একুনে এক দশক আগে লেখা কিতাবে ভাষাবিজ্ঞানী ও মনোদার্শনিক স্টিভেন পিঙ্কার এই দাবি নিয়া হাজির হইছিলেন,- মানবগ্রহে সহিংসতার মাত্রা সময়ের সঙ্গে ভালোই হ্রাস পাইতেছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কোরিয়ার যুদ্ধ, ভিয়েতনামের সঙ্গে আম্রিকার দীর্ঘমেয়াদে সংঘটিত যুদ্ধ, এবং বিশ্বের অলিগলিতে চলতে থাকা ছোট-বড়ো-মাঝারি আকৃতির সব যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়াও বিচিত্র কিছিমের সহিংসতা অবিরাম চলতে থাকলেও স্টিভেন পিঙ্কার মনে করেন,- বিগত িএক শতক ধরে সংঘটিত সহিংসতার মাত্রা ও পরিণাম অতীতের তুলনায় নগণ্য, এবং সময়ের পালাবদলে তাল দিয়া সেটি ক্রমাগত নিম্নগামী। তাঁর বিবেচনায়,- মানবজাতি তুলনামূলক ভালো একখান সময়ের দিকেই অগ্রসর হইতেছেন।
মানবমনের কগনিটিভ এক্সলেন্স বা সহজ করে বললে জ্ঞান ভিত্তিক অগ্রগতির কারণে সহিংসতা হ্রাস পাইতে বাধ্য ;- কথাখান স্টিভেন পিঙ্কার উনার বহুল আলোচিত কিতাব The Blank Slate-এ প্রচ্ছন্নভাবে তুলে আনছিলেন। সহিংসতা কমার কার্যকারণ নিয়া রচিত কিতাব The Better Angels of Our Nature: Why Violence Has Declined-এ একদম খুল্লামখুল্লা ঝেড়ে দিছেন সব। দ্য ব্ল্যাঙ্ক স্লেট-এর পটভূমি অনেকখানি ভিন্ন ছিল। কোনো এক অবসরে হয়তো কিতাবের সারবস্তু নিয়া আলাপের মওকা আসবে। আপাতত সহিংসতা হ্রাস পাওয়ার ব্যাপারে উনার বক্তব্যে দৃকপাত করা যাক।
নেটে সুলভ থাকলেও কিতাবখানা পাঠের সুযোগ ঘটে নাই। পাঠ না করলেও স্টিভেন পিঙ্কার স্বয়ং এর সারকথা একাধিক লেকচার ও আলাপচারিতায় তুলে ধরেছিলেন। যারা কিতাবখানা পাঠ করছেন তাদের পক্ষ থেকেও দাবির সারবস্তু নিয়া পক্ষে-বিপক্ষে প্রচুর আলাপ উঠছিল সেই সময়। সুতরাং এই জায়গা থেকে আগানো যাইতে পারে। আমরা সাদা নজরে যেখানে বিশ্ব জুড়ে সহিংসতার মারাত্মক উল্মফন প্রতিনিয়ত দেখতে পাইতেছি, সেখানে স্টিভেন পিঙ্কার কী হেন কারণে সহিংসতা হ্রাসের ব্যাপারে ক্রমশ অটল হইতেছেন? সওয়ালের জওয়াব দিতে গিয়া প্রখর যুক্তিবাদী ও ধর্মে অবিশ্বাসী বুদ্ধিজীবী অনেক কথাই বলছিলেন। তার সারসংক্ষেপ পেশ করি এবার। স্টিভেন পিঙ্কার যুক্তি দিতেছেন :
ক. মানব সভ্যতার বিকাশলগ্ন হইতে অদ্যাবধি নানা প্রকার সহিংসতার স্ট্যাটস বা পরিসংখ্যান যদি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে আমরা দেখব, মানবজাতি বিগত একশো বছরে ভয়াবহ দুটি বিশ্বযুদ্ধ ও হাজারে-বিজারে মারপিটে লিপ্ত থাকলেও সহিংসতার হার অতীত কালপর্বের তুলনায় নিম্নগামী। সহিংসতার মাত্রা নিচের দিকে নামতে থাকার এই প্রবণতা এখনো অব্যাহত আছে।
খ. প্রাগৈতিহাসিক কালপর্ব, প্রাচীন সভ্যতা এবং সেখান থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত কালসীমার হিসাব নিলে দেখা যাবে গোত্রদ্বন্দ্ব বা ট্রাইবাল ওয়ার, দেশ দখল, উপনিবেশ স্থাপনে সংঘটিত যুদ্ধবিগ্রহে শতকওয়ারী বিপুল পরিমাণ মানুষ মারা যাইতেন। বিশ্বযুদ্ধসহ অন্যান্য যুদ্ধ, স্টালিন-মাও-সুহার্তো ছাড়াও নিদারুণ সব একনায়কের হাতে সংঘটিত নিধন আর গণহত্যা সহিংসতার ধারা বজায় রাখলেও অতীত পরিসংখ্যান হাতে নিলে এগুলোকে মামুলি মনে হবে।
গ. সহিংসতার চরিত্র যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাইতেছি অতীতে নরহত্যা দৈনন্দিন ঘটনা ছিল। সেসব নরহত্যার প্রকৃতি নির্মম, নৃশংস বা আরো স্পষ্ট করে বললে অতিব বর্বর আর জান্তব ছিল। প্রাচীন হইতে মধ্যযুগ অবধি কালসীমায় মানুষকে নির্যাতন, নিপীড়নের তরিকা এতটাই বীভৎস আর অযৌক্তিক ছিল যে, এগুলোর বিবরণ একালের কোনো মানুষের পক্ষে হজম করা কঠিন। মধ্যযুগে নিপীড়ন ও নরহত্যাকে শিল্পে পরিণত করা হইছিল।
মিশেল ফুকোর নামখানা এই সুবাদে বোধহয় ইয়াদ করা যাইতে পারে। পিঙ্কারের কথার প্রতিধ্বনি আমরা ফুকোর উন্মাদনা, কয়েদখানা ও চিকিৎসাবিদ্যা নিয়া বিরচিত অভিসন্দর্ভে পাইতেছি। ইউরোপে আলোকায়ন সংঘটিত হওয়ার কালপর্বেও অবিশ্বাস্য নিপীড়নের বিচিত্র সব তরিকা মহাসমারোহে জারি ছিল সেখানে। ফুকো যার সুনিপুণ পটভূমি গবেষণায় তুলে আনছিলেন। ক্ষমতাকে ব্যবহার করে শৃঙ্খলার বিকাশ স্বয়ং কতখানি ভয়ানক হইতে পারে তার বিবরণ ফুকোয় আছে বৈকি।
ঘ.. বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যুক্তি বিরচনে সিদ্ধহস্ত স্টিভেন পিঙ্কার সহিংসতা হ্রাস পাওয়ার নেপথ্যে মানবমস্তিষ্কে যুক্তিনিষ্ঠতার বিকাশ ও অগ্রগতিকে গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে কিতাবে হাজির করছেন। উনার মতে, দাসপ্রথা, নারীকে অবরুদ্ধ রাখা ও বিচিত্র তরিকায় শারীরিক-মানসিক নিগ্রহ, শিশুশ্রম ও নির্যাতন, বাকস্বাধীনতায় আগল তোলা ইত্যাদি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সুদূর অতীত থেকে একশো বছর আগেও মানবসমাজ যে-পরিমাণ বীভৎস ছিল… সময়ের সঙ্গে এগুলোকে মোকাবিলার পন্থায় তারা অনেকবেশি বিবেচক ও সমঝোতাপ্রবণ হইতে পারছেন।
উন্নত অথবা উন্নয়নশীল, অগ্রসর অথবা এখনো অগ্রসরমান সমাজ… সর্বত্র ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কারণে সংঘটিত সহিংসতার মাত্রা হ্রাস করতে মানবসমাজ আগের তুলনায় অধিক সচেতন, যুক্তিশীল, আইন প্রয়োগে কঠোর, এবং বিবেচক। এর সামগ্রিক প্রতিফলন স্ট্যাটস বা পরিসংখ্যানে ধরা পড়তেছে।
ঙ.. সহিংসতার প্রকৃতি ও তার মাত্রা অবধানে স্টিভেন পিঙ্কার প্রত্নতাত্ত্বিক তরিকা প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার গিয়েছেন। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আধুনিক কালসীমায় মৃত মানবের প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনা বিশ্লেষণের পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে বাধ্য হইছেন,- অধুনা কালপর্বের তুলনায় অতীতে সহিংসতার প্রকৃতি অত্যন্ত হিংস্র, জান্তব আর ভয়ানক ছিল। সেকালে মানুষের মধ্যে এ্যাম্পেথি বা সংবেদনের মাত্রা তীব্র ছিল না। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যত সহিংসতা ঘটছে, নিপীড়ন-নির্যাতন আর যথেচ্ছ হত্যা-খুন ঘটত তখন,- মানুষ এগুলাকে ব্যাপার না বইলা ধরে নিতে অভ্যস্ত ছিল।
পৈশাচিক প্রকৃতি ও বুনো স্বভাব তখন স্বাভাবিক গণ্য হইত, যা বিগত কয়েক শতকে যুক্তিশীল সংবেদনের ধারাবাহিক বিকাশের প্রভাবে হ্রাস পাইতেছে। মানুষ এখন অধিক সংবেদনশীল। অন্যায় নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও প্রতিবাদী। এর পেছনে রাষ্ট্রগঠনে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি ও দায়বদ্ধতার ভূমিকা যুগান্তকারী বইলা পিঙ্কার মনে করেন। একালে চরম নিপীড়ককে মানুষ ছাড় দেয় না। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে সংহত হ্য়ইতে থাকে। কয়েকশো বছর আগে এই ঘটনা অচিন্ত্যনীয় ছিল!
. . .
মোটের ওপর এইটা হচ্ছে মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়া ভীষণ ইতিবাচক স্টিভেন পিঙ্কারের কিতাবের সারকথা। পক্ষে-বিপক্ষে অনেকে তখন যুক্তি হাজির করছিলেন। নেটে যে-কেউ খোঁজ নিলে পাবেন। দাবির স্বপক্ষে উনি যেসব তথ্য কিতাবে পরিবেশন করছিলেন, আলাপচারিতা ও বক্তিমায় সেগুলা তুলে ধরছিলেন, সেগুলা ভ্যালিড সন্দেহ নাই। এর থেকে এইটা আমরা ধরে নিতে পারি,- স্ট্যাটস বা পরিসংখ্যান বিচারে সহিসংসতার হার সময়ের সঙ্গে কমে আসতেছে। তার প্রকৃতি অমার্জিত হইতে পরিশীলিত হইতেছে। যুক্তিহীন সহিংসতার মাত্রা আগের তুলনায় সীমিত ইত্যাদি। মানবমস্তিষ্কের অগ্রগতির সঙ্গে অধিক রিফাইনড বা পরিশীলিত সমাজে আমরা আছি;- এই ব্যাপারে সন্দেহ না রাখাই সমীচীন। পরিশীলিত হওয়ার কারণে সহিংসতার প্রকৃতি পরিশীলিত বটে! ফেদরিকো ফেলিনির লা দলচে ভিতা-র বিখ্যাত সংলাপ মনে পড়তেছে, আচমকা কোনো উন্মাদ যদি পাগলাঘণ্টা বাজায়, নিমিষে সবাই মারা পড়বে।
প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির সঙ্গে মানুষের যুক্তিশীল বুদ্ধিদীপ্ত সংবেদনের জের ধরে কিন্তু আবার পারমাণবিক অস্ত্রের জনক হয়ে বসে আছি আমরা! আণবিক শক্তি ব্যবহারের পরিস্থিতি যদি তৈরি হয় এবং কেউ সেইটা করে বসে, তখন যে নরহত্যাসহ প্রকৃতিহত্যা ঘটবে… সেইটা কি কোনো হিসাবে ধরা যাবে? এর প্রকৃতিকে কী বলবেন স্টিভেন পিঙ্কার? যুক্তিশীলতার এই বিপদ সম্পর্কে সচেতন হইলেও তাঁর ধারণা,- ওই পর্যায়ে যাওয়ার আগে মানুষ রিভার্স লজিক দিয়া একে প্রতিহত করবে। নিবৃত্ত করবে নিজেদের। তাই কি?
. . .
. . .