আসুন ভাবি

সত্য-মিথ্যার সাতকাহন

. . .

ইন্ট্রো : সত্য-মিথ্যার সাতকাহন

থার্ড লেন-এর হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে মিথ্যা নিয়ে আহমেদ বেলাল চমৎকার একটি আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন, যার কিছু অংশ নেটালাপ-এ পাঠক পাবেন। আলাপটি বিস্তারে যাওয়ার এক পর্যায়ে মোস্তাফিজুর রহমান জাভেদ যোগ দেন। তাঁর বক্তব্য মিথ্যার ইতিহাস ও দার্শনিকতায় আলো ফেলার চেষ্ট করেছে দেখে নেটালাপ-এ উক্ত অংশটি আমরা আর যুক্ত করিনি। পূর্ণাঙ্গ রচনা হিসেবে এটি আপ করছি এখন। রচনাটির ওপর আহমদ মিনহাজের সংযুক্তিও থাকছে সেখানে। আশা করি পাঠক মন্তব্য, প্রতিমন্তব্য যোজনা করবেন। যেন, মিথ্যা তুমি দশ পিঁপড়া নিয়ে আমরা আরো ভাবতে পারি গভীর।

. . .

মিথ্যা নিয়ে বেলাল ভাই বেশ চমৎকার একটি আলাপের সূত্রপাত করেছেন। বিষয়টি ওপর অনেকভাবে আলো ফেলা যেতে পারে। বেলাল ভাইয়ের কথার সূত্র ধরে রাজিব ভাই যেমন যেমন ইউভাল নোহা হারারিকে টেনেছেন। মানবসমাজের বিকাশকাল জুড়ে মিথ্যা কীভাবে ভূমিকা রেখে এসেছে তার চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায় সেপিয়েন্স- এ ব্রিফ হিস্টরী অফ হিউম্যানকাইন্ড গ্রন্থে। হারারি দেখান মিথ্যা ও কল্পনার মাধ্যমে কীভাবে মানবসমাজ ও সভ্যতার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে।

গবেষকরা দেখিয়েছেন প্রাণীজগতের মধ্যেও মিথ্যা ক্রিয়াশীল। কিছু প্রাণী তাৎক্ষণিক শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। যেমন মারা যাওয়ার বা আহত হওয়ার ভান করা। আবার কিছু প্রাণী নিজেকে ভীতিজনক প্রমাণ করার জন্য গর্জন অথবা সাংকেতিক শব্দের আশ্রয় নেয়। কিছু প্রাণী প্রজননের সময় নিজেকে আকর্ষণীয় দেখাতে মিথ্যা সংকেতের আশ্রয় নেয়। গোষ্ঠীগতভাবেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রাণীজগতে এরকম মিথ্যার প্রচলন নিয়ে অনেক ধরনের গবেষণাজাত তথ্য পাওয়া গেছে। সুতরাং এটা বলা যায় যে একদম আদিমকাল থেকেই মানবসমাজে বিভিন্ন ডাইমেনশনে মিথ্যার প্রচলন ছিল। সেই সময়ে মিথ্যা থেকে সত্যকে আলাদা করার কোনো প্রয়োজন ছিল না, যেহেতু এটা অনেকটা প্রাকৃতিকতার সাথে সম্পৃক্ত ছিল।

আলোচনার শুরুতেই সত্য-মিথ্যার জগৎকে মোটাদাগে দুইভাগে আলোচনা করে আগালে স্ববিরোধী অবস্থানকে এড়ানো সম্ভব হবে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে প্রাত্যহিক জীবনযাপন, যাকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক পরিধির মধ্য দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। এখানে প্রভাবশালী হচ্ছে বিজ্ঞান, ধর্মশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র প্রভৃতি। দার্শনিকবৃন্দ এক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে আলো ফেলেছেন। জীবনকে সুসংহত ও সুনিয়ন্ত্রিত করতে এর ভূমিকা অপরিসীম। এছাড়াও সামাজিক শৃঙ্খলাবোধ এবং মানবিক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রেও এটি ভূমিকা রাখে। অন্যটি হচ্ছে মানুষের সৃজনশীলতার জগৎ, -যা সৃষ্টি করে সাহিত্য, চিত্রকলা সঙ্গীত প্রভৃতি। এটি সত্য-মিথ্যার মধ্য দিয়ে এমন এক জীবনবীক্ষণ যার সৌন্দর্য্য এবং বোধ অতুলনীয়। এখানে লক্ষনীয় তফাৎ হচ্ছে শেষোক্তটি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে বাধ্য নয়। যদিবা কোন উদ্দেশ্য থাকেও তাতে তার ভূমিকা সহায়কের। যেমন একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে,- মহাভারত কিংবা রামায়ণকে ধর্মীয় নৈতিকতার জায়গা থেকে পাঠ না করে বরং সৃজনশীলতার জায়গা থেকে বিবেচনা করা, ফলে সত্য-মিথ্যাজাত দ্বন্ধ কাঠিয়ে ওঠা সহজেই সম্ভব।

সাহিত্য, চিত্রকলার বাইরে সামাজিক রাজনৈতিক পরিধির মধ্য থেকে একজন ব্যাক্তি মানুষের কাছে সত্য কিংবা মিথ্যার প্রকৃত স্বরপ সন্ধান একটি অপরিহার্য় বিষয়। আলোচনাটি মূলত এইদিককে ফোকাস করে অগ্রসর হবে। একদম প্রাচীনকালে সত্য-মিথ্যাকে আলাদাভাবে বিভাজিত করার কোন প্রয়োজন ছিল না, কেননা প্রাকৃতিকতার সাথেই সেটি সম্পর্কিত ছিল। পরবর্তীসময়ে মানুষ যখন থেকে সভ্যতায় প্রবেশ করল, সেইসময় থেকেই মিথ্যা এবং সত্যকে বিভাজিত হতে দেখা যায়। যদিও তার জটিলতার মাত্রা এতোটা গভীর যে আজ পর্যন্ত এই রহস্য পুরোপুরি উম্মোচন করা সম্ভব হয়নি। এর মূল কারণ হলো বিভিন্ন ধরনের ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রের উদ্ভব। রাজনৈতিক মতাদর্শ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ক্ষমতা ইত্যকার বিষয়গুলি সত্য ও মিথ্যাকে বিভিন্নভাবে ডিফাইন করতে গিয়ে এক জটিল ব্যাখ্যায়ন তৈরি করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে ধর্মের ভূমিকা। মিথ্যার বিরুদ্ধে ধর্মের শক্ত অবস্থান স্বত্ত্বেও ধর্ম নিজেই একটা মিথিক্যাল ব্যাপার, অর্থাৎ বাস্তবিক নৈতিকতার সাথে কল্পনাজাত ভাবধারা দিয়ে ধর্মের স্বরূপ তৈরি হয়েছে। এই বিষয়টি জাগতিক সত্যকে মিথ্যা বা মায়া হিসেবে দেখায় এবং কল্পনাজাত একটি জগতকে সত্য হিসেবে তুলে ধরে। ফলে সত্যমিথ্যা একটা গোঁলকধাধায় নিক্ষিপ্ত হয়।

There Is No Creator – Osho Source – Osho International YTC

দার্শনিক নীতিশাস্ত্র এদিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে সত্য-মিথ্যা তার স্বরূপে অবস্থান করে। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো, এ্যারিস্টোটলের দর্শন সত্য-মিথ্যাকে বৈশিষ্ট্যসহ সংজ্ঞায়িত করেছেন । প্লেটো তার রিপাবলিক গ্রন্থে যে আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা তুলে ধরেন সেখানে সত্যকে ন্যায়ের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছিল। সেখানে দার্শনিক তথা জ্ঞানীদের কাজ হচ্ছে অবিরত সত্যের সন্ধান করা। এ্যারিস্টোটলও বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলকে সত্য এবং বাস্তবকে প্রতিফলন করে না এরকম বিষয়কে মিথ্যার সাথে সম্পর্কিত করেন। দার্শনিক দেকার্তেও বিষয়টি নিয়ে আলাপ তুলেছেন। যেখানে তিনি বলছেন,- মিথ্যা হচ্ছে মানুষের চিন্তা ও উপলব্ধির বিকৃত প্রতিফলন। দার্শনিক কান্ট বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন। যে-কারণে কান্টের নীতিশাস্ত্র এখন পর্যন্ত বহুল প্রভাবস্তিারী। কান্ট বলেন, সত্যের ধারণা আমাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। সত্য একটি সুস্থ সমাজের জন্য অপরিহার্য। সত্য বলা একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা। তাঁর ক্যাটাগরিক্যাল ইম্পারেটিভ তত্ত্ব অনুসারে, আমাদের উচিত সর্বদা এমন নীতিতে কাজ করা যা সবসময়ের জন্য সাধারণ আইন হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে। সত্য বলা তাই একটা মৌলিক দায়িত্ব। তিনি দেখান,- মিথ্যা বলার মাধ্যমে অন্যের স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদা বিনষ্ট হয়, মিথ্যা আমাদের কর্তব্যকে অস্বীকার করে, নৈতিক জীবন ধ্বংস করে।

