. . .
আত্মসমালোচনা ছাড়া উত্তরণের উপায় নাই। কিছু বিষয় নিয়ে তবু দ্বিধা আমার যায় না। স্থানিকতায় থেকেও বৈশ্বিক হতে বাধা কোথায়? ফরহাদ মজহার, সলিমুল্লাহ খান থেকে শুরু করে যাঁরা বারবার স্থানিকতার কথা বলেন, সেই স্থানিকতার স্বরূপটা কী? কোন শেকড়ের দিকে আমাদের ফেরত আসতে বলছেন তারা? আমার ধর্ম কি? আমি তবে মুসলমান হলাম কবে? হিন্দুই-বা হলাম কখন? মার্কসবাদ যদি বৈদেশি হয় তবে ধর্মও তো বৈদেশি! চাপিয়ে দেয়া। বয়ান আর পাল্টা বয়ানের মধ্য থেকে দাঁড়াবার জন্য একটি জায়গা তো দরকার।
বৈচিত্র্য জরুরী, বৈচিত্র্য সুন্দর তবে এর সমন্বয় নিয়ে স্পষ্ট কোনো আলাপ নেই কেন? সমন্বয়কে স্পষ্ট রূপ দিতে না পারার কারণে ফরহাদ মজহার প্রায়োগিক দিক থেকে ইতোমধ্যে অনেকখানি ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি ইসলামকে বিভাজিত করছেন সৌদি ইসলাম, তুর্কি ইসলাম, আঞ্চলিক ইসলাম বলে। বহু ইসলামকে একসূত্রে গাঁথতে চান তিনি, অথচ আদর্শগত জায়গা থেকে, সহনশীলতার দিক থেকে তারা পরস্পরবিরোধী। ফলে মাজার ভাঙা এক পক্ষের কাছে ইমানি দায়িত্ব বটে।
প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার স্বরূপ সত্যিকার অর্থে কী? কী-কী উপাদান থাকলে আমরা তাকে প্রগতি বলব, আর কোন-কোন উপাদান প্রতিক্রিয়াশীলতার ধারক? এখানে নৈরাজ্য কারা তৈরি করল? এর পেছনে যেসব বুদ্ধিজীবী রয়েছেন, তাঁরা কারা? বিগত তেপ্পান্ন বছর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতিতে আমরা পরস্পরবিরোধী অবস্থান দেখতে পাই। বাঙালি ও বাংলাদেশি জাতীয়তা, ধর্মনিপক্ষেতা ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইসলামবিদ্বেষ, আরো কত ছোট-ছোট ফ্রন্টে যুদ্ধ। বাঙালি জাতীয়তাবাদে আদিবাসী গোষ্ঠীর স্থান কোথায়? আবার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে হাজার বছরের ঐতিহ্যই-বা কোথায়? মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কে বা কারা ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড় করাল? প্রশ্নগুলি তোলা জরুরি।
মুজিববাদ কিংবা হাসিনা রেজিম এই প্রশ্নগুলি ভালোমতো ডিল করতে পারেনি,- এটি সত্য। এককভাবে কুক্ষিগত করার বাসনায় তারা অনেকখানি ধ্বংস করেছে এর ভিত্তি, তাই বলে কি এর উপযোগিতা শেষ হয়ে গেল? প্রচলিত বুদ্ধিজীবীতা কেন এখনো প্রশ্নগুলো ভালোভাবে ডিল করতে পারছে না? তারা কেন আত্মধ্বংসী হয়ে উঠছে? ধর্মশাসিত সমাজ কি আমাদের মেনে নিতে হবে? রাষ্ট্রপরিচালনায় ধর্মভিত্তিক মতাদর্শ পৃথিবীব্যাপী কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। এর মূল কারণ ধর্মের মৌলিক কাঠামোর মধ্যে স্ববিরোধ ও সময়কে পাঠ করার অনিচ্ছা। এই মূহূর্তে পৃথিবীজুড়ে যে-সকল রাষ্ট্র সক্রিয় যেমন ইসরায়েল, ইরান, আফগানিস্তান, সৌদি আরব ইত্যাদি রাষ্ট্রসমূূহ মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে, স্বাধীনতার প্রশ্নে যৌক্তিক কোনো সমাধান দিতে পারেনি। ধর্মকে উপলক্ষ করে কঠোর ভাবাদর্শ সমাজের শ্বাসরোধ করে রেখেছে। সৌদি আরব হয়তো সময়কে পাঠ করে খানিকটা সংস্কার করছে, কিন্তু তাতে তার মৌলিক ব্যবস্থা যার ওপর ভিত্তি করে সে টিকে আছে, তার থেকে বেরিয়ে আসবে কীভাবে?
প্রায়োগিক ক্ষেত্রে মার্কসবাদও সফল হতে পারেনি। সেটিও ভিন্ন একটি ধর্মের রূপ ধারণের কারণে। সে টিকে থাকে নিরবচ্ছিন্ন চাপ প্রয়োগ করে। সামষ্টিকতা ও যৌথতার বাহানায় তারা দমিয়ে রাখে ব্যক্তিস্বাধীনতার জায়গাটি। বাংলাদেশে সেই অর্থে সমাজতান্ত্রিক কোনো পটভূমিই তৈরি ছিল না। সিরাজুল আলম খানরা সেক্ষেত্রে কি অহেতুক মুজিবের উপর চাপ প্রয়োগ করেননি? আখেরে তাঁরা কী পেয়েছেন? বাকশাল গঠনে তাঁদের ভূমিকা তাহলে কি নেই? ভূ-রাজনৈতিক বিষয়াবলী নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে, এর অভিঘাত সম্পর্কে সচেতনতা সত্ত্বেও নিজস্ব বয়ান ও পাল্টা বয়ানের জায়গাটি হয়তো সুস্পষ্ট করা দরকার আমাদের। খানিকটা সময় হয়তো এখনো রয়ে গেছে।
অনেকগুলা প্রশ্ন আপনি তুলেছেন জাভেদ। আমার মনে অহরহ এসব সওয়াল পয়দা হয়। তখন মনে হয় নব্বই থেকে মিলেনিয়ামের প্রথম দশক বরং ঢের ভালো ছিল। মনে তখন অনেক প্রশ্ন জমা হলেও সেগুলোর নিষ্পত্তি অনায়াস ঠেকত নিজের কাছে। ফোকাস আইটির ওইসব আড্ডাবাজির দিনকালে দেশজাতিরাষ্ট্রের কত না গুরুতর প্রসঙ্গে চট করে উপসংহার টেনেছি আমরা। সময়ের সঙ্গে চুলে পাক ধরেছে। বুড়ো হলে বোধহয় আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি আসে। স্ট্রেটকার্ট ডিসিশন নেওয়া কঠিন হয়। যদি ভুল না করি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের কোনো এক লেখায় বাক্যটি পড়েছিলাম,- সময় বড়ো বলবান। আসলেও তাই। যাই হোক, আপনার তোলা প্রশ্নগুলোর উত্তর বলবান সময়রেখায় দাঁড়িয়ে নিজ মাপে মিলানোর চেষ্টা করলাম ক্ষণিক। সারাংশটি পর্যায়সারণীর মতো নিচে তুলে ধরি এবার। বলে রাখি, এগুলো ঠিক সিদ্ধান্ত নয়, অনুসিদ্ধান্ত বলেতে পারেন, কাজেই এখান থেকে নতুন আলাপের সূত্রপাত হলেও হাতে পারে।
. . .
আপনি লিখেছেন, ‘স্থানিকতায় থেকেও বৈশ্বিক হতে বাঁধা কোথায়?’ সমস্যাটি স্থানিকতা থেকে বৈশ্বিকতায় যাওয়া-আসার নয় জাভেদ। ফরহাদ মজহার বলেন, সলিমুল্লাহ খান বলেন, উনারা কেউ স্থানিকতা বা বৈশ্বিকতার বিমারে আক্রান্ত মানুষ না। উনাদেরকে অতটা সংকীর্ণ আমরা নাই-বা ভাবলাম। এসব প্রেজুডিসের ঊর্ধ্বে তাঁরা নিজেকে নিতে পেরেছেন মনে করি। বৈশ্বিকতা ও স্থানিকতাকে আমরা কীভাবে পাঠ করছি,- সমস্যার জড় সেখানে নিহিত। যেমন ধরুন, ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিল্পকলাকে আমরা পাঠ যাই, তার সঙ্গে একাত্ম হই, এখন এর প্রভাব আমাদের মনে অজান্তে সক্রিয় থাকে। একখানা বিচার-পদ্ধতিও গড়ে ওঠে। সেটি দিয়ে নিজের পরিপার্শ্ব বা দেশকালকে আমরা দেখি। বিচারও কি করি না?
একবিংশ শতকে এসে উক্ত বিচারবোধ কতখানি সঠিক,- এই প্রশ্নটি জোরেসোরে তুলছেন অনেকে। কিতাবের-পর-কিতাব লিখে তুলছেন। এর পেছনে আবার উত্তর-আধুনিক চিন্তাপদ্ধতির বিরাট ভূমিকা রয়েছে। চিন্তাপদ্ধতিটি যদিও আমরা আবার সেই ইউরোপ বা আরো স্পেসিফিক করে বললে প্রতীচ্য থেকেই নিচ্ছি, কিন্তু একে এখন প্রয়োগ করছি নিজ স্থানিকতায় দাঁড়িয়ে। মনে হচ্ছে, এতদিন আমরা যেভাবে নিজেকে দেখে এসেছি, পাঠ করেছি, তার মধ্যে গোলযোগ আছে। ফলত আমরা এখন আর আধুনিকতাবাদ প্রসূত তরিকায় নিজেকে দেখতে পারছি না। দেখা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতীচ্যকে যেমন প্রশ্ন করছি, আমাদের ওপর তার চাপানো পাঠপদ্ধতিকেও সমানে প্রশ্ন করছি। অন্যদিকে নিজেকেও প্রশ্ন করতে বাধ্য হচ্ছি। কোনো ব্যাপারেই নিঃসংশয় নই আর।
রবি ঠাকুরের বিলেতবাস ও বঙ্গবাসকে যদি লক্ষ্য করেন, দেখবেন উনার মধ্যে এই ডুয়ালিটি সারাক্ষণ ছিল। ইউরোপীয় চিন্তাপ্রণালী তাঁকে ভীষণ আলোড়িত করেছে। কর্মপাগল জীবনছন্দের ব্যাপ্তিতে মুগ্ধ হয়েছেন রবি। ভারতবর্ষের স্থবির পাক সে-তুলনায় দুর্বিষহ মনে হয়েছে তাঁর। কিন্তু ইউরোপে তরঙ্গিত জীবনবেদের মন্ত্র ও সেখানে সক্রিয় জড়বাদী-ভোগবাদী বিকারে এসে তাঁকে ধাক্কা খেতে হয়েছে। আত্মবিশ্বাস টলে উঠেছে তাৎক্ষণিক। ভারতবর্ষে সচল ভাববাদী জীবনবেদে একে চালান করা আত্মঘাতী ঠাউরাচ্ছেন ঠাকুর। তাঁর মনে হয়েছে, বৈদেশিক অথবা বৈশ্বিক জড়বাদে সক্রিয় জীবনবেদকে প্রাচ্যে খাপ খাওয়ানো সম্ভব নয়। প্রকৃতগতভাবে দুটি আলাদা। তাহলে এখন কী করা? এই প্রশ্নের পরিষ্কার মীমাংসা কিন্তু আপনি রবি ঠাকুরে পাবেন না। রক্ষণশীল ঘেরাটোপ বরং পাবেন তাঁর রচনায়।
বস্তুবাদে সচল ইউরোপের অতিকায় ইহজাগতিকতা, তার সমুদয় জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিল্পকলায় নিজের নিরতিশয় মুগ্ধতা ও সম্মোহন শেষে রবি ফেরত যাচ্ছেন চিরাচরিত ভারতীয় জীবনবেদের কাছে, যার মূলে রয়েছে চরৈবেতির মন্ত্র। থেমো না, এগিয়ে যাও;- এমনভাবে যেও না, যেটি কেবল ভোগসুখে নিঃস্ব; এগিয়ে যাও নিজেকে অসীম অনন্তে সমাহিত ভেবে। তো এই যে উপনিষদমন্ত্র, এখানে এসে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে ব্যবধান জারি থাকছে। তাদের চাপিয়ে দেওয়া বয়ান, যেটি প্রথমত ঔপনিবেশিক সূত্রে আমরা পেলাম, তাদের চোখ দিয়ে দেখতে শিখলাম তারা হচ্ছেন We আর আমরা হচ্ছি Other, অপরায়নের এই খেলাটি বড়ো মারাত্মক। তখন আপনি আর নিজের চোখ দিয়ে নিজেকে দেখতে পারছেন না। আপনার ইতিহাসকে পাঠ করছেন তাদের ইতিহাসপাঠের তরিকা মেনে। ফলে দেরিদীয় ব্ল্যাঙ্ক স্পেস জারি থেকে যাচ্ছে। উচিত ছিল, তারটা আত্মস্থ করে আপনার নিজের তরিকা তৈরি। আপনি তো ভাই সেটি করতে পারেননি। এক ধরনের চিন্তাগোলামি আপনাকে তাই পেয়ে বসেছে। আপনার ঘাড়ে চড়ে নর্তনকুর্দন করছে সে। এখান থেকে আপনি আপনার নিজেকে আর ঠিকঠাক চিনতে অক্ষম।
সমস্যাটি এখানে, বিনিময় বা আদান-প্রদানে নয়। দেখুন, ফুকো ফরাসি দেশে বসে আলোকায়নকে প্রশ্ন করছেন? সওয়াল করছেন, ইউরোপ যাকে আলোকায়ন নামে বিশ্ব জুড়ে রাষ্ট্র করেছে সেটি কি সত্যি আলোকায়ন? নাকি তার অন্তরালে এমন সব অন্ধকার রয়েছে, যারা কিনা চাপা পড়েছে ইতিহাসের নতুন বয়ানে? এই-যে প্রশ্ন করতে পারা, এটাও দেখুন আমাদেরকে ফুকোর থেকে শিখতে হচ্ছে। কারণ, আমাদের এখানে যে-জ্ঞানপদ্ধতি ছিল সেটির সঙ্গে সংযোগের রাস্তা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। যে-কারণে দুইহাজার চব্বিশে এসে যেসব উৎপাত দেখছি, সেগুলোকে বিশ্লেষ ও বিশ্লিষ্ট করার তরিকা ভেবে পাচ্ছি না। সংকট এখানে। জানি না বোঝাতে পারলাম কিনা।
. . .
মিনহাজ ভাই, আপনি যথার্থভাবে আমার মূল সংকটের জায়গাটি ধরতে পেরেছেন। এই দ্বিধাগ্রস্ততা আমার মধ্যে যেমন তেমনি সমাজরাষ্ট্রের মধ্যেও প্রবলভাবে উপলব্ধি করি। আপনি খেয়াল করেছেন কিনা,- আমি একাধিকবার চিন্তার, বুদ্ধিজীবীতার নৈরাজ্যের কথা বলছি। ওপরের লেখাটি ভিন্ন অর্থে আপনি উত্তর আথুনিকতার সমালোচনা হিসেবেও বিবেচনা করতে পারেন। ফরহাদ মজহার, সলিমুল্লাহ খানরা নমস্য, পড়াশুনার পরিধি ব্যাপক, চিন্তার গভীরতা মুগ্ধ করার মতো, কিন্তু নানাভাবে তাদের চিন্তায় স্ব-বিরোধী উপাদান প্রবল হয়ে উঠতে দেখা যায়। আলোকায়ন, আধুনিকতার সমালোচনা করতে গিয়ে তারা এমনসব বিষয়াদি হাজির করেছেন তার থেকে আর কোনো বিষয়কে সঠিকভাবে আইডেন্টিফাই করা সম্ভব হচ্ছে না।
ফরহাদ মজহার যেমন ইসলাম সম্পর্কিত ভাবনাকে পাঠ করতে গিয়ে মৌলিক করে তোলেন, তিনি তখন বিবেচনা করেন না চিন্তাপদ্ধতি কখনো দানব হয়ে উঠতে পারে। আমরা দেখেছি সেই দানবকে রুখতে গিয়ে তাকে আবার মাঠে নামতে হয়েছে। সলিমুল্লাহ খানের অসংখ্য বক্তব্য আছে কওমি মাদ্রাসা কেন্দ্রিক, তিনি সেটি গ্লোরিফাই করেন, প্রতিষ্ঠা দিতে গিয়ে তর্ক করেন। এই যে বুদ্ধিজীবীতার বিশৃঙ্গলা, ফলত এইসব প্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি দিনে দিনে মাদ্রাসায় পরিণত হয়। নানাবিধ ন্যারোটিভ জন্ম নেয়। কোনটি প্রগতি আর কোনটা পশ্চাদপদ তা আর ঠাহর করা যায় না।
. . .
আপনার যুক্তির সঙ্গে সহমত জাভেদ। প্রশ্নটি তথাপি আবার তুলতে হচ্ছে,- চিন্তার বা বুদ্ধিজীবীতার বিশৃঙ্খলা কি খারাপ কিছু? আপনি হাইডেগারকে দেখেন অথবা নিটশে। হেগেলকেও ধরতে পারেন। উনাদের চিন্তাকাঠামো ও ভাবুকতায় স্ববিরোধ কম নেই। হাইডেগার সারা জীবন চেয়েছেন, তাঁর চিন্তা স্ববিরোধী বলে লোকে চিহ্নিত করুক। কেন চেয়েছেন? কারণটি সহজ, এছাড়া পরবর্তী চিন্তায় তিনি গমন করতে অক্ষম। নিজে যা ভাবলেন ও আপাত ভাষা দিলেন, এখন ওই ভাষায় নিজেকে নিরোধ করার ঝুঁকি এড়াতে হাইডেগার অবিরত বিতর্কের বীজ উসকে দিয়েছেন। মূলে কাজ করেছে এই ভাবনা,- দর্শনের দায়িত্ব মীমাংসা নয়, তার কাজ অবিরত প্রশ্ন করে যাওয়া ।
নিটশেও তাই। যেমন ধরুন, Twilight of the Ideals-এর এক জায়গায় এসে নিটশে কবিতালগ্ন ভাষায় ভারতীয় বর্ণপ্রথাকে পাঠ ও বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর বক্তব্য পাঠে মনে হবে, এখানে তো ফ্যাসিবাদের বীজ দপদপ করছে রে ভাই! আবার একে অন্যভাবে দেখলে ফ্যাসিবাদ মনে হয় না। আমার সেরকম বোধ হয়েছিল তখন। যাই হোক, মহাবিশ্ব এনট্রপিজনিত বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে শৃঙ্খলা রচনা করলেও আমরা চিন্তায় ডিসিপ্লিন বা শৃঙ্খলা চাইছি। প্রশ্ন হলো কোন ডিসিপ্লিন? ইংরেজের শেখানো ডিসিপ্লিন? যেখানে সুনির্দিষ্টভাবে ইসলামকে আমরা ফ্রেমিং করতে পারি? যেমন করে ইউরো-আমেরিকায় পয়দা ন্যারেটিভ সচরাচর করে থাকে?
একজন উগ্রবাদী ইসলামপন্থীকে আমরা কীভাবে বিচার করব? কেন সে ওই পথে যাচ্ছে? ওহাবিপ্রবাহ তো সাম্প্রতিক ঘটনা। এর আগে কি বঙ্গ বা ভারতবর্ষে ধর্ম নিয়ে উগ্রতা ছিল না? ব্যাপকভাবে ছিল। বাউল ধ্বংসের ফতোয়া কারা জারি করেছিল তখন? আবার ধরুন, মাদ্রাসা শিক্ষার পদ্ধতি কী কারণে এই হালতে এসে পৌঁছালো? মধ্যযুগে মাদ্রাসার যে-বিশ্ববিদ্যালয় ধাঁচের বিস্তার ছিল, সেটি কেন ভারতবর্ষে সংকুচিত হয়ে উঠল? কী কারণে যুগের সঙ্গে নবীকরণ করা গেল না তাকে? মাদ্রাসাকে কারা প্রান্তিক ও অপর করে রাখলেন? ইংরেজরা? আমাদের সেকালের মুসলমান রাজনীতিকরা? এসব প্রশ্ন ভ্যালিড, যদিও মজহার বা সলিমুল্লাহকে এদিকে কম যেতে দেখি। উনাদের ব্যাখ্যা এখানে এসে গোজামিলে মোড় নেয়। উনারা অ্যান্যাটিক্যাল না। এর কারণ, আমাদের এখানে অ্যনালিটিক্যাল ফিলোসফি হিন্দু যুগ খতম হওয়ার সঙ্গে অস্ত গিয়েছিল।
স্যার সৈয়দ আহমদ যখন আলীগড় গড়ে তুলছেন, তখন উনার ভাবনায় মাদ্রাসা কেন স্থান পায়নি? ধর্মসংষ্কার আমরা ঊনিশ শতকে হিন্দু সম্প্রদায়ের এলিটদের মধ্যে দেখেছি। বিনয় ঘোষ যদিও এই সংস্কার প্রসূত বঙ্গীয় রেনেসাঁসকে মানতে পারেননি। উনি মার্কসিস্ট ছিলেন বলে পারেননি। কারণ, সেখানে অপরায়নের সমস্যাটি জারি থেকেছে। শিক্ষিত সমাজের বাইরে আলোকায়নের আলো চুঁইয়ে পড়েনি। তো এসব প্রব্লেমকে আপনি যখন উত্তর-আধুনিক পন্থায় প্রশ্ন করছেন তখন দেরিদীয় ফাঁকা স্পেসগুলো মাথা তুলছে। আপনার মধ্যে ভর করছে সমবেদনা ও দরদ। ফরহাদ মজহার যেমন এই জায়গা থেকে দরদ ও ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গটি টানছেন। এখন উনার সমস্যা হচ্ছে উনি একে রাজনীতির জায়গা থেকে কেন জানি বিচার করে উঠতে পারছেন না। একইসঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগ-উপযোগী করার প্রস্তাবনা সেখানে মিসিং। সলিমুল্লাহ খান ইতিহাসকে কোট করে আনন্দ পান কিন্তু উনি, আমার বিবেচনায়, ভাবুক নন। মজহারে সেটি তীব্র এবং সে-কারেণে বহু জায়গায় স্ববিরোধী।
যাই হোক, মজহারের ভিন্ন টাইপের ইসলামকে এলাউ করা আমি সমর্থন করি। ওটা অতীতেও নানা মাত্রায় আমাদের এখানে ছিল। এখনো আছে। লক্ষ্য করুন, উনি কিন্তু বসে নেই। প্রতিরোধ করছেন, একজন বুদ্ধিজীবী যেমন করেন। সমস্যা একটাই, ইসলাম সময়ের সঙ্গে নিজের ব্যাখ্যা বা ইন্টারপ্রিটেশনে ওইসব উপাদান আনতে পারছে না, যেগুলো থাকলে পরে তাকে আপনি মানবিক ভাবতে পারেন। সুফিপন্থায় বীজাধারটি ছিল। এখন সেটি বাউল হোক অথবা শরিয়তি তাসাউফ। রাজনীতির মারপ্যাঁচে সুফিরা একপ্রকার নিহত। সাংস্কৃতিক জাগরণ ছাড়া, সংস্কৃতিকে রাজনৈতিক ন্যারেটিভের হাতিয়ার করতে না পারলে মজহার ইসলামকে কেন্দ্র করে দেখা দেওয়া অশুভ প্লাবন কিছুতেই রোধ করতে পারবেন না। যে-কারণে একদিন বোধহয় বলেছিলাম,- উনাকে লালন অখড়ায় ভালো লাগে দেখতে, বিপ্লবে নয়।
. . .