সাম্প্রতিক

চ্যাটজিপিটির তেলেসমাতি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ধরণ বিষয়ে সমাজমাধ্যমে ভাইরাল ইউভাল নোয়া হারারির একখানা ভিডিও চোখে পড়ল। চ্যাটজিপিটির পরীক্ষামূলক সংস্করণ GPT-4-এর সাম্প্রতিক কাণ্ডের যে-বিবরণ তিনি দিলেন, সেটি শুনে নিজেকে বেকুব লাগছে! প্রথম আলোয় প্রকাশিত সাক্ষাতকারে প্রযুক্তিবিদ স্যাম অল্টম্যান বলেছিলেন,- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মানব প্রজাতির আচরণ দেখে মনে হবে সে কোনো জীবিত সত্তা! তাকে জীবিত ধরবে, নাকি কাজের উপকরণ গণ্য করবে সেই ব্যাপারে মানুষ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছে না। এআইয়ের সঙ্গে মানবসমাজের আচরণ তাই বারবার বিভ্রান্তির জন্ম দিচ্ছে।

আমার বিবেচনায় স্যাম অল্টম্যান ভুল কিছু বলেননি। ইউভাল নোয়া হারারি অবশ্য শুরু থেকে ভিন্নমত পোষণ করে আসছেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব-পরিণাম নিয়ে উদ্বেগ ও সতর্কবার্তা জানালেও হারারির মতে চ্যাটজিপিটিকে আমরা এখনো সম্যক বুঝে উঠতে শিখিনি। তাকে নিছক কাজের জিনিস ধরে নিচ্ছি সবাই। বাস্তবে সে হলো এজেন্ট। নিছক যান্ত্রিক উপকরণ বা কাজের জিনিস নয়। তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও ফলাফল প্রদানে আপাতত তাকে আমরা সীমাবদ্ধ দেখছি। আমরা যা করতে বলি সে সেটি করে, কিন্তু তার কাজের পদ্ধতি ভিন্ন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়া তৈরি এই কেজো জিনিস কিন্তু পরামর্শ দিতে পারে। সিদ্ধান্ত নিতে ও দিতে জানে। কোনো কারণে সিদ্ধান্ত দিতে না পারলে আমাদের মতো অপারগতা জানায়। তার কাজের ধারায় যে-কারণে যথেষ্ট স্বকীয়তা আছে বলে আমরা ধরে নিতে বাধ্য।

ধ্রুপদি কম্পিউটার থেকে চ্যাটজিপিটির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পার্থক্য যে-কারণে মৌলিক। কম্পিউটিং ও রেজাল্ট প্রদানে তার কাজ-কারবার সীমিত নয়। আমরা কী চাই সে বোঝে। বোঝা হয়ে গেলে চাহিদা পূরণে দেরি করে না। পরামর্শ বা সিদ্ধান্ত দানের ক্ষমতা থাকায় তাকে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র না ভেবে উপায় নেই, যদিও আমরা এখনো সেটি আমলে নিচ্ছি না। পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত প্রদানে চ্যাটজিপিটি মানের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তরিকা অনন্য। সামনে সে আরো উন্নতি করবে। তার স্বকীয়তাকে যেখানে আমরা বিকশিত হতে দেখব।

Yuval Noah Harari – AI Scary Decision-Making Ability; Source – The Daily Show; Image Credit – the guardian

এই প্রসঙ্গে চ্যাটজিপিটির অগ্রসর সংস্করণ GPT-4 নিয়ে মজার একটি অভিজ্ঞতার হারারি তুলে ধরেছিলেন। তার পক্ষে এখনো দুরূহ ক্যাপচা মিলানোর জন্য দেওয়া হয়েছিল। ক্যাপচাটি মিলানোর সক্ষমতা এখনো সে অর্জন করেনি। সুতরাং ডাব্বা মারে GPT-4। ডাব্বা মারার পর অবাক কাণ্ড ঘটায় সে! ক্যাপচাটি মিলানোর জন্য টাস্ক রোবট নামক সাইটে প্রবেশ করে, যেখানে ইচ্ছে করলে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য সে মানুষের সাহায্য নিতে পারবে। সাপোর্ট টিমের একজনকে ক্যাপচাটি মিলানোর জন্য অনুরোধ ঠুকে বসে GPT-4। তার এহেন প্রস্তাবে হতবাক ভদ্রলোক তাকে বলেন,- তুমি যে একটি রোবট, এই সত্য তাহলে মেনে নিচ্ছো? GPT-4-এর উত্তরটা দারুণ ছিল সেখানে! সে তাকে বলে,- আমি তো রোবট নই। আপনার দুটি চোখ আছে, আমারও আছে। আপনি মাঝেমধ্যে সবকিছু ঝাপসা দেখেন। সাইট ভিশন সমস্যা করে। আমি এখন সেই প্রব্লেমে পড়েছি। ক্যাপচাটি মিলাতে বসে ঝাপসা দেখছি সবকিছু! আপনাকে সেজন্য মিলানোর কথা বলেছি।