Kant’s Categorical Imperative (Deontology) – ‍Source – Thinking About Stuff YTC

অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা সত্যমিথ্যা, নৈতিকতাকে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে আগ্রহী নন বরং ব্যাক্তিক অবস্থান থেকে যাছাই করতে ইচ্ছুক। জঁ-পল সার্ত্র, ফ্রেডরিখ নিটশে প্রমুখরা এ-বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
জীবিত চিন্তকদের মধ্যে মিথ্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন সুইডিশ বংশোদ্ভুত আমেরিকান দার্শনিক সিসেলা বক। তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে লাইং: মরাল চয়েজ ইন পাবলিক এন্ড প্রাইভেট লাইফ, ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত এই বইটি মিথ্যা নিয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ রচনার অন্যতম। বইটিতে বক মিথ্যার প্রভাব, তাৎপর্য ও নৈতিক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করেন।

সিসিলা বলেন,- মিথ্যা বলা একটি জটিল নৈতিক সমস্যা। তিনি যুক্তি দেন যে কখনও কখনও মিথ্যা বলার মাধ্যমে ভালো উদ্দেশ্য অর্জিত হতে পারে, কিন্তু অবশ্যই তা নৈতিক বিবেচনার অধীনে থাকতে হবে। সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন স্তরে মিথ্যার ব্যবহার এবং এর পরিণতি বিশ্লেষণ করেছেন সিসেলা। তিনি যুক্তি দেখান, সরকারি সংস্থাগুলি কখনও কখনও মিথ্যা বলে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং এতে মানুষের বিশ্বাসের সংকট তৈরি হয়। এছাড়া বক ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও মিথ্যার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি দেখান, পরিবার এবং বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে মিথ্যা কিছু ক্ষেত্রে সংবেদনশীলতাকে রক্ষা করে আবার কিছুক্ষেত্রে এটি সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্তও করে। সিসিলাও অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের মতো চিন্তাভাবনা করার দিকে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেন এবং ব্যাক্তিক অভিজ্ঞতা ও নৈতিক ভিত্তির মাধ্যমে সত্য-মিথ্যা গ্রহণ বর্জনে ভূমিকা রাখতে প্ররোচিত করেন।

এখানে একটি বিষয় খুবই পরিষ্কার, যেসব চিন্তক মিথ্যা নিয়ে কথা বলেছেন সবাই কমবেশি মিথ্যাকে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকেই বিবেচনা করেছেন। যেহেতু ব্যাক্তিক, সামাজিক অবস্থানে মিথ্যা একটা বিভ্রান্তি তৈরি করে, প্রতারণার জন্ম দেয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ভুল দিকে নিয়ে যায়, ক্ষতিকারক পরিণাম তৈরি করতে পারে এই বিবেচনায় মিথ্যা বর্জনীয়। কিন্তু যেসব দার্শনিক পরিস্থিতিগত বিবেচনায় কোন কোন ক্ষেত্রে মিথ্যাকে গ্রহণ করতে বলেন তার পেছেনেও সক্রিয় হচ্ছে এক ধরনের ব্যাক্তিক ও নৈতিক বোধ, যা পঠনপাঠন ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে। মিথ্যার ক্ষেত্রে নৈরাজ্যবাদ কখনো কার্যকর হতে পারে না, যদি এরকম কিছুকে গ্রহণীয় হিসেবে বিবেচনা করতে হয় তাহলে অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে সামাজিক বিশৃঙলা। বিষয়টি সচেতনতার সাথে বিবেচনা করতে হবে।

Full Interview – Sissela Bok – Source – Business Ethics Pioneers YTC

বর্তমান সময়ে বসে আমরা দেখি মিথ্যার ছড়াছড়ি। বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে একদল মানুষ বিভিন্ন উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখে অনবরত মিথ্যা তথ্য ছড়ায়। গোয়েবলসীয়ধারার এই মিথ্যা একধরনের প্রোপাগান্ডার জন্ম দেয়। বিভিন্ন দেশে মার্কিন আগ্রাসনের আগে একধরনের মিথ্যা ন্যারেটিভ তৈরি করতে আমরা দেখি যাতে আগ্রাসনকে বৈধতা দেওয়া যায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে নানাধরনের মিথ্যা ন্যারেটিভ তৈরি হতে আমরা দেখেছি এবং এখনো দেখি। বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিক-মানসিকভাবে মূলগত দুটি অংশে বিভক্ত। ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ, যুদ্ধে জামাতসহ চীনাপন্থী বামদের ভূমিকা, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের ভূমিকা, ভারতের সাথে সম্পর্ক ইত্যাদি এর অন্যতম মূল কারণ। তাই প্রতিনিয়ত নানাধরনের মিথ্যা তথ্য প্রচার পায়। সত্য-মিথ্যা যাছাই করা অনেকক্ষেত্রে কঠিন হয়ে পড়ে। ২৪ এর আন্দোলনে এইরকম নানাধরনের মিথ্যা ব্যাপকভাবে প্রচার পায় এবং জনমানুষের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করতে সাহায্য করে

সার্বিকভাবে বলা যায়,- সত্য-মিথ্যা আপেক্ষিক;- দৃষ্টিভঙ্গিগত বিষয়। নিজের বোধ-বুদ্ধি বিবেচনা ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়ে তার অন্তরাল সন্ধান করতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন সৃজনশীল মন, একটা শক্তিশালী নৈতিক বোধ, সর্বোপরি দর্শনের সাথে গভীর সংযোগ। হয়তো এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই জটিলতা থেকে উত্তরণ সম্ভব।

. . .

মিথ্যা একটি শিল্প, যেটি কার্যকর সত্য জন্ম দিতে থাকে
(অথ স্লাভয় জিজেক সমাচার)


সত্য এবং মিথ্যা নিয়া স্লাভয় জিজেকের আলাপ মজাদার জাভেদ। দ্বান্দ্বিক মার্ক্সবাদী হিসেবে জিজেকের কাজই হইতেছে প্রচলিত পথটারে ভেঙে দেওয়া। আপনি যেভাবেই ব্যাখ্যা করেন, জিজেক সেখানে হাজির থাকার মানে হইতেছে উনি আপনার ব্যাখ্যার বিপরীতে একটা দ্বন্দ্ব পয়দা করে একে ভেঙে দিবে।

যাই হোক, কাজের কথায় আসি। স্লাভয় জিজেকের কথা হইতেছে, সত্য বলি আর মিথ্যা… এর সবটাই ডেটা এবং ফ্যাক্টসের উপ্রে নির্ভর করবে। বক্তব্যের শুরুতে লাঁকার রেফারেন্স টানছেন জিজেক। লাঁকা উনার কোনো এক লেখায় অথবা বক্তব্যে সন্দেহবাতিক স্বামীর আলাপ নাকি তুলছিলেন। নিজের বউকে বিনা কারণে সন্দেহ করত সে। বউ তার চোখ ফাঁকি দিয়া অন্য লোকের সঙ্গে পরকীয়া করে, সন্দেহটা মজ্জাগত ছিল মনে। সত্য হইতেছে বউটি ওই ধাঁচের ছিল না। এমতাবস্থায় বউয়ের উপ্রে তার সন্দেহকে আমরা অযথা বা মিথ্যা ধরে নিতে পারি।

As These Are the Facts by Rafel Bestard (2022); Source: www.reddit.com

লাঁকার মত এখানে ভিন্ন। উনার মতে, বউয়ের উপ্রে অযথা সন্দেহের কারণে লোকটা মিথ্যায় আচ্ছন্ন ধরে নেওয়া সঠিক হবে না। জেলাসি বা ঈর্ষা হইতে সে এইটা করতেছে। বউকে সে ভালোবাসে। বউয়ের জীবনে অন্য পুরুষের আগমন সহ্য করা কাজেই তার পক্ষে কঠিন। ঈর্ষা এখানে এমন এক ফ্যাক্ট যেটি তার অস্তিত্বের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। ঈর্ষা যদি না থাকে তাহলে তার সত্তা ভঙ্গুর হইতে বাধ্য। মিথ্যা সন্দেহের কারণে আমরা এখন লোকটারে দোষী করতে পারি, কিন্তু এতে করে সন্দেহটা বাতিল হয়ে যায় না। ওই লোকের জীবনে বউকে সন্দেহ করা এমন একখান ফ্যাক্টে পরিণত হইছে যেটি তার অস্তিত্বের অংশ। সুতরাং একে বাদ দিয়া লোকটারে ডিফাইন করা কঠিন।

আজব যুক্তি খাড়া করছেন লাঁকা! ঈর্ষার চোটে লোকটি যে ওদিকে বউয়ের জীবন নরক করে তুলতেছে, এখন এর প্রতিকার কী? উক্ত বিষয়ে লাঁকা কিছু বলছিলেন হয়তো। জিজেক আবার সেদিকে গমন করেন নাই। লাকাঁভক্ত সলিমুল্লাহ খান কী কারণে তসলিমা মুনকে ভালোবেসেও ঘর করতে পারলেন না, তার জন্য এই ফরাসি ভাবুককে আসামি করা যাইতে পারে।
. . .
স্লাভয় জিজেক অতঃপর উনার স্বভাবসুলভ মজাদার ভঙ্গিতে গমন করছেন মূল কথায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি নিধনের প্রসঙ্গ টানছে উনি। তাঁর মতে, ইহুদি নিধন বা হোলোকাস্ট ঘটছে;- এইটা ধ্রুব সত্য। ফ্যাক্ট হিসেবে নিধনযজ্ঞকে অস্বীকার যাওয়ার সুযোগ নাই। এখন ইহুদির কাছে নিধনযজ্ঞটা ফ্যাসিস্ট বর্বরতা হিসেবে গণ্য। হিটলারের আদেশে নাজিরা পরিকল্পিতভাবে তাদেরকে নির্মূল করতে চাইছিল ওইসময়। সংখ্যালঘু ও উদ্বাস্তু হইলেও ইউরোপে তারা সকল দিক থেকে অগ্রসর ছিল। হিটলার এখন যে-অজুহাত খাড়া করে নিধনে নামলেন, সেইটকে আমরা কী ধরব তাহলে? আমরা কি বলব হিটলার মিথ্যার উপ্রে দাঁড়িয়ে নিধনটা ঘটাইছে?

স্লাভয় জিজেক এখানে এসে ট্রিকি। বলতেছেন,- হিটলারের সমস্যাটি সত্য বা মিথ্যা দিয়া যাচাই করা কঠিন। ডেটা এবং ফ্যাক্টস আমলে নিয়া যা করার করছিল সে। ইহুদি সংক্রান্ত যত ডেটা নাজিরা তখন গোনায় ধরছে, এর ভিত্তিতে তাদের ইহুদি সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠছিল। সেখান থেকে ন্যারেটিভে গেছে তারা। সিদ্ধান্ত নিছে,- ইহুদি জাতটারে ফিনিশ করতে না পারলে জার্মান জাতিকে উচ্চাসনে বসানো যাবে না। নিধনযজ্ঞের পরিকল্পনা এভাবে ফ্যাক্টকে ব্যবহার করে দানবীয় আকার নিছিল তখন।

জিজেকের কথাগুলাকে যদি সারসংক্ষেপ করি তাহলে বলতে হয়,- ডেটা যে-ফ্যাক্টগুলা সামনে নিয়া আসছিল তার ভিত্তিতে সত্য নিরূপিত হইতেছে। হিটলার এর উপ্রে ভর দিয়া বয়ান তৈরি করছে। মানুষের কাছে সেই বয়ান প্রচার ও বিশ্বাসযোগ্য করতে ত্রুটি করে নাই। জিজেক এই পর্যায়ে এসে বলতেছেন,- এখানে ইহুদিরা সত্য বলতেছে নাকি নাজিরা… এর কোনো ভ্যালু নাই। সোজা কথা রিলেটিভিজম বা সত্য ও মিথ্যা আপেক্ষিক ইত্যাদি দিয়া বিচার করা যাবে না। এখানে অমরা বলতে পারি,- ইহুদিদের ব্যাপারে হিটলারের ব্যবহৃত ফ্যাক্টগুলা সত্য ও মিথ্যার চাবিতে পরিণত হইছিল। আমরা এখন বুঝি,- সে ভুল ডেটা হাতে নিছিল; কিন্তু ভুল ডেটা যেসব ফ্যাক্ট হাজির করতেছে সেখানে, হিটলারে কাছে এর ভ্যালু মারাত্মক ছিল। আদতে মিথ্যাকে সত্য ধরে শক্তিশালী ন্যারেটিভ নাজিরা তৈরি করছিল,- যার পরিমাণ এই ইহুদিনিধন।

. . .
জিজেকের ডায়ালেকটিক্যাল নোটেশন শ্রবণে আরেকবার টাসকি খেলাম। জিনিস একখান এই বলকান! বইলা রাখা ভালো, জিজেক সকল প্রকার আধিপত্য ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বরাবর সক্রিয়। কিন্তু এগুলাকে দেখার ভঙ্গি উনার ওই নব্য মার্ক্সবাদী ভাবুকতার কারণে সকলের থেকে পৃথক। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে কি আমরা জিজেকের মতামতের আলোকে ভাবতে পারি? ডেটা এবং ফ্যাক্ট তো এখানেও ফ্যাক্টর মনে হইতেছে। যার উপ্রে অতিকায় মিথ্যাকে সত্য বইলা কার্যকর দেখতেছি আপাতত। প্রশ্নটি ঘুরতেছে মাথায়।
. . .

The Most Efficient Lies Reproduce Only Factual Data – Zizek Source – Philosophy Overdose YTC

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *