মাঝেমধ্যে ভাবি,—এই দেশে মার্কেজের জন্ম হলে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে নিয়ে জমিয়ে লিখতেন। কী নেই তাঁর মধ্যে! দ্বৈত ও বিচিত্র। সহ্য করার পক্ষে গুরুভার, তথাপি কমিক হওয়ার কারণে সহনীয়। দেখতে সুদর্শন ও রমণীমোহন। কবি ও প্রেমশিকারি। ভং ধরতে ওস্তাদ। এই দূরদর্শী তো পরক্ষণে বিদূষক। প্রায় এক দশক জাতি তাঁকে মসনদ দখলে রাখতে দেখেছিল। পরের দুই দশক দাবার বড়ে হয়ে বিচরণ করেছেন রাজনীতির ময়দানে। এরশাদের জীবনজার্নি কাজেই রিয়েলিটি ও ফিকশনে বোনা গোলকধাঁধা! অন্য সামরিক জান্তার মতো রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার রূপে যাঁকে কল্পনা করা বেশ কঠিন।
লাতিন সিনেমাকার পাবলো লারেন এল কোন্দে-র (The Count) ফ্যান্টাসিঘন বয়ানে পিনোশেট ও মার্গারেট থ্যাচারকে এই ছকে পর্দায় তুলে ধরেছিলেন। পিনোশেট-থ্যাচারের দলে পড়লেও এরশাদকে ড্রাকুলা বা ভ্যাম্পায়ার ভাবাটা দুরস্ত ঠেকে না। তিনি এই জনপদে সাক্ষাৎ মানিয়ে যায় এরকম বহুরূপী ছিলেন। বাস্তবতাকে নিমেষে কাল্পনিকে বদলে দিতে যাঁর জুড়ি মেলা ভার!
নিজের তৈরি ফিকশনজালে স্বেচ্ছাবন্দি বিদূষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেও জাতি এই জেনারেলকে অনেকবার দেখেছে। ক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখতে সংবিধানকে তিনি ক্ষতবিক্ষত করলেন। ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করতে দ্বিধা করলেন না। প্রতিবাদ দমনে আগ্রাসী থেকেছেন, তথাপি ওই সময়কার রাজনৈতিক আন্দোলনে প্রবল ভূমিকায় অবতীর্ণ ছাত্র রাজনীতিকে ঘুঁটি হিসেব ব্যবহারের ভাবনা তাঁকে কাবু করেনি। এটি একদিক থেকে তাঁর পতনকে ত্বরিত করে তুলেছিল।
পঁচাত্তরে ক্ষমতার পটপরিবর্তন যে-ভয়াল অমানিশা ও রাজনৈতিক গুটিবাজি দেশে অমোঘ করেছিল, তার সঙ্গে তুলনায় এরশাদের আমলকে সহনীয় ভাবা যায় কি? প্রশ্নটির মধ্যে নিহিত ইতিনেতিকে বিবেচনার অবকাশ এখন তৈরি হয়েছে। সুবিধাবাদকে বৈধ করে তুলবে এরকম একটি স্পেস মনে হয় তিনি তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তাঁর মনে এই ভাবনা কাজ করছিল,—বিরোধীরা অপছন্দ করতে পারে তবে জনগণ তাঁকে অসহনীয় ভাবছে না। এরশাদকে নিয়ে প্রশ্নটি অগত্যা তোলাই যায়,—তিনি কি একালের অনেক শাসকের মতো কর্তৃত্ববাদী? কর্তৃত্ববাদের নতুন যে-স্বরূপ বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে আমরা কমবেশি ব্যাপক হতে দেখছি, এখন এর সঙ্গে তাঁর আমলে দেখা দেওয়া কর্তৃত্ববাদকে অভিন্ন ভাবা কি সম্ভব?
ক্ষমতা ও রাজনৈতিক অস্তিত্বের প্রশ্নে বিরোধীকে দমনের অপকৌশল, আর নিজের কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করতে তাকে নিস্তেজ করে ফেলায় ব্যবধান রয়েছে। এরশাদকে এদিক থেকে যে-পরিমাণ কৌতুককর দেখায়, সমপরিমাণ আগ্রাসী তিনি হতে পেরেছিলেন কি? কথাটি বলছি এ-কারণে,—দ্বৈত ভূমিকায় সবাক শাসককে মানুষ ক্ষমাঘেন্না করতে কসুর করেনি।
নয় বছর কবি ও ক্যাসোনোভায় রঙিন এরশাদ তথাপি জাদরেল সেনানায়ক ও রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। জাতিকে ক্ষুব্ধ করা ছাড়া বড়ো একটা হাসাতে পারেননি। মসনদহারা এরশাদ সেক্ষেত্রে নিখাদ বিনোদনের খোরাকে পরিণত হয়েছিলেন। জাদরেল দুই রমণীচিপায় কী করে নিজের কারাগার গমন ঠেকানো যায় এই ভাবনায় তাঁর দিন কাটত।
জাদরেল সেনাশাসক থেকে কৌতুক-অভিনেতায় এরশাদের রূপান্তর সত্যি অভিনব! গিরগিটির মতো ক্ষণে-ক্ষণে রং পালটানো শাসক জাতির সাহিত্যিক বয়ানে প্রচণ্ড অবহেলিত। তাঁকে নিয়ে যেটুকু রচনা তার সবটাই একপেশে। এই দেশে মার্কেজ পড়ুয়ার অভাব নেই, তবে জাদুবাস্তবতাঘন পরিহাসে এরশাদকে নিয়ে লেখার মতো লোকের বড়ো অভাব।
. . .
. . .