শর্ট ইন্ট্রো : শেখ হাসিনার পতনকে কেন্দ্র করে যেসব আলাপ থার্ড লেন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এখনাবধি চলমান তার থেকে এই আলাপটি অবশেষে ব্লগে তুলছি এখন। অক্টোবর ২৩, ২০২৪ ঈসায়ী সনে এবাদ রহমানের একখানা ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে এর সূত্রপাত ঘটেছিল। প্রথম দফার নাতিদীর্ঘ আলাপ আহমেদ সায়েমের করা মন্তব্যের সুবাদে নভেম্বর মাসের ৬ ও ৭ তারিখে পুনরায় ফেরত আসে। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ যেহেতু ব্লগের একান্ত পরিসর, গ্রুপ সদ্যসদের আলাচারিতার ধরন ও ভাষাভঙ্গি মোটের ওপর শোভনতার তোয়াক্কা করে না। বক্ষ্যমাণ নেটালাপে নিতান্ত ব্যক্তিগত ও স্পর্শকাতর কিছু প্রসঙ্গ আলাপে ঢুকে পড়েছিল। ব্লগের উন্মুক্ত পরিসরে প্রকাশ-উপযোগী ও শোভন নয় বিধায় সেগুলো আমরা এখানে বাদ দিয়েছি। সেইসঙ্গে কিছুটা ভাষিক পরিমার্জনাও করতে হলো।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এতদিন পরে আলাপটি কেন তুলছি এখানে। এর উত্তর বিগত নেটালাপের নানান অংশ সাইটে তোলার সময় আমরা দিয়েছি। পাঠক তার কোনো একটিতে চোখ রাখলে উত্তর পেয়ে যাবেন। উপরন্তু এবাদ রহমানে কেন্দ্রীভূত আলাপ আদৌ কতটা প্রাসঙ্গিকতা রাখছে ইত্যাদি আমাদের ভাবিয়েছে। অবশেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেছে,- দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আলাপটি এখনো প্রাসঙ্গিকতা রাখে, সুতরাং ব্লগে তোলা যেতে পারে তাকে।
থার্ড লেন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যেসব পয়েন্ট ধরে আলাপিরা তখন কথা বলেছিলেন, এর পক্ষে-বিপক্ষে মত থাকাটা স্বাভাবিক। আমরা সেগুলো শুনতে আগ্রহী। পাঠকরা ইচ্ছে করলে ব্লগের মন্তব্য বিভাগ অথবা থার্ড লেন ব্লগের ফেসবুক পাতায় মন্তব্য জুড়তে পারেন। কোনো আলাপ প্রকৃতপক্ষে নিখাদ নিরপেক্ষ হয় না। আমরা সে-দাবি করছিও না। এবাদ রহমান যেমন তাঁর ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে বাঙালি জাতিসত্তাকে দেখেন ও নিজের বুদ্ধিজীবীতা নিভানোকে দায়িত্ব বলে ভাবেন, আমরাও নিজানুগ ভাবনাছকে তাঁর বা জুলাই আন্দোলনে সম্পৃক্তজনদের মনোজগৎ বোঝার চেষ্টায় আছি। যারা এই দীর্ঘ নেটালাপটি পাঠের সময়-সুযোগ করে নিতে পারবেন এবং পাঠ করবেন ধরে নিচ্ছি,- তারা এখন এদিকটা আমলে নিয়ে প্রশ্ন, মন্তব্য, তর্ক জুড়বেন আশা করি।
. . .
জুলাই আন্দোলন যারা সফল করছেন উনাদের প্রতি জনাব এবাদুর রহমানের নসিহত
…
চার দিন আগের একখানা ফেসবুক পোস্ট এবাদুর রহমান এই ঘোষণা দিয়া শুরু করছেন,- বাঙালি মুসলমান নওজোয়ানদের জন্য তিনি মূলত লেখালেখিটা করেন। বেশ লম্বা আলাপ। পুরোটা উদ্ধৃত করার চাইতে সামারি করা ভালো মনে হইতেছে। বক্তব্যের সারসংক্ষেপ বুলেট আকারে হাজির করি বরং। এবাদ সেখানে জানাইতেছেন :
ক. জুলাই আন্দোলনের নওজোয়ানরা যে-অভ্যুত্থান ঘটাইছে এখন তাকে বিপ্লবে রূপ দিতে হবে। অভ্যুত্থানে আপামর ছাত্র-জনতা অংশ নিলেও বিপ্লবে পূর্ণতা লাভ করে নাই। অভ্যুত্থানের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক যত কাজ করা হইছে সেগুলা পরিষ্কার বৈপ্লবিক ছিল। উনার ভাষায় ইন্টেলেকচুয়াল রেভোলুশন। তো এই বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবটাকে এখন আরো সামনে নিতে হবে।
খ. ফ্যাসিস্ট কাঠামোয় খুটখাট মেরামত বা রিস্ট্রাকচার করে মসনদে থাকায় তাঁর সমর্থন নাই। পুরাটাই ভেঙেচুরে নতুন শেইপে আনতে হবে।
গ. ফ্যাসিস্টরা ক্রীড়া, শিল্প, বিজ্ঞাপন, সিনেমা, সাহিত্য ইত্যাদিতে নিজেকে পুনর্বাসিত করার প্রস্তুতি নিতেছে। এইটা মারাত্মক। কাজেই এখন থেকে প্রচুর পরিমাণে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চালাতে হবে। প্রচুর লিখতে হবে। গান, ছবিসহ প্রচুর সাংস্কৃতিক এলিমেন্টস বা সোজা কথায় ন্যারেটিভ তৈরিতে নওজোয়ানদের নামা জরুরি।
ঘ. উনার ভাষায় বাঙালি মুসলমান হইতেছে একটা হরাইজন । সে ওই দিগন্তরেখা কখনো একটু ছুঁইতে পারে, কখনো পারে না বা লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতি হয়ে যায়। এইবার সেইটা ঘটতে দেওয়া যাবে না। যারা বাঙালি মুসলমানের জাগরণকে ঠেকাইতে চেষ্টা করবে তাদের শায়েস্তা করার বাণী ঝাড়ছেন এবাদ। উনার কাছে জাগরণটা জাইটগাইস্ট বা নতুন উন্মোচন। কার? উত্তরটা তাঁর ভাষায় কোট যাই,- ’এই জাগরণ তুর্কির সুলতান না, পাকিস্তানের খান না, আরবের শেখ না, বাঙলার কোন মফিজ বা কুদ্দুসের সন্তান দিশা দিবে, নূতন দুনিয়ার।’
. . .
নসিহত দান শেষে নিজেকে সামান্য মানুষ বইলা বিনয় প্রকাশের পর দুঃখ করছেন এই বইলা,- আজকে ডিএফপি অডিটোরিয়ামে বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের সংস্কার নিয়া আলাপে তাঁকে কেউ ডাকে নাই। কওমের নবজাগরণ সফল করতে যারা লড়তে রাজি আছেন তাদেরকে ডাকা উচিত ইত্যাদি। মোটের উপ্রে এই হইতেছে বক্তব্য। ফরহাদ মজহারে আরেকখানা কপিক্যাট। কেবল কপিক্যাট বললে ভুল হবে, দাস ক্যাপিটাল আখ্যানের লেখক হুঁশবুদ্ধি খোয়াইলেন কিনা বুঝতে পারতেছি না! মজহারকে উনি লাইন-বাই-লাইন কপি করছেন এখানে। একটা কথা নাই যা মজহারকে এতদিন যাবত আমরা বলতে ও লিখতে দেখি নাই। যাই হোক, উনার বক্তব্যের টেক্সচুয়াল অ্যনালিসিসি কি হইতে পারে? হওয়া উচিত বোধহয়।
পুনশ্চ : দুইটা জিনিস ইন্টারেস্টিং। প্রথমত, নতুন নবজাগরণ বুঝাইতে নতুন শব্দটা উনি রবি ঠাকুরের ধাঁচে এখনো লিখতেছেন! যদিও কিছুদিন আগে কিছু চ্যাংড়া (বিদেশে থাকে বোধহয়) ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর বৌদির সম্পর্ক নিয়া জঘন্য টাইপের মিম বানাইছিল। উনি সেইটা ভীষণ অ্যাপ্রিশিয়েট করতেছেন দেখলাম। এখন আবার ঠাকুরধাঁচে নূতন লেখা তো উচিত না ভাই। আপনে মুসলমানি ধাঁচ বের করেন। এইভাবে লিইখেন না।
সাদিয়া নামের এক শিল্পীর আর্টওয়ার্ক শেয়ার করছেন এবাদ। উনি তো আর্ট কিউরেটর। ছবি সংগ্রহের তালাশে বিশ্ব ঘোরেন। এখন সাদিয়া কে সেইটা জানি না। আর্টওয়ার্কটি যদিও চমৎকার। আর যারা এই আর্টওয়ার্কের সাবজেক্ট, তারা কারা সেইটা ছবিগুলা দেখলে যে-কেউ বুঝতে পারবেন। এর মধ্য দিয়া বার্তাটা দিতেছে উনি,- বাঙালি মুসলমানের জাগরণ ধরে রাখতে কলেমা খচিত পতাকা নিয়া জিহাদে নামার সময় হইছে।
. . .
কিছুদিন আগে পিনাকী এবাদুর রহমানকে নিয়ে একটি প্রোগ্রাম করেছিল তার চ্যানেলে। বিষয়বস্তু ছিল ৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশে নতুন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলন তৈরি করা, যার মধ্য দিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থানকে একটি ভিত্তির উপর দাঁড় করানো যায়।
এবাদুর রহমান তো ফরহাদ মজহার শিবিরের লোক। বাংলার মুসলমান সমাজকে নিজস্ব পরিচয়ে তাঁরা দাঁড় করাতে আগ্রহী। বাঙালি সংস্কৃতির একান্ত মৌলিক সব উপাদানকে জাতীয়তাবাদ অনুসন্ধানের উক্ত পন্থা অনুসারে যে-কারণে অবিরত আঘাত হানছেন তাঁরা। ঐতিহ্যকে সংস্কৃতঘেঁষা ব্রাহ্মণ্য অভিমানী ও গেরুয়াপন্থী দাগিয়ে বিভাজন ঘটাতে ত্রুটি করেননি। পূর্ব বাংলার ভাষা বলে একটি কর্মযজ্ঞ এবাদুর রহমানের নেতৃত্বে সম্পন্ন হয়েছিল। চিন্তার এই সংকীর্ণতা, একপাক্ষিক অনুসন্ধান যে-জাতীয়তাবাদের রব তুলছে সেটি উগ্র হতে বাধ্য। উগ্র ইসলামী জাতীয়তাবাদী ফ্রেমে সুতরাং এবাদুর রহমান শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নিয়েছেন। এটি হচ্ছে তাঁদের চিন্তার অনিবার্য পরিণতি।
রবীন্দ্রনাথ ও সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এরকম আরো যত ঐতিহ্য রয়েছে, তার সবটাই তাঁদের কাছে অপাঙক্তেয়;- প্রবলভাবে ঘৃণিতও। প্রবণতাটি থেকে উক্ত ধারায় সক্রিয় লেখক-বুদ্ধিজীবীরা কেউ মুক্ত না। তাঁরা আর কিছু করতে পারুন বা না পারুন, সমাজে ঘৃণা ও বিভাজনকে জিইয়ে রাখবেন। তাঁদের এই বুদ্ধিজীবীতার পরিণাম আমরা চোখের সামনে এখন দেখছি প্রতিদিন।
. . .
চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা
এবাদুর রহমান নাকি এবাদ রহমান… কোন নামে ডাকব সেইটা এখন বুঝতেছি না জাভেদ! ফেসবুকে উনি নাম সংক্ষেপ করছেন। আবার অন্যত্র এবাদুর রহমান নামে পরিচয় রাখতেছেন। বিষয়টি মনে কনফিউশন তৈয়ার করে। একটা সময় কেবল এবাদুর রহমান নামে লিখতেন। ফরহাদ মজহারের মুরিদ হিসেবে পূর্ব বাংলার ভাষা প্রকল্প চালুর দিনকালে সেই নামে আমরা তাঁকে চিনছি। তাঁর সঙ্গে যাদের ভাবনা সাংঘর্ষিক ছিল তখন, নামের পয়লা অক্ষর বাদ দিয়া বাদুর নামে তারা তাঁকে ট্রোল করত। কুলদা রায় একটু বেশি-বেশি করতেন। সে-কারণে হয়তো ফেসবুকের মতো পাবলিক প্লাটফর্মে সক্রিয় এবাদুর নিজ নামের ওপর ছুরি চালাইছেন। কাটছাট করছেন নামখানা।
করতেই পারেন। নিজের নাম কোথায় কীভাবে জুড়বেন সেইটা উনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বা অভিপ্রায়। কারো ব্যক্তিস্বাধীনতায় বাধা দেওয়ার এখতিয়ার আমাদের নাই। হইতে পারে, নামবদল নিয়া উনি থোড়াই ভাবছিলেন। বদলের পরিণামকে কেয়ার করেন নাই বড়ো। আমরাও করি নাই। বিশেষ কারণে এখন করতে ও ভাবতে বাধ্য হইতেছি। নিজ নামের উপ্রে তাঁর এই শল্যচিকিৎসার মাহাত্ম্য আছে মনে করি। একটু খোলাসা করে না বললে ধরতে পারবেন না। যেমন ধরেন, কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ সমাজমাধ্যমে তাঁর মার্কামারা নামে আত্মপ্রকাশ করছিলেন। একটা পর্যায়ে এফবি প্রোফাইলে গোমেজের পরিবর্তে গোমেদ শোভা পাইতে দেখছি আমরা! কবিতায় পরিহাসপটু গোমেজ নিজ নাম নিয়া মশকরা করলেন স্ব-ইচ্ছায়।
গোমেজ এখন এইটা কেন করলেন? প্রশ্নটা তাঁকে কেউ করছেন বইলা আমার জানা নাই। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের কবিতা আমরা যারা পড়ছি একসময়, তাঁর ব্যাপারে মোটের ওপর ধারণা রাখি কমবেশি, তারা এই নামবদলকে খামোখা যাইতে দিবো কেন? বদল কেন করছেন সেইটা একবার হলেও আন্দাজে নিতে চেষ্টা করব। আমার যেমন মনে হইছিল,- দেশজাতির ওপর দিয়া যেসব ঝড় অবিরত যাইতেছে, সেখানে গোমেজ নিস্পৃহ মনে কবিতা লেখায় সম্পৃক্ত রাখেন নাই নিজেকে। সক্রিয় থাকছেন আগাগোড়া। তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে কবিবন্ধুদের সঙ্গে দেশজাতির গতিবিধি নিয়া বাহাসে লিপ্ত হইছেন ম্যালা! সময়টানে বাহাসের তীব্রতা হ্রাস পাইলেও রাইসুদের সঙ্গে পুরানা দোস্তিতে কমবেশি ঘাটতি তাতে দেখা দিছে নানান সময়। এইটা যদি মার্ক না করে থাকেন তাইলে বুঝতে হবে আপনি সমাজমাধ্যমে সক্রিয় থাকার মধু ও বিষের কোনোটাই বোঝেন না।
গোমেজ এভাবে এফবিতে নিজের একটা স্বকীয়তা তৈরি করে নিছেন। তাঁকে স্টাডি করতে যেটি সাহায্য করে বেশ। ব্রাত্য রাইসুসহ আরো অনেককে মার্ক ও স্টাডি করতে যেমনটি করে আর কি! পুলিপোলাও-র কবি এই-যে গোমেজের জায়গায় গোমেদ লিখতে শুরু করলেন তার কারণ কিন্তু ওই বন্ধুবৃত্ত। রাইসু ছাড়াও অনেকের সঙ্গে মতের অমিল এতটাই তীব্র হইতেছিল, সময়টানে তাঁরা একজন আরেকজন থেকে দূরে সরে যাইতে থাকলেন। বন্ধুবৃত্তের অনেককে অচেনা বইলা মনে হইতেছিল গোমেজের। তাদেরকে ঠিকঠাক আদমসুরত বা মানুষ বইলা ভাবতে অসুবিধা বোধ করতেছিল উনি। এখন তাদরেকে তো আর সরাসির গবাদি বইলা ডাকতে পারে না। তাতে শোভনতা বিপন্ন হয়। পরিহাসপটু গোমেজ কাজেই নিজ নাম দিয়া শোধটা তুললেন। গোমেদ লিখে বুঝাইতে থাকলেন,- বাংলাদেশের মতো তার কবিলেখক প্রজাতি মোটের উপ্রে মানুষ নাই এখন;- খড়বিচালি খাওয়া গবাদিতে পরিণত করছেন নিজেকে।
গোমেজের এই মশকরার পেছনে সমাজমাধ্যম অনেকখানি দায়ী। দিনের-পর-দিন দেশে খ্রিস্টান সংখ্যালঘু রূপে যাপনের তিক্ত সব অভিজ্ঞতা তাঁর মনে সংগোপন ক্ষত তৈরি করছিল। সমাজমাধ্যমে রাইসু-এবাদরা আওয়ামী ন্যারেটিভকে ধসাইতে নেমে যেসব বয়ান তৈরি করেন, সেখানে সংখ্যালঘু হিসেবে পুলিপোলাওর কবি আত্মপরিচয় নিয়া দাঁড়ানোর মাটি দেখতেছেন না। ঝামেলা মূলত সেখান থেকে ঘটে বইলা আমরা ধরে নিতে পারি।
মার্ক করেন, গোমেজ কিন্তু কোনোভাবে আওয়ামী বয়ানকে সাপোর্ট করার বান্দা না। এই দল ও তার কাজকারবারের ওপর তাঁর ঘৃণার মাত্রা সাংঘাতিক! অন্যদিকে না চাইলেও সংখ্যালঘু তকমা তাঁকে বহন করতে হইতেছে। সেখানে হাসিনা আর ওদিকে মজহার-এবাদ-রাইসু-সুমন… দুই পক্ষের একজনও তাঁর অবস্থান নিয়া ভাবিত নয়। একধরনের ইগনোরেন্সে আছে তারা। গোমেজ সেখান থেকে পুরানা দোস্তদের সঙ্গে মেরুকরণ ও মেরুবিচ্ছেদে গেলেন । গোমেদ লিখে বুঝাইতে থাকলেন, তোরা ভাই নিজেকে গবাদিতে চেঞ্জ করে ফেলছিস। হাসিনাপার্টির সঙ্গে তোদের বালের ন্যারেটিভ ওই খড়বিচালির সমান! ওগুলা খাইতে থাক তোরা।
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের জায়গায় দাঁড়িয়ে যদি দেখি তাহলে এইটা আইডেন্টিটি পলিটিক্স এবং উনার অবস্থান থেকে উনি তা বহন করতে বাধ্য। আমার পূর্ণ সমর্থন আছে সেখানে। এবাদ কিন্তু সেরকম কারণবশত নামে কাঁচি চালান নাই। লোকের টিটকারী থেকে বাঁচতে নামে কাটছাট আনতেছে উনি। এবাদুর নামটার ওপর সটান দাঁড়িয়ে থাকার হ্যাডম যেখানে উনি দেখাইতে পারে নাই। এই ব্যক্তিত্বহীনতা জুলাইয়ে তাঁর নিশ্চুপ থাকার পেছনে ভূমিকা রাখছিল। এখন উনি যতই ত্যানা প্যাঁচাক, উনার বিপ্লবী ভাইলোগ তাঁকে ছাড়বে না। মওকা পেলে তারা তাঁকে খোঁচাবে। এইটা আমার মত। অন্যদের সেখানে ভিন্নমত থাকতেও পারে।
যাই হোক, এবাদ রহমান পড়াশোনাকরা লোক। ভিন্ন ধাঁচে লিখতে পারা লোক। গুণী ও মেধাবী। তাঁর যোগ্যতা নিয়া মনে হয় না কারো দ্বিমত বা আপত্তি আছে। যারা তাঁকে অপছন্দ করে, তারা এর জন্য উনাকে গালি দিতেছে বলাটা সরলীকরণ হয়ে যাবে। জুলাই আন্দোলন তুঙ্গ হওয়ার আগে অবধি নিষ্ক্রিয়তার কারণে এবাদের উপ্রে যারা খাপ্পা ছিলেন বা এখনো আছেন কমবেশি, তার নেপথ্যে বিবিধ কার্যকারণ আছে বটে! আমি আমার অনুমান আপনাকে জানাইতে পারি :
নাম্বার ওয়ান : এবাদ বাংলাদেশকে বা বাঙলি মুসলমানকে যে-দৃষ্টিকোণ হইতে ব্যাখ্যা করেন সেইটা অনেকের কাছে আত্মঘাতী। সমালোচনা সেখান থেকে আসতেছে। এর সঙ্গে উনার সাহিত্যিক তৎপরতার বিশেষ যোগ নাই। আমার ধারণা, যারা গালি দিতেছে তারা সেগুলা পড়ে নাই। পড়ার দরকার নাই। সেখানে এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়া যদি কিছু থাকেও,- এবাদের সমাজমাধ্যম কেন্দ্রিক ধারবাহিক বক্তব্যে তার সিংহভাগ প্রতিফলিত। নাম্বার টু : এবাদের কাছে জুলাইটা বিপ্লব বইলা গণ্য। আমাদের মতো বহু লোক আছেন যারা ওই চোখে জুলাইকে দেখতে অক্ষম। এখন এই বিষয় নিয়া উভয় পক্ষের বনিবনা ইহজীবনে হওয়ার নয়। ধস্তাধস্তির সম্ভাবনাকে বরং প্রবল ধরা যাইতে পারে সেখানে।
যারা বিপ্লব বলতেছেন এবং যারা সেইটা মানতে নারাজ, দুটি পক্ষই আদতে যে-যার কক্ষপথ স্বজ্ঞানে বেছে নিছেন। সেই মোতাবেক নিজ কক্ষপথে তারা ভ্রাম্যমান। ইহজীবনে কাছাকাছি হওয়ার সম্ভাবনা নাই। দরকারও নাই বলা যায়। উভয় পক্ষ পরস্পরের চেনা হইলেও অচেনা। চিনতেছি জানার পরেও না চেনার ভান করতে দুই পক্ষই বাধ্য এখন। হাসিনার পতন উভয়কে এই জায়গায় এনে দাঁড় করাইছে।
. . .
এবাদুর আর গোমেজ সময়ের তালে চলেন। সময়ের বাইরে কিছু থাকতে পারে, তারা তা নিতে পারেন বলে মনে হয় না। যাঁদের নাম নিলাম, শুধু তারা না, আমাদের পরিচিত আরো অনেক কবি-লেখক আছেন সেখানে। তাদেরকে জেনে রাখা ভালো। জানার বদলে পর্দা তুলে দেওয়ার মানে হয় না।
. . .
পর্দা হ্যায় পর্দা
পর্দা থাকলে তো পর্দা টানবেন সায়েম। আমরা কিন্তু ঘরের বিষয় নিয়া আলাপ করতেছি না। জাতীয় জীবনে দেখা দেওয়া সংকটের জায়গা থেকে আলাপ চলতেছে। দেশ-জাতি-সরকার ইত্যাদি আমাদের মতো ছাপোষা মানুষের জন্য গুরুপাক, তথাপি এসব নিয়া কথা বলতে বাধ্য করা হইতেছে। কারণটা সিম্পল,- ইয়াবড়ো বিষয়গুলা আমার-আপনার মতো ছাপোষা মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতেছে অনেকখানি। আদার ব্যাপারী হয়েও জাহাজের খবর নিতে আমরা অগত্যা মজবুর হয়ে পড়ছি। আম্রিকার মতো দেশে থাকলে কিন্তু মজবুর হওয়া লাগত না।
আম্রিকায় বিগবসরা এমনভাবে ছক তৈরি করেন, সেখানে আপনি সিটিজেনের যা দরকার সেগুলা তারা নিশ্চিত করতেছেন। নিশ্চিত করতে গিয়া এখন তারা কার টুপকিতে আঙুল দিতেছে… এসব নিয়া নওম চমস্কির মাথাব্যথা থাকতে পারে,- বাকি সিটিজেনরা বদার করে না। আমরা এখনো ওই সিঁড়িতে পা দিতে পারি নাই। আরো অপেক্ষা করতে হবে। হাসিনা তাঁর মতো চেষ্টা করছেন, কিন্তু শেষের দিকে সব তালগোল পাকানোর কারণে দেশছাড়া হইতে হইছে তাঁকে। ইউনূস সায়েব এখন চেষ্টা করতেছেন, যেন আমরা স্বপ্নের সিঁড়িতে কদম রাখবার পারি। এবাদ-রাইসুরা সেখানে উনার হয়ে কামলা দিতে আছেন। নতুন বাংলাদেশ গড়ার খোয়াব নিয়া জোর কদমে আগুয়ান হওয়ার চেষ্টায় আছেন তাঁরা।
আমাদের মতো গাণ্ডুরা সমস্যায় আছি। নিজের কোনো ভ্যালিডিটি সেখানে আমরা খুঁজে পাইতেছি না। আমাদেরকে আদার বা অপর বা সংখ্যালঘু, এবং এভাবে একদিন মাটিতে কবর দেওয়ার মতলব বুকে নিয়া নতুন বাংলাদেশ গড়ার মিশনে এবাদরা নিয়োজিত। গোমেজের সঙ্গে উনার জানি দোস্তদের অথবা আমাদের সঙ্গে চেনা পরিচিত অনেকের লড়াই এখান থেকে পুনরায় গতি পাইছে। এর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমরা কে কারে চিনিজানি, কে কার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করছি, কে কার জানু ছিলাম বা আছি… ইত্যাদির ভাই কোনো সম্পর্ক নাই। আপনি রিড করতে আবারো ভুল করলেন।
পর্দার আলাপ, বুঝতে পারতেছি আপনি সরলমনে তুলছেন। সমস্যা হইল, ওপরে যে-কথাগুলা এইমাত্র বললাম, যদি ভাবেন তাইলে বুঝতে পারবেন,- এখানে পর্দা বইলা কিছুর অস্তিত্ব কখনো ছিল না। কক্ষপথ শুরু থেকে আলাদা। এখনো আলাদাই আছে। দুটি কক্ষপথে যারা আছেন তাদের দেখার ধরন, ভাবনা ও বিবেচনা পৃথক। এতটাই পৃথক যে, সেখানে পর্দা টানার মামলা নাই। যে-যার কক্ষপথ থেকে আমরা একজন আরেকজনকে ন্যাংটা দেখতে পাইতেছি। লজ্জাতুন্নেসা হওয়ার দরকার নাইরে ভাই।
. . .
সায়েম ভাই ইশারাঘন কথা বলেছেন। অন্তর্নিহিত ভাব কৌশলী ভাষায় প্রকাশ করতে চেয়েছেন। এই দ্ব্যর্থকতা অগ্রাহ্য করা যেতে পারে, আবার সময় বিবেচনায় আমলেও নেয়া যায় একে। অগ্রাহ্য করা এই অর্থে যে, তিনি স্পষ্ট করেননি কী কী কারণে তাদের চিনে রাখা দরকারি? মিনহাজ ভাই প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে আলাপ তুলেছেন। সায়েম ভাইয়ের ক্লারিফিকেশন এখানে আরো স্বচ্ছ বা সরাসরি হতে পারত। যাইহোক সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ কবি হলেও সবার ওপরে তিনি একজন মানুষ। সমাজমাধ্যমে সংখ্যালঘুসহ নানা ইস্যুতে অসহিষ্ণু ভাবাদর্শিক আবহ মনে হয় তাঁকে বিচলিত করেছে বারবার। অনুমানটি তাই অবান্তর নয়। এবাদুররা যে-ছকে ভাবতে অভ্যস্ত, গোমেজের এখন হবহু একই ছকে ভাবার যৌক্তিকতা নেই।
এবাদুর রহমান শুরু থেকে উদ্দেশ্যমূলক। তাঁর সম্পাদিত পূর্ব বাঙলার ভাষা ও অন্যান্য রচনায় সেই আভাস তিনি অবিরত দিয়ে গেছেন। এদিকে থেকে উনি বা সমমনা আরো যারা রয়েছেন, তারা সকলেই ভাবাদর্শিক অবস্থানে একে অন্যের পরিপূরক। ফরহাদ মজহারের চিন্তায় বৈচিত্র্য ও ব্যাপকতা থাকলেও এবাদুর রহমান সরলরৈখিক পথ ধরে সবসময় এগিয়ে গেছেন। মজহারকে তাঁর ভাবনার ব্যাপ্তি ও স্ববিরোধিতার কারণে অনেকসময় ধরতে সমস্যা হয়। কোন মতলবে বলছেন সেটি বুঝেও বোঝা যায় না। এবাদুর রহমানের ক্ষেত্রে প্রব্লেমটি একেবারে নেই। সরলরৈখিক হওয়ায় তিনি আসলে কী ভাবছেন, তাঁর উদ্দেশ্য কী… এগুলো বুঝতে খুব বেশি খাটতে হয় না।
প্রশ্ন হলো, তাঁর চিন্তা ও তৎপরতা কেন বিপজ্জনক? কী কারণে নিজেকে উনি আলাদা করতে তৎপর? উত্তরে আমার এটাই মনে হয়েছে সবসময়,- উনার সকল তৎপরতা একটি উদ্দেশ্য পূরণে এখন পর্যন্ত অগ্রসর। নিজের শিকড় খুঁজতে গিয়ে ধর্মীয় আত্মপরিচয়কে তিনি নিশানা করেন। ইতিহাসের একটি ফ্রেমে বসে আত্মপরিচয়ের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আবর্তকে বিবেচনায় নিতে থাকে উনি। ধর্মীয় আত্মপরিচয়ে সক্রিয় ভাবাদর্শকেও এভাবে গ্রহণ করেন এবাদুর রহমান। ভাবাদর্শকে যেখানে প্রশ্ন করার দায় তাঁর মধ্যে আমরা দেখি না। যে-মতলবে তিনি এসব ঘটান, এখন বাকুচাতুরীর সাহায্যে একে বৈধ করাটা তাঁর মিশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলাফল তাহলে কী সেখানে? ফলাফল হচ্ছে, তাঁর মধ্যে সাম্প্রদায়িক অভিমানের প্রাবল্য সময়-সময় নাঙ্গা হতে দেখছি আমরা। সাম্প্রদায়িক অভিমান চিন্তার পরিসরকে এভাবে ছেটে ফেলে। নিজের সৃজনশীল তৎপরতাকে অগত্যা একরৈখিক ও সংকীর্ণ করে তুলছেন এবাদুর।
মানুষের সামগ্রিকতাকে তিনি যাপন করতে ইচ্ছুক বলে কখনো মনে হয়নি। গ্রহণ যতটা করেন, বর্জন করেন আরো ব্যাপক পরিসরে। বিভাজন হচ্ছে তাঁর মৌল-আকাঙ্ক্ষার জায়গা;- তাতেই পরিতৃপ্ত তিনি। সময়-পরিপার্শ্বে নিজেকে অবরুদ্ধ করে ইতিহাস-চেতনাকেও এভাবে একরৈখিক করে তোলেন। দায়মুক্তিও নিয়ে নেন সেখান থেকে। নিজেকে কোনো একটি ফ্রেমে ভুলভাবে রুদ্ধ করা যে-কোনো চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক। এটিকে মৌলিক ত্রুটিও বলা যেতে পারে। সাহিত্যিক মান যাই থাকুক, মানুষকে অবরুদ্ধ এক সামাজিকতার দিকে টানার মিশনে এবাদুর রহমান সদা নিবেদিতপ্রাণ। এটি তাঁর মঞ্জিলে মকসুদ।
এবাদুর রহমানদের এসব বিভ্রান্ত তরিকার ফলাফল জুলাই আন্দোলন পরবর্তী বাংলাদেশে আমরা পরিষ্কার টের পাচ্ছি। হাসিনা আমলে সেটি ঢাকা ছিল মাত্র। ধর্মরাষ্ট্রের চাপ এখন আমাদের নিতে হচ্ছে, যেখানে মজহার, এবাদুর, জামাত, হেফাজত সব গলেমিশে একাকার! আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করাটা যেখানে তাঁদের একমাত্র ব্রত। এখান থেকে তাঁদের মধ্যে চিন্তাগত ঐক্য সুস্পষ্ট। একজন আরেকজনকে সুতরাং পিঠ চাপড়াচ্ছে উনারা।
এবাদুর রহমানকে ডিএফপি অডিটোরিয়ামে আমন্ত্রণ করেনি। এটি ভুল বোঝাবুঝি মনে হচ্ছে। উনার তরিকা থেকে ইউনূস সরকার মোটেও দূরবর্তী বা বিচ্ছন্ন দ্বীপ নয়। সুতরাং উনি তাঁর পরিকল্পনা ভালোভাবে চালিয়ে যেতে পারবেন মনে হচ্ছে। সায়েম ভাইয়ের সুবাদে তাঁর দীর্ঘ একখানা কবিতা পাঠ করলাম। বাংলা একাডেমিতে স্বকণ্ঠে পাঠ করার কথা ছিল। কবিতার কমেন্টবক্সে শরিয়া শাসন কায়েমে মরিয়াদের সহানুভূতির অন্ত নাই মনে হলো। তথ্যচিত্রেরও লিংক পেলাম। কারা কীভাবে হাসিনাপতনের আন্দোলনে সক্রিয় ছিল তার আত্মবয়ান দিয়ে তথ্যচিত্রটি সাজানো। সেখানেও শরিয়াভিত্তিক বাংলাদেশের স্বপ্নের কথা অনেকে বলেছেন। এবাদুর রহমানকে কাজেই এসব প্রেক্ষাপট থেকে দেখা যৌক্তিক। উনি এরকম একটা কিছুই চাইছেন, স্বপ্ন দেখছেন অনেকদিন ধরে। এবার মনে হয় কায়েম করেই ছাড়বেন।
. . .
এবাদনামায় হিংটিংছট বাঙালি মুসলমান
এবাদুর রহমানের সমস্যা হচ্ছে উনি বাংলাদেশী জাতিসত্তার আত্মপরিচয় বাঙালি মুসলমানের মধ্যে এখনো তালাশ করতেছেন। কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু এলিট সমাজের নবজাগরণ ও তার ফলশ্রুতিতে বাঙালি জাতিসত্তার যে-ন্যারেটিভ সময়ের সঙ্গে গড়ে উঠছিল, সেখানে মুসলমানসহ অন্যরা অচিহ্নিত ছিলেন। বাংলাদেশী মুসলমান সম্প্রদায় লম্বা সময় ধরে হিন্দু নবজাগরণসৃষ্ট ঐতিহাসিক ফ্রেমের ভিতরে বসে নিজেকে এতিমের মতো খুঁজে ফিরছেন। সংগতকারণে মুসলমান সমাজের জীবনধারা, তার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান, তার রাজনীতির সবটাই হিন্দু নবজাগরণ হইতে সৃষ্ট ভাষা ধার করতে বাধ্য ছিল। হিন্দুসৃষ্ট ভাষা দিয়া নিজের মুসলমান পরিচয়কে খুঁজতে থাকায় একধরনের মেকি প্রগতিশীলতা তাদের মধ্যে দেখা দিতে থাকে। নিজেকে চিনতে যা সাহায্য করে নাই।
এসব জায়গা থেকে জনাব এবাদ প্রথমত দিল্লি কেন্দ্রিক হিন্দুত্ববাদী গেরুয়া উত্থানকে ক্রিটিক করেন অহরহ। উনার ধারণা,- দিল্লি কার্যত বাঙালিকে মার্জিনাল ও আদার করে রাখতে চায়। সেইসঙ্গে তাদেরকে গেরুয়া হিন্দুত্বের বসন পরিয়ে ব্রেনওয়াশড করতেছে এখন। এই জায়গা থেকে তিনি তাঁর গুরু ফরহাদ মজহারের মতো দিল্লিকে ডেলি একবার ঝাড়েন। না ঝাড়লে বোধহয় কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। এই রাজনীতি উনি সাহিত্যে নিয়া আসছেন, এবং জাতির সাহিত্যিক মান স্থির করার দায়িত্বও কাঁধে বহন করতেছেন। দ্বিতীয়ত, বাঙালিকে তিনি গেরুয়া উত্থানের বাইরে নিজ স্বকীয়তায় বিকশিত দেখতে ইচ্ছুক। যেখানে সে লোক-ঐতিহ্য ও ধর্মীয় ঐতিহ্যকে একীভূত করে বিকশিত হবে;- এইটা তাঁর খায়েশ। সে পরিত্যাগ করবে হিন্দু এলিট ব্রাহ্মণসৃষ্ট ডিসকোর্স। হইতে থাকবে হিন্দু ও মুসলমান বাঙালি। ভারতবর্ষের মতো বিচিত্র রক্তসংকর জাতি এককভাবে হিন্দু বা মুসলমান বাঙালি কীভাবে হবে সেইটা মাথায় ধরে না আমার!
এবাদ আরো আগে বাড়েন এইবেলা। নসিহত দিতে থাকেন,- মুসলমান হিসেবে যারা বাঙালি তারা এখন বঙ্গে মুসলমান শাসনের কালপর্ব থেকে নিজেকে রিড করবে এবং গড়ে তুলবে নিজের ইমানি বিশ্বাস ও রাজনীতি। উনার এই আজব থিয়োরি হইতেছে ফরহাদ মজহারের দরদি অংশীজনের সমাজ নামক বিচিত্র মত-পথ-পন্থাকে খিচুড়ি বানিয়ে তৈরি হাইপোথিসিসের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। বলা যাইতে পারে উনি মজহার থেকে সবটা কপি করতেছেন এখানে। তারপর সেটাকে কেটেছেটে ইসলামিক বানাইছেন। এতো হাঙ্গামার পর যেইটা দাঁড়ায় তাকে তো ভাই হিন্দু নবজাগরণের নকলি লাগে দেখে! হিন্দু নবজাগরণের ছাঁচে উনি মুসলমান নবজাগরণের ছাঁচ বানাইতেছে, আর আমাদের কবি-লেখকের বড়ো একটি অংশ সেইটা দেখে আত্মহারা বোমভোলা। ঊনিশ শতকের বাঙালি রেনেসাঁসের পটভূমি কিংবা আরো পেছনে গমন করলে সংস্কৃত ভাষাকে কুক্ষিগত রেখে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণসমাজ সৃষ্ট আদি-জাগরণের পটভূমি ইত্যাদি উনারা ভালোভাবে বোঝেন কিনা কে জানে!
দুই বিশিষ্ট কালপর্বের ওপর ফরহাদ মজহার বা সলিমুল্লাহ খানের স্টাডি থাকতে পারে, এবাদ এখানে তাঁদের মুখের ঝাল খাইতেছেন মনে হয়। নিজে গভীরে গিয়া নড়াচড়া করলে গাড্ডায় পড়বেন। ওই সময়ের পটভূমিতে কী কারণে হিন্দুরা তাদের একলার চেষ্টায় সংঘটিত নবজাগরণে মুসলমানকে প্রান্তিক রাখলেন সেইটা অনায়াস ধরতে পারবে উনি। বেশিদূর যাইতে হবে না। বঙ্কিমের নিবিড়পাঠ প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য ভালো কাজে দিবে। এবাদ কি তাহলে বঙ্কিম পড়েন নাই বইলা ধরে নেবো?
এবাদ একদিকে বাঙালি হিন্দু সমাজকে বিনষ্ট করার জন্য রবি ঠাকুরসহ পুরো এলিট সমাজকে ঝাড়েন, অন্যদিকে নিজে আরেকখান মুসলমান এলিট সমাজের জন্ম দিয়া বসতেছেন! মহা গণ্ডগোলের বিষয়! এর মধ্য দিয়া সাম্প্রদায়িক অভিমান যে নিজের মধ্যে তীব্র করতেছেন সেইটা উনার কাছে ব্যাপার না। উনার রাজনীতি ও ইতিহাসচেতনা এখনো মুসলমান পরিচয়ে আটকা পড়ে আছে। এখনো আমি শোষিত ও প্রান্তিক ছিলাম, তারা আমারে ডমিনেট করছে, আমার পরিচয় তৈরি হইতেছে না;- এসব নাকিকান্নার বৃত্তে ঘুরপাক খাইতেছেন! আজব বটে!
উনারা ভাবতেছেন,- এভাবে বাংলাদেশ তার স্বকীয় পরিচয় গড়ে নিতে পারবে। ইবনে খালদুনের আসাবিয়া বা গোত্র-সম্প্রীতির বৃহত্তর ভার্সন হইতেছে জাতীয়তাবাদ। এখন সেইটা যে-ফ্রেমে আমরা দেখি না কেন। জাতির আত্মপরিচয় গড়তে এইটা লাগবে, কিন্তু এর মধ্যে সংকীর্ণ হইলে ক্ষতির শেষ নাই। হিন্দু জাতীয়তাবাদের কাউন্টার মুসলমান জাতীয়তাবাদ! হাস্যকর এই ফ্রেমিংটা এখন বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষের চাওয়ায় পরিণত করছেন মজহার-এবাদ গং। হাওয়া ভীষণ অনুকূল। অ্যারাব স্প্রিং মিশরে সফল হয় নাই। উনারা মনে হইতেছে সফল করেই ছাড়বেন।
সোজা কথায় ইসলামের রাজনৈতিক বিকাশ, তার মরমি আধ্যাত্মিক উন্মেষ ও জাগরণ, তার লোকায়ত সংমিশ্রণ, তার আভিজাত্য ও গরিমা, এবং এর সঙ্গে নিম্নবর্গ বা সাবঅল্টার্নকে সেখানে একীভূত করা… সব মিলিয়ে একটা ককটেল বানাইছে উনারা। এবাদের ভাষা ও চিন্তার তরিকাটি যে-কারণে ককটেলের ন্যায় দেখায়। অনেকে এর সাহিত্যিক রূপ দেখে টাসকি খাইতেছেন। আদতে এগুলা হলো পোস্ট কলোনিয়াল নাইটমেয়ার। একইসঙ্গে বিভিন্নস্তরে নিজেকে গোলাম ও শোষিত দেখার বিকার সইতে না পেরে মনে যে-ইগো পয়দা হয়, তার আউটবার্স্ট।
একুশ শতকের পৃথিবীতে জাতীয়তাবাদের অন্য লেভেলে চলে যাইতেছে ক্রমশ। পুঁজিবাদ এখন দেশীয় জাতীয়তাবাদের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে একাধিক জাতিরাষ্ট্রে একীভূত নয়া অলিগার্কি টাইপের ন্যাশনালিজমে মোড় নিতেছে, যার প্রতিনিধি রূপে আমরা পুতিন মামা, ট্রাম্পু মামা, মোদিজিকে ডমিনেন্ট ক্যারেক্টার হয়ে একক্ষুরে মাথা কামাইতে দেখব অচিরে…;- আর উনি এখনো মুসলমানের প্রাগৈতিহাসিক বঞ্চনার আলাপ নিয়া পড়ে আছেন। মুসলমান সম্প্রদায় আসন্ন বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলানো ও নয়া সমাজ পত্তনের দিকে কীভাবে যাইতে পারে তার কোনো থিয়োরি উনাদের কাছে নাই। সবটাই ওই ফরহাদ মজহারের বেবি ভার্সন।
সায়েম সরল মানুষ। উনার সরলতাকে এবাদরা দরকার পড়লে কামে লাগায়, কাম শেষ হইলে সোজা রাস্তা মাপতে কয়। তারা হইতেছে উচ্চাঙ্গ আর উনি নিম্নাঙ্গ। সমস্যা হইল এইটা সায়েম বুঝতে না পেরে আবার যান, যাইতে থাকেন, এবং কট খান। লাল বিপ্লবের মহিমা হইল সবাইকে ওই বাঁধন ম্যাম আর শবনম ফারিয়ার মতো আবাল বানাইছে। ভাই, আপনার এইগুলার সঙ্গে যাওয়ার দরকার কী? সোজা ইগনোর করেন।
মুজিবের মাল্টি ক্লাস থিয়োরিতে বরং আসেন। উনি পারে নাই, কিন্তু এই বুঝ উনার ছিল, বাঙালি বললেও তার মধ্যে পাহাড়ি আছে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আছে, অবার সংখ্যালঘু হিন্দু আছে, আরো আছে বিচিত্র সব ধান্ধা নিয়া কাউয়া মামার মতো আজিব কিসিমের ধান্দাবাজ। সব মিলিয়ে একটা সংকর জাতি। এদেরকে চীনা স্টাইলে দাবায়া রাখা সম্ভব না, আবার ছাড় দিলে বান্দর হয়ে মাথায় উঠে নাচবে। এখানে বিশ্বস্ত আছে,- মীরজাফরও ভরতি। এ-কারণে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স ছাড়া জাতটারে লাইনে নেওয়া কঠিন। ওইটা করতে গিয়া এবং করতে না পেরে উনি জান দিলো। কথা কিন্তু সত্য, কোনো একটা ফ্রেমে আপনি বাঙালিকে ধরতে পারবেন না। সকল ফ্রেমের মধ্য থেকে সলিড জিনিসগুলা বাহির করেন। সেগুলাকে সঙ্গে নিয়া সেকুলার টাইপ পুঁজিবাদী সমাজে কী করে যাওয়া যায় তার তালাশে পারলে নামেন। এবাদ যা চাইতেছেন তার বেইল সামনের পৃথিবীতে থাকবে না। বিগবসরা এগুলা কাট করতেছে। নয়া মহাসড়কে কী করে জান বাঁচাবেন সেইটা ভাবতে পারে উনি।
হারারি বলছিল না, আমরা এখন ইনফরমেশন এজ-এর এমন এক যুগে আছি যেখানে তথ্যকে ম্যানিপুলেট করে অবিরত মেকি ভাবাদর্শ জন্ম নিতে থাকবে। বাকিরা সেখানে পাছা মোছার টিস্যু রূপে স্রেফ ব্যবহৃত হবে। এবাদকে অচিরে সেই নিয়তি বরণ করতে হবে। তার আগে ওই জাদুঘর নামের জিনিসখানা উনি ভালো তৈরি করতে পারবে। হাজার হোক উচ্চাঙ্গমারানি এলিট…! থুক্কু, কাজী ইমদাদুল হক বিরচিত আবদুল্লাহ উপন্যাসের আশরাফদের উনি রিপ্রেজেন্ট করতেছেন। উনার একহাতে ইসলাম, আরেক হাতে রণজিৎ গুহ আর ইরফান হাবিব। এর বাইরে কোনো জগৎ নাই।
. . .