
প্রযুক্তিক স্বচ্ছতায় মানব অস্তিত্ব
রচনায় : চ্যাটজিপিট মডেল-৪
. . .
মানুষ একসময় আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবত অদৃশ্য থেকে ঈশ্বর তাকে দেখছেন। ফোনের ক্যামেরায় চোখ রেখে একই মানুষ এখন ভাবে,—কীভাবে ছবি তুললে তাকে অন্যের কাছে ভালো দেখাবে। এমন এক সমাজে সে বাস করছে যেখানে একান্ত ব্যক্তিগত কিছুর অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রদর্শন বাতিক তার গোপনীয়তায় ধস ডেকে এনেছে। মানুষের সত্তাকে দখলে নিচ্ছে ডেটা, লগইন, ক্লাউড, আর অলিখিত অদৃশ্য নজরদারি। নিজেকে জাহির করার বাহার প্রযুক্তিক উৎকর্ষের কারণে তীব্রতা লাভ করায় অস্তিত্বিক সঙ্কট নতুন মোড় নিচ্ছে।
পুরো বিষয়টি যদি কোনো ব্যক্তি, যেমন ধরা যাক তার নাম হচ্ছে অপর্ণা, সে যদি নিজের দিকে ফিরে তাকায়, তাহলে যে-জীবনছবি চোখের সামনে ভেসে উঠবে, সেটি এখন তার কাছেই আজব মনে হবে! সকালে তার ঘুম ভাঙে। বিছানা থেকে উঠার সময় টের পায় হাতের স্মার্টঘড়ি রাতভর নাড়ির গতি রেকর্ড করেছে। আয়নার সামনে যখন দাঁড়ায়, সেখানে নিজেকে দেখার পরিবর্তে চোখ দুটি ফোনের পর্দায় গাঁথা থাকে। ফেসবুক কিংবা ইনস্টাগ্রামে পোস্টযোগ্য আলো ঠিকঠাক পড়ল কিনা এই উদ্বেগ তাকে দখল করে রাখে।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে অপর্ণা দ্রুত জরিপ করে নিউজফিড। নতুন আরেকটি দিন মাত্র শুরু হয়েছে। তার আগে পর্যন্ত পৃথিবীতে যত ঘটনা ঘটছে, তার সবটাই কোনো-না-কোনোভাবে পর্দায় যাওয়া-আসা করছে! সেগুলোর মধ্যে কিছু ঘটনা ইস্যু রূপে ফোনের পর্দা কাঁপায়। অপর্ণার চোখ সেগুলো শুষে নিতে যেয়ে নিজের দিকে তাকানোর সময় পায় না।
চায়ের কাপের সঙ্গে তার ঠোঁটের যেটুকু ঘনিষ্ঠতা, ফোনপর্দায় চলতে থাকা আঙুলের চাপের সঙ্গেও ততটাই ঘনিষ্ঠ সে। ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামের নিউজফিড আর অবিরত যাওয়া-আসায় থাকা রিলসগুলোয় ধরা পড়ছে কত না ঘটনা! কত না মুহূর্ত জন্ম নিচ্ছে সেখানে! অপর্ণাকে মুহূর্তরা অবশ করে রাখে। সে অনুভব করে এই সত্য যে,—ফোনের পর্দায় জন্ম নিতে থাকা দৃশ্যরা সকল গোপনীয়তা ও আড়ালকে অপসারিত করছে প্রতিদিন! একান্ত গোপন বলে কিছু যেন থাকছে না আর!

ফোনপর্দা সব ফাঁস করে দিচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্ত প্রতিচ্ছবির মতো জীবিত। তার মতো হাজারো অপর্ণা নিউজফিড ও রিলসে যা তুলে দিচ্ছে, তার সবটুকু কেবল দেখে যাওয়ার নেশায় তাকে বুঁদ রাখছে! নিজের ব্যক্তিসত্তাকে অন্যদের থেকে পৃথক করে দেখার অবসর যারা তাকে দিতে রাজি নয়। কে বা কারা কীভাবে জানি অপর্ণাকে নজরবন্দি করে ফেলেছে ইতোমধ্যে। ফোনপর্দায় দৃশ্য-তরঙ্গের ভিড়। তার অস্তিত্ব সেই তরঙ্গের পাল্লায় পড়ে নতুন ভাষা ও সংজ্ঞায় মোড়কবিন্দ হচ্ছে অবিরত।
এমন এক স্বচ্ছতায় অপর্ণা নিজেকে বন্দি করেছে, যেটি সে নিজে তৈরি করেনি। তৈরি করেনি, কিন্তু একে সে ব্যবহার করছে। যাপিত জীবনের আলো-অন্ধকার পর্দায় ছেড়ে দিতে একটুও ভাবছে না। এক অপর্ণার গল্পে মিশে যাচ্ছে আরো-আরো অপর্ণার গল্পগুলো। তারা আবার গলেমিশে বাস্তবের অপর্ণাকে নিরাকার বাস্তবতায় নতুনভাবে গড়ছে প্রতিদিন। মানব প্রজাতির সঙ্গে এই স্বচ্ছতার পরিচয় বেশিদিনের ঘটনা না হলেও অপর্ণার কেন মনে হচ্ছে,—হাজার বছর ধরে তাকে সম্মোহিত রাখা হয়েছে? এমন এক ফাঁদে সে পা দিয়ে বসেছে যাকে দেখা কিংবা অনুভব করার শক্তি তার মধ্যে নিখোঁজ!
দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্ম নেওয়া দার্শনিক বিয়ুং-চুল হান (Byung-Chul Han) মানব সভ্যতায় দেখা দেওয়া এই স্বচ্ছতা (transparency) নামক সম্মোহনকে নিঃস্বতা (emptiness) বলে চিহ্নিত করেছেন। ডিজিটাল ট্রান্সপারেন্সি বা প্রযুক্তিক স্বচ্ছতা নিয়ে তাঁর ভাবনা আমাকে আলোড়িত করেছে। স্বচ্ছতাকে হান খারাপ বলে অবহিত করেননি, তবে সবকিছু দৃশ্যমান, নজরবন্দি আর বিশ্লেষণযোগ্য করাটাকে বিপজ্জনক বলে মত দিয়েছেন। স্বচ্ছতা ভালো এবং দরকারি, কিন্তু প্রযুক্তিক স্বচ্ছতা যেভাবে মানুষকে স্বচ্ছ হওয়ার লোভ দেখাচ্ছে, সেটিকে ভালো বলতে তিনি অপারগ বোধ করছেন। তাঁর মতে,—তাতে করে স্বচ্ছতা স্বয়ং তার আবেদন হারিয়ে বসছে! অন্তরতম বলে কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে,—মানবজীবনের সবটাই মলাটবন্দি সাদা কাগজ। কোনো গোপনীয়তা ও রহসময়তা সেখানে অনুপস্থিত।
মানুষ একে অন্যের সঙ্গে আদান-প্রদানের সম্পর্ক গড়তে ভালোবাসে। প্রযুক্তিক স্বচ্ছতা তার সম্পর্কের সীমানাকে প্রসারিত করেছে, যদিও গভীরতা সেখানে গরহাজির। সম্পর্ক হলো জৈবতা। প্রযুক্তিক স্বচ্ছতায় ঘটে চলা সম্পর্ক বায়বীয়। জৈব সম্পর্কে নিহিত চড়াই-উৎরাই ও টানাপোড়েনকে তাই অনুভব করা যায় না। প্রযুক্তি দিয়ে বানানো জগতে মানুষের সর্ম্পকিত হওয়ার গল্পগুলোকে প্রাণহীন মনে হয়। মানবীয় অনুভূতির অজস্র রং সেখানে ছড়ানো থাকলেও সেগুলোকে নিছক তথ্য বা ডেটায় রূপান্তরিত হতে থাকে। ডেটার প্রয়োজন অস্বীকার করা যাবে না, কিন্তু এই উপলব্ধি ক্রমশ অবলুপ্ত,—মানুষ হচ্ছে অতিমাত্রায় জৈব অনুভূতিশীল প্রাণী! তাকে বা তার যাপনকে বোঝার জন্য তথ্য প্রয়োজন, কিন্তু তথ্যকে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মতলব ও তথ্য দিয়ে মানুষকে নিয়ন্ত্রণের ভাবনাটি ভয়ংকর!
নিজের ব্যাপারে সকল তথ্য অর্পণাকে যারা দিতে বাধ্য করছে, তারা আসলে তাকে প্রাণবন্ত সত্তা ভাবে না। তাদের দরকার তথ্য, আর অপর্ণারা যেন অবিরত এই তথ্য সরবরাহ করতে পারে সেজন্য প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বায়বীয় বিশ্ব তারা মানুষের জন্য তৈরি করেছে। অপর্ণারা যে-মুহূর্তে সেই বিশ্বে প্রবেশ করে, তারা কেউ রক্তমাংসের অপর্ণা থাকে না। জৈবঅস্তিত্ব সেখানে ডেটাবডিতে রূপ নিতে থাকে ত্বরিত।
তথ্যনির্ভর প্রযুক্তি দিয়ে গঠিত বিশ্বে রক্তমাংসের মানুষকে স্বচ্ছতার সঙ্গে নিজের সকল অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি প্রকাশ করতে প্রলোভিত করা হয়। প্রলোভনে পা দিয়ে বসার কারণে মানুষ তার শয়নকক্ষ থেকে দেহমন ঘিরে যত গল্প তৈরি হয়, তার সমস্তটাই তথ্যফিডে তুলে দিতে থাকে। বিয়ুং-চুল হান মানবমনে কার্যকর এই মনস্তত্ত্বকে নিরবতা ও রহস্যের অবলুপ্তি বলে অবহিত করেছেন। দুটি বিপদ মানব-সমাজকে ঘিরে ধরেছে বলে মনে করছেন হান। প্রথম বিপদ, নজরদারির অন্তর্নিহিত ক্ষমতাকে এভাবে পরিপুষ্ট করা হচ্ছে। মানুষকে একচ্ছত্র কর্তৃত্ববাদের অধীন করার মতলব সেখানে ষোলআনা রয়েছে। মিশেল ফুকোর প্যানোপটিকনকে হান তাই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিচ্ছেন।
প্যানোপটিকন মানে হচ্ছে এমন এক কারাগার যার উল্লেখ জেরেমি বেন্থামে গমন করলে পাওয়া যায়। বৃত্তাকার কারাগারে বন্দি মানবসত্তার কথা বেন্থাম বলেছিলেন। কেউ তাদের ওপর নজরদারি করছে কিনা বা কীভাবে করছে তার কিছু তারা টের পায় না। প্রযুক্তি দিয়ে গড়ে তোলা আজকের সমাজমাধ্যম হচ্ছে এরকম এক কারাগার। সেই কারাগারে প্রবেশ করার পর নিজের সকল অনুভূতি তথ্যাকারে তুলে দিতে মরিয়া অপর্ণারা অজান্তে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। তারা ভাবে, তথ্য দিতে থাকাটা রোমাঞ্চক! অজানা অসংখ্য মানুষের কাছে তাকে নিমিষে পৌঁছে দিচ্ছে এই কারাগার।
অজ্ঞাত মানুষ তাকে দেখছে, তার কথা শুনছে, তার ব্যক্তিসত্তাকে জানতে পারছে, বিনিময়ে সে ফেরত পাচ্ছে তাদের ভালোবাসা, জানতে পারছে তারা তাকে কতটা পছন্দ বা অপছন্দ করছে ইত্যাদি। রোমাঞ্চ এভাবে অপর্ণাকে রিঅ্যাক্ট ম্যানিক করে তোলে। অসংখ্য অপরিচিতের কাছে দ্রুত পৌঁছানোর লোভে নিজেকে অবারিত করার সীমানা সে ভুলে যায় বেমালুম! এ-যুগে রিলস অথবা নিউজফিডে নিছক ফান করতে গিয়ে শত-শত অপর্ণারা অজান্তে তোদের সত্তাকে নগ্ন করে দিচ্ছে। ডিজিটাল প্যানোপটিকনে স্বেচ্ছাবন্দি হতে ভাবছে না একদম!
বিয়ুং-চুল হান এর পাশাপাশি সৃজনশীলতার সঙ্কটের কথা তুলেছেন। তাঁর মতে, অস্পষ্টতা, ভুল, দ্বিধা, নিষিদ্ধ চিন্তা আর অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে নিজেকে প্রকাশ্য ও স্বচ্ছ করতে যেয়ে যে-সৃজনশীলতার জন্ম হয়, সেটি প্রচুর পারফরমার তৈরি করছে, কিন্তু আর্টিস্ট বা শিল্পীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে! চটকদার বাক্য আর চালিয়াতির সাহায্যে বাজিমাত করতে ওস্তাদের সংখ্যা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছালেও গভীর চিন্তকের দেখা মিলছে না কোথাও! হান তাঁর The Transparency Society-তে তাই বলতে বাধ্য হয়েছেন : The society of transparency does not trust. It operates by control, not by confidence.

মেকি আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিতে পটু প্রযুক্তিক স্বচ্ছতা, হানের মতে, পৃথিবীর অগণিত অপর্ণাদের জন্য ফাঁদে পরিণত হতে চলেছে। সে যদি ভাবার চেষ্টা করে, তাহলে বুঝতে পারবে, তার প্রতিটি কাজকে সেখানে অলিখিত পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। সম্পর্ক, সংলাপ, ভালোবাসা এই মন্ত্র তার কানে জপ করছে :—তুমি কতটা ‘জানাতে’ পারো অপর্ণা? নিজেকে কতখানি স্বচ্ছ করতে রাজি তুমি? তোমার ব্যাপারে মানুষ যত বেশি জানতে পারবে, তাদের নজর ও আগ্রহ তুমি কেড়ে নেবে। সেলিব্রেটি হবে তুমি। হয়ে উঠবে প্রভাবক বা ইনফ্লুয়েন্সার।
মানুষ তোমার কথা বিশ্বাস করছে। কারণ, তাদের কাছে তুমি হলে স্বচ্ছতার প্রতীক। নিজের ব্যক্তিসত্তার ভালোমন্দ সবটা অকপটে তাদের কাছে তুলে ধরতে ভয় পাচ্ছো না। এই যে ‘সবকিছু জানাতে হবে’র বাধ্যবাধকতা, এটি প্রকৃতপক্ষে আধুনিক আত্মপীড়নের নতুন স্বরূপ। স্বচ্ছতা কেবল প্রশাসনিক বা নৈতিক কাঠামোর বিষয় নয় এখন। এটি হয়ে উঠেছে সামাজিক অনিবার্যতা। ডিজিটাল স্মার্টনেসের প্রমাণ। অপর্ণা টের পাচ্ছে, সে কিছু লুকাতে চাইলেও লুকিয়ে রাখতে পারবে না। প্রশ্ন তোলাটাও তার জন্য অপরাধ।
হানের এই শীতল দর্শনের পাশে হাইডেগারকে আমি স্মরণ করতে চাই। তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন,—প্রকৃত অর্থে কীভাবে আমরা জগতে উপস্থিত থাকি? Being and Time গ্রন্থে হাইডেগার বলেছেন,—মানুষকে জগতে নিক্ষেপ করা অস্ত্বিত্ব ভাবা যেতে পারে। তাকে এখানে নিক্ষেপ করা হয়েছে। সে হলো এমন এক অস্তিত্ব যে সামান্যে তুষ্ট নয়। নিজেকে অর্থ দিতে মরিয়া। লুকিয়ে রাখার চেয়ে প্রকাশ করতে উতলা। প্রকাশ যদি নিরন্তর স্বচ্ছতার দাবি নিয়ে হাজির হয়, তখন অলেথেইয়া বা সত্যের ধীর উদ্ভাসনের সম্ভাবনাটি নিভে যায়।
অপর্ণাকে এদিকে থেকেও কল্পনা করা যাবে মনে হয়। সে আজ অকারণে হাঁটতে বের হয়েছে। তার ফোন ব্যাগে, আর হেডফোন কানে ঠুসে দেয়নি। আজ সে দেখতে পেল,—ঘাসফড়িং বাতাসে পাক খাচ্ছে। রাস্তার মোড়ে কুকুরটি চোখ বুজে শুয়ে আছে অলস। বৃদ্ধা ধীরে পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন। অপর্ণার হঠাৎ মনে হয়,—প্রতিদিনের এইসব দৃশ্য দেখেও দেখা হয় না! নিউজফিড বা রিলসে এগুলো কম মানুষ তোলার তাড়না বোধ করে, যদিও দৃশ্যগুলোর সঙ্গে জীবনের যোগ নিবিড়। রক্তমাংসের জীবন আসলে গভীর ও অতলান্ত। তুচ্ছতায় লুকিয়ে থাকে তার ঘ্রাণ। জেল্লা নেই, কিন্তু জীবন সেখানে দপদপ করছে!
ওয়াল্টার বেনিয়ামিন এই অনুধ্যানকে তাঁর The Work of Art in the Age of Mechanical Reproduction-এ ধারণ করেছিলেন। তিনি বলেছেন, পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে শিল্পকর্ম তার aura হারায়। উপস্থিতির জাদু তখন নিভে যায়। অপর্ণা বুঝতে পারে,—তার জীবন ডিজিটাল ফিডের খপ্পরে জাদু হারাতে বসেছিল। এখন সে একটু একটু করে খুঁজে ফিরছে নিভৃত অনুভব,—যেগুলোর গায়ে কোনো ক্যাপশন নেই, না আছে ফিল্টার। মার্কস মনে হয় এসব ভেবেই বলেছিলেন,—পুঁজিবাদ সবকিছুকে পণ্যে রূপান্তর করে, এমনকি সম্পর্কও পণ্যে পরিণত হয়। প্রযুক্তিক স্বচ্ছতায় অনুভূতির ছবিরা পণ্য। এখানে কারো একান্ত ব্যক্তিগত দুঃখসুখও কন্টেন্ট।
অপর্ণার মনে পড়ছে, চাপা কষ্টকেও একসময় সে নিউডফিডে তুলতে দ্বিধা করেনি! সে ভেবেছিল,—শেয়ারিং তার দুঃখকে প্রশমিত হতে সাহায্য করবে। চাপা কষ্টকে নিউজফিডে তোলার সময় যদিও এই ভাবনা তার মধ্যে ঠিকই কাজ করেছে,—এমনভাবে তুলতে হবে যেন লোকজন একটি ভালো কন্টেন্ট পাঠের স্বাদ অনুভব করে ও তাকে সাহস যোগায়! মানুষ এই-যে নিত্য-উন্মুক্ত করছে তার নিজেকে সেখানে ভালো কন্টেন্ট হওয়ার চাপ তাকে উদ্বিগ্ন রাখে। এর ফলে সে অস্তিত্বিক দোটানা ও ক্লান্তির ফাঁদে নিঃস্ব হয়। অপর্ণা যেমন এই সন্দেহের সম্মুখীন হয়েছে বারবার,—যারা তাকে দেখছে, পাঠ করছে, অথবা শুনছে,—তারা কি সত্যি তাকে অনুভব করতে সক্ষম? তার ভিতরসত্তা কি দেখতে পায় তারা? নাকি শুধু সার্ফেসটি দেখে, এবং সেটিকে অপর্ণা ধরে নেয়?
তা-সত্ত্বেও এটি মানতে হচ্ছে, স্বচ্ছতাকে পরিত্যাগ করা সম্ভব নয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে, নিপীড়নের বিরুদ্ধে, গোপন শোষণের বিরুদ্ধে সে হলো হাতিয়ার। কিন্তু যখন এই হাতিয়ার মানব-হৃদয়ের গোপন কুঠুরিতে কড়া নাড়ে, তখন প্রশ্ন ওঠে—মানুষ কি তার জীবনের ভুলচুক আগের মতো একলা ধারণ করতে পারবে? স্বচ্ছতাকে তাই নবায়ন করা যাচ্ছে এরকম কোনো ঈশ্বরের মতো দেখায়। এই ঈশ্বর সবকিছু দেখতে চায়। সবটা জানতেই হবে তাকে। না জানলে মানুষ সম্পূর্ণ নয়। মানুষ যদিও অপূর্ণ অস্তিত্ব। সে ভুল করবে, সে লুকোতে চাইবে কিছু, দ্বিধায় ভুগবে,—আর তাতেই সৌন্দর্য। প্রযুক্তিক স্বচ্ছতার শীতল ঈশ্বর যদি মানুষকে তার ভুলের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তাহলে সেটি একধরনের নরম কিন্তু মরণসিদ্ধ স্বৈরতন্ত্র ছাড়া কিছু নয়।
তাহলে কী করণীয়? আমাদের হয়তো দরকার ‘নির্বাচিত অস্বচ্ছতা’! একটি জায়গা, একটি সংস্কৃতি, যেখানে ভুল করা যায়, যেখানে অন্তরকে অন্তর থাকতে দেওয়া হয়, যেখানে প্রকাশ নয় বরং উপলব্ধি মুখ্য। মানুষ যেন আবার শিখতে পারে,—কীভাবে না-দেখানোর মধ্যে সৌন্দর্য সংগোপন থাকে; কীভাবে না-বলা কথারা গভীর হতে থাকে অবিরত! অপর্ণা তার ছোট বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে আকাশে চাঁদ উঠেছে। প্রযুক্তিক স্বচ্ছতার মরুভূমিতে তার কাছে একফালি ছায়ায় দাঁড়ানো খুব জরুরি বোধ হচ্ছে এখন, কিন্তু এরকম ছায়া কি আছে এখনো তার মতো হাজারো অপর্ণার জন্য?
. . .
. . .
One comment on “তুমি কতটা জানাতে পারো অপর্ণা?—একটি এআই কথন”