নেটালাপ

জামায়াত কেন নিষিদ্ধ করা গেল না

শর্ট ইন্ট্রো : হাসিনা সরকারের পতন পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের জের ধরে দেশে উগ্রবাদী রাজনীতির উত্থান বিষয়ে থার্ড লেন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে  জারি থাকা আলাপের অংশটি অক্টোবর মাসের ২৩ হইতে ২৪ তারিখে সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশে জামায়াতি ইসলামীর রাজনৈতিক ভিত্তি ও প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ক আলোচনা ও মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য একত্রে সংকলিত করার মতলবে উক্ত আলাপটি আমরা তখন সাইটে আপ করা হইতে বিরত ছিলাম। এখনো প্রাসঙ্গিকতা আছে বিধায় জামায়াতে ইসলামীর জন্য সদা অস্বস্তিকর বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে আলাপটি সাইটে প্রকাশিত হইতেছে। জামায়াত নিষিদ্ধ নিয়া বহু পুরাতান ক্যাচালকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলাপিরা এখানে ভাবার চেষ্টা করছেন। আগ্রহী পাঠকদের পাঠ-শরিকানা বাঞ্ছা করি। 

. . .

সময় যতো গড়াচ্ছে, আন্দোলনকারীদের চেনা যাচ্ছে আর নানা প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে। 

প্রশ্ন ১ : হাসিনা সরকার যুদ্ধাপরাধীদের হত্যার পরেও জামাতে ইসলামকে কেন নিষিদ্ধ করলেন না? 
প্রশ্ন ২: আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে এখন শুধু জামাতিরা বেরিয়ে আসতেছে, আওয়ামী লীগ কি তবে জামাতিদের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল?  
প্রশ্ন ২:  হাসিনা কি জামাতিদের কেউ?

খুব ভয় হচ্ছে এসব চিন্তা করে। দেশ এখন কোন দিকে রওয়ানা দিচ্ছে? আজ ফেবুতে একটা ছেলের মাথা দুই ভাগ হয়ে গেছে দেখলাম। শরীরটা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। ছবিটার কথা মনে আসলে, আর কিচ্ছু করা যায় না…!

. . .

জামায়াতকে হাসিনা কেন নিষিদ্ধ করেন নাই তার জবাব পাইতে হলে ইমরান এইচ সরকারদের ডাকে উত্তাল শাহবাগ আন্দোলনকে আপনার বিবেচনায় নিতে হবে সায়েম। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন শুরুতে সংহত ছিল, পরে ইমেজ বিনষ্ট হয় দ্রুত। জাতিকে বিভক্ত করা হইতেছে, বিচারপ্রক্রিয়া সঠিক নয়, ইসলামের অবমাননা করা হইতেছে… ইত্যাদি অভিযোগ নিয়া ফরহাদ মজহার, মাহমুদুর রহমান, অসিফ নজরুলরা মাঠে সক্রিয় হইতে থাকেন। বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বাকিরা এই সুযোগে আন্দোলনটি আওয়ামীদের সাজানো বইলা লেবেলিং করে ব্যাপক। শাহবাগীদের গায়ে ধর্মীয় অবমাননা ও নাস্তিকতার ট্যাগ বসাইতে দিরং করেনি তারা। এসব কাণ্ডের জের ধরে হেফাজতের নজিরবিহীন উত্থান শাহবাগকে মাটিতে কবর দেওয়ার কাম সেরে ফেলে। আওয়ামীরা তখন হেফাজতকে নিয়া পলিটিক্সে যাইতে বাধ্য হয়। তারা ভাবে জামায়াতকে কোণঠাসা রেখে হেফাজতকে হাতে নিতে পারলে আখেরে মোল্লাদের ম্যানেজ করা সহজ হবে। চালটা কাজে আসে নাই। মোল্লারা ইহজীবনে আওয়ামীপন্থী ছিল না, কখনো হবেও না। হাসিনার মোল্লা পলিটিক্সের পয়লা কদম কাজেই ভুল ছিল। 

যে-পরিমাণ বয়ান ফরহাদ মজহার গং ওইসময় তৈরি করে সেগুলাকে কাউন্টার দেওয়ার মতো পাল্টা বয়ান শাহবাগীদের পক্ষে হাজির করা সম্ভব হয়নি। বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে বিচার করলে উনাদের ক্ষমতা ছিল না এইটা আটকানোর। মানুষ তখন সংগতকারণে মজহারদের বয়ান দ্বারা প্রভাবিত হইতে থাকে ও ব্যাপকভাবে গ্রহণও করে। ইসলামের অবমাননা, আলেমদের শাস্তি, ভারতের চাল… সবটাই দেশের পাবলিক বেদম গিলছিল তখন। বড়ো কারণ, সাঈদী এ্যাফেক্ট। দেশের বলদা কিছিমের পাবলিকের উপ্রে মাওলানা দেলওয়ার হোসেন সাঈদী ওরফে দেল্লা রাজাকারের ব্যক্তিগত প্রভাব কোন লেভেলের সেইটা যদি বোঝেন তাহলে মজহার মিয়াদের সাকসেসের কারণ ধরতে পারবেন। 

Delwar Hossain sayeedi on Moon – Rumor constructed by Basher Kella provoking people against Hasina Government; Source – Google Image

নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর মতো প্রভাবশালী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা খালি যুদ্ধটাই করছিলেন, পরে এর তাৎপর্যকে সময়ের আলোকে বিচার-বিবেচনা ও নতুন বয়ান তৈরিতে সক্রিয় থাকতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধ করা আর চেতনার লেবেল দিয়া নামতপড়া এক জিনিস না। জাতি-রাষ্ট্রের কার্যকর বনেদ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে সাংস্কৃতিক সংগ্রামে জারি থাকতে হইতে পারে। উনারা সেখানে বিরাট ডাব্বা মারছেন। মজহার গং এই সুযোগে মুক্তিযুদ্ধকে আওয়ামীরা ছিনতাই করতেছে বইলা বিভাজনের রাজনীতিতে হাওয়া দিতে থাকে। ওই অবস্থায় জামায়াত নিষিদ্ধ করার যৌক্তিকতাও হ্রাস পায়। তারে গুঁটি হিসেবে ব্যবহারের রাজনীতি হাসিনা সরকারের নীতি নির্ধারক মহলে স্থান নিতে থাকে ক্রমশ।

এখন আমরা এইটা দেখি যে, শাহবাগ আন্দোলন কারা শুরু করছিল তখন। আমরা দেখতেছি গেঞ্জিদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম জেন এক্সদের হাতে আন্দোলনটা তখন ভাষা পায়। আমরা সকলে ওই প্রজন্মে পড়তেছি। আমাদের আন্দোলনের নেপথ্যে নব্বইয়ের এরশাদ শাহীর পতন বড়ো প্রেরণা ছিল। সেখানে আবার গেঞ্জিদের পয়লা তরঙ্গ, মানে আজকের মাহফুজ-নাহিদ-আসিফরাও ছিল কিন্তু। পনেরো থেকে আটেরো-কুড়িতে পড়ছে এরকম বয়স নিয়া তারা ছিল সেখানে। প্রথমদিকে শাহবাগীদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হইলেও ফরহাদ মজহার গং যখন এইটারে লেবেলিং করলেন, তাদের মত ঘুরে গেল। বাকিটা ইতিহাস। 

Shahbagh Movement against War Criminals Execution; Source – Pinterest

কী ইতিহাস? গণজাগরণ মঞ্চ হইতে ঘোষিত আন্দোলন জাহানারা ইমামকে পুনরায় ফেরত আনতে পারলেও শেখ মুজিবকে ফেরত আনতে পারে নাই। তিন মাসের আন্দোলন মুজিবকে ফ্রেমের বাইরে রেখে করতে হইছে উনাদের! মুজিবকে প্রতিষ্ঠিত ও সর্বজনীন করতে গণজাগরণ মঞ্চ স্বয়ং ব্যর্থ হয়। সেইসঙ্গে জামায়াত নিষিদ্ধ করার সুযোগ মিস করেন হাসিনা। উনি কেন এত বাপের নাম নিতেন, অতিরিক্ত করতেন, এসবের পেছনে কারণ নেই বলা যাবে না। যদিও দেশ চালাইতে গেলে অনেককিছু নতুন করে বিবেচনা করতে হয়। হাসিনার ওই মেজাজ ছিল না।  

