দেখা-শোনা-পাঠ

কোয়েলিয়া গান থামা এবার

Reading time 2 minute

অস্থির-অনিশ্চিত সময়ে মনকে সুস্থির রাখার উপায় হয়তো গানবাজনায় কান পাতা। গত সাত-আট মাসে গান শোনার নিয়মিত অভ্যাসে ভাটা পড়েছে। যে-কারণে হয়তো রিপন কুমার সরকার ওরফে বগা তালেবের নতুন রিলিজের খবর কানে আসেনি তাৎক্ষণিক। কোক স্টুডিও বাংলায় বাজিমাতের আগে থেকে তাঁকে শুনে আসছি। সময়ের সঙ্গে বগা তালেব আরো পরিণতি করেছেন নিজেকে। মার্চের ১৮ তারিখে উন্মুক্ত কোয়েলিয়া গান থামা এবার-এ নতুন এক বগা তালেবকে পাচ্ছি যেন!

পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ বিরচিত গানটি বেগম আখতারের কণ্ঠে আজো অবিনশ্বর লাগে কানে। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষকে নিয়ে বলার যোগ্যতা আমি রাখি না। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতসহ আধুনিক বাংলা গান রচনায় ও সুরদানে তাঁর কৃতি সম্পর্কে গুণীজনরা বিস্তর বলেছেন। কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁর স্বভাবসুলভ মজলিশি ঢংয়ে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ও ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখেছিলেন বটে!

Pandit Ravi Shankar interviewed by Pandit Jnan Prakash Ghosh, 1967; Source – AIR Raagam YTC

বিচিত্র গানের সম্ভার ও আলাপচারিতায় আকাশবাণীকে জাদুকরের মতো বদলে দিয়েছিলেন জ্ঞানপ্রকাশ। পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতা ইউটিউবে সুলভ। কান পেতে শোনার মতো সে-আলাপ। বহুমাত্রিক এই মানুষটির হারমোনিয়াম বাদন নিয়ে কী আর বলব! যন্ত্রটি রবীন্দ্রনাথ বড়ো একটা পছন্দ করতেন না। ঠাকুরের মনে হতো তাঁর গানের অন্তর্নিহিত বাণীর মধ্যে যে-মৌনতা নিহিত, সেখানে এই যন্ত্রটি উৎপাত স্বরূপ। যন্ত্রানুষঙ্গের আড়ম্বর কমিয়ে গান গাইতে ও শুনতে ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথ। শান্তিদেব ঘোষকে যে-কারণে আমরা দেখব,—খোল-করতাল ও মৃদঙ্গের অধিক না গিয়ে প্রায় খোলার গলায় গাইছেন হামেশা। যদিও ঠাকুরের জীবদ্দশায় যন্ত্রবাদনে তাঁর গান, বিশেষ করে ফিল্মি পরিসরে অনেকে গেয়েছেন। তখন যা রবিবাবুর গান নামে সমধিক পরিচিতি ছিল।

জ্ঞানপ্রকাশের হাতে কিন্তু হারমোনিয়াম হয়ে উঠল সুমসৃণ ঐকতানের এক লহরি! সে তিনি রাগ ভৈরব বা অন্য সব রাগ,—যাই তুলুন না কেন পিয়ানোর গলিভাই বাদ্যযন্ত্রে। হারমোনিয়াম বাদনে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় ও জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ অতুল কীর্তির অধিকারী যে-কারণে। ভীষ্মদেবের বাদনে কাফি কিংবা ভৈরবী ঠাঠের রাগ শুনে মনে হবে হারমোনিয়াম থেকে বুলেট ছুটছে। আর জ্ঞানপ্রকাশের হাতে তারা যেন-বা চপল নর্তকী।

Vishmadev Chattopadhyay Bhairavi – Harmonium; Neil Maitra YTC

যাইহোক জ্ঞানপ্রকাশ গান লিখতেন, সুর দিতেন, এবং শিল্পীদের কণ্ঠে তুলতেন বিলক্ষণ। কলের গানের যুগে কারিগরি কারণে একটি গান গলায় তুলতে মাসখানেক লাগত। গ্রামোফোন কোম্পানি শিল্পীদের কণ্ঠে গান তুলতে প্রশিক্ষক বা ট্রেইনারের ব্যবস্থা রাখতেন। কাজী নজরুল ইসলাম, কমল দাশগুপ্ত থেকে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ…সকলে এই দায় মিটিয়েছেন কমবেশি। এর একটি সুবিধা ছিল, গানের প্রতিটি কথার সঙ্গে শিল্পী ও বাদকদলের নিবিড় একাত্মতা তৈরি হতো তখন। জ্ঞানপ্রকাশ যেহেতু সে-যুগ থেকে পরবর্তী যুগ-পরিবর্তনের তরঙ্গ দেখে যেতে পেরেছেন,—নিজেকে সেখানে সাক্ষাৎ মানিয়ে নিতে একটুও অসুবিধা হয়নি তাঁর।

Jochona Koreche Aari – Begum Akhtar; Source – Touhid YTC

যাইহোক, কোয়েলিয়া গান থামা এবার তাঁর বিখ্যাত গীতকলির অন্যতম। এবং বেগম আখতারের কারণেও গানটি বহুশ্রুত ছিল একসময়। বেগম আখতারের ব্যাপারে কিছু বলার নেই! কুমারপ্রসাদের লেখাপত্রে আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি ওরফে বেগম আখতারের গায়েন-কুশলতা ও ব্যক্তিত্বের পুরোটা উঠে এসেছিল। সে রীতিমতো রসেবশে জড়ানো কাহিনি। তো সেই উর্দুভাষী বেগম আখতার বাংলায় কোয়েলিয়া যবে গাইলেন, এবং তাও জ্ঞানপ্রকাশের অধীনে,—সোনা হতে সময় লাগেনি। বগা তালেব এখন নতুন যুগের পরিবেশে গানটি গেয়েছেন। আখতারকণ্ঠে গীত গানের সঙ্গে এর তুলনা অনাবশ্যক। দুজনের গায়কি আলাদা। সময় পৃথক। কাজেই দুটির মধ্যে তুলনা সমীচীন নয় কোনোভাবে।

ব্যক্তিগতভাবে বেগম আখতারের কণ্ঠে এ-গানের পরিবেশনা তাঁর কণ্ঠে গীত জোছনা করেছে আড়ি-র মতোই ঐশ্বরিক। সেটি ঠুমরি ও গজল সম্রাজ্ঞীর কণ্ঠের ওস্তাদির কারণেও বটে। বগা তালেব একালের ছেলে, এবং সেখানে তার পরিবেশনাও হৃদয়গ্রাহী। লোকগানের হাইপিচ ডেলিভারি থেকে কোয়েলিয়ার রাগাশ্রিত ডেলিভারিতে তাঁর কণ্ঠের মনোটোনাস উচ্চলয় আশ্চর্য দিব্য লাগল শুনে। বেগম আখতার ও জ্ঞানপ্রকাশ বেঁচে থাকলে খুবসরত বলে আশীর্বাদ করতেন নিশ্চয়।
. . .

Koyeliya Gaan Thama Eber – Boga Taleb; Source – Boge Raja Dilo Bor YTC

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 7

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *