. . .
ফরহাদ মজহার আমার বিবেচনায় বাংলা চিন্তার ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত, উদ্দেশ্যমূলক এবং একইসাথে প্রভাববিস্তারী চিন্তক ও বুদ্ধিজীবী। দীর্ঘদিন থেকে তিনি তার ভাবধারা, চিন্তনপদ্ধতির মধ্য দিয়ে লেখক-কবি, ছাত্র-জনতার বেশ বড় অংশকে প্রভাবিত করে আসছেন। যার একদম সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো ছাত্র-আন্দোলনপ্রসূত সফল গণ-অভ্যুথান। একজন তাত্ত্বিক থেকে ক্ষমতাকেন্দ্র পর্যন্ত তার যাত্রাপথের বিবর্তন কিংবা রূপান্তরের কিছু চুম্বকঅংশ (যেখানে তিনি উদ্দেশ্যমূলক) আলোচনাই এই লেখার মুখ্য উদ্দেশ্য। পরবর্তীতে বিস্তারিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা রাখি।
ফরহাদ মজহার বাঙালি জাতীয়তা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, রবীন্দ্রনাথসহ হিন্দু লেখকগোষ্ঠীর বুদ্ধিভিত্তিক জায়গার সমালোচনা করেছেন কেননা তা একপাক্ষিক, উপনিবেশিক, বিভাজনের জন্য দায়ী, আমাদের মৌল গঠনকাঠামোর পরিপন্থী। তাঁর মতে এই চিন্তা মুসলমানকে প্রান্তিক হিসেবে বিবেচনা করে।তার মৌল চিন্তার আরেকটি বিষয় হলো ভারতবিরোধিতা। ভারত আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। পূর্ববর্তী অথবা সমসাময়িক অনেক বুদ্ধিজীবী এই বিষয়ে কমবেশি কাজ করলেও ফরহাদ মজহার এই বিষয়ে অগ্রণী হিসেবে বিবেচিত হবেন। সমসাময়িক অনেকেই এই ভাবধারায় প্রভাবিত।
পূর্ববর্তী সময়ে চিন্তার নানাবিদ বিবর্তন ঘটলেও ফরহাদ মজহারের এই ধারার চিন্তা বিগত দুই দশক থেকে সক্রিয় হয় এবং তা আচ্ছন্ন করে রাখে তাবৎ গোষ্ঠীকে। বাংলাদেশের মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে আওয়ামী, ভারত বিরোধী সকলেই কমবেশি চিন্তার রসদ যোগাড় করেছেন ফরহাদ মজহারের কাছ থেকে। এটি পরিপুষ্ট করেছে হিজবুত তাহরীরের মতো জঙ্গি সংগঠন থেকে শুরু করে জামাতে ইসলামী, খেলাফতের মতো বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলিকে। যার বিকাশ আমরা দেখতে পাই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতায়। তিনি সফলভাবে হেফাজত এর মতো একটা অরাজনৈতিক শক্তিকে মাঠে নামাতে ভূমিকা পালন করেন। করে তোলেন রাজনৈতিক শক্তির হাতিয়ার।
তাঁর চিন্তায় প্রভাবিত হয়ে অনেক তরুণ লেখক বুদ্ধিজীবী সক্রিয় হয়ে উঠেন, একইসাথে ইসলামি ভাবাদর্শের সক্রিয়তা এমন এক বাতাবরণ তৈরি করে যে অন্য সকল চিন্তা হয়ে ওঠে ব্রাত্য, কোণঠাসা। এই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নাস্তিক্যবাদী ট্যাগ এর শিকার হয়। সারাদেশব্যাপী জামাত-হেফাজতের সন্ত্রাস বৈধতা পায় তার ও সমমনাদের কৌশলে। বিভাজনের বিরোধিতা করতে গিয়ে বিভাজনটাকে যেন অমোঘ করে তোলেন তিনি। তার এই একপাক্ষিক অবস্থান, বিশ্লেষণ সামাজিক এবং মনোজাগতিক একটা দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি করে, যা আগামী অনেক যুগকেই বহন করতে হবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। গণজাগরণ পরবর্তী সময়কালেও তার চিন্তা প্রায় সরলরৈখিক পথ ধরে চলে, যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে ৫ আগস্ট। হাসিনা পতনের মধ্য দিয়ে ইসলামী ভাবাদর্শ আর বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বুদ্ধিজীবীতার জগতে নিরঙ্কুশ হয়ে ওঠে।
৫ আগস্ট এর পূর্বাপর সময়ে ফরহাদ মজহারের সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায় বিপুলভাবে। ফরহাদ মজহার নিজের তত্ত্বের এই বিজয় উপভোগ করছিলেন, আমরা দেখলাম ৯ আগস্ট তাঁর ৭৮ তম জন্মদিন পালন উৎসব। তিনি অনেককিছুই বললেন সেদিন, বিপ্লবের স্বার্থে কিভাবে কৌশলী হতে হয় সেই অকপট স্বীকারোক্তি তাঁকে তাত্ত্বিক ভাবার চেয়ে রাজনৈতিক ভাবতে প্ররোচিত করতেই পারে যে কাউকে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাঝে তার চিন্তার প্রভাব তাঁকে বিশেষভাবে আলোড়িত করে। তিনি গণ-অভুত্থানের মাঝে বৈপ্লবিক উপাদান খুঁজে পান। জনগণের আকাঙ্খা ও অভিপ্রায় এই টারমোলজি ব্যাবহার করে সার্বভৌম ক্ষমতার মধ্য দিয়ে বিপ্লবের বাকি কাজ সমাধা করতে তিনি আগ্রহী হয়ে উঠেন। ফলে একে সফল সমাপ্তিতে নিয়ে যাবার আকাঙ্খায় এমনসব ফর্মুলা এবং তত্ত্ব প্রয়োগ করেন যা অনেকসময় স্ব-বিরোধী হয়ে উঠে। কখনও ছাত্রশক্তি, কখনো ইসলামিশক্তি আবার কখনো বিএনপি এর মধ্য থেকে ভবিষ্যত উত্তরণের হদিস করতে থাকেন। প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা অথবা নিজস্ব চিন্তার জটিলতায় আওয়ামী, শেখ মুজিব ইত্যাদি প্রশ্নে তীব্র রকম অশহনশীল হয়ে ওঠেন। তিনি তার সাফল্য ধরে রাখতে এতটা মরিয়া যে তার চিন্তার মধ্য থেকে বিভিন্ন ফ্যাসিস্ট উপাদানগুলি প্রকাশ্য হতে থাকে। তিনি আসলে প্রচলিত আওয়ামী, বাম ইত্যাদি ন্যারেটিভ ভাঙার মধ্যে নিজের সাফল্য খুঁজে বেড়াতে থাকেন।
ক্ষমতাকাঠামোয় নিজের অবস্থান গ্রহণযোগ্য হওয়ার প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠে বিচিত্র ভাবাদর্শকে ধারণ করে (যেখানে স্বার্থগত দ্বন্ধ অমোঘ) তাকে কীভাবে বাস্তবিক রূপ দিবেন। তত্ত্বগত দিক থেকে আপাত মানবিক এবং তাত্ত্বিক দিক থেকে উপযোগী হলেও বাস্তবিক দিক থেকে এটা কেমনভাবে কার্যকরী হবে? ৫ আগস্ট পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সেই বাস্তবিকতাকে আমাদের সামনে উম্মোচিত করে। ফরহাদ মজহারের তত্ত্বের বাস্তবিক রূপদর্শনের সুযোগ করে দেয়। শুরুর সময়টা ভিন্নমুখী নানান স্বর, কলরবে মুখরিত ছিলো। যদিও এটা ছিল আওয়ামী তাড়ানোর উদযাপন। জামাতে ইসলাম, হেফাজতে ইসলামী, হিজবুত তাহরীর ইত্যাকার বহু ইসলামকে আমরা জানি, এই বহুরকম ইসলামকে কিভাবে তিনি একসূত্রে গাঁথবেন এই প্রশ্ন ছিল জোরেশোরে।
৫ আগস্ট এর পূর্বাপর সময়ে ফরহাদ মজহারের সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায় বিপুলভাবে। ফরহাদ মজহার নিজের তত্ত্বের এই বিজয় উপভোগ করছিলেন, আমরা দেখলাম ৯ আগস্ট তাঁর ৭৮ তম জন্মদিন পালন উৎসব। তিনি অনেককিছুই বললেন সেদিন, বিপ্লবের স্বার্থে কিভাবে কৌশলী হতে হয় সেই অকপট স্বীকারোক্তি তাঁকে তাত্ত্বিক ভাবার চেয়ে রাজনৈতিক ভাবতে প্ররোচিত করতেই পারে যে কাউকে।
পরবর্তী সময়ে আমরা সারাদেশবাপী এক অরাজক পরিস্থিতির উদ্ভব দেখলাম। মাজার ভাঙা থেকে শুরু করে হিজবুত তাহরীরের প্রকাশ্য অবস্থান, জাতীয় সংগীত বদলে দেয়ার প্রশ্ন, ৭১ এর চেতনা বিলুপ্ত করা ইত্যাদি স্বর আর সুর বলিষ্ঠ হতে থাকলে ফরহাদ মজহার জটিলতাগুলি টের পেতে শুরু করেন। যদিও প্রথমদিকে নীরব কিংবা সরব সমর্থন দিলেও পরবর্তীতে পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন বয়ান হাজির করেন। তসলিমা নাসরিনের শেয়ার করা ভিডিওতে ফরহাদ মজহারের এই নতুন বয়ান আমরা খুঁজে পাই। যে মজহারকে হারিয়ে ফেলেছিলেন তাঁকে যেন আবার নতুন করে আবিষ্কার করেন তসলিমা। আমরা দেখি নতুন বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে মজহার ইসলামের ট্রেডিশনসাল ভার্সন হাজির করছেন। সহজিয়া সুফি ঘরানা যেখানে এক সময় বুঁদ ছিলেন তিনি। ফরহাদ মজহার এতো মত পথ অতিক্রম করে এসেছেন যে প্রয়োজনমতো যে কোনো জায়গায় ফিরে যেতে পারেন অনায়েসে। এই হচ্ছে ফরহাদ মজহারের উদ্দেশ্যমূলক জায়গা।
খিলাফত আর ইসলামী রাষ্ট্রে বিভোর শক্তি এখন তার স্বপ্নের সৌধ ভেঙে দিতে মরিয়া হয়ে উঠছে। এটা তাঁকে ভীত করছে। তিনি আবার তাই ফিরছেন লালনে, ফিরছেন ৭১-এ। খারিজ করছেন ইসলামের অন্যসব ভার্সন। অথচ এই ইসলামী শক্তির উত্থানে তার দায়ভার কোনোভাবেই তিনি অস্বীকার করতে পারেন না। তিনি ইসলামের অন্যসব ভার্সনকে দিল্লি ইহুদি চক্রান্ত বলে খারিজ করছেন। কী অদ্ভুত ফরহাদের মন! যাই হোক তসলিমা ফরহাদ মজহারের সর্বশেষ রূপান্তরকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন। বলছেন সেই পুরনো ফরহাদ ভাইর মতো লাগছে। যিনি কিনা একসময় সাচ্চা ঈমানদার হয়ে উঠেছিলেন।
ফরহাদ মজহারের এই রূপান্তর, সময়-সময় পল্টি দেয়ার মানসিকতা ভাসানীকে মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু ভাসানীর সাথে মজহারের বড় তফাত হলো ভাসানী সমাজ-রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর ছিলেন না যতটা মজহার। কারণ বিভাজন, ভাঙার রাজনীতি ইত্যাদি করতে করতে পুরা সমাজব্যবস্থাকেই পশ্চাদপদ শক্তির হাতে তুলে দিতে মজহার দ্বিধা করেন না। মজহার তাই রূপান্তরকামী। তাঁর ভিশন অনেকসময় আকর্ষণীয় মনে হলেও যে প্রক্রিয়ায় তিনি তা হাসিল করতে চান সেটা গ্রহণীয় মনে হয় না। তার স্ব-বিরোধ তাঁকে উজ্জ্বল হতে দেয় না। কিন্তু এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যে সুপ্ত-শক্তিকে তিনি জাগরূক করেছেন তাঁকে ঠেকাবেন কোন কৌশলে? ফ্রাঙ্ককেনস্টেইনের জন্ম হয়ে গেছে, সে ধ্বংসলীলা চালাতে দিগ্বিদিক ছুটছে। মজহার আটকাবেন কেমন করে?
