. . .
চিমামান্দা এনগোজি আদিচির সিঙ্গেল স্টোরি
নাইজেরিয়ার মেয়ে চিমামান্দা এনগোজি আদিচি (Chimamanda Ngozi Adichie) কথাসাহিত্যিক হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। ১৯৭৭ সনে ধরায় তশরিফ রাখেন। আফ্রিকার সমাজ, সংস্কৃতি ও অভিবাসী সমস্যা ছাড়াও সমাজে নারীর অবস্থান ও মর্যাদার বিষয় নিয়ে আদিচি নিরলস লিখে চলেছেন। হাফ অব অ্যা ইয়েলো সান (Half of a Yellow Sun) শিরোনামে রচিত আখ্যানের জন্য বিশ্ব জুড়ে সমাদৃত হয়েছেন। নাইজেরিয়ায় দফায়-দফায় চলতে থাকা গৃহযুদ্ধে দেশবাসীর ভোগান্তির বিবরণ সেখানে তুলে ধরেছিলেন তিনি। আমেরিকানা উপন্যাসে আবার একালের আফ্রিকায় অভিবাসীদের জীবনযন্ত্রণা তুলে এনেছেন সংবেদী ভাষায়। পারপল হিবিসকাস (Purple Hibiscus)-এর বয়ানে নাইজেরিয়ায় একটি পরিবারে ঘটে যাওয়া অত্যাচার ও সুকঠিন প্রতিরোধের বিবরণ তুলে ধরতে কমতি রাখেননি আদিচি। উই শুড অল বি ফেমিনিস্টসকে (We Should All Be Feminists) নারীবাদী বিবৃতি বলা যেতে পারে। নারীঅধিকারের গুরুত্ব ও সমাজে নারীর স্থান নিয়ে জরুরি আলাপ তুলেছিলেন সেখানে। TEDx-এ আদিচি বিষয়টি নিয়ে হাজির হলে বিশ্ব জুড়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল।
চিমামান্দা এনগোজি আদিচির ঝুলিতে ইতোমধ্যে অনেক প্রাপ্তি ও পুরষ্কার জমা পড়েছে। বিশ্বের নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয় প্রদান করেছে বিশেষ সম্মাননা। বাংলাসহ একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছেন নারীঅধিকার সচেতন এই কথাশিল্পী। বিভিন্ন মঞ্চে রাখা বক্তিমা আর গল্প-আখ্যান মিলে বহুল পঠিত লেখক তিনি। আফ্রিকার মানচিত্রকে বিশ্বে তুলে ধরার পাশাপাশি সমাজে নারীর অসম অবস্থান ও অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সক্রিয়তা গেল এক দশকে সারা বিশ্বে তাঁকে আলোচিত ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি করে তুলেছে।
আমি এখানে আদিচির যে-স্পিচ সংযুক্ত করেছি সেটি প্রায় পনের বছর আগে টেড টক-এর মঞ্চে দিয়েছিল উনি। বয়স তখন মাত্র বত্রিশ। ব্যক্তিগত জীবনের গল্পগুলো শ্রোতাদের শুনিয়েছিলেন সেখানে। এর থেকে আমরা টের পাই,- জীবন আসলে কতটা বিরাট আর বৈচিত্র্যপূর্ণ! অনেকগুলো গল্প মিলে একটি জীবনের গল্প তৈরি হয়। একটি বা দুটি গল্প দিয়ে সে কখনো গড়া নয়, তাকে ওই চোখে পাঠ করা সম্ভবও না। সুতরাং কোনো একটি গল্প দিয়ে একজন মানুষ ও তার বেড়ে ওঠার কাহিনি যাচাই করা অনুচিত। সিঙ্গেল স্টোরি বানানোর বিপদ সম্পর্কে আদিচি সচেতন করার চেষ্টা করেন আমাদের।
কেবল কোনো ব্যক্তি নয়, সেই ব্যক্তি যেখানে বেড়ে উঠছে, অর্থাৎ তার স্থানকাল ও স্বদেশ স্বয়ং একগুচ্ছ গল্পের সমষ্টি। গুচ্ছ থেকে দুই-একটি বেছে নিয়ে তাকে বোঝার চেষ্টা তাই বিপজ্জনক। ভুল বোঝাবুঝি ও বিভ্রান্তিকে তখন নিরোধ করা যায় না। কাজেই কোনো মানুষ অথবা ঘটনাকে যদি বুঝতেই হয়ে তাহলে তার সবগুলোয় কান পাতা জরুরি। সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যদি আমরা আগাতে না পারি তাহলে কাজটি কখনো সম্ভব নয়।
. . .
. . .
চিমামান্দা এনগোজি আদিচির এই টেড টক তিন-চার বছর আগে শুনছিলাম জাভেদ। আপনি শেয়ার দিলেন তাই মনে পড়তেছে এখন। যদিও তাঁর কোনো লেখা পড়ার সুযোগ আমার হয়নি। সিঙ্গেল স্টোরি বা একরৈখিক বয়ান সত্যি বিপজ্জনক। ওরিয়েন্টাল বলতে যে অঞ্চলকে আমরা বুঝি, সেখানে সকলেই কমবেশি এর ভুক্তভোগী।
হেগেলের মতো বরেণ্য দার্শনিক জাতিসত্তা নিয়া যেসব কথা বলছেন ওইসময়, সেইটা রীতিমতো আপত্তিকর ছিল। কালো মানুষদের তিনি এমন এক মানবসত্তা হিসেবে দেখছেন যারা নাকি আজো শৈশব (Kindernation) অতিক্রম করতে পারে নাই। এম্নিতে শান্ত-সুবোধ কিন্তু রেগে গেলে কালোরা স্রেফ জন্তুসুলভ। হেগেল সেখানে থামেন নাই। আরো যোগ করছেন,- কালোরা, বিশেষ করে সাব-সাহারান আফ্রিকায় যারা বসবাস করে তাদের ব্যক্তিত্ব অবিকশিত। ব্যক্তিত্ব কী বস্তু সেইটা নাকি তারা বোঝেই না! যা-কিছু মানবতাকে সুসংগতি দান করছে তার একটাও কালো মানুষদের মধ্যে নাই! কখনো ছিলও না!
হেগেল এখন এই-যে সিঙ্গেল স্টোরি বানাইলেন, তার কারণ হইতেছে কালো মানুষের জগৎকে তিনি ইউরোপে কেন্দ্রীভূত মনন ও বয়ানের আতশকাচ হাতে নিয়া দেখতেছেন। যে-কারণে সকল দার্শনিক বোধি লোপ পাইতেছে তাৎক্ষণিক! ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস নিয়া বক্তিমায় স্লাভয় জিজেক যতই হেগেলের কংক্রিট উনিভার্সিলিটির দোহাই দিয়া আইডেনটিটি পলিটিক্সের আলাপ পাড়েন না কেন, কেবল কালো নয় বরং মানুষ মাত্রই মূল্য রাখে বইলা যতই যুক্তি সাজান,- এখন তাঁর বক্তব্যে সহমত জানানোর পরক্ষণে কালো মানুষদের নিয়া হেগেলের একতরফা বয়ান মনে চেপে বসে। মোছা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর প্রাচ্যবাদ-এ ওই একরৈখিক গপ্পো ফাঁদার খাসলতকে বাণ হানছিলেন। এখন এর সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক নিবিড়। ক্ষমতা যখন যার হাতে যায়, সে তার সুবিধামতো সিঙ্গেল স্টোরি তৈরি করে। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, আরব অঞ্চল এবং ভারত… উপনিবেশের কারণে শ্বেতাঙ্গরা যে-বয়ান তৈরি করছিল, তাদের সৃষ্ট সেই বয়ানফাঁদ থেকে আজো আমরা বাহির হইতে পারি নাই। আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সাহিত্য কার্যত এই চাপানো একরৈখিক বয়ানের প্রতিবাদে ভাস্বর।
এখনো তো আমরা ক্ষমতার কেন্দ্রে যারা আছেন তাদের বয়ান দিয়া নিজেকে দেখি ও বিচার করি। এমনকি আমাদের ইতিহাস যখন পাঠ যাই অথবা পুনর্বিবেচনা করি, সেখানে ক্ষমতাসৃষ্ট বয়ানকে ভিত্তি ধরে কাজটি সারতে হয় আমাদের। এর বড়ো কারণ, আমাদের যা ছিল বা আছে তার কাছে যাওয়ার লিংকগুলা মিসিং। বিষয়টি নিয়া আশিস নন্দী অন্য প্রেক্ষাপট থেকে বিস্তর কাজ করছেন একসময়। চিমামান্দা এনগোজি আদিচি ওই-যে রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের কথা তুললেন, তো এই কিপলিং নিয়া দীর্ঘ আলোচনা উনার The Intimate Enemy Loss and Recovery of Self Under Colonialism কিতাবে করছিলেন আশিস নন্দী।
এইটা এতো বড়ো একটি প্রসঙ্গ, এতোদিক থেকে সিঙ্গেল স্টোরি আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে… অল্পকথায় এর খেই পাওয়া কঠিন। এর প্রভাব আরো শক্তিশালী হয় যখন আমরা নীরব থাকি। নীরবতা সকল একরৈখিক বয়ানকে সংহত ও শক্তিমান হইতে ভূমিকা রাখে। তবে একথা বোধহয় চিরসত্য,- যে-বিজয়ী, যে-ক্ষমতা ও আধিপত্য অর্জন করে, আপনা থেকে সিঙ্গেল স্টোরি পয়দার হকদার হইতে থাকে সে। যতদিন ক্ষমতা বিকেন্দ্রিত না হইতে পারবে, এর থেকে মানবজাতির মুক্তি নাই। কিন্তু ক্ষমতা কি আদৌ বিকেন্দ্রিত হয়? হইছে কোনোদিন?
. . .
. . .