গণহত্যার তাৎপর্য কি আর পরিসংখ্যানে আঁটানো যায়! যুদ্ধ-বিগ্রহ তো আছেই, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলা মসনদ দখল ও ধরে রাখার ফিতনায় যত মানুষ মারা পড়েন,- এখন এই বীভৎসতাকে আমরা কী দিয়ে মাপব? মৃত্যু মানে কি কেবলই নাম্বার? নিশ্চয় নয়। কোরানের আয়াতটি (খুব সম্ভবত সূরা মায়েদা হবে) এখানে এসে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। গোত্রশাসিত আরবে নবি মোহাম্মদের জন্য সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ ছিল বিচিত্র স্বার্থকে কেন্দ্র করে কাইজ্জা-ফ্যাসাদে লিপ্ত গোত্রগুলোয় শান্তি ও সংহতি ফেরত আনা। সেখানে আবার ইহুদি ধর্মের অনুসারী গোত্রগুলোর সঙ্গে আল্লাহর বার্তাবাহকদের বিবাদ নানা কারণে ঐতিহাসিক ছিল। ঈসাকে এর জন্য জীবন দিতে হয়েছে তখন। মরিয়মপুত্র ধরা থেকে বিদার নেওয়ার পর এলেন মোহাম্মদ। তাঁকেও প্রতিপদে বৈরিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল। বনি ইসরায়েল সম্প্রদায়ের অবাধ্যতা ও অকারণ ফিতনা সৃষ্টির খাসলত আমলে নিতে নবিকে বারবার সতর্ক করা হয়েছে। কোরানের পাতায়-পাতায় তার বিবরণ পাচ্ছি। সূরা মায়েদায় আবারো সেই বনি ইসরায়েলের প্রসঙ্গ টেনে এরশাদ হচ্ছে,- গুরুতর কারণ ছাড়া কাউকে যদি হত্যা করা হয় তাহলে সেই ব্যক্তি সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল। আর নিরপরাধ লোকের জীবন যে বাঁচায় সে তো মানবজাতিকেই ত্রাণ করল।
ভিন্ন প্রেক্ষাপটে নাজিল হওয়া কোরানের এই আয়াতের সারার্থ আজো অমলিন। মানুষসহ যত প্রাণ নানা ছুতোয় আমরা নিকাশ করি,- এখন এই নিধনকে নিছক নাম্বার ভাবা কঠিন। প্রাণরক্ষা ও অস্তিত্বিক প্রয়োজনে কাউকে হত্যা করা আর অসৎ কোনো উদ্দেশ্য চরিতার্থে হত্যা ও নিপীড়ন এক বিষয় নয়। সেখানে একজন মারা গেলে যে-ক্ষতি, এক লাখ মরলেও কথা সমান। বাংলাদেশে যেমন সম্প্রতি হাসিনা সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে কেন্দ্রীভূত আন্দোলনে অনেক লোক মারা গিয়েছেন। পতনের আগে অনেককে জীবন দিতে হয়েছে। পতনের পরেও মৃত্যুমিছিল থেমে নেই। এসব হত্যা বা শাহাদত বরণের অন্তর্নিহিত আবেদন যদিও ইতোমধ্যে ম্লান হতে চলেছে। শেখ হাসিনা গদি ছাড়ার আগে যারা মারা গেলেন তাদের সংখ্যা নিয়ে মতান্তর চলছে। কেউ বলছেন হাজার বারোশো মারা গিয়েছে। কেউ বলছেন দেড় থেকে দুই হাজারের কম হবে না। চার মাস আগের ঘটনা হলেও সঠিক পরিসংখ্যান কেউ এখন দিতে পারছেন না।
শেখ হাসিনা গদি ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার পর দেশজুড়ে চলতে থাকা অরাজকতায় কতজন নিহত হয়েছেন তার সঠিক সংখ্যাটি পাওয়ার রাস্তা রোধ করা হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র তথাপি হিসাব দিচ্ছে,- সাড়ে চারশোর মতো থানায় লুটতরাজ চালানোর সুবাদে কমপক্ষে তিন হাজার পুলিশ মারা গিয়েছেন। অনেকে এখনো কাজে ফেরেনি। নিখোঁজ আছে কিছু। সরকার পতনের আগে যারা মারা গেলেন তাদের মৃত্যু নিয়ে মতান্তর আমরা তীব্র হতে দেখেছি। সরকারি ভাষ্য মতে শেখ হাসিনার পেটোয়া বাহিনি অর্থাৎ ছাত্রলীগ ও পুলিশের হাতে সকলে মারা গিয়েছে। অ-সরকারি অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে বিপরীত চিত্র। সেখানে দেখা যাচ্ছে, সংঘাতের জের ধরে পুলিশের গুলিতে অনেকে মারা গিয়েছেন এটি সত্য, পক্ষান্তরে হাসিনা সরকারের পতন ঘটাতে সক্রিয় শক্তি আন্দোলন জমিয়ে তুলতে ভাড়াটে খুনিদের দিয়ে মানুষ মেরেছে বিস্তর! চার মাস পার না হতেই মৃতের সংখ্যা নিয়ে বয়ান ও পালটা বয়ান তৈরি হতে দেখছি আমরা! মৃতরা সেখানে যেন-বা স্রেফ নাম্বার! রাজনীতির গুঁটি।
সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাব-নিকাশ যে-কারণে সবসময় অস্বস্তির জন্ম দিয়ে যায়। হত্যার তাৎপর্য উপলব্ধির জন্য যদিও পরিসংখ্যানকে গোনায় না ধরে উপায় থাকে না। ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ও পরিধি বুঝতে তার দরকার পড়ছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গণহত্যা যদি হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে এর বিচারিক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হলে মৃতের সঠিক সংখ্যা গুরুত্ব রাখে। এসব বিবেচনায় গণহত্যার সংখ্যাভিত্তিক হিসাব-নিকাশ নিয়ে যারা কাজ করেন তাদেরকে খারিজ করে আগানো মুশকিল হয়। সমস্যা হলো,- আপনি এখন যত নিখুঁতভাবে কাজটি সম্পন্ন করুন-না-কেন, প্রকৃত সংখ্যা কখনো বেরিয়ে আসবে না। হিসাবে গরমিল আর মতান্তর থেকেই যায়। একাত্তরে ছিল, চব্বিশেও তাই।
বলা হয়ে থাকে,- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ছয় কোটি মানুষ মারা গিয়েছেন। নাৎসিরা কেবল ইহুদি মেরেছিল ত্রিশ লাখ।পরিকল্পিত উপায়ে নাৎসিদের এই ইহুদিনিধন নিয়ে ফরাসি তথ্যচিত্র নির্মাতা ক্লোদ ল্যাঞ্জম্যান Shoah নামে নয় ঘণ্টার তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন। ওইসময় যারা নিধনের শিকার হয়েছে তাদের আত্মীয়পরিজন আর ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরতে পেরেছেন এরকম সাক্ষীর জবানবন্দি ক্যামেরাবন্দি করেন পরিচালক। নয় ঘণ্টার তথ্যচিত্র ধৈর্য ধরে দেখার ধাক্কা মর্মান্তিক ছিল। ক্যমেরার সামনে যারা ইহুদি নির্যাতন ও নিধনের বিবরণ দিচ্ছিলেন সেটি শুনতে ভয়াবহ বৈকি। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। পরিসংখ্যান তখন আর মাথায় থাকে না। নির্যাতন কক্ষে নাৎসিরা প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ ইহুদিকে নিধন করেছিল তার যথার্থ সংখ্যা নিয়ে বিতর্কের নিরসন আজো ঘটেনি। তথ্যচিত্রে পোল্যান্ডসহ পূর্ব ইউরোপের একাধিক দেশে ইহুদি অধ্যুষিত গ্রামগুলো দেখিয়েছেন ক্লোদ ল্যাঞ্জম্যান। বিরান, পতিত পড়ে থাকা গ্রামগুলো দেখে বোঝা যায় কী পরিমাণ ইহুদি প্রাণভয়ে তখন দেশ ছেড়েছিল, যাদের অনেকে আবার পালাতে যেয়ে নাৎসিদের হাতে প্রাণ হারায়।
ইহুদিরা সচরাচর একসঙ্গে পাশাপাশি থাকতে অভ্যস্ত। শত-শত বছর ধরে ইউরোপে উদ্বাস্তু জীবন কাটানোর সুবাদে একত্রে থাকাটাকে তারা আত্মরক্ষার পদ্ধতি গণ্য করে এসেছে সবসময়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যেটি আবার তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জার্মানিসহ অন্যান দেশে নাৎসিরা এক-একটি ঘেটো বা ইহুদিপাড়ার তালিকা হাতে হামলা করেছে। কাতারে কাতার ইহুদিকে ট্রেনে করে আউশভিৎসহ অন্যান্য নির্যাতনকক্ষে চালান করেছিল তারা। জিকলিন দিয়ে একত্রে মেরেছে বেশুমার।
রাশিয়ায় ওইসময় মোটের ওপর দুই কোটি মানুষ যুদ্ধে প্রাণ হারায়। সংখ্যাটি আনুমানিক। সঠিক নাম্বার কমবেশি হতে পারে। পৃথিবীতে প্রাচীন যুগ থেকে অদ্যাবধি দেশদখল ও যুদ্ধের বলি হয়ে যত লোক মারা গেছেন তাদের নিখুঁত হিসাব সম্ভব নয়। হিসাব টানতে গেলে সোর্স বড়ো অন্তরায় সেখানে। প্রমাণাদির ঘাটতি প্রকট হয়ে ওঠে। বিচিত্র বয়ান পদে-পদে তৈরি করে ধাঁধা। বড়ো কথা, মাথা ঘুরবে বনবন। এসব কারণে পরিসংখ্যান এই জায়গায় এসে খানিক হাস্যকর বস্তু হয়ে দাঁড়ায় শেষতক।
ভিয়েতনামে দফায়-দফায় আটেরো বছর ধরে আমেরিকা সামরিক হামলা করেছে। সেখানে তারা নাপাম বোমা ফেলেছে। শামসুর রাহমানের কবিতার সঙ্গে মিল করে ক্লকওয়াইজ ফেলেছে নাপাম। কবি লিখেছিলেন : আমরা যখন ঘড়ির দুটো কাঁটার মতো/ মিলবো রাতের গভীর যামে/ তখন জানি ইতিহাসের ঘুরছে কাঁটা,/ পড়ছে বোমা ভিয়েতনামে। দেশটির এক ইঞ্চি মাটি মার্কিনসেনারা খালি রাখেনি। এখন ভিয়েতনামে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা কত হতে পারে? ভিয়েতনাম সরকারের হিসাব মোতাবেক আটেরো বছরে প্রায় তিরিশ লাখ মারা গিয়েছিলেন। নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ মরেছে বিশ লাখের ওপর। আর ভিয়েতনামের হয়ে লড়তে থাকা সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনির মধ্যে মরেছে দশ লাখ। আমেরিকা যদিও দুই থেকে আড়াই লাখের হিসাব (যার মধ্যে তাদের সেনারাও ধরা আছে) পেশ করে দায় এড়িয়েছে। কোরিয়া ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের দায়ে আমেরিকাকে এখন কাঠগড়ায় তুলবে সেই সাহস কারো আছে? না, নেই।
প্যালেস্টাইনের কথাই ধরি। ইসরায়েল এখন পর্যন্ত কত ফিলিস্তিনিকে মেরেছে, ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছে, কাঁটাতার বসিয়ে তাড়িয়েছে, তার সঠিক হিসাব কি দিতে পারবেন কোনো সংখ্যাবিদ? মনে হয় না। এই-যে এখনো সমানে মারছে, কদিন বাদ দেখা যাবে সংখ্যা নিয়ে লেগেছে গোলযোগ। গণহত্যার জনমিতি বের করা কঠিন কাজ। এতোরকম বয়ান সেখানে তৈরি হয়, এর থেকে বেরিয়ে সঠিক হিসাব কিছু দাঁড়ায় না।
ইন্দোনেশিয়ায় সুকর্নকে অপসারিত করে সুহার্তো ক্ষমতায় আসার পর প্যানক্যাসিলা নামধারী আধা সশস্ত্র বাহিনির হাতে পাঁচ থেকে দশ লক্ষ লোক মারা যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়াবহ এই গণহত্যার কোনো বিচার আজো হয়নি। বিচারের পথ তারা একটাও খোলা রাখেনি। যেমন আমাদের দেশে বর্তমান সরকার হাসিনাপতন পরবর্তী পুলিশহত্যার বিচার করা যাবে না বলে আইন পাশ করাতে যাচ্ছে। পুলিশ একজন মারা যাক আর তিন হাজার, তারা তো মরেছে। মারা যদি গিয়ে থাকে তাহলে তাদের তদন্ত ও বিচার হবে না কোন যুক্তিবলে? বিপ্লবের দোহাই দিয়ে সব জাস্টিফাই করে নিচ্ছে এই সরকার। যদিও আইনি পন্থায় গেলে কোনো বিপ্লব যে-দেশে হয়নি, হয়েছে অত্যন্ত খারাপ ষড়যন্ত্র, সেটি প্রমাণ করতে বেশিকিছুর দরকার হবে না। আর্গুমেন্টই যথেষ্ট।
. . .
রুয়ান্ডায় এথনিক ক্লিঞ্জিংয়ের অংশ হিসেব সংখ্যালঘু টুটসি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ হুতুদের মধ্যে যারা উদারপন্থী ছিলেন তাদের নিকাশ করার নামে আট থেকে দশ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। হোটেল রুয়ান্ডা ছবি হিসেবে দারুণ হলেও প্রকৃত বিভীষিকার সামান্য উঠে এসেছিল সেখানে। উপহাদেশে ইংরেজ খেদাও আন্দোলনের জের ধরে তীব্র হতে থাকা সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় মারা পড়েছেন হাজার-হাজার লোক। যাত্রীবোঝাই ট্রেনে এমনভাবে আগুন দেওয়া হয়েছে, সব লোক পুড়ে কয়লা হয়েছে তখন। এ তো গেল মানুষের হিসাব। মনুষ্যসৃষ্ট তাণ্ডবে আরো কত জীব বেকার জান খুইয়েছে, তার হিসাব কোনো অঙ্কে আঁটবে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় এক কোটি ঘোড়া মারা গিয়েছিল। প্রতিটি হত্যা, রক্তারক্তি ও সহিংসতায় এরকম শত-শত প্রজাতি কচুকাটা হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধে কতজন মারা পড়েছে আর কত পশুপাখি অকাতরে মরছে তার হিসাব কী দিয়ে মাপব আমরা?
মানুষের চেয়ে ভয়ংকর প্রাণী পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। নিজেকে মারতে গিয়ে অন্যকে অবলীলায় সাবাড় করে। এখন এই জায়গা থেকে যদি একাত্তরকে বিচার করি তাহলে এর ভয়াবহতা আমরা বুঝতে পারব। প্রথম কথা, সাত কোটি মানুষ টানা নয় মাস অনিশ্চিত আতংকে রাতদিন পার করেছেন। আকাশ থেকে যুদ্ধবিমান বোমা ফেলছে, মাটিতে দফায়-দফায় বন্দুকবাজি চলছে, প্রাণভয়ে লুকাতে গিয়ে অনেকে মারা পড়েছে তাৎক্ষণিক। নির্যাতন কক্ষে বন্দি করে মেরেছে শত-শত। ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। রেল-সেতু-সড়কের কিছু অক্ষত থাকেনি। সোজা কথায় সার্বক্ষণিক যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে প্রাণের মূল্য থাকে না। প্রাণ তখন স্রেফ গাণিতিক সংখ্যায় পরিণত হয়।
যুদ্ধে বাঙালি সমানে মরেছে, পাকিস্তানী সেনাও মরেছে। মরেছে ভারতীয় সেনা। এক কোটি মানুষ শরাণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। অ্যালেন গিন্সবার্গের সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড-এর দীর্ঘ কবিতা তো ওইসব মানুষের সচিত্র দলিল হয়ে আজো আমাদের অন্তর কাঁপায়। চোখে কি আসু বহে না? নিশ্চয় বহে। যে-লোক পাষাণদিল নয়, গিন্সবার্গের পঙক্তিতে ধৃত যশোর রোড তাকে অপরাধী করে তোলে বারবার। অনেক-অনেক দলিলের চেয়ে শক্তিশালী এই দলিল;- অ্যালেন গিন্সবার্গ যেটি ধরেছিলেন সেইসময় কবিতায়।
ভারত সীমান্ত দিয়ে পরাপারের সময় পথে কত মরেছে তার সঠিক হিসাব কে বের করবে এখন? সব মিলিয়ে সংখ্যাটি তিন লাখ… দশ লাখ… নাকি ত্রিশ লাখ…, এই হিসাব বের করার একটা উপায় অবশ্য আছে। একাত্তরে মোট জনসংখ্যা কত ছিল আর যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কত দাঁড়িয়েছিল সেটি আমরা গোনায় নিতে পারি। স্বাভাবিক মৃত্যুর হিসাব ও ভারতে যারা চলে গিয়েছিল এবং পরে ফেরত আসেনি, উভয় সংখ্যাকে সেখানে মোট জনসংখ্যা থেকে ছাটাই করা লাগবে। নয় মাসে জন্ম নেওয়া নবজাতকের সংখ্যা আলাদা করার প্রয়োজন রয়েছে। নবজাতকের মধ্যে কতজন মারা গেছে তার হিসাব লাগবে। দেশ জুড়ে যত গণকবর সেখান থেকেও হিসাব পাওয়া যাবে কিছুটা। সংবাদপত্রসহ দলিল-দস্তাবেজ আমলে নিতে হবে। যাদের দাহ করা হয়েছে, যারা নদী-খালে ভেসে শেষ হলো,- তাদের হিসাব মিলবে না কোনোদিন। এরকম অনেকগুলো সূচক ধরে যদি গোনাগুনতি করা যায় তাহলে যোগ-বিয়োগ করে একটি ফিগার বের হবে নিশ্চয়। এখন সেটি তিন লাখ হতে পারে, দশ লাখ হতে পারে, ত্রিশ লাখ হওয়া অবান্তর নয়। আরো বেশিও হতে পারে।
গণহত্যা নিয়ে যারা কাজ করেন উনাদের মতে একাত্তরে বাংলাদেশে যুদ্ধের যে-প্রকৃতি, সেটি ছিল ভয়াবহ! তুলনামূলক দ্রুত শেষ হলেও প্রাণহানির মাত্রা ও ধরন দ্রুততর ছিল সেখানে। হিন্দু নিধন মিশনে পরিচালিত অপারেশন সার্চ লাইট-এ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের হিসাব বলছে, ঢাকায় দশ হাজার থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার হিন্দুকে দু-একদিনের মধ্যে পাকিরা হত্যা করেছিল। পঁচিশ মার্চের কালোরাত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শহর জুড়ে সাত হাজার মানুষকে তারা হত্যা করে।
বাংলাদেশের জেনোসাইড আর্কাইভ-এ যদি গমন করি তাহলে গণহত্যার ভয়াবহ ছবির কতকটা আঁচ করা যায়। এখন এর সংখ্যা নিয়ে ওইসময় গণমাধ্যম ও বিশেষজ্ঞরা নানা তথ্য দিয়েছেন। তিন লাখ থেকে ত্রিশ লাখ পর্যন্ত সংখ্যার আলাপটি সেখান থেকে মূলত এসেছে। তবে বিশেষজ্ঞরাই বলছেন,- নয় মাসে গণহত্যার সংখ্যা কোনোভাবে দশ লাখের নিচে হবে না, বরং আরো বেশি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। জেনোসাইড আর্কাইভ-এ মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আর. জে. রামেলের উদ্ধৃতি পাচ্ছি। রামেল লিখেছেন :
সংবাদপত্র, তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন একত্র করলে বাংলাদেশে আটারো জেলার মধ্যে মাত্র পাঁচটির অসম্পূর্ণ পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়,- পাকিসেনারা গত নয়মাসে ঢাকায় এক লক্ষ, খুলনায় দেড় লক্ষ, যশোরে পঁচাত্তর হাজার, কুমিল্লায় পাঁচানব্বই হাজার ও চট্টগ্রামে এক লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে। আটারোটি জেলার হিসাব নিলে সংখ্যা সাড়ে বারো লাখের কাছাকাছি দাঁড়ায়। পরিসংখ্যানটি যদিও অসম্পূর্ণ। হিসাব বলছে পাকিসেনা ও তাদের অনুচর মিলে প্রতি ৬১ জনে ১ জনকে হত্যা করেছে তখন। রামেল আরো পরিষ্কার করে বলছেন : মার্চ ১৯৬৯-এ জেনারেল ইয়াহিয়ার ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকে ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত হিসাব টানলে এই সামরিকজান্তার শাসন কমিউনিস্ট শাসিত সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সামরিক শাসনের অধীন জাপানের চেয়েও জঘন্য ছিল।
. . .
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সংঘটিত গণহত্যা পৃথিবীর ভয়াবহ পাঁচটি গণহত্যার অন্যতম। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড কেবল নয়, গণহত্যা বিশেষজ্ঞরাও এই ব্যাপারে পূর্ণ সহমত। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা এর প্রকৃত তাৎপর্য নিয়ে মাখা না ঘামিয়ে সংখ্যায় পড়ে আছি। সংখ্যা বিষয়ক মতভেদের পুরোটাই রাজনৈতিক। মুক্তিযুদ্ধ, পতাকা, মানচিত্র, জাতীয় সংগীত, জাতির পিতা থেকে আরম্ভ করে যা-কিছু একাত্তরকে সিগনিফাই করছে কিন্তু বিবিধ কারণে পলিটিক্যাল রেটোরিকের বাইরে যেত পারেনি, তার জের ধরে গণহত্যাকেও পাল্টাপাল্টি রাজনীতির গুঁটি করা হয়েছে। আওয়ামীরা ত্রিশ লক্ষ নাম্বারের ব্যাপারে অটল। বিএনপি ওদিকে একবার তিন লাখ, সময় বুঝে ত্রিশ লাখ, এই করে পার করেছে এতগুলা বছর। সুযোগ বুঝে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি সংখ্যাটি কীভাবে কম দেখানো যায় তার পাঁয়তারা করেছে সদা। ইন্ধন দিয়েছে অযথা বিতর্ক যেন লেগে থাকে সবসময়।
একাত্তর এতটাই বিস্তারিত পরিসর এবং সেখান থেকে মানুষের অকথ্য সাফারিং যদি আমরা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করি তাহলে নিজে বুঝতে পারব কী পরিমাণ হত্যা অল্প সময়ে চালানো হয়েছে। একটি ভূখণ্ডের কোনো স্থাপনা অক্ষত ছিল না। এখন যেটি আমরা গাজায় দেখছি, তখন সেকালের পূর্ব পাকিস্তানে ওই তাণ্ডব চলছিল। পাক সেনাবাহিনি যে-পরিমাণ আর্টিলারি ব্যবহার করেছে, যে-পরিমাণ অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করেছে, এবং বিপরীতে ভারতীয় ও মুক্তিসেনারা পালটা প্রতিরোধ,- এটি তো নিছক দুটি বাহিনির লড়াইয়ে সীমিতি থাকেনি,- জনযুদ্ধে মোড় নিয়েছিল। আর জনযুদ্ধে প্রাণহানির পরিসংখ্যান সদা ভীতিকর হয়ে থাকে।
গণহত্য নিয়ে তথাপি বাংলাদেশে যাঁরা কাজ করছেন তাঁরা সাধুবাদ পাওয়ার দাবি রাখেন। এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে রাজনৈতিক মতলব হাসিলের মানসিকতা নিয়ে কাজটি করা হলে এর পরিণাম খারাপ হতে বাধ্য। আগে বুঝে নেওয়া দরকার,- গণহত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনায় মৃত্যু নিছক নাম্বার নয়, ওইসব মানুষের লাশের ওপর দিয়ে আমরা একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছি। তারা অনেকে সম্মুখ রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেননি, কিন্তু দেশ পাওয়ার জন্য নিজের জান খুইয়েছেন। তারাও শহিদ। কথাটি যেন আমরা পারতপক্ষে না ভুলি।
. . .
. . .