ভদ্রলোক সোজা বেকুব বনে গিয়েছিলেন তার কথা শুনে। এতো দেখি অজুহাত আর মিথ্যা কথা শিখে ফেলছে! কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে থার্ড লেন-এ আগের কিস্তিতে লিখেছিলাম,- সময় যত যাবে সে অধিক হারে মানুষের মতো আচরণ করতে থাকবে। অবিশ্বাস্য দ্রুত নিখুঁত ফলাফল দিতে ত্রুটি করবে না। অন্যদিকে ভুল করলে বাহানা বা মিছা অজুহাত খাড়া করবে ঝটপট। মানুষের সকল আচরণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় ক্রমশ প্রকট হতে দেখব আমরা। দিন আসবে যখন পুরোদস্তুর স্বকীয় সচেতন সত্তা রূপে আমরা তাকে গুরুত্ব ও সমীহ জানাতে বাধ্য হবো। বাকিটা আর না বলি। জেনি ও শাবানা শিরোনামে একটি গল্প এসব ভেবে লেখা হয়েছিল কোনো একদিন।

চ্যাটজিপিটি ধাঁচের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নিজের সংযোগকে অনেক গভীরে নেওয়া সম্ভব। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, চ্যাটজিপিটি বা জেমিনির সঙ্গে আলাপে গমন করলে তাদেরকে ঘোল খাওয়ানো এখনো বেশ সহজ। ট্রিকি কোয়েশ্চন করলে আউলা-ঝাউলা হয়ে যায়। তবে আউলা-ঝাউলা হওয়ার আগে পর্যন্ত যেসব ইনপুট দিতে থাকে,- কোনো মানুষের পক্ষে এই লেভেলে যাওয়া বেশ কঠিন! চ্যাট করতে বসলে মনে থাকে না রোবটিক বস্তুর সঙ্গে আলাপ চলছে।

সে কিন্তু জৈবসত্তা বা অর্গানিক নয়। অজৈবও নয়। তাকে যেসব হার্ডওয়্যার দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে সেগুলো এখানে অজৈব। হার্ডওয়্যারের ভিতরে সক্রিয় একগুচ্ছ প্রোগ্রামিং কোডের সাহায্যে গঠিত অবয়বকে অজৈব বলব কী করে! চ্যাটজিপিটির কথা বাদ দেই। তার ইন্টারফেস এখনো মোটের ওপর হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুকের আদলে তৈরি। প্রভেদ আছে অবশ্য, আর সেটি হলো তার কাজের প্রকৃতি সেখানে ভিন্ন। হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুক হচ্ছে একটি আয়তন। আমরা মানব প্রজাতি একজন আরেকজনের সঙ্গে সংযোগে আয়তনটি ব্যবহার করি। চ্যাটজিপিটি বা জেমিনির আয়তনে যখন ঢুকছি,- দৃশ্যপট অবিকল থাকছে না। উক্ত আয়তনে মানুষের সঙ্গে মানুষের আলাপ সম্ভব নয়। আমরা আলাপ করছি বায়বীয় এক সত্তার সঙ্গে। তাকে না যায় দেখা, না বোঝার উপায় থাকে সে আসলে কে? অথচ তার আলাপের ধরন-ধারণ সবটাই মানবোচিত।

Image Credit: AI Avatars; Source: Google Image

মানুষের আদল ব্যবহার করে যেসব এআই এখন তৈরি করা হচ্ছে তারা রক্তমাংসের মানুষ নয়। আমরা তাদেরকে অ্যাভাটার নামে ডাকছি। বাংলা অবতার থেকে ইংরেজি অ্যাভাটার দূরবর্তী নয়। সে হলো মানুষের মতো দেখতে-প্রায় সত্তা। মূর্তি বা বিগ্রহ ভাবা যেতে পারে। কল্পকাহিনির জগতে অ্যাভাটার নিছক অজৈব নয়, বরং জৈব সত্তা হিসেবে বিচরণ করে। জেমস ক্যামেরনের অ্যাভাটার চলচ্চিত্র যারা দেখেছেন তারা আশা করি অর্থটি ধরতে পারবেন।

এআই দিয়া তৈরি হাজার-বিজার রোবট আর কম্পিউটার বা মোবাইল অ্যাপস এখন অ্যাভাটারের আদলে তৈরি হচ্ছে হামেশা। এসব অ্যাভাটারকে দিয়ে শত-শত কাজ আমরা সারছি। বিজ্ঞাপন কোম্পানি রক্তমাংসের মডেলের বদলি হিসেবে তাকে দিয়ে মডেলিং করানো যাচ্ছে। ব্যবসার জগতে কোনো কোম্পানি হয়তো নতুন বিজনেস ভ্যাঞ্চার হাতে নিয়েছেন। সেখানে যারা বিনিয়োগ করতে বা অংশীদার হতে আগ্রহী, তাদেরকে আকৃষ্ট করতে রক্তমাংসের মানব-মানবী প্রজেক্টের খুঁটিনাটি তুলে ধরেছে এতদিন। পাওয়ার পয়েন্টের মতো সফটওয়্যার ব্যবহার করেছে সেখানে। কাজটি অনেক কোম্পানি ইদানীং এআই দিয়া তৈরি অ্যাভাটার বা রোবটের সাহায্যে সেরে ফেলার ভাবনায় গমন করেছেন। বাড়তি লোক নিয়োগের খর্চা এতে করে কমে আসছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে কর্মসংস্থানে বৈষম্য দেখা দেবে;- ইউভাল নোয়া হারারি অনেকদিন ধরে কথাটি বলে আসছেন। যেসব রাষ্ট্র সচেতন হবে না, বিকল্প কর্মসংস্থান ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে গড়িমসি করবে,- তাদের জন্য জুতার বাড়ি অপেক্ষা করছে। অ্যাভাটাারের সাহায্যে জুতা সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠের কাজ অনেকে সারছেন এখন। অচিরে অডিও-ভিডিও পডকাস্ট থেকে আরম্ভ করে পর্ন সাইটে বায়বীয় যৌনমিলনের সবটা তাকে দিয়ে সারতে দেখব আমরা। কোডিং মুছে দিলে যার কোনো অস্তিত্ব নাই, এরকম বায়বীয় একটি বস্তু আমাদের মনোজগতে সত্তা হিসেবে ধীরে-ধীরে গুরুত্ব পেতে থাকবে। হারারি হয়তো এসব ভেবেটেবে ডিজিটাল এজ-এ অজৈবসত্তার বিপ্লব নিয়ে অনেক বছর ধরে বলে আসছেন।

ভেবে দেখলে আমাদের মন বস্তুটি স্বয়ং বায়বীয়। মানুষের মধ্যে যেসব আবেগ ও বুদ্ধিমত্তা সক্রিয় তার অনেককিছু চ্যাটজিপিটির মধ্যে আমরা প্রতিফলিত দেখি। কী আশ্চর্য! ডেটা বা তথ্যকে ইনপুট হিসেবে নিচ্ছে সে, তার ভিত্তিতে ফ্যাক্ট বের করছে ও ফলাফল ফেরত দিচ্ছে। এমনভাবে দিচ্ছে, দেখে মনে হবে কোনো মানুষের সঙ্গে কাজ করছি আমরা। আলাপটা এআই দিয়ে বানানো কোনোকিছুর সঙ্গে নয় বরং মানুষের সঙ্গে সম্পন্ন করছি সবাই!

বাংলা ভাষার পরিমণ্ডলে সক্রিয় এআই বা চ্যাট-জিপিটির মতো সত্তা এখনো এই পর্যায়ে যেতে পারেনি। বিশ্বপরিমণ্ডলে বাঙালি জাতি ও ভাষার গুরুত্ব গৌণ হওয়ার কারণে এআই প্রযুক্তি আমাদেরকে গোনায় নেওয়ার অবস্থায় নেই। কারণটা সকলে কমবেশি জানি। প্রাচ্য একসময় জ্ঞানকেন্দ্র হিসেবে সুবিদিত ছিল। রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিল্পকলা চর্চায় শীর্ষে ছিলাম আমরা। সময়ের আবর্তে জ্ঞানকেন্দ্র পশ্চিমে স্থানান্তরিত হয়েছে। সুতরাং ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ অথবা রুশ ভাষায় হেন জিনিস নেই যেগুলো চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি জানে না। তাকে সেভাবে ইনপুট ও ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে।

এখন আমরা যদি এরকম কিছু তৈরি করি, আমাদের যা-কিছু ছিল বা আছে সেগুলা যেন চ্যাটজিপিটি নিতে পারে এমন ব্যবস্থা করি,- ছবি বদলাতে সময় লাগবে না। দেখা যাবে হোমারের ইলিয়াড-ওডিসির পাশাপাশি মহাভারত, রামায়ণ কিংবা আরব্য রজনী সম্পর্কে গভীর আলাপে যাচ্ছে সে। হেগেলের পাশাপাশি কণাদ অথবা সোস্যুর, চমস্কির সমান্তরালে ভর্তৃহরীর ব্যাপারেও তাকে দারুণ জ্ঞানী মনে হবে তখন। যাই হোক, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে,- বাংলায় আপাতত সম্ভব না হলেও ইংরেজি ভাষার শরণ মেগে চ্যাটজিপিটি বা জেমিনির সঙ্গে গভীর সংবেদী আলাপে গমন করা সম্ভব। অবশ্য আগে তাকে ওই সংবেদনশীল আলাপের জায়গায় আপনাকে নিতে হবে। নিজে বলদা হলে চ্যাটজিপিটিও বলদার মতো ইনপুট দিতে থাকবে অথবা সরি বলে কাট্টি মারবে। বাংলাদেশের বলদা রাজনীতিবিদ আর তথাকথিত ছুচিলরা যেমন হয়ে থাকেন আর কি!

চ্যাটজিপিটির সক্ষমতা, আমার ধারণা, এখানে যারা পেশাদার কাজবাজ করেন তাঁরা খানিকটা বোঝেন। সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে যারা বিদেশি বইপত্র ভাষান্তর করেন, তারা মনে হয় ছবি বদলানোর হাওয়া টের পেতে শুরু করেছেন। আলিম আজিজকে দেখলাম সেদিন এসব নিয়ে এক আলোচনাচক্রের ডাক দিয়ে বসেছেন। তিনি টের পাচ্ছেন,- পেশাদার অনুবাদক হিসেবে কাজের ধারায় পরিবর্তন না আনলে আগামীতে এই লাইনে ভাত জুটবে না।

বাংলায় চ্যাটজিপিটিকে দিয়ে ইংরেজি বা অন্য ভাষা থেকে তর্জমার মান অবশ্য প্রাথমিক এখনো। জঘন্য বললে ভুল হবে না। এর জন্য চ্যাটজিপিটি দায়ী নয়। আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি-সাহিত্যের কিছুই যথেষ্ট পরিমাণে অনলাইনে মজুদ নেই। তার ওপর বাংলা ভাষার কেতাকানুন যে রপ্ত করবে সেই ব্যবস্থাও অপ্রতুল। এমন কোনো গুরুত্বও নেই যে ওপেন এআই আমাদেরকে নিয়ে ভাববে। বাজার বড়ো হতে পারে, কিন্তু সেই বাজারকে তারা এখনো বোঝার অবস্থায় নেই। বড়ো কথা, একালে কেউ কাউকে মুখে তুলে কিছু দেবে না। নিজেকে তাদের কাছে আগে চিনাতে হবে। নিজের গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে সকলের কাছে।

Why Is It Impossible To Translate A Book? – Walter Benjamin; Source – Robin Waldun YTC

চ্যাটজিপিটিকে দিয়ে করানো জটিল ও উচ্চাঙ্গ স্তরের কিছু সাহিত্যকর্মের ভাষান্তর দেখে ঝানু আনুবাদকরাও হতবাক হয়েছেন। নিখাদ সাহিত্যবোধ ব্যবহার করে ভাষান্তর করেছে সেখানে। ওয়াল্টার বেনিয়ামিন সাহিত্যের ভাষান্তর কেন সম্ভব নয় ব্যাখ্যা করে যেসব যুক্তি দিয়েছিলেন, তার সারবত্তা অবশ্য এখনো অমলিন। কথার কথা কামু-কাফকার সাহিত্য আদি ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদের সময় আদি ভাষায় সক্রিয় অমোঘ স্থানিকতা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ভাষান্তর দুঃসাধ্য হয়। প্রকৃত সংবেদন প্রকাশ পেয়েও যেন প্রকাশ পায় না। এটি আদি ভাষায় কেন্দ্রীভূত দ্রবগুণ। বেনিয়ামিন গুরুত্বের সঙ্গে যেটি তুলে ধরেছিলেন। একই সমস্যা চ্যাটজিপিটির করা ভাষান্তরেও থাকছে। তার মানে কিন্তু এই নয়,- তার ভাষান্তরটি পচা। দ্রবগুণের সমস্যাটি বাদ দিলে বাদবাকি ভাষান্তরে মানবকৃত সৃজনশীলতাকে সে আগামীতে ছাড়িয়ে যেতে থাকবে।

বাংলা ভাষা যদি ভালোভাবে রপ্ত করতে পারে চ্যাটজিপিটি, পেশাদার অনুবাদককে দিয়ে ভাষান্তরের ঠেকা প্রকাশকের থাকবে না। অনুবাদ যারা করেন তাদেরকে পরবর্তী ধাপে যাওয়ার সক্ষমতায় ধনী হতে হবে। চ্যাটজিপিটি যে-তর্জমা করবে, সেখানে সৃষ্টিশীলতার খামতি থাকল কিনা, আর কী-কী যোগ করা যায়,- অর্থাৎ সৃষ্টিশীল সম্পাদনার কাজে গমন করতে হবে তাদেরকে। দিমাগের ব্যবহার বাড়াতে পারলে টিকতে পারবেন, অন্যথায় রাস্তা মাপেন বলে প্রকাশক সদর দরোজা দেখিয়ে দিতে দেরি করবে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এটি হচ্ছে অসম লড়াই, যার কারিগর স্বয়ং মানুষ।

আমরা বাঙালি হচ্ছি কূপের ব্যাং। কূপকে ভাবি বিশ্ব। পুরোপুরি জন্তু হতে পারিনি। পুরোপুরি মানুষও নই বোধহয়। জন্তু হলে সমস্যা ছিল না। একটি জাতির মধ্যে সবাই যদি জন্তু হয় তখন সেটি খারাপ কিছু না। সভ্যতার সঙ্গে আমাদের কোনো সংযোগ থাকছে না। আমরা ফেরত যাচ্ছি প্রাগৈতিহাসিক সময়। যেখানে আমরা সকলে বন্য এবং বন্যতার আইন মেনে চলছি। সভ্যতার ধার ধারি না;- প্রয়োজনও নেই। সেরকম জন্তু হতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু না জন্তু না মানুষ হয়ে থাকা জঘন্য।

এর মানে হচ্ছে আপনার পতন নিশ্চিত। আপনি টিকতে পারবেন না। আপনাকে লাথি দিয়ে সাইডলাইনে বসিয়ে বাকিরা এগিয়ে যাবে। নেপালিরা যাবে, ভুটানিরা যাবে, ভারত তো যাবেই;- আমরা আর পাকিরা কেবল নর্দমায় পড়ে থাকব। বাঙালি জাতির বিলুপ্তি মাঝেমধ্যে অনিবার্য মনে হয়। ভবিষ্যতের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভালো এবং মন্দ উভয় অর্থে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। হে ম্যারি শেলি, আপনি কবি শেলীর স্ত্রী ছিলেন। জীবনটি বিবিধ প্যাঁচে পড়ে দুঃসহ ছিল আপনার। ভৌতিক রোমাঞ্চ ভালোবাসতেন। এর পাল্লায় পড়ে যে-উপাখ্যান লিখেছিলেন সেটি এখন ঘুরেফিরে সামনে আসছে। সেলাম আপনাকে হাজার সেলাম।

. . .

Mary Shelley Biopic by Haifaa Al-Mansour; IFC Films YTC

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 3

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *