. . .
ফেসবুক পোস্টে ব্রাত্য রাইসু যে-বক্তব্য পেশ করেছেন, এখন উনার এই নসিহতের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণের কারণ দেখি না হাসান। অন্যদিকে যে-মতলবে কথাগুলো টেনেছেন তিনি, এখন সেটি আমলে নিলে বিষয়টি সোজাসরল থাকে না। বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই,- ফ্যাক্ট ছাড়া বয়ান হয় না আর বয়ান যদি না থাকে তাহলে ফ্যাক্টের তাৎপর্য বোঝা দুষ্কর হয়। ফ্যাক্ট হচ্ছে যা ঘটেছিল বা এখন ঘটছে। ঘটনাকে আমরা কোন চোখে দেখছি, কীভাবে ব্যাখ্যা ও বিচার-বিশ্লেষণ করছি… এসবের ওপর গড়ে উঠছে ন্যারেটিভ বা বয়ান। কাজেই বয়ান মানে হচ্ছে বিবেচনা, সহমত, প্রত্যাখ্যান ও সেখান থেকে পুনরায় নতুন সব বয়ান তৈরির খেলা। যেটি আমাদের মানস ও চেতনাকে অবিরত নতুনভাবে বিনির্মিত করে। বয়ানের মধ্য দিয়ে ফ্যাক্ট আসলে ফিরে-ফিরে ক্রিটিকের সম্মুখীন হতে থাকে, যারপরনাই তার অন্তর্নিহিত আবেদন যেমন বদলায়, মূল্যও একরকম থাকে না। এই জায়গা থেকে ভেবে দেখলে বয়ান বা ন্যারেটিভ স্বয়ং ফ্যাক্টকে ডমিনেট করছে, সেটি ধরে নেওয়া যেতে পারে। বিষয়টিকে পুনরায় অ্যাড্রেস করায় রাইসুকে ধন্যবাদ জানাইতে অসুবিধা নেই।
ফেসবুক পোস্টে তাঁর বক্তব্যের মিডল পয়েন্টে এবার নজর দেওয়া যাক। রাইসু লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের গণমানুষের অংশগ্রহণ কিংবা কর্তাসত্তাকে নাকচ করে দিয়ে ইতিহাসের দলীয় এবং উপনিবেশিক যেসব বয়ান আমাদের রাজনীতির গতিপথ এবং নাগরিক মানসকে নিয়ন্ত্রণ করে সেসব, এর কাউন্টার বয়ান হাজির করার জন্য নিজেরাই চিন্তা-গবেষণা করুন।’
‘গণমানুষ ও তার কর্তাসত্তা’র বয়ান রাইসুরা সচরাচর যেভাবে হাজির করে থাকেন সেটি নিয়ে আলাপের জায়গা এখানে অল্প। আলাপে গমন করলে বাত লম্বা হতে থাকবে। সংক্ষেপে এটুকু বলা প্রয়োজন,- রাইসুদের তৈরি বয়ান ১৮৫৭ থেকে কেন শুরু হইতেছে সেটি মাথায় ঢোকেনি। গণমানুষের কর্তা রূপে বাঙালি জাতিসত্তার আবির্ভাব তো লম্বা আলাপ ভাই। আপনাকে আরো পেছনে যেতে হবে। কর্তাসত্তা হিসেবে তার আত্মপ্রকাশের ইতিহাস আচমকা ১৮৫৭ থেকে শুরু হয়নি। এর পেছনে কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে। হাজার বছরের ইতিহাসে এক-একটি কালপর্ব জুড়ে সংঘটিত সব ঘটনা বা ফ্যাক্টের পরোক্ষ ভূমিকা সেখানে আপনাকে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। এছাড়া সিপাহী বিদ্রোহের কোনো সলিড ন্যারেটিভ দাঁড় করানো যাবে না।
১৮৫৭ থেকে ক্রমাগত পেছনে যেতে থাকলে গণমানুষের সম্পৃক্তি ছিল এরকম অনেকগুলো ইভেন্টের দেখা আমরা পাবো। কথার কথা, মুঘল আমলে বাংলাসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে একাধিক কৃষক বিদ্রোহ ঘটেছিল। ইরফান হাবিব ও গৌতম ভদ্র বিরচিত বইপত্র হাতে নিলে তার আভাস আমরা পাচ্ছি। মুঘল আমলে বিরাজমান প্রশাসনিক বিন্যাস ও সেখানে কেন্দ্রীয় শাসনের ভূমিকাকে চিরাচরিত বামপন্থী তরিকায় বোঝার চেষ্টা করলেও মুঘল শাসনামলকে মোটা দাগে ইতিবাচক বলেই রায় দিয়েছেন এই ইতিহাসবিদ। ধর্মীয় মামলাকে কেন্দ্র করে জাঠ ও সৎনামী দুটি বড়ো বিদ্রোহ তখন সংঘটিত হলেও মোটের ওপর মুঘলরা ধর্মীয় সহাবস্থানের সংস্কৃতিতে আগাগোড়া জারি থেকেছেন। জবরদস্তির মামলা কাজেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল। সমস্যা দানা বাঁধছিল মূলত কর আদায় ও রাজস্বপ্রথাকে কেন্দ্র করে। যার জের ধরে কৃষকরা রাজনীতির গুঁটি রূপে বারবার ব্যবহৃত হয়েছে।
কেবল ইরফান হাবিব বা গৌতম ভদ্র নয়, আরো অনেকে কৃষক বিদ্রোহের কার্যকারণ বোঝার চেষ্টা করেছেন। জায়গিরদার প্রথার বাড়বাড়ন্ত, অতিকায় সৈন্যবাহিনি ভরণপোষণ ও বিলাস-বিলাসিতার খর্চা মিটাতে রাজস্ব আদায়ের চাপ কৃষকশ্রেণিকে কার্যত ঘনঘন বিদ্রোহে গমন করতে বাধ্য করেছে। সেকালের সামন্তপ্রভু জমিদারশ্রেণির সঙ্গেও মুঘল প্রশাসনের নানা খুটখাট যেহেতু লেগে থাকত, ইরফান হাবিব জানাচ্ছেন বটে,- জমিদারগণ নিজ মতলব হাসিলে কৃষকশ্রেণিকে ফিরে-ফিরে বিদ্রোহী হতে উসকে দিতেন।
মোটা দাগে এগুলোকে জাতিমানস গঠনে বৃহৎ ঘটনা মনে নাও হতে পারে, কিন্তু বাদ দিয়ে আগানোর অর্থ হচ্ছে বাংলা তথা ভারতবর্ষ জুড়ে শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়নের যে-প্রলম্বিত ইতিহাস সেটিকে বেমালুম সরিয়ে রেখে সিপাহী বিদ্রোহকে মাঝখান থেকে অগ্রগণ্য করে তোলা। এতে করে এক ধরনের জাতীয়তাবাদের বনেদ তৈরি হয় বটে, কিন্তু জনমানস ও গণমানুষের সম্পৃক্তির সংক্ষুব্ধ পরম্পরা মুছে যেতে থাকে। রাইসুরা সেটিই চাইছেন বোঝা যায়। ইংরেজ আমলের প্রথমপর্ব অর্থাৎ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে নীলচাষকে কেন্দ্র করে বড়ো আকারের বিদ্রোহের বীজ দানা বেঁধেছিল তখন। দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ তার দালিলিক বয়ান লিপিবদ্ধ আছে বৈকি।
ইংরেজ আমলের পুরোটা জুড়ে একের-পর-এক কৃষক বিদ্রোহ, আদিবাসী বিদ্রোহ… এগুলোকে কী কারণে তুচ্ছ গণ্য করতে হবে তার ব্যাখ্যা কি রাইসু দিতে পারবেন? আদিবাসীদের তিনি গণমানুষের কর্তাসত্তা ভাবে না বোঝা যায়। মুসলমান ছাড়া কাউকে বোধহয় তাঁর চোখে পড়ে না। আহমদ ছফা আর ফরহাদ মজহার উনার মাথা খুব ভালোভাবে চিবিয়ে খেয়েছেন তাতে সন্দেহ পোষণ না করলেও চলছে। উনাদের খোয়াব তো আমরা বুঝি কিছু। বাংলাদেশ কেবল মুসলমানদের ওয়ারিশান হবে, এবং সেই জায়গা থেকে যত ঘটনা সেগুলোকে বয়ানের মাধ্যমে নতুন করে বিনির্মাণ করতে হবে, এভাবে এমন এক মিথ দাঁড় করাতে হবে যেন ইতিহাসকে নতুন করে লেখা সম্ভব হয়;- এই মতলব বুকে নিয়ে ফেসবুকে গণমানুষের কর্তাসত্তা হওয়ার আলাপ নিয়ে হাজির হয়েছেন রাইসু।
সিপাহী বিদ্রোহ, আমি মানছি, ক্ষমতাকে নির্মমভাবে কুক্ষিগত বৈদিশিক শক্তি ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রথম বড়ো বিদ্রোহ ছিল। দূর লন্ডন শহরে বসে স্বয়ং কার্ল মার্কস এর মধ্যে বৈপ্লবিক বীজ ও সমাজ-পরিবর্তনের নিয়ামক সক্রিয় দেখতে পেয়েছিলেন। সে-তুলনায় ভারতবর্ষের জলবায়ুতে পুরোদস্তুর মানিয়ে নেওয়া মুঘল রাজের বিরুদ্ধে কিছুদিন অন্তর সংগঠিত কৃষক বিদ্রোহে বৈপ্লবিক বীজ অতটা প্রবল ছিল না। তথাপি ফুলকি তো কিছুদিন অন্তর উঠছিল! এগুলোকে একত্র করলে বুঝতে পারি গণমানুষের কর্তাসত্তা হওয়ার সুপ্ত আকাঙক্ষা সেখানে বেশ ভালোভাবেই সক্রিয় থেকেছে। এগুলোকে এখন বাদ দিতে যাবো কেন?
১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে ভারতবর্ষ কুক্ষিগত হলো। গণমানুষ কেন দর্শকের ভূমিকায় ছিলেন তখন? প্রশ্নটি বাদ যাবে কেন? এর উত্তর যদি তালাশ না করি তাহলে পরের ইভেন্টগুলার (ধরা যাক ১৮৫৭) ব্যাপক অবদান রাখা সত্ত্বেও গণমানুষকে কর্তা গণ্য করে রাষ্ট্র গঠনে ব্যর্থতার খেই কি উনি ধরতে পারবে? গণমানুষ এই ভূখণ্ডে কর্তাসত্তার ভূমিকা বিভিন্ন কালপর্বে নিয়েছে। তাৎপর্যের দিক থেকে প্রত্যেকটি ভূমিকার ফ্যাক্ট ও ন্যারেটিভ বারবার যাচাই করার প্রয়োজন রয়েছে। কর্তারূপে গণমানুষের ভূমিকা কখনো সাফল্যের সম্ভাবনা তৈরি করেছে আবার বড়ো দাগে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে সিংহভাগ। ব্যর্থ হয়েছে বলে কি সেগুলো গোনায় ধরব না?
রাইসুর এই ১৮৫৭ থেকে শুরু করাটা আসলে মতলবি। কার্ল মার্কস এই ফ্যাক্টকে লন্ডনে বসে যে-আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করেছিলেন, রাইসু এখানে সেদিকে যাবেন না ধরে নিতে পারি। না গেলে অসুবিধা নেই। মার্কস এখানে আদৌ জরুরি বা বিবেচ্য বিষয় না। তিনি যাবেন ভিন্ন বয়ানে। সিপাহী বিদ্রোহের দুটি সংস্করণ সময়টানে দাঁড় করানো হয়েছে। এর একটি হিন্দুত্বকে গ্লোরিফাই করতে তৈরি করা হয়েছিল। অন্যটি মুসলমানিত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে উৎসুক থেকেছে।
ফেসবুকে অহরহ মতলবি বয়ান হাজির করে হাইপ তুলতে ওস্তাদ রাইসু দ্বিতীয়টি নিতে চাইবেন মনে হচ্ছে। সেটি নেওয়ার মতলবেই ফেসবুকে উনি পোস্টাইছেন। আর বঙ্গভঙ্গ তো কার্যত পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাস্তবতাকে মূর্ত করার অন্যতম নিয়ামক শক্তি। তো এভাবে উনি পৌঁছাবেন সেই জায়গায় যেটি মুসলমান সম্প্রদায়ের মার্জিনাল থাকার ইতিহাস তুলে ধরতে ইচ্ছুক, যেটি আওয়ামীপন্থী বয়ানের কারণে একাত্তরে এসে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল ইত্যাদি। যাই হোক, উনাকে ধন্যবাদ দিতে হচ্ছে শেষ বাক্যটির জন্য, যেখানে উনি এই আবেদন পেশ করেছেন,- একটি ঘটনা বা ইভেন্টকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অন্যটিকে আমরা যেন নাকচ না করি।
যদি তাই হয় তাহলে, জাতিসত্তার গঠন ও গণমানুষের কর্তা রূপে আবির্ভাবের ধারা বুঝতে রাইসুকে আরো পেছনে যেতে হবে। বাঙালি জাতিসংকর। এ-কারণে গণমানুষের অংশগ্রহণ ও কর্তাসত্তা রূপে তার আবির্ভাবের ইতিহাসকে ১৮৫৭ থেকে ধরার কিছু নাই। আরো পেছনের অনেক ইভেন্টকে সেখানে গোনায় নিতে হবে।
. . .
. . .