বাংলাদেশে একাত্তরকে যেসব বুদ্ধিজীবী একসময় ধারণ করছেন বা এখনো মোটের ওপর এই সনটিকে আমাদের অভ্যুদয়ের সন্ধিক্ষণ মানতে আপত্তি করেন না,- এখন তাঁদের একাংশই আবার একাত্তরকে বিতর্কিত করতে বড়ো ভূমিকা নিভাইছেন। ফরহাদ মজহার গং নামধারী এসব বুদ্ধিবিক্রেতা হইতেছে আসল ক্রিমিনাল। জেনারেশনের সংজ্ঞায় তাঁরা বেবি বুমার্সবাংলাদেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময়, সাহসী, মেধাবী, প্রতিবাদী, এবং একইসঙ্গে করাপ্টেড লোকজনে প্রজন্মটা ভরপুর। মেধা ও অবদান বিবেচনায় আমরা কেউ তাদের ধারেকাছে নাই। শয়তানির দিক দিয়াও উনারাই চ্যাম্পিয়ন। দেশটা স্বাধীন করছিলেন আবার সমানে বাঁশও দিতেছেন পাছায়। একইসঙ্গে সাহসী ও পল্টিবাজ জেনারেশন। হাসিনাসহ সব্বাই ওই প্রজন্মের বৈশিষ্ট্যগুলা কমবেশি ধারণ করতেছেন। সুতরাং বুঝতেই পারতেছেন, উনারা কেন জামায়াত নিয়া মীমাংসায় পৌঁছাইতে টালবাহানা করছে। হুমায়ুন আজাদের অমর প্রবচনগুচ্ছের একটি কাজেই বারবার ফেরত আসে : একবার রাজাকার মানে চিরকাল রাজাকার; কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা মানে চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা নয়।  

জেন এক্স প্রজন্ম কিন্তু এখনো দেশ চালানোর মওকা পায়নি। তারেক জিয়া যদি আসে অথবা জয়… বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জেন এক্সরা দেশ চালানোর সুযোগ পাবে। পায় নাই ভালো কথা কিন্তু প্রজন্মটিকে মজহারদের বেবি বুমার্সরা নির্মমভাবে ব্যবহার ও দূষিত করতে কোনো ত্রুটি করে নাই। যেমন ধরেন, অভি-নিরুর মতো মেধাবীদের নষ্ট করেন জিয়াউর রহমান। জাহানারা ইমামের সঙ্গে বেইমানি করে যে-আসিফ নজরুল… তারে আবার রেইপ হইতে হয় বেবি বুমার্সদের হাতে। আওয়ামীরাও জেন এক্স প্রজন্মকে আজেবাজে কাজে ব্যাপকভাবে এক্সপ্লয়েট করছে শুরু থেকে। শাহবাগী ইমরান এইচ সরকারের দল বাদ পড়ে নাই।

জেন এক্স হইতেছে হতভাগা প্রজন্ম। দেশের স্বাধীনতাকে তারা মোটের উপ্রে ধারণ করে কিন্তু কারো না কারো দ্বারা বলদারা ব্যবহৃত হয় বারবার। এখন যেমন গেঞ্জিরা তাদের বড়ো অংশকে ব্যবহার করতেছে। কবিদের মধ্যে যেমন ধরেন, নিজেকে হুমায়ুন আজাদ ভাবতে থাকা চঞ্চল আশরাফ কিছু না বুঝে রেইপড হইতেছেন। এরকম আরো আছে। নাম নিতে গেলে ইতিহাস হবে।

গেঞ্জিরা ওদিকে ক্ষমতার টেস্ট পাইলেও তাদের আবার ব্যবহার করতেছে চির পুরাতন সত্যের মতো বদমাশ বেবি বুমার্স প্রজন্মের লোকগুলা। তাদের হাতে জেন এক্স আসিফ নজরুল এবং গেঞ্জি নাহিদ-আসিফরা রেইপড হইতেছে প্রতিদিন। বেবি বুমার্সদের চেহারা যদি না চিনেন তাইলে আপনি বাংলাদেশের বিকাশ, অভ্যুদয় ও ঐতিহাসিক পতনের কিসুই ঠার করতে পারবেন না। তারা একই অঙ্গে হিরো এবং ভিলেন। সত্যের মতো বদমাশদের যদি উৎপাটিত করতে না পারেন তাইলে আপনি দেশ গড়ার পথে আগাইতে পারবেন না। ভুল করবেন বারবার। গেঞ্জিরা এদের চিনতে পারে নাই বইলা তাদের দিয়া দেশগড়া হবে না। ফেইল মারছে তারা। নেক্সট, মানে আপকামিং, জেন আলফারা কী করে সেইটা হইছে দেখার বিষয়। 

আমার পোলারে আমি বলি, তুই তো গেঞ্জি। সে দাঁত বাইর করে হাসে এবং উত্তর করে, আমার লগে জেন আলফার ডিফরেন্স তিন মাস। এর জন্য আমারে তুমি গেঞ্জি বলতে পারো না। আমি আলফা। আমারে দিয়া নতুন শুরু। মার্ক করেন সায়েম, জেন আলফারা কিন্তু গেঞ্জিদের মুভমেন্টে শামিল ছিল। এখন ওরা বুইড়া খাটাস বেবি বুমার্স, গাছ বলদা জেন এক্স, অলরেডি রেইপড ও আত্মকামী গেঞ্জিদের সাইডলাইনে রেখে দেশটারে গড়তে পারে কিনা সেইটা কেবল দেখা বাকি। আমাদের হায়াতে এর বেশি দেখা এবং নেওয়া সম্ভব না।

. . .

সংযুক্তি : জামায়াতের মতো ক্ষতিকর কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব হবে যখন জনমতের বৃহৎ অংশকে আপনি এই ব্যাপারে পাশে পাবেন। একাত্তরে শেখ মুজিব দলটিকে কার্যত নিষিদ্ধ করছিলেন। জিয়াউর রহমান এসে নিজস্ব রাজনৈতিক মতলবে তার পুনরুজ্জীবন ঘটান। নিজ মন্ত্রীসভায় একাধিক স্বাধীনতাবিরোধীকে উনি স্থান দেন। খালেদাও একই আকাম করেন দ্বিতীয় দফায় গদিতে বসার পর। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক রেষারেষি এবং স্বাধীনতা নিয়া পাল্টাপাল্টি ন্যারেটিভ, তার সঙ্গে দুই দলের দেশ পরিচালনায় নানা ব্যর্থতার কারণে জামায়াতের মতো দল বারবার রাজনীতির গুঁটি হয়ে উঠছে। হাসিনা এই জায়গা থেকে খেলছেন পনেরো বছর। উনি ভাবতে পারে নাই ঘরের ভিত্রে কালনাগিনী পুষতেছেন। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার চেয়ে অনেকবেশি জরুরি ছিল তারে রাজনৈতিক বয়ান দিয়া মোকাবিলা করা। দুর্নীতি আর শত আকামে লিপ্ত হাসিনা সরকারের ওসব নিয়া ভাবার সময় ছিল কি?

Generations Throughout History; Source – BuzzFeedVideo

. . .

সায়েম ভাই যে-ভাষাভঙ্গিতে প্রশ্নগুলো তুলেছেন তার দুটি অর্থ আছে। প্রথমত, বিষয়টি নিয়ে তার অনভিজ্ঞতা, যেখানে নিজের কাণ্ডজ্ঞান ব্যবহারে তাকে অনাগ্রহী দেখছি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে আওয়ামী লীগ নিয়ে গভীর সন্দেহ। উনার ধারণা, আওয়ামী লীগের মধ্যে জামায়াত এমনভাবে সমাহিত, এখন তাদেরকে আলাদা করা সম্ভব হচ্ছে না। স্বয়ং হাসিনা জামায়াতের লোক কিনা প্রশ্নটি তিনি তুলেছেন। প্রশ্নগুলোকে বৃদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান থেকে বিবেচনায় নিলে তার উদ্দেশ্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গিটি খানিকটা পরিস্কার হবে বলে মনে করি। এর আগেও তিনি এই আলাপ গ্রুপে একাধিকবার তুলেছেন। তার মনের গভীরে নিমজ্জিত সন্দেহ দূর করতে কিছু কথা পরিষ্কার বলা প্রয়োজন।

এটা ঠিক,- বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য মানতে হবে, এমন কোনো রাজনৈতিক দলের দেখা আমরা পাইনি যারা মূলগত জায়গায় প্রতিনিধিত্ব করেছে বা করছে। যেমন মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, মুক্তচিন্তার চর্চা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা,  অগ্রসর শিক্ষা ও গবেষণা ইত্যাদি। যতগুলো দল এখন দেশে সক্রিয়, তাদের মধ্যে কেউ মন্দের ভালো, কেউ আবার মন্দের মধ্যে আরো মন্দ। আমাদের কপাল খারাপ,- স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়ী হয়ে নতুন যে-রাষ্ট্র পেলাম, আমাদের ভিতরে আকাঙ্ক্ষার যেসব জায়গা তৈরি হয়েছিল, তার কোনোটা পূর্ণতা পায়নি। জাতিকে উল্টো বিভাজনের পথে গমন করতে বাধ্য করা হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে যা এখন সংঘাতে বাঁক নিয়েছে। আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের সম্পর্কের রসায়নকে সুতরাং ওই মন্দের ভালো ও মন্দের মধ্যে আরো মন্দের জায়গা থেকে বিবেচনা করা উচিত।

মুক্তিযুদ্ধকে আমাদের জাতিসত্তার প্রকৃত জন্মক্ষণ ধরে অগ্রসর হলে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের বিপরীতমুখী অবস্থান যে-কারো কাছে পরিস্কার হয়ে যাওয়ার কথা। একপক্ষ সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিল। অন্যপক্ষ স্বাধীনতার বিপক্ষে সক্রিয় থেকেছে। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় তাদের সক্রিয়তা কেবল বিরোধীতায় থেমে থাকেনি,- যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করতে যা ঘটানো হয় সচরাচর,- এসব কারবারে তারা পুরোপুরি লিপ্ত ছিল। একাত্তরে নিজের ঘৃণ্য ভূমিকা নিয়ে আজ পর্যন্ত দলটিকে আমরা অনুশোচনায় ভুগতেও দেখিনি;- তারা বরং একে জাস্টিফাই করতে তৎপর আছে। এই যখন অবস্থা, সেখানে বিভাজন থাকবেই। সায়েম ভাই সহজ ঘটনাটি কেন ধরতে নারাজ, সেটি আমার মাথায় ঢুকছে না!

Jamaat-e-Islami’s rules on 1971 – Newspaper Footage; Source – thedailystar.net/magazine/2009

জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক রূপ, তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে গ্রুপে অনেকবার আলাপ হয়েছে। তারা একটি আদর্শ বহন করে এবং সেই আদর্শের সুশৃঙ্খল কাঠামো তৈরি করে নিতে পেরেছে। জনসমর্থন বেশি না থাকলেও পরিকল্পনা আর উদ্দেশ্য পূরণের জায়গা থেকে দেখলে দলটিকে আমরা সংহত মনে করতে বাধ্য। যে-কারণে আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা এই ধরায় যত দল বাংলাদেশে সক্রিয়, এখন নিজের মতলব পুরা করতে জামায়াত এসব দলের ভিতরে সহজে প্রবেশ করে থাকে। ২০২৪ এর কোটা সংস্কার আন্দোলনে সমন্বয়কদের মধ্যে তাদের আধিক্য আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়নি।

ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল বা তাদের মূল অঙ্গসংগঠনে অনুপ্রবেশ জামায়াতের জন্য যতটা সহজ, বাকিদের পক্ষে কিন্তু জামায়াতে অনুপ্রেবশ ততটাই কঠিন। আদর্শ ভিত্তিক দল যদি হয়, সেক্ষেত্রে তার বিকাশ প্রক্রিয়া ভিন্ন হয়ে থাকে। জামায়াতের বিকাশ প্রক্রিয়াও তাই। বড়ো দলগুলোর তুলনায় তারা অনেকবেশি গোছানো ও বৃদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতির মালমশলা ব্যবহারে সুদক্ষ। সে-তুলনায় আওয়ামী লীগ, বিএনপির মতো দলের কাঠামো খোলামেলা ও অগোছালো। ভাবাদর্শের প্রতি আনুগত্য নিখাদ নয়। আবার জনগণের সঙ্গে সরাসির সম্পৃক্ত ও এই সুবাদে প্রভাব রাখলেও সেখানে পরিষ্কার কোনো লক্ষ্য আমরা পাই না। প্রশ্ন হলো,- জামায়াতের এই কাঠামো বা আদল (অনেকটা সেনাবাহিনী বা মোসাদের মতো) আমাদের জন্য কতটা উপকারী? চমৎকার সাংগঠনিক কাঠামো ও পরিবল্পনা থাকা সত্ত্বেও তাদের কাছ থেকে আমরা পাচ্ছি ধর্মরাষ্ট্র বাে ইসলামী খেলাফত নামক অশ্বডিম্ব। একুশ শতকের যুগবিশ্বে এর ওপর ভর করে অধিক আগানো যাবে কি? আমার সেটি মনে হচ্ছে না।

Jamaat-e-Islami’s rules on 1971 – Newspaper Footage; Source – thedailystar.net/magazine/2009

বাংলাদেশে প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যারা সংযুক্ত, যেমন বামদল, তারা সংকুচিত হতে হতে নেই হওয়ার অবস্থায় চলে এসেছে। বামদের বড়ো অংশ এখন দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। আওয়ামী লীগ বিরোধিতায় নেমে তারা কখন-যে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছেন, সেটি নিজেরাও অনুধাবন করতে পারেন বলে বিশ্বাস হয় না। আরেকটি বিষয় খেয়ার করা প্রয়োজন,- আবেগের বশে ও নানাবিধ বয়ানের চাপে প্রভাবিত হয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে যারা সমর্থন দিয়েছিলেন, তাদের বড়ো অংশ এখন প্রতারিত হয়েছেন জেনেও নিজের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারছেন না। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে উল্টো বদ্ধমূল ধারণায় শান দিয়েই যাচ্ছেন। তাদের এই আজব অবস্থান মনোজগৎ বিশ্লেষষকদের জন্য ভালো খোরাকি হতে পারে।

আরেকটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। কোটা সংষ্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘটতে থাকা ঘটনাকে ৫ আগস্টের আগে থেকে মিনহাজ ভাইসহ আমরা কেউ আস্থায় নিতে পারিনি। আমাদের মধ্যে এসব নিয়ে বিস্তর আলাপ হয়েছিল তখন। আমরা যা সন্দেহ করছিলাম তার অনেকগুলো এখন সত্য প্রমাণিত হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগের প্রতি আমাদের কারো আলাদা করে কোনো মোহ নেই। হাসিনা শাসনের পনেরো বছর সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড আমদেরকেও বিরক্ত করেছে। সমালোচনা করতেও কার্পণ্য করিনি তখন। ৫ আগস্ট যদি সত্যিকার সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হতো তাহলে জুলাই অভ্যুত্থানকে আপন করে নিতে বাধা ছিল না। তার কিছুই আসলে ঘটেনি। সকল প্রকার উগ্রতার চাষাবাদ করছেন ইউনূস সরকার। এই-যে আমরা পেছন ফিরে হাঁটছি, সামনে অগ্রসর হওয়ার বদলে পশ্চাদমুখী আঁধারে গমন করছি, এর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য হলেও পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি ও নিজের শত্রু-মিত্র বুঝে নেওয়াটা খুব প্রয়োজন।

. . .

সায়েমের প্রশ্নগুলার মধ্যে সহজাত কাণ্ডজ্ঞানের অভাব থাকা স্বাভাবিক জাভেদ। আমরা যতভাবে বিশ্লেষণ করি না কেন, দেশকে স্বাধীন করার সংগ্রামে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক অবদান থাকলেও রাষ্ট্রগঠনে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারেনি। এই সুযোগে বাকিরা আওয়ামীদের প্রতিপক্ষ রূপে জামায়াতের মতো শক্তিকে প্রমোট করেছে। হাসিনা দেশের জন্য কাজ করেছেন আবার একের-পর-এক ভুল তো করেছেন উনি। এইটা অস্বীকার করা সম্ভব নয়। 

এমনকি সামনে যদি আওয়ামীরা আসেও, আবারো সেই প্রতিহিংসার পথে তারা হাঁটবে। এভাবে তো স্বাধীনতার স্পিরিটকে আপনি প্রতিষ্ঠা দিতে পারবেন না। ট্রুথ ইজ বিটার দ্যান ফিকশন। আওয়ামী লীগকে এই উপলব্ধিতে আসতেই হবে। দেশকে গড়ার প্রয়োজনে দলের ভিতরে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি চালু করা দরকার। নির্বাচনী কাঠামোসহ সকল পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার তো ঞয়নি। এটি সম্পন্ন করা জররি। বিএনপিসহ যারা নানা ত্রুটি সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষশক্তি নয় আদতে,- তাদের ব্যাপারে পরিষ্কার মীমাংসায় পৌঁছাতে হবে আওয়ামীদের। একাত্তরকে ধারণ করতে জানে এরকম সাংস্কৃতিক শক্তির মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা ছাড়া জামায়াতকে নিষ্প্রভ করা সম্ভব নয়। এখন এটি যদি আমরা বুঝতে ব্যর্থ হই, সেক্ষেত্রে সায়েমদের মনে সন্দেহ দূর করা কঠিন হবে এজন্যই মনে হচ্ছে, আগামী প্রজন্ম ছাড়া কারো পক্ষে দেশগঠন সম্ভব নয়।

. . .

Bangladesh: Secular bloggers live in fear after spate of killings; Source – FRANCE 24 English

. . .

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.

Contributor@thirdlanespace.com কর্তৃক স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *