যে ভাষাকে আক্রমণ করে, সে-ই ভাষাকে বাঁচায় : কমলকুমার মজুমদার
. . .
ভাষার ওপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ আখেরে কাজে আসে না। পাহারা ও বিধিনিষেধের বাড়বাড়ন্ত তাকে বরং চতুর হইতে সাহায্য করে। আঁকিয়ে সত্যজিৎ চক্রবর্তীর ছোট্ট একখানা ফেসবুক পোস্ট আচমকা নজরে আসার সুবাদে কথাখান ইয়াদ করতে হইতেছে। শেখ হাসিনার সরকারকে দেশছাড়া করার সুবাদে ফ্যাসিবাদ নিয়া জিকির-আজগার বাংলাদেশে এই মুহূর্তে চরমে আছে। ঊনপোস্টে প্রসঙ্গটির অবতারণা করে সত্যজিৎ বলতেছেন,- বাংলাদেশের মাটি বরাবর ফ্যাসিজম চর্চার উৎকর্ষ একখান ঘাঁটি ছিল। দেশে এ-পর্যন্ত যারা মসনদে আরোহন করছেন তারা সকলে কমবেশি ফ্যাসিবাদী ছিলেন।
সেইসঙ্গে এই বিষয়খানা সত্যজিৎ আমলে নিতেছেন,- হাসিনাপার্টি গেল পনেরো বছর যে-ফ্যাসিবাদ এখানে চর্চা করছেন, তাকে প্রতিহত করার মতো ঘোড়েল ফ্যাসিস্টের অভাব তথাপি দেশে ছিল। ড. ইউনূস নামধারী পুতলাকে গদিতে বসিয়ে পেছনে খেলতে থাকা লাল বিপ্লবীরা ঘাটতিটা অবশেষে ভালোমতন নিভাইতেছেন। উনাদের কল্যাণে ফ্যাসিজমের নতুন সব রূপ আমরা প্রতিদিন দেখতেছি। এমতাবস্থায় উপসংহারে যাওয়া যাইতে পারে,- ফ্যাসিবাদী খাসলত যে-দেশে একবার জন্ম নেয়, সেখানে কিছুদিন অন্তর এর চর্চা হইতে থাকবে।
সত্যজিতের বক্তব্যে সহমত হওয়ার অর্থ এইটা না,- উনি যা বলছেন তার সবটা সঠিক বইলা মানতে হবে। মন চাইলে তর্ক করা যাইতে পারে, তবে আপাতত না করলে ক্ষতির কারণ নাই। ফেসবুকে উনি যেভাবে এই পোস্টটা উপস্থাপন করছেন সেইটা নিয়া বরং আলাপ অধিক জরুরি এখন। শপাঁচেক শব্দ দিয়া সাজানো বক্তব্যে ফ্যাসিস্ট, ফ্যাসিজম, মিলিটারি, বৈষম্যবিরোধী, এবং সেইসঙ্গে লীগ সম্পৃক্ত শব্দগুলাকে অবলিক বা তির্যক চিহ্ন (/) দিয়া ভেঙে দিছেন সত্যজিৎ। টাইপো মিস্টেক অবশ্যই না। উনি যে-শব্দগুলা ব্যবহার করছেন সেগুলার উপ্রে মার্ক জুকারবার্গের ফেসবুক অ্যালগরিদম কি গণহারে সেন্সর আরোপ করতেছে ইদানীং? অ্যালগরিদম ফাঁকি দিতেই কি ট্রিকসটা খেললেন আঁকিয়ে?
কেবল উনি হলে কথা ছিল, আরো অনেককে এভাবে পোস্ট দিতে দেখছি। আরজি কর কাণ্ডে শরিক পশ্চিমবঙ্গের কবি-লেখক-সেলেবরা অ্যালগরিদমের পাহারা ফাঁকি দিতে ট্রিকসটা প্রচুর ব্যবহার করছেন। সত্যজিৎ যদি সে-কারণে এভাবে পোস্ট দিয়া থাকেন তাহলে বুঝতে হবে,- মতপ্রকাশ ও বাকস্বাধীনতার পরিসর বইলা বিদিত ফেসবুক এখন আর স্বস্তির জায়গায় নাই। হোয়াটাসঅ্যাপে যে-প্রভিশন জুকারবার্গ এখনো বহাল রাখছেন, ফেসবুকে এসে সেইটা জারি থাকতেছে না। কড়া পাহারা বসাইছেন জুকা। বসাইছেন ভালো কথা, কিন্তু পাহারা এড়ানোর উপায় মানুষ ঠিকই বের করে নিতেছেন। এর থেকে দুটি বিষয় আমরা বিবেচনায় নিতে পারি :
(ক) ভাষাচর্চার স্বীকৃত বিধিবিধানে পরিবর্তন আসন্ন। সত্যজিতের অবলিক বা তির্যক চিহ্নগুলা স্বয়ং শব্দ ব্যবহারের সর্বজনমান্য প্রথাকে চ্যালেঞ্জ জানাইতেছে। তির্যক চিহ্ন দিয়া এতদিন আমরা বিকল্প ও বিপরীত অর্থ বোঝায় এরকম শব্দগুলাকে পাশাপাশি উপস্থাপন করছি। বিধি ভঙ্গ করে আনেকে আবার সমার্থক শব্দকে তির্যক চিহ্নের সাহায্যে পাশাপাশি লিখতে দ্বিধা করেন নাই। সাহিত্যিক প্রয়োগের প্রয়োজনে কাজটি করছেন উনারা। অভ্যস্ত হওয়ার কারণে এসব নিয়া কেউ প্রশ্ন তোলেনি। মিস্টার জুকারবার্গের কারণে তাগিদটা এবে নতুন বাঁক নিতেছে মনে হয়।
তির্যক চিহ্নে ব্যবহার নিছক বিপরীত কিংবা সমার্থক শব্দে আবদ্ধ নাই, আস্ত বা অখণ্ড শব্দকে তির্যক (/), হ্যাশ (#), ডট (…), অ্যাট দ্য রেট (@) ইত্যাদির সাহায্যে নেটিজেনরা হামেশা ভেঙে দিতেছেন। শব্দের অর্থ ধরতে তাতে খুব-যে অসুবিধা হইতেছে সেইটা বলা যাবে না। অখণ্ড শব্দের কাঠামোয় ভাঙনের ফলে নতুন অর্থ হয়তো তৈরি হইতেছে না কিন্তু আদলটা আর অবিকল নাই সেখানে। ভাষাকাঠামোয় অপিরিচিতিকরণ অর্থাৎ ডিস্টর্শন এই বার্তাটি জানান দিতেছে,- পাহারা ও নিয়ন্ত্রণ বসাইতে পারো কিন্তু এসব দিয়া আমারে আটকে রাখা যাবে না। এখন থেকে আমি আরো বেশি অনির্ধারিত হইতে থাকব ক্রমাগত।
ভাষার স্বাধিকার ও স্বেচ্ছাচারিতা আমলে নিলে পরিবর্তনটা সাধারণ ঘটনা মেটেও নয়। আমার ধারণা, কবিরা অচিরে সাইনোলজির নতুন প্রয়োগটারে কবিতায় সাদরে গ্রহণ করতে বাধ্য হবেন। জর্জ অরওয়েল উনার 1984 উপন্যাসের কাহিনিছকে Big Brother is Watching প্যারাফ্রেজটি ব্যবহার করছিলেন। কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিকরা এখন এর সারার্থ পুনরায় অনুভব করবেন বইলা মনে হয়। ভাষার ওপর পাহারা ও নিয়ন্ত্রণকে অস্বীকার যাওয়ার প্রয়োজন সামনে আরো তীব্রভাবে অনুভূত হইতে থাকবে। যতিচিহ্নের সঙ্গে সম্পৃক্ত সিম্বল ধার করে শব্দের পরিচিত আদল কাজেই ভেঙে দিতে উনারা আপত্তি ঠুকবে না।
(খ) ভাষা অশ্লীল হইতে থাকে যখন আমরা তারে অতিরিক্ত মাত্রায় আভিধানিক গণ্য করতে থাকি। কলিম খান হয়তো একমাত্র যিনি এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হইছিলেন। উনার কোনো এক বইয়ে আম শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক ব্যাখ্যা পাঠ করে আমার মাথা বনবন করে ঘুরতেছিল। একটা শব্দের ভিত্রে এতগুলা ক্রিয়া বা ঘটনা সংগোপন থাকে, ইতিহাসের খুঁটিনাটি নিষ্ক্রিয় অবস্থায় জারি থাকে ভেবে ভিড়মি খাইছি তখন।
কলিম খানের বক্তব্য গোনায় নিলে স্বীকার যাইতে হবে,- বাংলা সাহিত্যে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দের প্রয়োগ ও তার মধ্য দিয়া শব্দের নবনব প্রতীকী অর্থ তৈরির মওকা থাকলেও আমরা সেই কাজে কামিয়াবি হাসিল করতে পারি নাই। ভাষার ছিরিছাদে বড়ো আকারের বিবর্তন ঘটতে যে-কারণে বিলম্ব হইতেছে। বাংলা ভাষার কবিগণ এইটা ভালো টের পাওয়ার কথা। উনাদের মস্তিষ্কের সুড়ংয়ে অনেকসময় যে-বিদ্যুৎ চমকায়, এখন লাগসই শব্দের অভাবে তারে আর নামানো যায় না। মস্তিষ্কের গহন কোটরে চমকটা চিরতরে নিরুদ্দেশ হয়।
. . .
সত্যজিৎ চক্রবর্তীর উদ্দেশ্যমূলক ভাঙন কাজেই আমার কাছে ওই ক্রিয়াভিত্তিক শব্দগঠনের বেশ নিকটবর্তী বইলা মনে হইতেছে। জানি, কলিম খান কথাটা শুনলে কষ্ট পাইতেন। শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক ও প্রতীকী অর্থ তৈরির বয়ান উনি ও রবি চক্রবর্তী যেভাবে ব্যাখ্যা করে গেছেন, হরিচরণের পর দুজনে মিলে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দের অভিধান আমাদের জন্য রেখে গেছেন… আমার ভাবনা সেই বয়ানের উপযোগী না। এর জন্য কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর নিকট ক্ষমা চাইতে আপত্তি নাই। সত্যজিতের ফেবু পোস্টে ব্যবহৃত শব্দবিন্যাসের সুবাদে উনাদের থিয়োরিকে ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে ভাবার অবকাশ আছে বইলা মনে হইতেছে। বাংলাসহ পৃথিবীতে যত ভাষা চালু আছে সেখানে শব্দ মাত্রই প্রতীকী অর্থ বহন করে বা সেই অর্থে নির্দিষ্ট অর্থে অবরুদ্ধ থাকা তার স্বভাব। সময়টানে প্রতীকী অর্থে অবরুদ্ধ সেই শব্দে নতুন অর্থ যোগ হইতে পারে এবং সচরাচর হয়ে থাকে।
যম শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক বুৎপত্তির ইতিহাস বাদ দিলেও হিন্দু পুরাণগুলার সুবাদে তার যে-বয়ান আমরা জানি, সেখান থেকে উনার কাজের ধারা ভালোই ঠার করা যায়, যাকে দিয়া এবে ফ্যাসিজমকে স্থানান্তরিত করা সম্ভব। ফ্যাসিজম নয়, আমরা অনায়াস লিখতে পারি ফ্যাসিযম।
যোগ-বিয়োগ যাই ঘটুক, শব্দের অর্থ সেখানে প্রতীকী বা সিম্বলিক। ক্রিয়াভিত্তিক শব্দ সেরকম না। প্রতিটি বর্ণ বা অক্ষরকে কেন্দ্র করে যত শব্দ হরিচরণ বা কলিম ও রবি প্রণীত অভিধানে গমন করলে পাই, তার উদ্ভবের নেপথ্যে সুনির্দিষ্ট ক্রিয়া নিহিত ছিল। একটা শব্দ কেবল মিনিং বা অর্থ প্রকাশক না। কোনো একটা ক্রিয়া বা কর্ম সম্পাদনের জের ধরে শব্দটি জন্ম নিতে থাকে। এই জায়গা থেকে মনে হইল সত্যজিতের ওই তির্যক চিহ্ন বসিয়ে শব্দকে ভেঙে দেওয়া এর প্রতীকী অর্থকে বিপন্ন করতেছে। শব্দটা অদ্য ডট, অবলিক, হ্যাশ, অ্যাট দ্য রেট এরকম সব চিহ্ন মাঝখানে বসানোর কারণে বর্ণভিত্তিক ভাষায় ফেরত যাইতেছে। তাদের অর্থকে আমরা অনির্দিষ্ট ও অনিশ্চিত গণ্য করতে বাধ্য এখন। যেন তারা দেরিদীয় তরিকায় পুনর্বিবেচিত হওয়ার অবকাশ দিতেছে আমাদের।
ফ্যাসিস্টের কাজকারবার আদতে মরণতুল্য, যমরাজ হয়ে মানুষের উপ্রে নিজের কাজবাজ চালাইতে থাকে সে। কাজেই এখানে ইজম-এ নিহিত প্রতীকী অর্থটারে ভাঙতে ফ্যাসিযম লেখা যাইতে পারে। যম কে বা কী-কারণে তার এহেন নামকরণ, সেইটা হয়তো কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী জীবিত থাকলে ব্যাখ্যা দিতে পারতেন, তবে যম শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক বুৎপত্তির ইতিহাস বাদ দিলেও হিন্দু পুরাণগুলার সুবাদে তার যে-বয়ান আমরা জানি, সেখান থেকে উনার কাজের ধারা ভালোই ঠার করা যায়, যাকে দিয়া এবে ফ্যাসিজমকে স্থানান্তরিত করা সম্ভব। ফ্যাসিজম নয়, আমরা অনায়াস লিখতে পারি ফ্যাসিযম। জুকারবার্গের অ্যালগরিদমের কাছে শব্দটা এখনো অপিরিচিত। তাকে যদি এর ব্যাপারে ইনপুট দেওয়া হয় তখন আবার শব্দটাকে ধরবে সে। অসুবিধা নাই, ফ্যাসিযম-এর মাঝখানে গাণিতিক অথবা অন্য চিহ্ন বসিয়ে নতুন অপিরিচিতকরণে আমরা যাবো তখন।
যা-কিছু মাুনষের স্বাধিকারকে চরমভাবে বিপন্ন করে নিজের মত ও আদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার কারণে, তার সবটাই ওই যমদূতের সোদর। সুতরাং অদ্য হইতে ফ্যাসিজম বা ফ্যাশিজমকে ফ্যাসিযম/ ফ্যামিযম অনায়াস ভাবা যাইতে পারে। বাত এটুকুই। নিচে সত্যজিতের বক্তব্য থাকতেছে। আপনারা ভাবতে পারেন, যদি ইচ্ছা করেন।
. . .
সত্যজিৎ চক্রবর্তীর ফেসবুক পোস্ট
না/ৎসি/দের দেশে ফ্যা/সিস্ট গভমেন্ট অবশ্যম্ভাবী। আ/লিগ গেলে বিএ/নপি, গেলে বাম, গেলে রাম, গেলে মিলি/টারি, বৈষম্য/বিরোধী সবাই ওই ফ্যাসি_জম চর্চাই করে। এতদিন মূলত লি/গের কাউন্টার ফ্যাসি—জম শক্তিশালী ছিলনা তাই লি—গের বিকল্প আসেনি। এখন সেটা হইছে তাই অন্য ফ্যাসি_স্ট আসছে। আবারো বলছি যেখানে একবার নাৎ—সিজম দেখা গেছে সেখানে কিছুদিন অন্তর অন্তর ফ্যাসি—জম চর্চা হবে।
(যারা ভিন্নমতকে হ—ত্যার সায় দেয় উদাহরণ পূর্ব পশ্চিম থাকাকালীন এদেশের একটি গোষ্ঠীর সহায়তায় ত্রিশ লাখ মানুষ গণ—হত্যার শিকার হয়েছিল যার বেশিরভাগ ছিল নন মুসলিম ও হিন্দু জনগোষ্টি দুইলাখ নারী শিশু বৃদ্ধা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন)
এদের হিরো হিট/লার …
@Sattyazit Chakrabarty@
. . .