ছবির অন্তরালে

কাবুল দেশের শরবত গুলা

Sharbat Gula by Steve McCurry; Source: Wikipedia

আমার ছোট্ট মেয়েটির মধ্যে কিছুদিন ধরে বিচিত্র বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করার ক্ষুধা প্রবল হয়েছে। সুযোগ পেলৈই হয়,- একরাশ প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে বসবে মেয়ে। এটা কী? এটা কেন? ওটা কেন নয়? হাজার প্রশ্নে আমাকে কাবু করে ফেলে। উত্তর যদি পছন্দ হয় তাহলে রক্ষা। না হলে প্রশ্নের ঝড় আসতেই থাকে একের-পর-এক। উত্তর জানা থাকলে ঝটপট ঝেড়ে দেই। না জানলে ঘটে বিপদ। আন্দাজে কিছু একটা দাঁড় করানোর চেষ্টা করি তখন।

প্রশ্নঝড়ের ঠেলা সামলাতে গুগল মামা আর চ্যাট জিপিটির ওপর ভরসা করা ছাড়া তখন উপায় থাকে না। এর জন্য আমি নিজেই দায়ী। মেয়েকে ঘুমপাড়ানিয়া গল্প শুনাতে গিয়ে ঘাড়ে বিপদ ডেকে এনেছি। গল্প শোনা সেই থেকে মেয়ের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। ডেলি নতুন গল্প শোনাতে হয় তাকে। রূপকথা, রাক্ষস-খোক্ষস থেকে ঐতিহাসিক গল্প… কোনোটা শুনতেই অরুচি নেই তার।

জানার ভাণ্ডার ফুরিয়ে যায় দেখে বানিয়ে-বানিয়ে বলতে শুরু করি। আজকাল সে আবার নিজে বেশ পড়তে শুরু করেছে। স্কুল ছুটি হলে আমার লাইব্রেরিতে হানা দেয়। ওর এই বইপাঠের ক্ষুধা মেটাতে আমি বা তার মা অনলাইন থেকে বই অর্ডার করি। কখনো-বা শহরে বইয়ের দোকান থেকে এনে দেই। পড়তে চাইছে পড়ুক। ওর মা অবশ্য মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়। স্কুলে পড়াশোনায় ক্ষতি হচ্ছে;- এসব বলেটলে আমাকে ঝাড়ে। আমি গায়ে মাখি না। গত বছর টেলেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে মেয়ে।

সমস্যা অন্যখানে। যাই পড়বে তাকে বাস্তব ও সত্য ধরে নেবে সে। তো এই পাল্লায় পড়ে তাজমহল দেখাতে আগ্রায় নিয়ে যেতে হয়েছিল, আর পিরামিড দেখাতে মিশর। অফিস থেকে ছুটি ম্যানেজ করতে জান বেরিয়ে গিয়েছিল আমার। যাই হোক, সেদিন অফিস থেকে ফেরার পর মেয়ে আমার কাছে ছুটে আসে। বুঝলাম কিছু একটা তার মাথায় ঘুরঘুর করছে।

Kabuliwala : Bengali Movie (2023) by Suman Ghosh; Source – Google Image
- বাবা জানো আজ আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাবুলিওয়ালা গল্পটি পড়েছি। 

: ভালো। আমার কন্ঠে তখন একরাশ ক্লান্তি ভর করেছে। অফিসে আজ ধকল গেছে খুব!

- বাবা গল্পটা কি সত্যি?

: হয়তো। আবার কল্পনাও হতে পারে। ঠিক জানি না মা। তবে একসময় আমাদের এখানে কাবুলিওয়ালা ছিল ।

- আচ্ছা বাবা, রহমতকে কাবুলিওয়ালা বলে কেন?

: আফগানিস্তানের রাজধানীর নাম হচ্ছে কাবুল। পাহাড়ঘেরা সুন্দর দেশ। আমরা যখন ভারতবর্ষে ছিলাম তখন এই আফগানিস্তান থেকে কাজের খোঁজে কিছু লোক এখানে আসত। পাড়া-মহল্লায় ঘুরে-ঘুরে জিনিস ফেরি করতে তারা। খুব গরিব ছিল তো, তাই আসত। কাবুল থেকে আসার কারণে সবাই তাদেরকে কাবুলিওয়ালা নামে ডাকত।

- বাবা কাবুলিওয়ালা কি তার মেয়ের কথা ভেবে মিনির কাছে আসত?

: হুম তাইতো জানিরে মা।

- জানো বাবা, কাবুলিওয়ালার মেয়ে তার বাবাকে ছাড়া কীভাবে থাকত ভেবে আমার কান্না পাচ্ছিল।

: এটা তো গল্পরে মা। অনেক আগে লেখা গল্প। মন খারাপ করার কী আছে?

- বাবা, আমাকে কাবুলিওয়ালার দেশে নিয়ে যাবে?

মনে-মনে এই আশঙ্কাই করছিলাম। গল্পটি তাকে তাতিয়ে তুলেছে। ছোটবেলা থেকে ওর আবেগকে আমার ভীষণ ভয়। মেয়ে আবদার ধরলে তার মা সোজা মুখের উপর না বলে দিতে পারে। আমি একদম পারি না। চেষ্টা করে দেখেছি, ভীষণ মন খারপ করে বসে মেয়েটা! মা বকাবকি করলে গায়েও মাখে না, কিন্তু আমি সামান্য কঠিন কথা বললে নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দেবে।

মেয়েকে বুঝাই,- ওই দেশে কেউ বেড়াতে যায় না মা। যুদ্ধ লেগেই থাকে সেখানে। ঠুসঠাস চলতে থাকে সারাক্ষণ।

বুঝলাম আমার কথাগুলোকে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না সে। কাবুলিওয়ালা আর তার মেয়ের কথা ভেবে মনটা আচ্ছন্ন হয়ে আছে তার। মুখ ভার করে ওঠে গেল!

Sharbat Gula – National Geography Cover Story; Source – Google Image

আমার মন আনচান করে ওঠে। যদি সব স্বাভাবিক হতো, নিশ্চয় নিয়ে যেতাম, কিন্তু সেটি সম্ভব নয়। শুনেছি আমাদের দেশের এনজিও ব্র্যাক সেখানে কাজ করতে গিয়ে হামেশা সমস্যায় পড়ছে। দুএকজনের গুম হওয়ার খবরও কানে এসেছে। না,- সম্ভব নয়। মনে-মনে দৃঢ় হয়ে উঠি। এর মাঝে হঠাৎ শরবত গুলার কথা মনে পড়ে। স্টিভ ম্যাককারির তোলা জগৎ বিখ্যাত ছবি। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যুদ্ধের বছরগুলোয় পাকিস্তানের নাসিরবাগ উদ্বাস্তু শিবিরে এক আফগান কিশোরীর ছবি তুলেছিলেন স্টিভ ম্যাককারি। ১৯৮৫ সালে ছবিটি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে স্থান পাওয়ার কারণে রাতারাতি বিশ্ব জুড়ে আলোড়ন ফেলে।

মনে-মনে ঠিক করে ফেলি, এই ছবিটা দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে হবে। শরবত গুলাকে আপাতত কাবুলিওয়ালার মেয়ে বলে চালিয়ে দেবো। অদ্ভুত এই মুখচ্ছবিতে তার কৌতূহল হয়তো কিছুটা হলেও কমবে। অনেকগুলো ছবি থেকে ভালো দেখে একটি প্রিন্ট দিয়ে ঘুমাতে যাই।

পরের দিন ছিল হলিডে। বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠি। নাস্তার টেবিলে মেয়ে দেখি মুখ ভার করে বসে আছে। আমি মৃদু হেসে তার পাশে বসি,- কাবুলিওয়ালার মেয়ের খবর বের করেছি রে মা। রাতে ছবিও হাতে এসেছে। মেয়ের চোখে ততক্ষণে খুশির ঝিলিক লেগেছে। ছবিটা দেখার জন্য তর সইছে না তার। আমি ছবিটা হাতে ধরিয়ে দেই।

চোখের পলক না ফেলে ছবিটা দেখছে সে। আমি তার মনের গতিক বোঝার চেষ্টা করি। ক্ষণে-ক্ষণে মুখের রং বদলাচ্ছে টের পাই। শেষপর্যন্ত বিষাদে মুখটা কালো হয়ে ওঠে।

- বাবা, এই ছবিটা কি তার বাবা দেশে যাওয়ার আগের তোলা? 

: হ্যাঁরে মা, কাবুলিওয়ালাকে জেলে পাঠানোর সময় তোলা।

- দেখো বাবা, মেয়েটা তার বাবার জন্য অপেক্ষা করতে-করতে কেমন হয়ে গেছে! চোখের রং বদলে গেছে তার। আর জামা দেখেছো? ছেঁড়া জামা পরে আছে! তার বাবা থাকলে নিশ্চয় সুন্দর জামা এনে দিতো তাকে।

আমি হু বলে মাথা নাড়ি।

. . .

আমার মেয়ে মিথ্যাটি ধরতে পারেনি দেখে মনে বেশ আরাম বোধ করি। শরবত গুলাকেই সে কাবুলিওয়ালার মেয়ে ধরে নিয়েছে। মিথ্যাটি বেশিদিন টিকবে না। কিছুদিন পরে সে ঠিক ধরে ফেলবে আমি তাকে ভোলানোর জন্য এসব করেছি। ততদিনে সে অনেকটা বড়ো হয়ে যাবে। মনটাও এখনকার মতো নিশ্চয় থাকবে না। আমি যে মিথ্যা বলে তাকে ভুলিয়েছি, সেটি হয়তো তার কাছে অতটা গুরুতর থাকবে না।

. . .

Kabuliwala Official Trailer; JioStudios YTC

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 1

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *