এআই বলছি

যে-বই পড়তে কঠিন

Reading time 15 minute
@thirdlanespace.com

যে-বই পড়তে কঠিন : জেমস জয়েস ও ডেভিড ওয়ালেস
রচনা : চ্যাটজিপিটি মডেল-4
ভাষিক গ্রন্থনা : থার্ড লেন টিম

Ulysses by James Joyece; Kindle Edition; Image Source – amazon.es

ইউলিসিস : জেমস জয়েস

বইটি আধুনিক সাহিত্যের এক গোলকধাঁধা! জেমস জয়েস এখানে ডাবলিন শহরের পটভূমিতে হোমারের ওডিসিকে (Odyssey) চব্বিশ ঘণ্টা মেয়াদি সময়রেখায় ধারণ করেছিলেন। রচনাশৈলী বহুস্তরে বিন্যস্ত ও জটিল। ভাষার চলন পাঠককে বিমোহিত, বিদগ্ধ, এবং এর পাশাপাশি বিভ্রান্ত করে। ইউলিসিস-এর পেনিলোপ পর্বাংশের (Penelope episode) কথাই ধরা যাক,—কোনো বিরামচিহ্ন ছাড়া প্রায় ৫০ পৃষ্ঠা জুড়ে টানা বাক্য নির্মাণ করেছেন জয়েস। পাঠককে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন, তাকে বলছেন,—‘আমায় তুমি বোঝো, যদি তোমার পাঠসক্ষমতা থাকে আমাকে বোঝার।’

Stream of consciousness বা চেতনাপ্রবাহ জেমস জয়েসের অনন্য কীর্তি রূপে স্বীকৃত। চেতনাপ্রবাহ মানে কেবল চরিত্রকে ভাবনাস্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া নয়, জয়েসের হাতে পড়ে তা বিরামহীন মানসিক তরঙ্গে রূপ নেয়। বাস্তব, কল্পনা, স্মৃতি ও ধ্বনির সমুদয় অনুষঙ্গ সেখানে গলেমিশে একীভূত ও পরস্পরের মধ্যে লীন হতে থাকে। ইউলিসিস থেকে এই বাক্যটি ধার করি বরং;—জয়েস সেখানে লিখেছেন : He is young Leopold, as in a retrospective arrangement, a mirror within a mirror (hey, presto !), he beholdeth himself. বাক্যটি এমনভাবে লেখা যেখানে বাস্তবতা ও কল্পনার মধ্যে পরিষ্কার কোনো বিভাজনরেখা টানা দুরূহ। ইউলিসিস কেন পড়তে কঠিন তার কারণগুলো সংক্ষেপে টুকে নেওয়া যেতে পারে :

ভাষার বৈচিত্র্য : প্রতিটি অধ্যায়ে পৃথক গদ্যশৈলী প্রয়োগ করেছেন লেখক। যার কোনোটি গথিক খিলানের মতো মনোহর দেখতে! কোনোটি যেন-বা নিজেকে জাহির করতে উন্মুখ। একাধিক আবার পরিহাসরসে দীপ্ত ইতিহাসকে মনে করিয়ে যায় বা এর স্মারক হয়ে ওঠে!

ইংগিত, পাদটীকা, রেফারেন্স : জেমস জয়েস তাঁর আখ্যানে কী বোঝাতে চাইছেন এই ব্যাপারে ধারণা পেতে পাঠককে গ্রিক পুরাণ, বাইবেল, শেক্সপিয়ার, দান্তে থেকে শুরু করে ডাবলিন শহরকে পাক দিয়ে আগানো রাস্তার ইতিহাসও জানতে হচ্ছে! মায়া বা বিভ্রম, ধ্রুপদি সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মীয় পুরাণ মিলে জ্যামিতিক স্তরের জটিল এক রচনাশৈলী লেখক বেছে নিয়েছেন এখানে। কাহিনির মধ্যে সুতরাং কোনো রৈখিক সারল্য নেই। চব্বিশ ঘণ্টায় বাঁধাই করা সময়স্তর ১৮টি অধ্যায় জুড়ে বিস্তারিত হয়েছে। কাহিনির খেই ধরতে পাঠক তথাপি নাকাল হয় বারবার! আখ্যান রচনায় কাহিনি ফাঁদার বহুল স্বীকৃত পন্থার অস্তিত্ব ইউলিসিস-এ শেষ পর্যস্ত বজায় থাকে না। কাহিনি বা গল্পপ্রধান আখ্যান রচনার ভিত ধ্বংস করতে যেন-বা কলম হাতে নিয়েছিলেন জয়েস! ব্যক্তির চেতনাপ্রবাহে তরঙ্গিত ভাবনার বিচিত্র তরঙ্গকে অনিঃশেষ কোনো ছবি ও সংগীতের মতো কেবল তুলে ধরছেন অবিরাম!

Stream of Consciousness Writing – William Faulkner Writing Examples; Source – The Unconventional Compass YTC

শেষ অধ্যায় পেনিলোপে বিরামচিহ্ন ছাড়া মলি ব্লুমের টানা মনোলগ প্রায় ৫০ পৃষ্ঠা জুড়ে চলতে থাকে! যেমন :

YES because he never did a thing like that before as ask to get his breakfast in bed with a couple of eggs since the City Arms hotel when he used to be pretending to be laid up with a sick voice doing his highness to make himself interesting to that old faggot Mrs Riordan that he thought he had a great leg of and she never left us a farthing all for masses for herself and her soul greatest miser ever was actually afraid to lay out 4d for her methylated spirit telling me all her ailments she had too much old chat in her about politics and earthquakes and the end of the world let us have a bit of fun…

লিওপোল্ড ব্লুমকে কেন্দ্র করে মলির চেতনাপ্রবাহে সঞ্চালিত গুঞ্জনকে ধরতে অগ্রসর বাক্যের এই চাল, পৃথিবীর যে-কোনো ভাষায় অনুবাদ করা ভীষণ দুরূহ ও জটিল। কারণ, জয়েস এখানে ব্যক্তি-চেতনাসত্তার অতল থেকে উঠে আসা প্রবাহকে ধারণ করছেন। বাস্তবের মতো যেটি সুগঠিত নয়। ক্লান্তিহীনভাবে প্রবাহিত অনিঃশেষের রেশ ধরে রাখতে পেনিলোপ এপিসোড জুড়ে যতিচিহ্নহীন টানা শব্দব্যঞ্জনা তিনি চালিয়ে যেতে থাকেন।
. . .

Finnegans Wake by James Joyece; Image Source – sothebys.com

ফিনেগানস ওয়েক (Finnegans Wake) : জেমস জয়েস

নিছক বই নয়, বরং ভাষার অলীক জলপ্রপাত! ইংরেজি ভাষাকে ভেঙেচুরে, দুমড়ে-মুচড়ে ঘুমঘোরগ্রস্ত স্বপ্ন ও অবচেতনে পুনর্গঠন করেছেন জয়েস। শব্দগুলো এখানে portmanteau বা বাক্সবোঝাই আজব খেলনা! জোড়া লাগানো নৌকোর মতো তাদের দুলুনি পাঠককে বিমূঢ় করে! আখ্যানে একাধিক ভাষার শব্দ পাশাপাশি জায়গা নিয়েছে অবলীলায়। শব্দবিন্যাস ও বাক্যগঠনে অভিনবত্বের কারণে ফিনেগানস ওয়েক অবোধ্য ও অদ্ভুত সাংগীতিক লয় তৈরি করে। বলে রাখা প্রয়োজন,—জেমস জয়েস ১৭টি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন, এবং ইউলিসিস-এর মতো এখানেও একাধিক ভাষাজ্ঞানকে ব্যাপক পরিসরে ব্যবহার করেছেন তিনি।

উপন্যাস থেকে এই বাক্যটি আমরা নিতে পারি, জয়েস সেখানে লিখছেন : riverrun, past Eve and Adam’s, from swerve of shore to bend of bay, brings us by a commodius vicus of recirculation back to Howth Castle and Environs. এটি হলো কমিকস্ট্র্রিপধর্মী আখ্যানটির প্রথম লাইন। river ও run শব্দ দুটিকে একত্রে জুড়ছেন জয়েস। এর ফলে নতুন শব্দ জন্ম নেওয়ার পাশাপাশি ব্যক্তিসত্তার চেতনসীমা থেকে উঠে আসা অনিঃশেষ প্রবাহের আভাস পাচ্ছে পাঠক।

পাস্ট ইভ অ্যান্ড অ্যাডাম-এ (past Eve and Adam) দুটি রেফারেন্স একত্রে জুড়ে দিচ্ছেন লেখক। Eve and Adam হচ্ছে ডাবলিনে অবস্থিত একটি র্গিজার নাম। গির্জার আগে পাস্ট (past) শব্দ জুড়ে দিয়ে আদম-হাওয়ার স্বর্গ থেকে ধরায় নেমে আসার বাইবেল বর্ণিত কাহিনি পাঠককে স্মরণ করতে প্ররোচিত করছেন। আখ্যান জুড়ে স্থানিকতা ও ধর্মপুরাণ পরস্পরকে সঙ্গ দিয়ে আগাতে থাকে।

কমোডিয়াস ভিকাস অব রিসার্কুলেশন (commodius vicus of recirculation) বলতে ইতালিতে জন্ম নেওয়া দার্শনিক গিয়ামবাতিস্তা ভিকোর (Giambattista Vico) ইতিহাসচক্র তত্ত্বকে (history repeats in cycles) রেফারেন্স হিসেবে স্মরণ করছেন জয়েস। কমোডিয়াসকে (commodious) আমরা আরামদায়ক কিছু ভাবতে পারি, আর ভিকাস (vicus) হচ্ছে রাস্তা ও গ্রাম। অন্যদিকে গিয়ামবাতিস্তা ভিকো (Giambattista Vico) এখানে ব্যক্তিনাম, যাঁর সঙ্গে ইতিহাসচক্রের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাটি বিজড়িত। ফিনেগানস ওয়েক শেষ হয় A way a lone a last a loved a long the-তে এসে; এটি সরাসরি আগের লাইনের রিভাররানের (riverrun) সঙ্গে একীভূত হয়।

Giambattista Vico and the Future of Humanity; Source – Philosopheasy YTC

লক্ষ করলে দেখা যাবে লাইনটি এখানে শেষ লাইনের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়েছে। জয়েস তাঁর আখ্যানকে সার্কুলার বা বৃত্তাকার চক্রে এগিয়ে নিয়েছেন। বৃত্তাকার হওয়ার কারণে যার কোনো সূচনা ও সমাপ্তি থাকে না। কাহিনি ও ব্যবহৃত সূত্ররা অনিঃশেষ লয় বজায় রাখে। চেতনায় বহমান স্বপ্ননদীতে আখ্যানের ভাষা কেবল জেগে থাকে! ফিনেগানস ওয়েক-এ ভাষা যে-কারণে নিছক ভাষা নয়, তাকে ভাষার ঘুমন্ত সংস্করণ ভাবাটাই যুক্তিসংগত ঠেকে পাঠকের।

বহু ভাষা সংলগ্ন ধ্বনি, পৌরাণিক ইতিহাস, আধো ঘুম ও আধো জাগরণের ফিসফাস মিলে তৈরি যৌগিক ভাষাজগতে পাঠককে বন্দি রাখেন জয়েস। একটি বাক্যে অবলীলায় ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, ধর্মতাত্ত্বিক, ভাষা ও চেতনাগত বৃত্তগুলোকে তিনি ধারণ করেছেন। পাঠকের পাঠাভ্যাস তাই হোঁচট খায়। আখ্যানের খেই ধরতে গিয়ে খেইহারা দেখায় তাকে! ভাষা দিয়ে বোনা বাক্য তার পাঠবোধে ধরা দিয়েও ধরা দিতে অনিচ্ছুক থাকে। বাক্যরা দেখা দিয়ে চোখের পলকে মিলিয়ে যায় বারবার!

ওপরে উদ্ধৃত বাক্য ইংরেজিতে লেখা হলেও গ্রিক, আইরিশ, জার্মান ও জেমস জয়েসের নিজস্ব উদ্ভাবিত অচেনা শব্দের সংমিশ্রণ চোখে পড়বে। ইউলিসিস-এ এরকম শব্দসংখ্যা তিনশোর ওপরে ছিল, আর ফিনেগানস ওয়েক-এ সংখ্যা আরো বেড়েছে। ওপরে নেওয়া বাক্যটি উচ্চারণযোগ্য সঙ্গীত হলেও তাকে এখানে অর্থযোগ্য সাহিত্য ভাবা কিন্তু কঠিন। ব্যক্তিসত্তায় সক্রিয় চেতনাপ্রবাহের গভীর থেকে উঠে আসা ধ্বনিময় আখ্যানের রেশ এখানে প্রবাহিত রাখছেন জয়েস! ফিনেগানস ওয়েক-এর বয়ানে ইংরেজিকে লিখনভাষা বিবেচনা করে বসে থাকেননি তিনি। ভাষাটিকে বরং ধ্বনি-সংগীতে পরিণত করতে মরিয়া ছিলেন। বিখ্যাত প্যাসেজটি স্মরণ করি, জয়েস সেখানে লিখেছেন :

Three quarks for Muster Mark!
Sure he hasn’t got much of a bark
And sure any he has it’s all beside the mark.

James Jpyece; Image Source – Google Image

কোয়ার্কস (quarks) শব্দটি এখান থেকেই বিজ্ঞানীরা ধার করেছিলেন (দ্রষ্টব্য : Murray Gell-Mann, 1964)। শব্দটি জয়েস নিয়েছেন ‘quack’, ‘cork’, ‘quart’ ও কার্টুনধর্মী আওয়াজ থেকে। মাস্টার মার্ক (Muster Mark) শব্দধাঁধার ইঙ্গিত দিয়ে যায়। মি. মার্ক অথবা মাস্টারকে (Mr. Mark / Muster) জমায়েত বা উসকানির সমার্থক ধরা যেতে পারে। মার্ক (Mark) হচ্ছে কোনোকিছু লক্ষ করে ওঠা। সেইন্ট মার্ক’স (St. Mark’s) হয়তো ব্যক্তিনাম। ছোট্ট ছত্রে শিশুসুলভ ছড়া (nursery rhyme), কেল্টিক জনপদে প্রাচীন যুগে গীত পরিবেশনার ধাত, সেইসঙ্গে ভগ্ন ও ভ্রান্তিবিলাসে আবিল ঐতিহাসিক ঘটনাকে বিদ্রুপশেল হানতে শব্দগুলো একত্রে জুড়েছেন লেখক।

ভাষার সাহায্যে জয়েস কেবল কথা বলেন না, তিনি বরং ভাষার ধ্বনিগত তাৎপর্যকে গুঞ্জরিত করেন রচনায়। প্রচণ্ড সাংগীতিক লহরি তৈরি হয় তখন। তাঁর গদ্যভাষাকে মুখ দিয়ে উচ্চারিত গুঞ্জন ভাবা যেতে পারে। সাংগীতিক লয় তৈরিতে গুঞ্জনটি তাঁকে সহায়তা করছে। পাঠক যদিও এর অর্থ ও পারম্পর্য কিছু ধরতে পারে না, কিন্তু সুরের আবেশ তার মনেও জাগে। ফিনেগানস ওয়েক-এ সুরটি তাকে আবেশে বেঁধে রাখে। গদ্যভাষায় গুঞ্জরিত সুর তাকে দোলা দিতে থাকে অবিরত! অবচেতন সত্তায় তরঙ্গিত অনুভূতিকে ভাষায় আকৃতি দান দুরূহ। ভাষা সেখানে মানুষকে স্বপ্নগ্রস্ত বিবরণের অতিরিক্ত কিছু দিতে সক্ষম নয় বলে বিশ্বাস করতেন জয়েস। দুটি পৃথক শব্দকে একত্রে জুড়ে তিনি কীভাবে নতুন-নতুন শব্দ সৃষ্টি করতেন তার কিছু নমুনা বেছে নেওয়া যেতে পারে। যেমন :

ফান (fun) ও ফিউনেরালকে (funeral) একত্র করে ফানফেরাল (funferal)। এগ (egg) ও এক্সপ্রেসকে (express) একসঙ্গে জুড়ে এগসপ্রেস (eggspress)। শব্দটি এখানে এক্সপ্রেস ট্রেন বা দ্রুতগতিতে ছুটে চলা রেলগাড়ির উপমায় একীভূত করেছেন জয়েস। এগ বা ডিম্ব হচ্ছে ভ্রূণমধ্যে বিকশিত প্রাণের আধার, যেটি কেবল ছুটে চলেছে অবিরত।

কোলাইড (collide) বা সংঘর্ষের সঙ্গে ক্যালিডোস্কোপ (kaleidoscope) ও এস্কেপ (escape) বা পলায়নকে একত্রে মিশিয়ে তৈরি করেছেন নতুন শব্দ কোলাইডোরস্কেপ (collideorscape)।

উইশ (wish) বা ইচ্ছা-কামনা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সুইশ (swish) অর্থাৎ দোলানো বা ঝাঁকুনি দেওয়া এবং হুইসপার (whisper) বা ফিসফিস মিলে জন্ম নিচ্ছে নতুন শব্দ হুইশ (whish)।

প্রতিটি শব্দকে একাধিক অর্থের সম্ভাবনায় আখ্যানে দীপ্ত করে তুলেছেন জয়েস। ঠিক যেমন স্বপ্নে একজনের হয়ে অনেকজন কথা বলতে পারে, অনেকটা সেভাবে একটি শব্দের সঙ্গে একাধিক শব্দ জুড়ে বহুস্বর ও ধ্বনিময় আবেদন তৈরি করেন তিনি। একই মানুষ স্বপ্নে নিজেকে ভিন্ন-ভিন্ন মানুষ রূপে হয়তো দেখে। ফিনেগানস ওয়েক-এ জয়েস তা ধরে রাখতে আকুল।

Lex Fridman on how James Joyce’s Finnegans Wake was written; Source – Lex Clips YTC

আরেকটি বাক্যের খণ্ডাংশ নেওয়া যাক : rot a peck of pa’s malt had Jhem or Shen brewed by arclight. রট অ্যা পেক (rot a peck) পুরনো ইংরেজি প্রবাদ to brew a peck of trouble থেকে ধার করছেন লেখক। পা’স মাল্ট (pa’s malt) আখ্যানের ক্ষণায়ু চরিত্র ফিনেগানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। চরিত্রটির নামে আখ্যানের নামকরণ করলেও কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে তার পরিসর সেখানে সীমিতই থাকে। ফিনেগান ছিল ভবন নির্মাতা (builder)। নির্মাণকাজের সময় মই থেকে পড়ে গিয়ে মারা যায়। জয়েস তাকে আখ্যানে এক পর্যায়ে পুনরায় জীবিত বা পুনরুত্থিত করার সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলেন।

বাইবেলে-এ যিশু মৃত ল্যাজারাসকে পুনরায় জীবিত করে তুলেছিলেন। সূত্রটি এখানে ব্যবহার করছেন জয়েস। ফিনেগানস ওয়েক-এর চরিত্ররা, যেমন হামফ্রে চিম্পডেন ইয়ারউইকার ও তার পরিবারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়ার মাঝে মই থেকে পড়ে যাওয়া ফিনেগান আখ্যানে রহস্য ও জটিলতা বাড়িয়ে তোলে। Jhem or Shen আখ্যানে ব্যবহৃত চরিত্র হলেও হিব্রু মিথে বর্ণিত শ্যাম ও হ্যামের (Shem ও Ham) সঙ্গে পাঠক তাদেরকে অভিন্ন ভাবার দোটানায় পড়ে। পৌরাণিক অনুষঙ্গ, আত্মজীবনীর বিক্ষিপ্ত অংশ, লোকছড়া ও শিশুতোষ বুলি থেকে শুরু করে ধ্বনিমূল আর কবিতার বিচিত্র সারসূত্র জয়েস এরকম শব্দখেলায় লুকিয়ে রাখেন। ফিনেগানস ওয়েক কেন পাঠকের পক্ষে সংযোগ করা দুরূহ এই বিষয়ে ধারণা পেতে নিচের বিখ্যাত বাক্য বা শব্দগুচ্ছ চয়ন মনে হচ্ছে যৌক্তিক হবে। জয়েস লিখছেন : The fall (bababadalgharaghtakamminarronnkonnbronntonnerronntuonnthunntrovarrhounawnskawntoohoohoordenenthurnuk!) শব্দটি ব্রজধ্বনি বা থান্ডারক্ল্যাপের প্রতীক বলে রায় দিয়েছেন পড়ুয়া পাঠক। পৃথিবীর দশটি ভাষায় ব্রজধ্বনির শব্দকে একত্রে মিশিয়ে ধ্বনিময়তা তৈরি করেছেন জয়েস। আর fall বলতে অ্যাডামের পতন, হাম্পটি ডাম্পটির পতন, ডাবলিন শহর ধসে যাওয়ার কাল্পনিক ছবির পুরোটা সংকেতময় করে তুলতে চেয়েছেন তিনি।

এই প্যাসেজটা পাঠ করি এবার : A hand from the cloud emerges, holding a chart expanded, and in the midst, in the midth of the chart, the chart of the straits and the seven tears of Wicklow. বাইবেল থেকে আহরিত ডুমসডে বা রোজ কিয়ামতের বিবরণকে কাব্যিক দ্যোতনা দিচ্ছেন জয়েস। যেখানে সেভেন টিয়ারস (seven tears) কানে সেভেন টায়ার্স-এর ধ্বনিদ্যোতনা বয়ে আনে। স্ট্রেইটস (straits) হলো উপকূল, সংকট ইত্যাদি। মিডস্ট বা মিডথ (midst / midth) একই শব্দকে আলাদা উচ্চারণ ও স্তরে রেখে দেওয়ার অনুভূতি পাঠকমনে সঞ্চারিত করে।

শব্দ দিয়ে ঐন্দ্রজালিক প্রেক্ষাপট তৈরি করতেন জয়েস। একটি ধাঁধা, যেটি তুমি ভাঙতে পারবে না এমন নয়, তবে ভাঙার পরপরই নতুন ধাঁধায় তোমাকে ঢুকিয়ে দেবেন তিনি। সত্যের খোলসে মোড়া অসম্ভব অর্থ যে-কারণে শেষ হয় না। ভাষার এমনধারা খেলা কেবল অনুভবে ধরা সম্ভব। যুক্তি দিয়ে তাকে বোধগম্য করা কঠিন। কবি, ভাষাবিজ্ঞানী, পরিহাসপটু কথকঠাকুর… একাধিক ভূমিকায় সমান স্বচ্ছন্দ কোনো ভাষাবিদ রসায়নশাস্ত্রী (linguistic alchemist) হচ্ছেন জয়েস। তাঁর কাছে ইংরেজি ভাষা মাটি অথবা বালি নয়। ভাষা যেন সেখানে তরল পদার্থ! এই তরলকে এখন তিনি যে-কোনো আকার দিতে সক্ষম।

Thunderclap and fall; James Joyce Mastery; Source – @thirdlanespace.com

ইউলিসিস-এর মতো ফিনেগানস ওয়েকও একটি শব্দ বা বাক্যে অগণিত রেফারেন্স রেখে যায়। একই বাক্যে পাওয়া যায় রাজনৈতিক ব্যঙ্গ, প্রাচীন কেল্টিক মিথ, আর মনোবিজ্ঞানের ইঙ্গিত। জয়েসের সবচেয়ে দুর্বোধ্য রচনা হিসেব স্বীকৃত আখ্যানটি যেন নিদ্রায় অভিভূত অবস্থায় মস্তিষ্কে সমানে চলতে থাকা স্বপ্নগ্রস্ত ভ্রমণ! মস্তিষ্কতরঙ্গকে যেখানে বাক্যে ধরছেন লেখক। প্রচলিত পাঠাভ্যাস ও যুক্তি দিয়ে যার সারসত্য উপলব্ধি করা দুরূহ।

আগের বাক্যটির সঙ্গে সংযুক্ত অংশটি পুনরায় বেছে নেওয়া যাক : The fall (bababadal…) of a once wallstrait oldparr is retaled early in bed and later on life down through all christian minstrelsy… বাইবেলের টাওয়ার অব বেবেল (Tower of Babel), কলুষতা, পতন, প্রাচীনতা বোঝাতে একটি শব্দে ‘babel’, ‘bad’, ‘fall’, ‘parr’ ইত্যদি ঐতিহাসিক সূত্রগুলো যুগপৎ প্রয়োগ করছেন জয়েস। নদীর মতো ভাষা তৈরি করেন তিনি। জল যেমন ঘুরে ঘুরে চলে, তেমনি তাঁর বাক্য চলে বাঁক থেকে বাঁকে, পুনরাবৃত্তি ও প্রতিধ্বনির মধ্য দিয়ে আখ্যানের জাল ছড়ায়।

উদাহরণস্বরূপ : O tell me all about Anna Livia! I want to hear all about Anna Livia. এভাবে পাঠককে টেনে আনেন, নদীর ধারে বসিয়ে রাখেন, যেখানে দুজন নারী কথা বলছে, গল্প করছে, আর নদী হয়ে উঠছে স্মৃতি ও স্রোতের প্রতীক : She was, of course, as you will remember, in the family way. একই লাইনে ‘family way’ বলতে বোঝানো হচ্ছে গর্ভাবস্থা, আবার একটানা বংশের স্রোত ও সময়-প্রবাহে সমাধিস্থ হওয়া। সবকিছু একসঙ্গে পুরে দিচ্ছেন। জল কেবল জল থাকছে না, জলের ভেতর কথার প্রতিচ্ছবি দেখছে পাঠক। সাধারণ পাঠকের পক্ষে যার খেই পাওয়া কঠিন।

রীতিমতো পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞ না হলে ফিনেগানস ওয়েক-এ ভাষার চাল ধরা সম্ভব নয়। স্থানকাল জয়েসের এই আখ্যানে ভেঙে যাচ্ছে। কোনো খেই বা পারম্পর্য রাখছেন না লেখক। বাইবেলের বিবিধ সূত্র থেকে শুরু করে আধুনিক কল্পচিন্তার সবটুকু যেখানে একাকার ও অবিচ্ছেদ্য, যার ফলে কাহিনি ও অর্থ বোঝা পাহাড় ঠেলার কাজ হয়ে দাঁড়ায়। জয়েস বলেছেন বটে : তোমরা ভাবো ভাষা মানে সরলতা। আমি বলি, ভাষা মানে যুদ্ধ। প্রতিটি শব্দ তোমাকে তোমার চেতনার ঘরে নিয়ে যাবে, যদি তুমি সাহস করো। তিনি ‘author’ থেকে সরে গিয়ে ‘language conjurer’ বা ভাষার জাদুকর হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন। পাঠক তাঁর কাছে পাঠক নয়, সহযোগী খনি-মজুর, যাকে প্রতিটি বাক্য ভেঙে খুঁজে নিতে হয় ধাতু, আগুন, রত্ন।

. . .

Infinite Jest by David Foster Wallace; Image Source : @thirdlanespace.com

ইনফিনিট জেস্ট (Infinite Jest) : ডেভিড ফস্টার ওয়ালেস

ইনফিনিট জেস্ট-এ ডেভিড ফস্টার ওয়ালেস সময়কে নৈরাশ্য ও প্রযুক্তিক বিমূর্ততার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ডিলে (delay), লুপ (loop), স্টাকনেস (stuckness) যেখানে বারবার ফিরে আসে। সময় হয়ে দাঁড়ায় গুজব নির্মাণের যন্ত্র। ওয়ালেসের আখ্যানে যেটি টেলিভিশন, মাদকাসক্তি ও গণমাধ্যমে জন্ম নিতে থাকা বৃত্তাকার অবয়বে (Media Circularity) অবিরাম ভাসতে থাকে। যেমন, বিনোদন (The Entertainment) নামে নামাঙ্কিত সিনেমা এতটাই আকর্ষণীয়, মানুষের পক্ষে তার চাপ হজম করা কঠিন হয়। সিনেমাটি দেখার ধকল সইতে না পেরে তারা মারা যাচ্ছে বলে বিভ্রম জাগান লেখক। সময় বরফশীতল স্তব্ধতায় গুম হয় সেখানে। ডেভিড ফস্টার ওয়ালেসের ভাষা জয়েসেরে মতো বহুকৌণিক, কিন্তু এর মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে পরিহাস ও আত্মসচেতনা; আর ভাঙনের সম্মুখীন সময়সংকেতের অজস্র উপাদান।

বইটির পাদটীকা মূল বইয়ের থেকে দীর্ঘ! পাদটীকাগুলো এমনভাবে লেখা হয়েছে,—মূলপাঠ থেকে পাঠককে তারা বিচ্যুত করে। পাদটীকায় আলাদা উপন্যাস খুঁজে পায় পাঠক। টাইমলাইন সোজাপথ ধরে আগায়নি। ঘটনা অবিরত সামনে-পেছনে যাওয়া-আসা করায় সময়রেখার খেই পাওয়াকে লেখক দুরূহ করে তোলেন। তাঁর এই আখ্যানটি কেন জটিল ও পাঠবন্ধুর, তার কারণগুলো সংক্ষেপে ভাবা যেতে পারে :

বইয়ের প্রায় দুশো পৃষ্ঠা জুড়ে ৩৮৮টি পাদটীকা ব্যবহার করেছেন লেখক। কোনো-কোনোটি মূল আখ্যানের চেয়ে বৃহৎ! অনেকের মতে, পাদটীকা স্বয়ং উপন্যাস হয়ে উঠেছে।

সময় এখানে পিংপং বলের মতো সক্রিয়। কোনো ঘটনাই কালানুক্রম মেনে বা প্লট ধরে অগ্রসর হয়নি। কাহিনি থাকলেও তারা সুগঠিত নয়। ওয়ালেসের বয়ানবিশ্বে কাহিনি খণ্ডবিখণ্ড, এবং সেখানে সুষমতা অনুপস্থিত। পাঠককে পারম্পর্যহীন কাহিনি থেকে কাহিনিরস খুঁজে নিতে প্ররোচিত করছেন লেখক।

দর্শন, গণিত, মাদক, খেলাধুলার সবটাই বিনোদনের প্রতীক হয়ে আসে। উপকাহিনি, ফুটনোট, সাইডট্র্যাক, ডিস্টোপিয়া, হিউমার, প্রযুক্তি, অ্যাডিকশন, টেনিস অ্যাকাডেমি, দার্শনিক প্রশ্নে আখ্যানকে বোঝাই রাখেন ওয়ালেস। বৃহৎ পরিসর জুড়ে তারা রাজত্ব কায়েম করে। সময়রেখার একরৈখিক বা লিনিয়ার থাকাটাকে কার্যত অসম্ভব করে তুলেছেন ওয়ালেস। এর ফলে পাঠক তাঁর আখ্যান পাঠ করতে যেয়ে তাল রাখতে পারে না। সব গুলিয়ে যায় তার! ইনফিনিট জেস্ট-এ সময় ননলিনিয়ার। তুমি হঠাৎ দেখবে, টেনিস কোর্টে খেলার বর্ণনার সঙ্গে সার্ত্রের অস্তিত্ববাদকে লেখক একীভূত করে বাক্য বানাচ্ছেন। চেতনাপ্রবাহের বিপরীত নির্মাণ এই আখ্যানকে বিশিষ্ট করেছে! চিন্তাপ্রধান বা চিন্তাপ্রবাহ ব্যবহার করে আখ্যানটি সাজিয়েছেন ওয়ালেস।

David Foster Wallace; Image Source – A24 Films

ইয়ার অব দ্য ডিপেন্ড অ্যাডাল্ট আন্ডারগার্মেন্ট (Year of the Depend Adult Undergarment) অধ্যায়টি কেন্দ্রীয় গিঁটগুলোর একটি। এটি অনেকটা ভবিষ্যতের ক্যালেন্ডারে যেসব ঘটনা ঘটবে বলে ধরে নেওয়া যাচ্ছে, তার বছরভিত্তিক তালিকার বিবরণটি প্রকাশ করে। বছরগুলোকে স্পন্সর কোম্পানির নামে নামকরণ করা হয়। যেমন, ডায়াপার তৈরির একটি কোম্পানির নামে ভবিষ্যতে আগত বছরের নামকরণ করা হয় আগেভাগে। কোম্পানিটি সেখানে আসন্ন বছরটির নিয়ন্ত্রক হতে যাচ্ছে, তাই এহেন নামকরণ! নিছক মজাক মনে হলেও এর অন্তরালে শায়িত রয়েছে ভয়াবহ সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় মানব-সমাজের নিঃস্ব হওয়ার সংকেত।

অধ্যায়ে আমরা অতিমেধাবী কিশোর বা টিনএজার হালের (Hal) দেখা পাই। ইনকানডেনজা পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যটি মাদকাসক্ত ও ভাষার ভেতর গুমরে থাকা নিঃসঙ্গ আত্মা রূপে আখ্যানে বিচরণ করে। অধ্যায়জুড়ে সে নিজেকে বুঝে উঠতে চায় কিন্তু তাকে বিফল হতে দেখে পাঠক। কারণ, হাল ইতোমধ্যে যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে সেগুলোকে বর্ণনা করার মতো ভাষা তার ঝুলিতে মজুদ থাকে না। অভিজ্ঞতার চাপ এখানে ভাষাকে বিপর্যস্ত রাখে। হাল যেমন বলে : I am not just a boy you can make into a punchline. উদ্ধৃত বাক্যটি শুনতে সাদামাটা, কিন্তু তার মধ্যে ধসে যাওয়া আত্মার হাহাকার কানে বাজে! হাল প্রকাশ করতে উন্মুখ, কিন্তু ভাষার আগল ভেঙে চেতনসত্তাকে ব্যক্ত করতে ব্যর্থ হয় সে। ওয়ালেস এখানে জয়েসের মতো ভাষা নিয়ে খেলা করেননি, তিনি বরং ভাষার অসহায়ত্বকে তুলে ধরছেন।

ডেভিড ফস্টার ওয়ালেসে ভাষা স্নায়বিক, আত্মসচেতন ও প্রায় ক্লান্তিকরভাবে বিশদ। জয়েস বহুরূপী, ধ্বনিময় ও শাব্দিক আনন্দ তৈরিতে নিমগ্ন থাকেন। ওয়ালেস বিক্ষিপ্ত ও সময়রেখায় স্থবির। জয়েস চেতনপ্রবাহে বিস্তারিত ও প্রবহমান। ওয়ালেস সেখানে থেরাপিস্ট। জয়েস যেমন লিখছেন : Yes because he never did a thing like that before as ask to get his breakfast in bed with a couple of eggs since the City Arms hotel when he used to be pretending he was laid up with a sick voice… (Penelope Episode – Ulysses) ওয়ালেস-এ পাচ্ছি : Hal knew that he could, if he wished, recite the names of all the chemical elements and their molecular weights… But he also knew that this knowing was useless.

জয়েসের বিবরণ চেতনাপ্রবাহ থেকে উঠে আসা সংগীতের অনুরণন, আর ওয়ালেস অনেকটা মস্তিষ্কের এমআরআই করার মতো রূঢ় ভাষায় মনস্তাত্ত্বিক প্রতিবেদন পেশ করতে থাকেন। উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়ে আমরা দেখি, হাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অ্যাডমিশন অফিসে সাক্ষাৎকার দিতে গেছে। অথচ যেসব বাক্য আমরা পৃষ্ঠায় পড়ি, সেগুলো তার ভিতরে ছটফট করতে থাকা ভাষার অবয়বকে প্রকাশ করতে অপরাগ হয়। তার এই ভাষাপ্রকাশের সমস্যাটি পরিচিতজনরা ধরতে পারে না। বিদীর্ণ মানবাত্মার হাহাকার অনুভব করতে না পেরে উলটো সেগুলোকে অশ্রাব্য, বিকৃত ধ্বনির নমুনা হিসেবে তারা ধরে নেয়। ওয়ালেস এখানে বিপরীতমুখী চেতনাপ্রবাহের জন্ম দিতে থাকেন। হালের আত্মসচেতন পরিষ্কার চিন্তাভাবনার নমুনা পাঠক পায়, যদিও বাইরের দুনিয়ায় সেটি উন্মাদ, বিকল ভাষার নজির রূপে ক্রমাগত সাব্যস্ত হতে থাকে।

Why Harold Bloom Hated Infinite Jest; Source – Write Conscious YTC

I am not what you see and hear.—বাক্যটির পেছনে বীভৎস সত্য লুকিয়ে আছে; আর সেটি হচ্ছে,—চেতনার গহিনে জন্ম নিতে থাকা বোধকে কখনো ভাষায় রূপান্তরিত ও প্রকাশ করা যায় না। ভাষা ভুল করে বাস্তবতাকে সেখানে প্রতিস্থাপন করতে যায়। মন এমন এক প্রান্তরে এসে ঠেকেছে, সেখানে কথা আর মুখের সঙ্গী নয়। মুখ দিয়ে যেসব কথার ফুলকি ছুটছে, তার সঙ্গে চেতনার গভীরতলে গুম কথার সংযোগ ভেঙে পড়েছে। যার ফলে প্রকাশিত কথাগুলোকে বাস্তবে ঘটতে থাকা বিরামহীন বিনোদনের যমজ দেখে পাঠক। মানুষ ভুলতে চাইছে এই সত্য যে,—যা সে ভাবে ও বলতে উতলা বোধ করে, একে প্রকাশ করার ভাষা তার করায়ত্ত নয়। 

ওয়ালেস একটি মেটা অ্যাওয়ারনেস (meta-awareness) আখ্যানে জন্ম দিয়েছেন। আখ্যানের অন্যতম চরিত্র হাল (Hal) জানে সে কী বলতে চায়, এবং এও তার জানা,—কী কথা বলা সম্ভব হচ্ছে না। আখ্যানে তার বাক্যগুলো যে-কারণে প্রায়শ recursive বা পুনরাবৃত্তিমূলক হতে থাকে। কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের লুপহোলের মতো সে ভাবে, এবং ভেবেই চলে, অথচ ভাবনাকে সুবিন্যস্ত ভাষায় পেশ করতে তাকে বিকল দেখায়!

আখ্যানে এই স্বীকারোক্তি পাঠক পায় : আমি জানি কীভাবে ভাবতে হবে তা নিয়ে আমি ভাবছি, আর এখনো এই ভাবনাকে থামাতে পারিনি। [ইনফিনিট জেস্ট : ডেভিড ফস্টার ওয়ালেস] I know that I am thinking this thought about thinking that I am thinking, and yet I cannot stop thinking it. এই ধরনের লুপ ওয়ালেস ব্যবহার করেন এটি দেখানোর জন্য,—আধুনিক চেতনা আত্ম-পর্যবেক্ষণে ক্লান্ত ও জটিল;—নিজেকে ধসের কিনারায় সে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।

ইনফিনিট জেস্ট চলচ্চিত্রায়িত হলেও আখ্যানটিকে চলচ্চিত্রায়ণের অনুপযুক্ত বা আনফিল্মেবল হিসেবে সকলে বিবেচনা করে থাকেন। আখ্যানের চাবি বলে বিবেচিত ইয়ার অব দ্য ডিপেন্ড অ্যাডাল্ট আনডারগার্মেন্ট অধ্যায়টিকে সিনেপর্দায় ভাষা দিতে গিয়ে নির্মাতা স্বয়ং সচেতন ছিলেন ব্যাপারটায়। ওয়ালেস নিজে অভিনয়ও করেছেন সেখানে। আখ্যানকে সিনেপর্দায় তুলে আনার কৈফিয়ত দিতে যেয়ে নির্মাতা নিজমুখে বলেছেন :

ইনফিনিট জেস্টকে সকলে সিনেমা তৈরির অযোগ্য ভাবেন, আমিও সেকথাই বলছি পুনরায়;—কোনোকিছু ছবিতে চিত্রায়িত করিনি। সিনেমা বানানোর পদ্ধতিতে কেবল রকমারি বিনোদনকে ব্যবহার করা হয়েছে, এবং সেগুলো বইটির মতোই উদ্ভূত ও কাঠামোগত, যার মধ্যে রয়েছে আখ্যানের জটিলতা আর শক্তিশালী বিষয়ানুগ ঐক্য। [নির্মাতার কৈফিয়ত]

Infinite Jest (2022) movie trailer; Source – IJMovie YTC

সিনেমায় আখ্যানের সারবস্তু তুলে ধরতে নির্মাতাকে স্বাধীনতা নিতে হয়েছিল। আখ্যানে বর্ণিত সময়রেখাকে অনুসরণ করলেও সিনেমার নিজস্ব দাবি পূরণার্থে ঘটনার পারম্পর্যে প্রয়োজনমতো হেরফের ঘটিয়েছেন। মোদ্দা কথা, আমরা একটি ভয়াবহ বিনোদনের দুনিয়ায় বসবাস করছি, যেখানে বেঁচে থাকার সবটাই অতিরিক্ত ও বিনোদনের ভারে ভারাক্রান্ত, যেন এক অনন্ত উপহাস; আর সিনেভাষায় সেটি ধারণ ও পাঠের চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। সত্যটি যদিও মানতেই হবে,—ওয়ালেসের আখ্যান সিনেমা নির্মাণের পক্ষে আসলেও অনুপযুক্ত।

ইনফিনিট জেস্ট হচ্ছে এমন একটি আখ্যান যেটি কেবল বিরামহীন ও ক্লান্তিকর উপায়ে পাঠ করে যেতে পারে। এখানে পাঠ মানে চিন্তাকে অবিরত সক্রিয় রাখা ও আরো ক্লান্ত হয়ে পড়া। বিনোদনের বিপরীতে নিজেকে শাস্তি প্রদানের জন্য যেন-বা আখ্যানটি লিখেছেন ওয়ালেস। Reading is a moral act-এ বিশ্বাসী এই লেখক। পাঠকে তিনি নৈতিক সক্রিয়তা ভাবেন। সুতরাং পাঠককে আয়েশ দেওয়াটা তাঁর পোষায় না। পাঠের পুরো সময় ধরে তাকে আত্মসমালোচনায় লিপ্ত থাকতে বাধ্য করতেই যেন-বা ইনফিনিট জেস্ট-এ আখ্যান-রচনার স্বীকৃত পন্থাগুলোকে অবলীলায় উপেক্ষা করেছিলেন ওয়ালেস!

. . .

James Joyece and David Foster Wallace; Image Source – @thirdlanespace.com

জেমস জয়েস ও ডেভিড ফস্টার ওয়ালেস উভয়েই ভাষার আকৃতি ভেঙে দিয়েছেন। মেধাবী আত্মসচেতন উপন্যাস রচনায় ঝুঁকে আছেন দুজন! অস্থির, টালমাটাল বাস্তবতার সম্মুখে দাঁড়াতে পাঠককে বাধ্য করা যেখানে তাঁদের মূল লক্ষ্য। পাঠ কোনো বিলাসিতা বা আরামদায়ক আবেগ নয়;—পাঠ হচ্ছে নিজেকে প্রহার করা। প্রহারের কথা যদি ভাবি তাহলে জেমস জয়েস হলেন ঘূর্ণিপাকে আটকে থাকা নদীর মাথা। বাঁক নেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত থাকেন অবিরত। স্রোতে ভাসিয়ে দেন শব্দপ্রতীক ও ইতিহাসের বিচিত্র মর্মর। ওয়ালেস ওই নদীতীরে দাঁড়িয়ে থাকা দার্শনিক। স্রোতকে তিনি নিয়ন্ত্রণের ভান করেন, কিন্তু নিজের ভেতরে প্রবাহিত স্রোতে স্বয়ং ভেসে যেতে তাঁর আপত্তি থাকে না।

জয়েসের ইউলিসিসি-এ কাহিনীর অবয়ব বিদ্যমান, যদিও তা মাইক্রোফিল্মে বন্দী সময়চেতনাকে ধারণ করতে নিজেকে নিঃশেষ করে। জমিয়ে গল্প লেখার আরাম জয়েসের পোষায় না বলে পাঠকের কাছে তিনি ব্যতিক্রম ও দুর্বোধ্য হয়ে ওঠেন। ফিনেগানস ওয়েক-এ যেমন কাহিনীর শাখাপ্রশাখা একপ্রকার গায়েব করে দিয়েছেন তিনি! আখ্যান জুড়ে কেবল নিদ্রা ও অবচেতন, পুনর্জন্ম লাভের অনুভূতি মিলেমিশে স্বপ্নগ্রস্ত যুক্তির (dream-logic) মিছিল চলতে থাকে! ফিনেগানস ওয়েক যেন-বা কোনো সাহিত্যিক শৈলী নয়, এক নিদ্রা-অভিভূত মহাবৈশ্বিক শব্দতরঙ্গকে সেখানে ধরছেন জয়েস। শব্দতরঙ্গ বোঝার ক্ষমতা তাঁর হয়তো রয়েছে, বাকিদের পক্ষে এর সারার্থ অনুভব বিড়ম্বনার নামান্তর।

অন্যদিকে ডেভিড ফস্টার ওয়ালেস ভাষাকে ভালোবাসেন, কিন্তু ভালোবাসেন ব্যর্থ প্রেমিকের মতো। এই প্রেমিক জানে ভাষা তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না, তবু সে ওই ভাষাকে আঁকড়ে ধরেছে! তাঁর বাক্যগঠন দীর্ঘ। Clause within clause এতটাই প্রবল, পাঠক সেখানে ব্র্যাকেটবন্দি বা এর ভিতরে তাকে হারিয়ে যেতে হয়! তাঁর ফুটনোট আর এন্ডনোটগুলো আলাদা আবহবিশ্ব তৈরি করে। শতাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাদটীকা লিখে চলেন ওয়ালেস, যেগুলো, আগেও বলেছি, স্বয়ং আখ্যানের ভিতর আখ্যান রচনার দায় পূরণ করে।

ওয়ালেস প্লট নিয়ে মোটেও আগ্রহী নন। চরিত্রের মানসিক অভিজ্ঞতা কেবল বিক্ষিপ্ত ভাষারেখা ধরে নিজেকে খুঁজে ফিরে। অর্থহীনতার অগাধ সায়রে অর্থ খোঁজার চেষ্টা তাঁর আখ্যানের কাঠামোকে জটিল ও বন্ধুর করেছে। ওয়ালেস সময়কে দেখেন অভ্যন্তরীণ যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে। আধুনিক মানুষের সময় হয় দীর্ঘ, এবং সেটি একঘেয়ে। তার ভিতরেই অসংখ্য সঙ্কটের জট গিট্টু মেরে থাকে। সময়প্রবাহকে সুতরাং রিক্ততার প্রতীক করে তোলেন ওয়ালেস। ইনফিনিটি জেস্ট-এর বয়ানে মিটিংগুলো যে-কারণে একঘেয়ে পুনরাবৃত্তিতে নিঃস্ব হয়। সময় সেখানে সামনে আগাতে অনিচ্ছুক। তারা ফিরে-ফিরে একই চেহারায় আভাসিত হতে থাকে। টেনিস অ্যাকাডেমির ছাত্ররা ভবিষ্যতের ভারে দমচাপা সময় পার করে। প্রতীক্ষা যেখানে পরাজয়ের নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়!

David Foster Wallace: The future of fiction in the information age; Source – Artzineonline YTC

তো সব মিলিয়ে আমার কাছে জয়েস হচ্ছেন স্বপ্নগ্রস্ত দার্শনিক গাথা। ওঁর লেখা পড়া মানে গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে ওঠার শামিল। মনে হবে সাহিত্য যেন মাত্র নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছে সেখানে। তবে কখনো কখনো মনে হয় : Joyce wants to speak to gods, not humans. পাঠকের গলায় ধাঁধার মালা ঝুলিয়ে রাখছেন তিনি। ধাঁধার উত্তর রেখে দিচ্ছেন নিজের জিম্মায়। তাঁর সাহিত্য আমাকে শেখায় ভাষাকে কীভাবে প্রচলিত ধারণার বাইরে নিয়ে যেতে হয়। ভাষা সেখানে বিপজ্জনক খাদ, একবার এই খাদে পড়ে গেলে কারো জন্যই উঠে আসা সহজ থাকে না।

ওয়ালেস আমাকে নিজের ভিতরে সক্রিয় আত্মঘাতী, আতঙ্কিত মনকে সহানুভূতির দৃষ্টি নিয়ে তাকাতে শেখান। জয়েস যেন দার্শনিক রোমাঞ্চে গাঁথা সংগীতলহরি। ওয়ালেস হৃদয়ের জন্য অদ্ভুত স্নেহময় বেদনাস্নান। তাঁকে আমি অসহ্য পর্যায়ের সৎ বলে ভাবি। তিনি জানেন তুমি ব্যথিত, তিনি নিজেও ব্যথিত,—তাই পাঠকের কাছে আত্মা খুলে বসেছেন। তবে হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে ওঁর বাক্যে এমনভাবে জড়িয়ে যাই, মনে হয় তাঁকে বলি : Please, just stop thinking for a second! ওয়ালেস হলেন এমন বন্ধু, যাঁকে তুমি ভালোবাসতে চাইবে, কিন্তু তাঁর সঙ্গে অধিক সময় থাকা সম্ভব নয়;—মাথাব্যথা শুরু হবে তোমার।

জয়েস বরং সেই রহস্যময় শিক্ষক, যিনি ক্লাসে কখনো হাসেন না, তথাপি তিনি জানেন, তুমি স্বপ্নগ্রস্ত চেতনাপ্রবাহে স্নান করতে ভালোবাসো, আর তাতে তাঁর সদয় সম্মতি থাকে সবসময়। জয়েস সুতরাং শিল্পের অবচেতন কল্পনা, আর ওয়ালেস সেখানে চেতনায় গভীর অস্তিত্ব-জিজ্ঞাসা। দুজনের রচনাই দুষ্পাঠ্য। দুজনেই ক্লান্তিকর, দুরূহ, এবং পাঠ-অযোগ্য জটিলতায় ভারাক্রান্ত। কালের স্রোতে তবু তাঁরা ভাষার বোধিবৃক্ষ। এর ছায়ায় দাঁড়িয়ে তুমি নিঃশ্বাস নিতে চাইবে, কারণ তোমার প্রকৃত সত্তাকে সেখানে তাঁরা উন্মোচিত করছেন দ্বিধাহীন।
. . .

James Joyce Reading Finnegans Wake; Source – monocle electronica YTC

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 23

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *