জাতির ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় বিশ্বে তুলে ধরতে যেসব চিহ্ন বা উপাদান আবশ্যক হয়ে ওঠে তার অনেকগুলো আমাদের রয়েছে। একটি স্বাধীন দেশ ও জনজাতির পরিচয় বোঝাতে জাতীয় পতাকা ও সংগীত ছাড়াও জাতীয় ফুল, ফল, মাছ, পশু, পাখি ইত্যাদি আমরা বেছে নিয়েছি। জাতীয় সংগীত নিয়ে হাসিনা সরকারের সময় নানা বিতর্ক উসকে দেওয়ার চেষ্টায় যদিও কমতি ছিল না। শেখ হাসিনা বিদায় নেওয়ার পর পুরোনো বিতর্কটি ফের সচল হয়ে ওঠে। আট বছর ধরে আয়নাঘরে চোখের আসু মুছতে-মুছতে কাহিল গামছাবাবা হিন্দু রবি ঠাকুরের লেখা থেকে নেওয়া জাতীয় সংগীত নাকচ করে বসেন। দেশ জুড়ে তখন অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। তার মধ্যে জাতীয় সংগীত বদলানোর প্রস্তাব নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মাতন শুরু হয়।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে শরিক কর্নেল অলি আহমেদসহ আরো অনেকে গামছাবার সঙ্গে সুর মিলিয়ে রবি ঠাকুর উচ্ছেদে ঘি ঢেলেছেন সমানে। একাত্তরের রণাঙ্গনে তিনি স্বয়ং জয় বাংলা শ্লোগান আর আমার সোনার বাংলা গানটি গাইতে-গাইতে দেশ থেকে পাকি সেনা তাড়ানোর শপথ নিয়েছিলেন;- সে আর মনে ছিল না বেচারার! হুমায়ুন আজাদের প্রবচনকে অমর প্রমাণ করতে কিছু বাকি রাখেননি এই মুক্তিযোদ্ধা। আজাদ বলেছিলেন বটে : একবার রাজাকার মানে চিরকাল রাজাকার; কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা মানে চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা নয়। কর্নেল অলি ভালোভাবে সে-প্রমাণ প্রতিনিয়ত দিয়েই যাচ্ছেন!
গতিক দেখে মনে হাচ্ছিল জামায়াত প্রযোজিত গজল ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি সোনার চাইতে খাঁটি গানখানাকে তাঁরা জাতীয় সংগীত করেই ছাড়বেন। ঊনিশশো একাত্তর সনে ইঞ্চি-ইঞ্চি মাটি রক্ষায় জামায়াতের ভূমিকা কী ছিল সেটি জাতির অজানা নেই অবশ্য! কর্নেল অলি আহমদ বেমালুম ভুলে গেলেও আরো অনেকের মনে ক্ষতটি এখনো জাগ্রত বটে। তাঁরা কেউ এতদূর ভীমরতিগ্রস্ত হয়ে পড়েননি যে দেশ স্বাধীনের লড়াইয়ের আমার সোনার বাংলা গানটির অসামান্য অবদান ভুলে যাবেন। কর্নেল অলির মতো বানোয়াট বয়ান হাজির থেকে কাজেই বিরত ছিলেন তাঁরা। গানটির সঙ্গে বিপুল সাধারণের বালেগ হওয়ার স্মৃতিতে সরাসরি আঘাত হেনে বসেছিলেন গামছাবাবা ও কর্নেল অলি আহেমেদের মতো লোকজন।
কেবল তাই নয়, শাকুর মজিদের মতো কিছু লোক চরম অসংবেদনশীল মন্তব্য করছিলেন তখন। হাসিনা পতন পরবর্তী দেশের বাজে অবস্থা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছিলেন যে,- জাতীয় সংগীত নিয়ে মাতন কাউকে দেশপ্রেমিক বলে প্রমাণ করে না। অতীতে হাজারকণ্ঠে জাতীয় সংগীত ইত্যাদি লোকজনকে দিয়ে গাওয়ানো হয়েছে, তাতে ফল তো কিছু মিলেনি। জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত এসব নিয়ে বেহুদা লাফালাফি বাদ দিয়ে সকলের উচিত উৎপাদশীল কাজে মন দেওয়া, যেন জাতি এভাবে তরক্কি হাসিল করতে পারেন ইত্যাদি।
শাকুর মজিদের মন্তব্য প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কেবল অসংবেদনশীল ছিল তা নয়;- মূঢ়তার পরিচয় ভালোই দিচ্ছিলেন এই মানব্যর সুশীল। জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, মাজার ভাঙার মতো ঘটনাগুলো ওইসময় কারা সামনে নিয়ে এসেছিল? মানুষকে পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্ত হওয়ার রাজনীতির দিকে ঠেলে দিতে মজবুর করেছিল? প্রশ্নগুলো তাঁর মনে একবারও জাগেনি। দেশে চলমান বিশৃঙ্খলায় মানুষজন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে তখন ত্রুটি করেনি। সদ্য মসনদে বসা সরকারের ওপর এভাবে চাপ তৈরি করছিল তারা। এর পাশাপাশি এসব অনাসৃষ্টি নিয়ে একদল কথা বলছিলেন। শাকুর মজিদ তার কিছু বিবেচনা না করে রায় দিয়ে বসলেন,- জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত নিয়ে এতো দরদ দেখানোর কিছু নেই। এগুলো আদৌ কাউকে দেশপ্রেমিক প্রমাণ করে না। জাতিকে দেশপ্রেম শেখানো সুশীল ভুলে গিয়েছিলেন,- বাংলাদেশের মতো বিশৃঙ্খল রাষ্ট্রে সকল আলাপ প্রাসঙ্গিকতা রাখে।
দেশকে কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় ইত্যাদি আলাপের সঙ্গে জাতীয় পতাকা ও সংগীত নিয়ে বানোয়াট বয়ান তৈরির চেষ্টার সমালোচনায় তীব্র হতে থাকা আলাপও সমান গুরুত্ব রাখে। স্বাধীন যে-ভূখণ্ডে দাঁড়িয়ে শাকুর মজিদ জাতিকে দেশপ্রেমের সবক দিচ্ছিলেন এখন সেই ভূখণ্ডের সুবাদে কিন্তু উনি কেউকেটা লোক হয়েছেন। মাজার ও বাউলকে ঘিরে সচল লোকসংস্কৃতিকে ক্যামেরায় ধারণ করে নাম-প্রতিপত্তি কামিয়েছেন বেশ! কী আশ্চর্য! এখন সেই লোকগুলো যেসব প্রতীকের ওপর ভর দিয়ে নিজেকে ভাষা দিয়ে এসেছে এতদিন,- তাদের বিপন্নতা তাঁকে একটুও স্পর্শ করছে না! দেশগঠনের আলাপ তোলে পাশ কাটাতে চাইছেন! জামায়াত আর মোল্লাদের অনাসৃষ্টিকে বৈধতা দিতে বুকের কলিজা কেঁপে উঠছে না তাঁর! এই হলো দেশের তথাকথিত সুশীল বুদ্ধিজীবীদের স্বরূপ। হাওয়া বুঝে ভোল পালটাতে উনারা চিরকাল ওস্তাদ বটে!
যাই হোক, আপামর সাধারণের অনুভূতিতে গামছাবাবা মারাত্মক আঘাত হেনে বসেছে বুঝতে পেরে ইউনূস সরকার আর আগে বাড়ার সাহস করেনি। জাতীয় সংগীত আপাতত বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় তারা। মওকা পেলে অবশ্য বদলানোর চেষ্টা তারা ঠিকই করবেন। সংবিধান সংশোধনের দায়িত্ব কাঁধে সক্রিয় জনাব আলী রিয়াজ যার ইঙ্গিত আগেভাগে দিয়ে রেখেছেন বৈকি! জাতির পরিচয় তুলে ধরার বিবিধ অনুষঙ্গ কাজেই সুযোগ পেলে নিমিষে বদলে দেবে উনারা। তো এসব ঘাপলার মধ্যে জাতীয় নৃত্যের প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ হাস্যকর ও অবান্তর মনে হতে পারে। প্রসঙ্গটি নিয়ে তথাপি আলাপের প্রাসঙ্গিকতা নেই বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে সংস্কৃতির সামগ্রিক স্বরূপ বলতে আমরা যেটি বুঝি, সেখানে নৃত্যশৈলীর ভূমিকা গৌণ নয়। সুতরাং আলাপটি এখানে টুকে রাখছি আমরা। পরে সময়-সুযোগ বুঝে নাহয় আরো বিস্তারিতে যাওয়া যাবে।
. . .
ভারত উপমহাদেশ নৃত্যকলায় বরাবর সমৃদ্ধ। ভারতনাট্যম, কত্থক, কথাকলির মতো ধ্রুপদি নৃত্যশৈলী এই ভূখণ্ডে জন্ম নিয়েছিল। রায়বেঁশে, ছৌ, ধামাইল, মণিপুরী থেকে আরম্ভ করে রয়েছে লোকনৃত্যের বর্ণাঢ্য সম্ভার। নৃত্যকলায় বাঙালি দাপটের সঙ্গে বিশ্বদরবারে হাজির ছিল যতদিন উদয়শঙ্কর জীবিত ছিলেন। রবিশঙ্করের হাত ধরে সেতারবাদন ইউরোপ-অমেরিকায় সায়েবসুবোকে মাতিয়ে রেখেছিল একসময়। অগ্রজ উদয়শঙ্কর অন্যদিকে একা হাতে ভারতীয় নৃত্যকলাকে বিশ্বে হাজির করছিলেন। তাঁরা চলে যাবার পর বিশ্বমঞ্চে নিজের দাপুটে পদচারণা বাঙালি ধরে রাখতে পারেনি।
উদয়শঙ্কর কল্পনা নামে একটি হিন্দি ছবি তৈরি করেন তখন। ভারতীয় কোনো ভাষায় এটি সম্ভবত নৃত্যশৈলীর অপূর্বতাকে তুলে ধরতে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ছিল। কাহিনিপ্রধান ছবিতে নিটোল গল্পের পাশাপাশি ভারতবর্ষ জুড়ে নাচের অফুরান বৈচিত্র্য, সেগুলোর শৈল্পিক তাৎপর্য ও আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনার নমুনা উদয়শঙ্কর তখন সিনেপর্দায় তুলে ধরেছিলেন। ছবিতে অমলাশঙ্করসহ আরো অনেকে অভিনয় করেন। পরিপাটি চিত্রনাট্য, উদয়শঙ্কর ও অমলাশঙ্কর ছাড়াও বাদবাকি শিল্পীদের সুঅভিনয়ের কারণে কল্পনা আজো উপভোগ্য লাগে দেখতে। নৃত্যকে কেন্দ্র করে উদয়শঙ্করের স্বপ্ন ও নির্দয় বাস্তবতা ছবিটির প্রাণ।
উদয়শঙ্করের এই ছবিটি নিয়ে বাংলার অগ্রগণ্য কবিলেখকরা বিস্তারিত কিছু লিখেছেন বলে আমার জানা নেই। অনলাইনে ছবিটির ব্যাপারে যেসব লেখাপত্র চোখে পড়েছে সেগুলো অকিঞ্চিৎকর। ওপার বাংলা থেকে প্রকাশিত অনলাইন ওয়েবজিন বঙ্গদর্শন-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন ধাঁচের লেখায় সত্যজিৎ রায়ের উল্লেখ পাচ্ছি। সত্যজিৎ নাকি উদয়শঙ্করের ছবিখানা এগারো বার দেখেছিলেন। বঙ্গদর্শন জানাচ্ছেন …
সত্যজিৎ রায়ের উপর ভার পড়ল উদয়শঙ্করকে নিয়ে একটি লেখা দিতে হবে আনন্দ গোষ্ঠীকে। তখন এক সাংবাদিককে নিজের বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে ডেকে সত্যজিৎবাবু জানিয়েছিলেন, “উদয়শঙ্করের উপরে ইস্যু করছেন বলেই ডেকে পাঠালাম, না হলে আমি এখন যা ব্যস্ত তাতে লেখার সময় বার করাই কঠিন। …উদয়শঙ্করের একটা জিনিস সকলের জানা দরকার, সেটা ওঁর করা একটা সিনেমা, ‘কল্পনা’। …আমি ভেবেছিলাম নৃত্যশিল্পী হিসাবে তিনি যতই মহান হন, সিনেমা সম্বন্ধে তাঁর কতটা ধারণা থাকা সম্ভব? ছবিটা রিলিজের দিনই আমি দেখেছি। দেখলাম এটা নির্ভেজাল সিনেমা, এ দেশে যে সিনেমা হত তার থেকে একেবারে আলাদা। কম্পোজিশন, আলোর ব্যবহার, ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল ভীষণ সাবলীল। আমি এই সিনেমাটা দেখেছিলাম মোট এগারো বার। …‘কল্পনা’র কদর আমাদের দেশে ক’জনই বা করতে পেরেছেন? [দ্রষ্টব্য : বঙ্গদর্শন, ডিসেম্বর ৮, ২০১৯]
দেশি-বিদেশি নাচের বিচিত্র আঙ্গিক উপমহাদেশের সিনেমায় নিয়মিত ঘটনা হলেও তার বাইরে এই শিল্পের পরিসরটি এখনো সীমিত। আমাদের এখানে গওহর জামিল, রওশন জামিল, লায়লা হাসান, জিনাত বরকতুল্লাহ, মুনমুন আহমেদ হয়ে শিবলী-নিপা পর্যন্ত নৃত্যশিল্পের ক্রমবিকাশ বেশ আশা জাগানীয়া মনে হতো একসময়। পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয়, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান আর টিভি পর্দার বাইরে তাঁরা নাচকে নিয়ে যেতে পারেননি। মঞ্চনাটক যেমন বেইলি রোড ও শিল্পকলা একাডেমির চৌহদ্দিতে আটকে দমবন্ধ পরিণতি লাভ করেছে, নৃত্যকলার অবস্থা আরো সকরুণ সেখানে।
বুলবুল ললিতকলা একাডেমি ও শিল্পকলার বাইরে নাচ শেখার স্কুল হয়তো অনেক আছে। সেগুলোয় নাচ শেখার পাঠ নিচ্ছেন শিল্পীরা, তথাপি সামগ্রিক অর্থে নৃত্যশিল্প আমাদের সংস্কৃতিতে গণ্য ভাষা হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। বাংলা সিনেমায় ডান্স ও কোরিওগ্রাফির ব্যবহার নিয়িমত ঘটনা হলেও আলাদা কোনো ভাষা হয়ে উঠতে পেরেছে কি? ফাঁকতালে যা হয়েছে সেটি বেশ মর্মান্তিক। লোকনৃত্যের বিবিধ আঙ্গিককে বরং চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে নিষ্প্রভ হতে দেখেছি আমরা। ধামাইল ও গম্ভীরার মধ্যে যেসব নাটকীয় অনুষঙ্গ, সেগুলোর জনপ্রিয়তা থাকলেও বিচিত্র কার্যকারণে তাদের প্রভাব ও লোকপ্রিয়তা অতীতের মতো অমলিন ও সর্বজনীন নয়। বিদেশি নাচের নানান আঙ্গিক সিনেমায় জায়গা নিলেও আমাদের গণ্য নৃত্যআঙ্গিকের সঙ্গে সংমিশ্রণটি খুব-যে সুখকর কিছু দাঁড়িয়েছে সেটি বলা যাচ্ছে না।
ভারতকে এদিক থেকে অনেক পরিণত ও অগ্রসর মানতে হচ্ছে। মাইকেল জ্যাকসনের নিখাদ ভারতীয় রূপ আমরা প্রভু দেবায় পাচ্ছি। ব্রেক ডান্সে তিনি অন্যমাত্রা যোগ করেছেন। স্প্যানিশ ফ্ল্যামেঙ্কোর সঙ্গে কত্থকের ফিউশন মোটের ওপর প্রতিষ্ঠিত নৃত্যধারা এখন। লাতিন ট্যাঙ্গো ও সালসা, ইউরোপীয় ওয়াল্টজ অথবা আইরিশ সোন নোস… পৃথিবী জুড়ে জনপ্রিয় এসব নৃত্যশৈলীর সঙ্গে ভারতীয় নৃত্যের সংমিশ্রণ সেখানে দেখছি আমরা। বাংলাদেশে অনুরূপ নিরীক্ষা এখনো বড়ো দাগে চল বা প্রতিষ্ঠা পায়নি। নাচের মধ্য দিয়ে ভারতআত্মাকে তুলে ধরতে পারে এরকম নৃত্যশৈলী অবশ্য খোদ ভারতেও পরিলক্ষিত হয় না। ভারতনাট্যমকে জাতীয় নৃত্য বলে অনেকে গণ্য করলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে এখনো স্বীকৃত নয়। ইসলামি মূল্যবোধের প্রভাবমানসে বালেগ বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে নাচকে মোটের ওপর সুনজরে দেখা হয়নি কভু। সুতরাং সমাজে বিভিন্ন নৃত্যকলার প্রচলন ও লোকপ্রিয়তা থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক বলয়ের বাইরে তার জাতীয় আবেদন নগণ্য।
আরববিশ্বে যদি তাকাই, বেলি ডান্স জাতীয় নৃত্য না হলেও আরবরা এর সঙ্গে ভীষণভাবে একীভূত। ইসলামের সাধ্য নাই তাকে আটকায়। মিশরসহ উত্তর আফ্রিকার মুসলিম প্রধান দেশে উদরনৃত্য স্বমহীমায় জায়গা ধরে রেখেছে। কিছু ঐতিহ্য এমন যাকে টাবু দিয়ে সেন্সর করলেও রোখা যায় না। ব্যালি ডান্স আরবে মৃত হলে আমরা শাকিরাকে পেতাম না বোধহয়। আরো কিছু নাচের ফর্ম আরব বেদুইনরা এখনো ধরে রেখেছেন। মাঝখান দিয়ে রুশসহ গোটা মধ্য এশিয়ায় ঐতিহ্যের অনন্য প্রতীক ব্যালে ডান্স এখন আর কেউ দেখতে পায় বলে জানা নেই। উদয়শঙ্করের হাত ধরে ব্যালে আমাদের এখানে প্রবেশ করেছিল। তৈরি হয়েছিল এর দর্শকশ্রেণি। রুশ ব্যালেরিনা আনা পাভলোভা সেইসময় এখানে এসে নাচ পরিবেশন করে গেছেন। ব্যালে তো বৈশ্বিক ঘটনা! জিমন্যাস্টিক্সও তাকে ব্যবহার করে অবিরত।
উদয়শঙ্কর এই স্বপ্ন দেখেছিলেন,- সমগ্র ভারত ভূখণ্ডকে নাচের মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্বে তুলে ধরবেন। এবং সেটি কীরকম হতে পারে তার আভাস কল্পনা ছবির বয়ানে আগাগোড়া পেতে থাকে দর্শক। ভারতবর্ষে প্রচলিত বিচিত্র সব নাচের শৈলীকে ছবিতে ধারণ করেছিলেন উদয়শঙ্কর। সাদাকালোয় বোনা কল্পনা যে-কারণে উপভোগ্য অভিজ্ঞতা দিয়ে যায় দর্শককে। উদয়শঙ্কর দেহ রাখার পর নৃত্যচর্চা বহমান। মমতাশঙ্কর এই বয়সেও অভিনয়ের পাশাপাশি নাচের স্কুল নিয়ে সরব। পণ্ডিত বিরজু মহারাজের মতো শিল্পী সেদিন অবধি বেঁচে ছিলেন। অনেক শিষ্য রেখে গেছেন। আরো অনেকে আছেন হয়তো, আমার অজানা।
. . .
জাতীয় নৃত্যের কথা মনে এলো মধ্য এশিয়ার দেশ জর্জিয়ার সুবাদে। জর্জিয়ানরা নাচের এমন সব ফর্মকে একত্রে জুড়েছেন, যার মধ্য দিয়ে তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, বীরত্বসহ একটি জনপদের সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতাকে তারা তুলে ধরেন। ব্যালে ও লোকনৃত্যের সংমিশ্রণে সৃষ্ট এসব নৃত্যআঙ্গিক ইন্টারনেটের বদৌলতে আমাদের সামনে অবারিত। গড়ে দেড়-দুই ঘণ্টার পরিবেশনায় জর্জিয়াকে তারা হাজির করেন সেখানে। পরিবেশনা এতটাই অপূর্ব… বাকরুদ্ধ হতে হয় দেখে।
জাতীয় নৃত্য যেসব শিল্পীরা পরিবেশন করেন তারা সেখানে ভীষণ সম্মানিত। সেলিব্রেটি। কারণও আছে। জর্জিয়ান ন্যাশনাল ডান্স অবিশ্বাস্য স্কিলের পরাকাষ্ঠা, যার জন্য একজন শিল্পীকে বছরের পর বছর কঠিন পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে নিজেকে তৈরি করতে হয়। চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতো না মানুষের পক্ষে এই লেভেলের অ্যাথেলেটিক স্কিল সম্ভব। শোকোসভ্যালি নামের নাচ শেখাবার প্রতিষ্ঠানটি গেল সত্তর বছর ধরে শিল্পী তৈরি করে চলেছে। সারা বিশ্বে জর্জিয়ার পরিচয়কে যারা নাচের মাধ্যমে তুলে ধরছেন।
ল্যাভিন আকিনের সমকামী প্রেমকে কেন্দ্র করে নির্মিত চলচ্চিত্র অ্যান্ড দ্যান উই ডান্সড ছবিটি দেখলে জর্জিয়ার জাতীয় নৃত্য পরিবেশনের জন্য নিবেদত শিল্পীদের কীভাবে তৈরি করা হয়, কতখানি অমানুষিক শ্রম ও স্ট্রাগলের ভিতর দিয়ে তারা খাঁটি সোনা হয়ে ওঠেন… ইত্যাদি বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যায়। ভালো লেগেছিল দেখে। তবে আকিনের সিনেমায় যেটুকু এসেছে, বাস্তবে এই নৃত্যশৈলী আরো ব্যাপক ও গভীরমাত্রিক অভিজ্ঞতার স্মারক। আমাদের পক্ষে নিজস্ব নৃত্য আঙ্গিক ব্যবহার করে এই লেভেলের কিছু সৃজন করা সম্ভব নয়, তবে কাছাকাছি কিছু হতেই পারে। উদয়শঙ্কর থাকলে হয়তো এতদিনে সেটি বাস্তবের মুখ দেখত। তিনি দেহ রাখার পর সকল সম্ভাবনা তিরোহিত হতে থাকে। বাঙালি ক্রমাগত হতশ্রী এক জাতিতে নিজের নির্ণয় খুঁজছে। আরেকটি নবজাগরণ ছাড়া এ-জাতির পক্ষে বড়ো কিছু ঘটানো সম্ভব নয়।
. . .
. . .