. . .
ফরহাদ মজহার : জাহেরি না বাতেনি?
সাক্ষাৎকারটি পড়লাম হাসান। আমাদের সৌভাগ্য, আমরা ফরহাদ মজহার মানের একজন সুচিন্তকের সময়ে বাস করি। চোখের সামনে তাঁকে এই অটাত্তর বছর বয়সে প্রখর চিন্তাশক্তি নিয়ে সক্রিয় থাকতে দেখছি। উনার সবচেয়ে ভালো দিকটি হলো উনি আলাপ পছন্দ করেন। মন খুলে তর্ক করতে ভালোবাসেন। সমস্যা হলো যাঁরা উনার সাক্ষাৎকারটি নিলেন, উনারা তাঁকে প্রশ্ন করেছেন কিন্তু আলাপ করেননি। ফরহাদ মজহারকে প্রশ্ন করা বৃথা যদি প্রশ্নকর্তা তাঁর সঙ্গে তর্ক ও আলাপে গমন না করেন। তো এই সওয়াল-জওয়াব থেকে কয়েকটি জিনিস যথারীতি আমার কাছে ঝাপসাই থেকে গেল। নিচে বুলেট আবারে তুলে ধরছি :-
ক.. দেশ ও রাষ্ট্র এক বস্তু নয়। ফরহাদ মজহার স্বচ্ছতার সঙ্গে বিষয়টি বোঝাতে পেরেছেন। একাত্তরের মধ্য দিয়ে আমরা দেশ পেয়েছি কিন্তু রাষ্ট্র এখনো গঠন করতে পারিনি। এখন রাষ্ট্র গঠনের নিয়ামশক্তি কি তাঁর বক্তব্য থেকে পরিষ্কার ধরতে পারছি? আমি আগেও কোনোদিন পারিনি, এখনো পারলাম না।
খ.. রাষ্ট্রের নিয়মকশক্তি বলতে বুঝি পরিষ্কার সাংবিধানিক কাঠামো, যেটি ফরহাদ মজহার বলছেন, জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী রচিত হবে। যার ভিত্তিতে রাজেনৈতিক দলসহ রাষ্ট্র পরিচালনায় যত উপকরণ বা প্রতিষ্ঠান দরকার পড়ছে, সেগুলো গড়ে উঠবে। ভালো কথা, এখন জনগণের অভিপ্রায় কথাটির অর্থ আমি বুঝতে নাচার! জনগণ বলতে কাকে মিন করছেন উনি? সংজ্ঞায় কারা পড়ছেন? যদি ধরে নেই সমাজের সকল শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব মিলে অভিপ্রায়টি রচিত হবে, তাহলে সেখানে এই প্রশ্নটি উঠবে,- অভিপ্রায় কে বা কারা নির্ধারণ করছে? রাজনৈতিক দল? সুশীল সমাজ? নানা আঙ্গিকে সক্রিয় দল-গোষ্ঠী-সংস্থা? ঠিক কারা? বুড়ো বয়সে এসে, সত্যি বলছি হাসান, জনগণ শব্দটি আমার কাছে সবচেয়ে বিমূর্ত ঠেকে। মজহার আজো এটি ক্লিয়ার করেননি। কেউ তাঁর কাছে জানতেও চায়নি, জনগণ বলতে কী বোঝাচ্ছেন আপনি?
গ.. গণতন্ত্রের কথা তিনি প্রায়শ বলেন। আমরাও বলি। সমস্যা হলো, তিনি তো পশ্চিমা বিশ্বের পুঁজিবাদ প্রসূত সাম্রাজ্যবাদী গণতন্ত্র চাইছেন না, কখনো চাইবেন না। আবার মার্কসবাদে নিহিত সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র, আমাদের দেশকাল বিবেচনায় তাঁর পক্ষে কপি করা সম্ভব নয়। কারণ এখানে তিনি ধর্মীয় সংস্কৃতি বিশেষ করে ইসলামকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছেন। গণতন্ত্রের স্বীকৃত দুটি পথকে পাশ কাটিয়ে যা চাইছেন সেটি কী বস্তু? দেখতে কেমন? অনেকভাবে বোঝানোর পরেও আজো আমার মাথায় ঢোকেনি। এটি আমারই ব্যর্থতা যে আমি তাঁর গণতন্ত্র বুঝি না।
ঘ.. তাঁর নিজ ভাষ্য মোতাবেক রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকে না, মানুষের থাকে। সঠিক কথা। এখন রাষ্ট্র গঠনে প্রচলিত সেকুলার তরিকাকে তিনি ফ্যাসিস্ট বলে সবসময় ভেবে এসেছেন। তাহলে রাষ্ট্রকে তিনি ধর্মের বাইরে কীভাবে রাখতে চাইছেন বা ক্যামনে রাখবেন? জামায়াতে ইসলামিকে তিনি রাজনৈতিক দল হিসেবে রাষ্ট্রের জায়গা থেকে ফিট ভাবছেন। অন্য ইসলামি দলকে অবশ্য তাদের ভিতরকার নানা ফ্যাসিস্ট উপাদানের কারণে সহজে এলাউ করতে চাইছেন না। জামায়াতারে ক্ষেত্রে স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা নিয়ে তাঁর যা অস্বস্তি বা আপত্তি। এর বাইরে জামায়ত তাঁর কাছে পরম বৈধ। সমস্যা হলো, রাষ্ট্রের যদি ধর্ম না থাকে তাহলে জামায়ত যখন ধর্মকে ভিত্তি করে রাষ্ট্র গঠন করতে চাইবে, একে তিনি কী দিয়ে আটকাবেন? সে তো ওই ধর্মের ভিত্তিতে পুরো সমাজকে ছকবদ্ধ করতে চাইবে? এটি তবে কোন গণতন্ত্র? আমি ভাই কিছু বুঝতে পারিনি।
ঙ.. জিয়াউর রহমানকে তিনি রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে সঠিক রোক ছিলেন বলে ভাবছেন। এখন এটি তো আপেক্ষিক। আমার বিবেচনায় ভারত নয় বরং জিয়াউর রহমান জামায়ত ও আওয়ামী লীগকে পরস্পরের প্রতিপক্ষ করতে গোলাম আজমকে দেশে ফেরত এনেছিলেন। সেইসঙ্গে ভারত কার্ড খেলার রাজনতিও তাঁর হাতে পোক্ত হয়েছিল। তিনি জিয়াকে নিষ্পাপ ভাবছেন, আমি ভাবতে পারছি না। মুজিববাদ যেমন সহি ছিল না, জিয়ার রাজনীতিও সহি না।
সব মিলিয়ে তাঁর বয়ান বরাবর যেমন হয়ে থাকে,- আলঙ্কারিক। পড়তে-শুনতে আরাম কিন্তু ভেতরে তাকালে ঘোলাটে লাগে সবটা। গায়েবি ঠেকে। এসব নিয়ে তাঁকে আসলে আলাপে টানা উচিত, কেবল উত্তর শোনার আশায় প্রশ্ন করে ফায়দা নেই।
. . .
মূল আলাপ তো এখানেই জাভেদ। সূনৃতর চতুর্থ সংখ্যায় আমরা নাদান তাঁকে আক্রমণ করেছিলাম। তার মধ্যে অনেক জায়গায় বয়সজনিত ছেলেমানুষী ছিল। কিন্তু মোটা দাগে তাঁর চিন্তনপদ্ধতিকে তখনো নিতে পারিনি, আজো পারলাম না। তাঁর মূল সমস্যা তিনি এমন এক দেশে বসে অংশীজনের সাম্য চাইছেন, যেটি অবিকশিত। এখানে মার্কসীয় পন্থায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়নি। পুঁজিবাদী বিকাশটাও ব্রিটিশ উপনিবেশের কারণে ইউরোপীয় ছাঁচ বা আদরায় রূপান্তরিত হতে পারেনি। তার ওপর রয়েছে ধর্মীয় সংস্কৃতি থেকে উঠে আসা ন্যারেটিভের সুদীর্ঘ গভীর প্রভাব। এসবের আপাত সুরাহা হিসেব হিন্দু সম্প্রদায়ের বেঙ্গল রেনেসাঁস নিছক শিক্ষিসমাজে গণ্ডিবদ্ধ ছিল। যেটি আবার একইসঙ্গে ব্রিটিশ উপনিবেশকে ওয়েলকাম করেছে আবার অন্যদিকে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদকে পুনরায় শক্ত বনেদে দাঁড়িয়ে আধপত্যবাদী সংস্কৃতির দিকে ধাবিত হয়েছে। মুসলমানসহ বাকিরা সেখানে গৌণ ও উপেক্ষিত ছিল বৈকি।
এর কাউন্টার হিসেবে মুসলমান রেনেসাঁস ভালো করে বিকশিত হতে পারেনি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক কাঠামো প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই যে সমাজের সর্বস্তরে রেনেসাঁসকে নিতে না পারা, এর অভিঘাত রাজনৈতিক দলের ওপর তীব্রভাবে আসর করেছে। ইংরেজ শাসন থেকে বাংলাদেশ… সুদীর্ঘ কালপর্বে সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক দল এখানে গড়ে উঠেনি। এই যখন অবস্থা তখন ফরহাদ মজহার কিন্তু বিরাজমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বৈপ্লবিক সংস্কার কী করে আনা যায়, সেদিকে যাচ্ছেন না। তিনি চলে যাচ্ছেন এমন এক চিন্তায় যেখানে তাঁর ছাঁচ মোতাবেক একটি সমন্বয়বাদী ইসলামের ভিতর দিয়ে তিনি জাতি, রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানকে বিকশিত দেখতে চাইছেন। এটা কিছু হলো!
. . .
উনার চিন্তার ধরন এই জায়গা থেকে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়াশীল। বাহাত্তরের সংবিধান অবশ্যই প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়। বিস্তর গোজামিল ও পরবর্তী সব সংশোধনীর কারণে ওটা কুৎসিত আকৃতি নিয়েছে। তার মানে কি, একে ফেলে দিতে হবে? এর পরিশোধন সম্ভব নয়? উনি যেটি চাইছেন, তার জন্য বৈপ্লবিক পন্থায় তৈরি রাজনৈতিক দল লাগবে। সেটি কি দেশে আছে? তিনি নিজেই তো নাই বলছেন। তাহলে কী কারণে উনার এই জামায়াত প্রীতি। আমি না বুঝতে নাচার!
উনি ৭২-এর সংবিধানকে যেভাবে খারিজ করে দিচ্ছেন, সেটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? আর ৭২-এর সংবিধান যদি আমরা খারিজ করে দেই, তাহলে কি অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হচ্ছে না? আবার উনি যে কাল্পনিক সংবিধানের কথা বলছেন, সেটাও আমার কাছে ক্লিয়ার মনে হয়নি। উনি কোন জনগণের কথা বলছেন, যারা সংবিধান রচনা কররবে? জনগণের মধ্যেও অনেক অংশ, অনেক মত আছে? জনগণ এখানে কারা?
. . .
বাহাত্তরের সংবিধান খারিজ করার বিষয়ে জাভেদ বিস্তারিত লিখেছেন। তবু সংক্ষেপে বলছি হাসান, ফরহাদ মজহারের মূল উদ্দেশ্য তিনটি :-
১.. রাষ্ট্র গঠন ও জাতিসত্তার অন্যতম বনেদ রূপে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে গুঁড়িয়ে দেওয়া। আওয়ামীরা তাঁর কাছে সেই ভীতিকর শক্তি, যারা জাতীয়তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধ ও শেখ মুজিবের প্রশ্নে ভীষণ গোঁড়া বা উগ্রবাদী হওয়ার কারণে জামায়াত-বিএনপি বা আরো যারা আছে তাদেরকে প্রতিরোধ করে। এইটা তিনি যে-ইসলাম ভিত্তিক গণতন্ত্র চাইছেন তার পরিপন্থী, সুতরাং মজহারের ন্যারেটিভে আওয়ামী নেই, থাকতে পারে না।
২.. তিনি বাংলাদেশসহ ভারতের উত্তর অঞ্চল নিয়ে একটি অখণ্ড রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন, যা অনেকটা হিযবুত তাহরির ও জামায়াতে ইসলামির বাংলাস্তানের কাছাকাছি পর্যায়ে পড়ছে। ভারতের অখণ্ডতা এক্ষেত্রে সমস্যা, সুতরাং ভারতে কার্ড তাঁকে খেলতেই হচ্ছে।
৩.. তাঁর যে বৈপ্লবিক বাসনা সেখানে বাঙালি হচ্ছে এমন এক জাতি যে তার প্রাপ্য কখনো বুঝে পায়নি। তাকে সেটি না ভারত পেতে দিচ্ছে, না পাকিস্তান দিয়েছে। তো এই জায়গা থেকে তিনি বাঙালির জন্য এমন এক ভূখণ্ড চাইছেন যেখানে দুই বাংলা মিলে যাবে।
ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে সে তো আমরা বলতে পারছি না, তবে সেই ভবিষ্যৎ যদি ফরহাদ মজহারের ইসলাম ভিত্তিক গণতন্ত্রের ধাঁচে আসে, আমার ধারণা সেখানে কনফ্লিট অব ইন্টারেস্ট বাংলাস্তানকে ভেঙে যেতে বাধ্য করবে। আপনি বাঙালি, কুকি, নাগা, অসমীয়া, মণিপুরি… তার ওপর হিন্দু ও মুসলমানের পৃথক ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যকে কখনোই একটি বিন্দুতে মিলাতে পারবেন না। এখানে ধর্মকে কুঠার হানতে বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিক তরিকার রেনেসাঁস ঘটেনি। তো কাজেই রাষ্ট্র যদি গড়তেই হয়, আপনাকে নিজের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে বিবেচনায় নিয়ে রাষ্ট্রকে পুরোপুরি সেকুলার করতেই হচ্ছে। বাহাত্তরে এটি (গোজামিলসহ) আছে। মজহারের আপত্তি এখানেই।
. . .
ফরহাদ মজহারের বিষয়টিকে আমার সাম্রাজ্যবাদের গোপন আঁতাত বলে মনে হয় না। তিনি তাঁর ব্যক্তিবিশ্বাসের স্থান থেকেই হয়তো ইসলামি বিপ্লবের আশায় আছেন, যেমন এককালে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন। এটি স্ববিরোধীতা। বামদলগুলো ফরহাদ মজহারের কাছে থেকে কি নিতে পেরেছে জানি না, কিন্তু ইসলামি সংগঠনগুলো জঙ্গীবাদ লালনের নৈতিক শক্তি লাভ করবে তাতে সন্দেহ নেই।
. . .
You pick the correct point Hasan. বামরা ফরহাদ মজহার থেকে নিতে পারবে না। ধ্রুপদি বামরা তো পারবেই না। জোনায়েদ সাকী টাইপের অধুনা বামের পক্ষেও তাঁর ভিশনে সহমত হওয়া কঠিন। যে-কারণে তিনি বামরা মার্কস না পড়ে বাম ইত্যাদি বলছেন ইদানীং, তবে হ্যাঁ, ইসলামিস্টদের জন্য তিনি প্রেরণা। এখন সেটি কতদিন বজায় থাকে সে এক প্রশ্ন বটে!