণ করা সম্ভব হয় নাই। ইংরেজরা এসে আরো ভজকট পাকানোর কারণে সব বিনষ্ট হয়। আমরা ধনী থেকে ফকিরে পরিণত হই। রবি ঠাকুরের একখানা শান্তিনিকেতন বিরাট এই শূন্যতা পূরণে যথেষ্ট ছিল না। যে-কারণে Etiology ও Indoctrination-এর বাংলা কী হইতে পারে ইত্যাদি নিয়া আপনাকে গাড্ডায় পড়তে হইতেছে। 

আমাদের তরিকা মোতাবেক Etiology-কে আমরা কারণবাদ বইলা বুঝে নিতে পারি। কার্যকারণ কিন্তু না। কারণবাদ… যেইটার ওপর ভিত্তি করে বৌদ্ধ ও বৈদিক দর্শনের ষোলআনা গড়ে উঠছিল একসময়। পরে কারণ বা Causation সূত্রে আসছে কার্য বা Effectদুইয়ের যুগলবন্দি করে আমরা কার্যকারণ বলতেছি। আর Indoctrination তখন ঘটতেছে যখন কারণ ও কার্যকে কেন্দ্র করে দার্শনিক প্রস্তাবনা বা তার মীমাংসা পরিস্কার ভাবাদর্শ বা Ideology রূপে মানুষ গ্রহণ করতেছেন। যা পরে, আমরা ভাবতে পারি, মতাদর্শ রূপে মানুষের চিন্তা-মনন ইত্যাদিকে আকার দিতেছে। 

Bimalkrishna Motilal Memorial Lecture – Prof Arindam Chakraborty; Source – Naao Initiative YTC

জসোয়া দি পাওলোর গোছানো আলোচনা মূলত এই জায়গায় ফোকাস করতেছে। যেখানে আবার Etiology-কে তিনি কিছুটা সরলীকরণ করে ফেলতেছেন মনে হইল। উইকিপিডিয়ায় ক্লিক দিলে Etiology বা কারণবাদ-এর একাধিক উৎস আপনারে দেখাইতেছে। চিকিৎসা শাস্ত্রে এর ব্যবহার গ্রিকরা করতেন একসময়। সোজা কথায় রোগের কারণ সন্ধান অর্থে শব্দখানা আদিতে বিদ্যমান ও চর্চিত ছিল। মিথ বিশ্লেষণ ও দর্শনশাস্ত্রের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা হিসেবে এর ব্যবহার ব্যাপক। সেখান থেকে ধর্মের সঙ্গে তাকে লিংক করা হইছে।

বিশ্বাসী মানেন বা না-মানেন, ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে মিথ প্রসূত বিষয়াদির সংযোগ নিবিড়। মিথ নিজে হইতেছে এমন একখান কারণ যেইটা প্রকারান্তরে ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্মকারণ। আবার মিথ কিন্তু Indoctrination বা ভাবাদর্শ বা মতাদর্শে অতটা ঘনীভূত না। যারপরনাই ধর্মীয় বিশ্বাস যখন পরিষ্কার ভাবাদর্শ বা মতাদর্শ-এ পরিণত হয় তখন সেইটা আবার তার গা থেকে সকল মিথকে অপসারিত করতে চায়। অলৌকিককে সে তখন Etiology বা কারণবাদের এমন এক প্রস্তাবনায় একীভূত করে, যার আভাস ভারতীয় দর্শনে গেলে আপনি ভালোমতন পাইতেছেন।

উনারা কারণবাদের জড় ধরে যে-আলোচনার বিস্তার করছিলেন, সেখানে ধরেন, স্রষ্টা বা ব্রহ্ম কিন্তু মিথ না। ব্রহ্ম স্বয়ং একখান প্রপঞ্চ বা Phenomena;– জগৎ সৃষ্টির গণ্য কারণ। কারণ কাজেই কখনো মিথ হইতে পারে না। যা সবকিছুর কারণ সে মিথ নয়, তবে হ্যাঁ, যা-কিছু কার্য বা Effect, তার সুবাদে মিথ তৈরি হইতে পারে। পৌরাণিক গল্পগাছা হইতেছে আদিকারণ বা অ্যারিস্টোটলের ভাষায় First Mover বা আদিচালক। এখন এই আদিচালককে কেন্দ্র করে আপনি মিথের বিরাট জগৎ তৈরি করতেছেন। কারণকে কেন্দ্র করে ভাবাদর্শ হইতে মতাদর্শ হইতে ধর্মীয় বিশ্বাস… এই যে ক্রনোলজি গড়ে উঠতেছে, মিথকে সেখানে অপাঙক্তেয় করে তোলার রাজনীতিমধ্যে নিহিত থাকে গোঁড়ামি ও অন্ধত্ব।

ধর্মীয় বা এরকম যে-কোনো মতাদর্শ (কমিউনিজমও হইতে পারে অথবা ফ্যাসিজম), যারা কিনা কারণবাদ-এ নিহিত দার্শনিক প্রস্তাবনায় অটল থাকার নাম করে তার বিকশিত হওয়ার আদি উৎস মিথকে ছাটাইয়ের রাজনীতি করে, তখন সেইটা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। জসোয়া দি পাওলোর গোছানো আলোচনায় এই দিকটি আরো উদাহরণ সহকারে আসলে পাঠকের উপকার হইত। রচনাটি সুখপাঠ্য হইলেও সরলরৈখিক। কারণ, Etiology বা কারণবাদকে দিয়া Etiology বা ভাবাদর্শ/মতাদর্শকে প্রশ্নবিদ্ধ করার যে-প্রস্তাবনা তার সমস্যার দিকটি আলোচনায় বিস্তারিত আসে নাই। 

. . .

Jacques Derrida and Bhartrihari – About the orgin of language – Debaprasad Bondhopadhaya; Source – Bodhichitta YTC

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 1

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *