মতিউর রহমানের সঙ্গে বেশ মন খুলে কথা বললেন ড. ইউনূস। কিছুটা নিজের অবস্থান পরিষ্কার করলেন মনে হলো। যদিও মতিউর রহমান চাইলে উনাকে আরো কঠিন প্রশ্ন করতে পারতেন। কি মনে হয় জাভেদ?
. . .
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ড. ইউনূসের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। বেশ লম্বা, দুই কিস্তিতে ছাপা হয়েছে। সাক্ষাৎকারের দুটো তাৎপর্য রয়েছে। প্রথমটি সরকারের ভাবনা ও গতিপথ, আর দ্বিতীয়টি প্রথম আলোর রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থানকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া । অর্থাৎ দ্বিপাক্ষিক অবস্থানকে যাচাই করার উদ্দেশ্য থেকে এই সাক্ষাৎকারকে আমি বিবেচনা করি।
মতিউর রহমান দীর্ঘদিন থেকে মিডিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতি ও জনমতকে প্রভাবিত করে আসছেন। ওয়ান ইলেভেন-এর অন্যতম কুশীলব ছিলেন তিনি। মাইনাস টু নিয়ে সক্রিয় ছিলেন আগাগোড়া। ড. ইউনূস আর মতিউর রহমানের মধ্যে কমন মিলের দিকটি হচ্ছে দুজনেই মার্কিনপন্থী হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকেন। দুজনে আবার হাসিনা সরকারের আমলে হয়রানির শিকার হয়েছেন। রাজনীতির জায়গা থেকে শেখ হাসিনা তাঁদেরকে শত্রু ধরে নিয়েছিলেন। যার পেছনে মাইনাস টু ফর্মুলার ভূমিকা রয়েছে। এসব কারণে আবার শেখ হাসিনার প্রতি মতিউর রহমান ও ড. ইউনূস মনে-মনে বিদ্বেষ পোষণ করেন। সাক্ষাৎকারে বিষয়টি গোপন থাকেনি।
এর বাইরে আরেকটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া দরকার,- অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর জনসমর্থন ও আস্থা গত দুই মাসে হ্রাস পেয়েছে। সন্দেহ দানা বাঁধছে দিনদিন। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে এরকম একটি সাক্ষাৎকারের উপযোগিতা রয়েছে। মতিউর রহমান সাক্ষাৎকারকে এমনভাবে এগিয়ে নিয়েছেন যেন ড. ইউনূসকে দিয়ে আশার বুদবুদ তৈরি করা যায়। সেদিক থেকে ভেবে দেখলে উনার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে বলা যায়।
এখন প্রশ্ন হলো ড. ইউনূস যে-কথাগুলো বলেছেন সেগুলো কি আশাব্যঞ্জক নয়? আশাব্যঞ্জক কথা ইউনূস বলেছেন। দুএকটা বাতিক্রম বাদ দিলে উনার বক্তব্যের পুরোটাই আশাবাদী বচনে ভরপুর। কথার খই ফুটিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। আস্থা আর জনপ্রিয়তার জায়গা ধরে রাখতে যা বলা দরকার ছিল, সেই টোনে বলেছেন। সংস্কার নিয়ে কথা বলেছেন। নির্বাচন ও জাতীয় ঐক্য নিয়ে বলেছেন। এখন উনার এসব কথার সারবস্তু যদি চিন্তা করি তাহলে সেটি বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না।
কীভাবে কী করবেন তার বিষয়ে কিছুই বলেননি ড. ইউনূস। সংস্কার কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে এগিয়ে নিতে দেবে সেভাবে সব ঘটবে বলে জানাচ্ছেন তিনি। মানে দাঁড়াচ্ছে,- নিজের ভাবনা তিনি স্পষ্ট করতে পারেননি বা স্পষ্ট করতে চাইছেন না। বিতর্কিত ইস্যুগুলো পাশ কাটিয়ে গেছেন প্রধান উপদেষ্টা। মব জাস্টিসের যে-ব্যাখ্যা তিনি দিলেন সেখানে সরকার প্রধান হিসেবে তার ভূমিকা আমার কাছে স্পষ্ট হলো না। ধরি মাছ, না ছুঁই পানি,- এরকম অবস্থানে তাঁকে দেখছি মনে হলো।
মিনহাজ ভাই, আপনার কথার সঙ্গে একতম,- অনেক বিষয় ছিল যেমন হাসিনাপতনের পর আওয়ামী মালিকাধীন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিপীড়ন, ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করা, ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থান ইত্যাদি নিয়ে মতিউর রহমান প্রশ্ন করতে পারতেন। করা উচিত ছিল। তিনি সেদিকে যাননি। যাওয়ার কোনো অভিপ্রায় তাঁর ছিল না। উনি আসলে ইউনূস সরকারকে জাস্টিফাই করতে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন। সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার অভিলাষ মাথায় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার মুখোমুখি হয়েছেন প্রথম আলো সম্পাদক।
সাক্ষাৎকারের দুএকটা চুম্বক অংশে দৃষ্টি ফেরানো যাক :
ড. ইউনূস : ‘আমরা যে-কোনো উপলক্ষ বানিয়ে শত্রু বানিয়ে ফেলি। কীভাবে শত্রু বানাতে হয়, শত্রু বানানোর প্রক্রিয়াটাকে আমাদের আগের সরকার ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে। আপনাকে শত্রু বানিয়েছে। আমাকে শত্রু বানিয়েছে। এখানে কতজনকে শত্রু বানিয়েছে;- আপনি দেখেন। খালি শত্রু, শত্রু,- কঠিন শত্রু। এমন যে, সে দেশের শত্রু, শুধু আমার শত্রু না;- ওই ভঙ্গিতে নিয়ে গেছে। কাজেই ওই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আজকে সংস্কারের জন্য আমরা গলা ফাটাচ্ছি কেন? সেই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’
প্রথম আলো : এর মধ্যে সমাজে হানাহানি-বিদ্বেষ, এগুলো খুব দেখা যায়। ‘মব জাস্টিস’ বলে একটা জিনিস চালু হয়ে গেছে। বেশ কিছু মানুষ মারা গেছেন। সমাজের মধ্যে একটা অস্থিরতা এসে গেছে। এটাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন?
ড. ইউনূস : ওই-যে ল অ্যান্ড অর্ডার স্ট্যাবলিশ করা। এগুলো হলো ল অ্যান্ড অর্ডার সিচুয়েশনের বিষয়। এখানে কোনো রাজনৈতিক বিষয় নেই। এখানে যে-হত্যাকাণ্ড, মব জাস্টিস হচ্ছে, এগুলো হচ্ছে ল অ্যান্ড অর্ডারের বিষয়। ল অ্যান্ড অর্ডার শক্ত করতে পারলে এ-জিনিসগুলো হবে না। সামাজিক তৎপরতা যদি বাড়াই, মানুষ মানুষের প্রতি যত্ন নেয়, তাহলে এগুলো হবে না। সরকার গিয়ে মারামারি থামাতে পারবে না। মারামারি করলে শাস্তি হবে, এটুকু আমরা বলতে পারি। আমরা বারবার বলছি, আমরা একটি পরিবার। আমাদের মতের ভিন্নতা থাকতে পারে। এজন্য কেউ কারো শত্রু নই। এ-জিনিসটা যেন আমরা পরিষ্কার রাখি।
প্রথম আলো : আপনি যে-কথাটি বললেন, স্বপ্নের কথাটা। একটা জাতীয় ঐক্য। এ-ধরনের কোনো উদ্যোগ নেওয়ার বাস্তবতা কি আছে?
ড. ইউনূস : আপনারা বলেন, আপনারা পত্রিকায় লেখেন। শুরু করেন, কথা বলেন। যদি এটা কাজে লাগে, একত্র করা, সবাই একমত হওয়া; একমত হওয়ার কাজে। একমত হতে হবে না, একত্র হতে হবে। মত যার-যার হতে পারে। নানা মত থাকবে। বাপে ছেলের মতে বা মেয়ের মতে একমত হয় না, দেশের একমত কেমনে হবে? মত থাকবে, কিন্তু আমরা একমত হবো।
. . .
ড. ইউনূসের চিন্তা-ভাবনা একদম মানুষের চিন্তার মতো লাগতেছে এখন পর্যন্ত। যারা সরকারে যায়, পরের দিন থেকে মনে হয় তার ওপর অন্য কোনো দেও জাতি ভর করেছে। উনাকে এখনো মানুষ মনে হচ্ছে। আমার মনে হয় না বাংলাদেশের কোনো অংশের জন্য তিনি যোগ্যতা রাখেন। দেশ এখনো সেই পর্যায়ে যায় নাই। উনি যাতে সম্মানের সহিত দেশ থেকে বের হয়ে আসেন, আমি সেই কামনা করি।
. . .
মতিউর রহমান বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন একসময়। কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র একতা সম্পাদনা করেছেন বেশ কিছুদিন। উনার হাতে প্রাণ পাওয়া আজকের কাগজ , ভোরের কাগজ ও পরে প্রথম আলোর মতোই গোছানো ছিল সেকালের একতা । অর্থনীতি বিষয়ক প্রতিবেদনগুলো মনকাড়া থাকত সবসময়। যার সাহায্যে মার্কসবাদী পার্টিলাইনটাকে আমরা তখন আবছায়া ধরতে শিখছি কেবল। ছাত্রজীবনে কিছুদিন ছাত্র ইউনিয়নে সংযুক্ত থাকার নেপথ্যে মতিউর রহমান ও একতা বড়ো ভূমিকা রেখেছিল।
মনে পড়ে, ছাত্র শিবির তখন পুরোদমে সক্রিয়। তাদের আনেকের সঙ্গে আমাদের ভাব, বন্ধুতা ও আড্ডাবাজি নিয়মিত ঘটনা ছিল। দলের পাঠচক্রে শিবিরের ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশার জন্য সিনিয়র ভাইরা মাঝেমধ্যে ঝাড়িটাড়ি দিতেন। বোঝাতেন। সতর্ক করতেন। আমরা কেন জানি সেসব উপেক্ষা করে শিবিরের লিটারেচার চেখে দেখার কৌতূহল দমন করতে পারতাম না। বাচ্চা বয়সের কারণে বোধহয় উল্টেপাল্টে দেখতাম ওসব। দুর্বোধ্য মনে হতো। কারণ ততদিনে আমরা ম্যাক্সিম গোর্কি পড়তে শিখে গেছি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়ছি বটে! কতটা বুঝে পড়ছি সেটি পৃথক বিষয়, কিন্তু ওগুলো শিবিরের ইসলামি বাখানভরা বইপত্রের চেয়ে ঢের বেশি মনকাড়া মনে হতো। কাজেই তারা আমাদের মগজ ধোলাই করতে পারেনি।
এই-যে পারেনি, এর জন্য তখনকার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও নানামুখী পথে রাজনীতি সচেতন অগ্রজদের প্রভাব বড়ো ভূমিকা রেখেছিল। আমাদের মানস ও সচেতনা উনারা গড়ে দিচ্ছিলেন। আজকের জেন-জি প্রজন্ম এই ঘটনা বোধহয় কল্পনাও করতে পারবে না! একটি শূন্যতার মধ্যে তারা বেড়ে উঠেছে। কেবল দেখেছে এক আয়রন লেডির বিতিকিচ্ছি কাজকারবার। লেডিকে প্রতিহত করার মতো সম্মুখগামী ভাষা গত পনেরো বছরে দেশে মাথা তুলতে পারেনি। যেগুলো ছিল, দেশিক-বৈশ্বিক নানা পটপরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলাতে না পেরে ধ্বংস হয়েছে। যেমন ধ্বংস হয়েছেন মতিউর রহমান। উনি কী ছিলেন একসময় আর এখন কী হয়েছেন… আমি মিলাতে পারি না!
একইভাবে ড. ইউনূসরাও পাল্টেছেন ব্যাপক। সত্তর থেকে নব্বইয়ের পুরোটা সময় জুড়ে এনজিওর ভূমিকা কী ছিল আর পরে কী দাঁড়িয়েছিল… এই গবেষণা হয়তো করবেন কেউ একদিন। এবাদুর রহমানদের মতো একচোখা হয়ে নয়, ইমতিয়ার শামীমের মতো একরৈখিক ন্যারেটিভে বোনা আখ্যানে নয়;- যা আমি মনে করি, বাংলাদেশে এনজিওর সামগ্রিক দিকটি বিবেচনায় না নিয়ে বিরচিত। ইউনূসরা যথন শুরু করেন, উনারা কিন্তু স্বাপ্নিক ছিলেন। ড. ইউনূস কতটা ছিলেন সেটি বলতে পারছি না, কারণ তারো আগে থেকে উনি দেশ-বিদেশ এভাবে জীবন পার করেছেন। কিন্তু ফজলে হাসান আবেদ, ড. জাফরুল্লাহর মতো মানুষ সত্তরের দশকে দেশটাকে নতুন করে গড়ার স্বপ্ন বুকে করে লোভনীয় সব অফার পায়ে ঠেলে গ্রামেগঞ্জে উদয়াস্ত খেটেছেন। উনারাও পরে ঠিক জায়গা থেকে সরে গেলেন ক্রমশ।
এতকিছুর পরেও এনজিওতে ওইসব মানুষ কাজ করতেন একটা সময়, যাদের মধ্যে সৃষ্টিশীলতার বীজ থাকত। গ্রামে মানুষের তাড়া খেয়ে তারা পিছু হটেননি। প্রান্তিক নারীদের ঘর থেকে বের করে আনার কারিগর কিন্তু তারাই ছিলেন। পোশাকশিল্পে যাওয়ার রাস্তা গড়ে দিতে ভূমিকা রেখেছিলেন। পরে উনারাই একে-একে বদলাতে থাকলেন। আশার ফানুস নিভতে আরম্ভ করল। প্রশিকার মতো অতিকায় এনজিওকে চোখের সামনে ধসে পড়তে দেখলাম। আরো কতগুলো ধসেছে তার লেখাজোঁকা নাই। প্রশিকা যদিও ঘুরে দাঁড়ানোর বার্তা দিচ্ছে ইদানীং, কিন্তু ধসের আগে যেখানে পৌঁছেছিল সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়।
এনজিওকে তার আদিলক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করার নেপথ্যে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যাপক অবদান আছে মনে করি। এমন এক জাদুর কাঠি ড. ইউনূস সকলের হাতে ধরিয়ে দিলেন, সকলে হিতাহিত জ্ঞান খুইয়ে বসলেন। ক্ষুদ্র ঋণের ম্যাজিকে দাতানির্ভর এনজিও থেকে কর্পোরেট এনজিওর বিকাশ ঘটল দেশে। তখন থেকেই এনজিওতে কাজকরা মানুষগুলো হয়ে উঠলেন স্রেফ বেনিয়া। সেইসঙ্গে পলিটিক্যালি এ্যাম্বিশাস। ফজলে হাসান আবেদ ব্যতিক্রম সেখানে। উনি কর্পোরেট ইনভেস্টার হতে চেয়েছিলেন, যেখানে সরকারের সঙ্গে পলিটিক্সে না জড়িয়ে বরং সরকারকে তার ওপর নির্ভর থাকার রাস্তায় হেঁটেছেন। সফলও হয়েছেন মারাত্মক। সেইসঙ্গে এনজিও ও বাণিজ্যকে একটি পৃথক সীমারেখায় বেঁধে দিয়েছেন আবেদ। আমার বিবেচনায় আবেদ সবচেয়ে সফল উদ্যোক্তা। দেশের অর্থনৈতিক বিকাশে উনার অবদান ব্যাপক। বিষয়টি বুঝতে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও এসথার দ্যুফলো বিরিচত পুওর ইকোনমিক্স পাঠ করা যেতে পারে।
সে-তুলনায় ড. ইউনূসের গতিবিধি আমি কখনো ধরতে পারিনি। বদরুদ্দীন উমররা ক্ষুদ্র ঋণ ব্যাখ্যা করতে যেয়ে উনাকে তুলোধুনা করতেন। আমরা পড়তাম। ড. ইউনূসকে সত্যি-সত্যি কাবুলিওয়ালার নতুন সংস্করণ মনে হতো। অথচ একই ব্যক্তি কথা বলেন চমৎকার! বিশ্ব জোড়া নামডাক তাঁর। নোবেল পেলেন। পত্রিকায় দুই হাত প্রসারিত করে উনার ছবি বের হলো। আমরা ততদিনে পুরোদস্তুর প্রাপ্তবয়স্ক। উল্লাস প্রকাশের ধরনটি কেন জানি বিদঘুটে লেগেছিল সেদিন। অথচ দেখুন, অমর্ত্য সেন বা অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল পাওয়ার খবরে উৎফুল্ল হতে বাঁধেনি। হতে পারে উনাদের চিন্তাপ্রণালীর সঙ্গে একধরনের নিবিড় সংযোগ এর পেছনে ভূমিকা রেখেছে।
অমর্ত্য সেন আজো পাঠমুগ্ধ রাখেন। অভিজিতের ভাবনার সঙ্গে মতের অমিল থাকে কিন্তু উনাকে প্রাসঙ্গিক মনে হয় সদা। ইউনূসকে সেরকম কিছু মনে হয়নি কোনোদিন। উনার কথা, লেখাপত্র, এ্যাক্টিভিজম… সবটাই দূর সুদূর মনে হয়েছে। আজ, দেশের ক্রান্তিকালে তিনি দায়িত্বে। আজো দূর সুদূর মনে হচ্ছে তাঁকে। আমার মতো অনেকে আছেন ধারণা করি, যাদের কাছে তিনি এমন এক মানুষ, যাকে তারা বুঝতে অক্ষম। এখন সেটি আমাদের না উনার দোষ… সে এক ঈশ্বর জানেন।
. . .
এটাই বলছিলাম জাভেদ। মতিউর রহমানের মতো ঝানু সম্পাদক সুকৌশলে বিব্রতকর প্রশ্নগুলা উঠাননি। সাংবাদিকের কাজ হচ্ছে প্রশ্নের ভিতর দিয়ে ফ্যাক্ট বের করে আনা। আমরা তো ওরিয়ানা ফাল্লাচির নাম শুনে বড়ো হয়েছি। খোমেনি, গাদ্দাফি, হেনরি কিসিঞ্জার, ভুট্টো, মুজিব, ইন্দিরা কার ইন্টারভিউ করেননি ফাল্লাচি! বাংলায় অনূদিত হয়েছে ওইসময়। বইও বেরিয়েছিল বোধহয়।
এমন সব প্রশ্ন ফাল্লাচি করে বসতেন যার উত্তর দিতে বাঘা-বাঘা সেলেবরা বিব্রত হয়েছেন বহুত। _প্রশ্নের ভিতরে থাকত চাতুর্য, থাকত সাক্ষাৎকার যিনি দিচ্ছেন তার ভিতর পড়ে নেওয়ার মতলব। সাক্ষাৎকার নিতে যেয়ে ঝুঁকি নিতেন এবং যিনি সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন তাকেও ঝুঁকিতে ফেলতেন অহরহ। বলতে পারেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াকু ফাল্লাচি এমনভাবে প্ররোচনায় ঠাসা সাংবাদিকতা করতেন যা স্বয়ং তাঁকে বিতর্কিত করে তুলত। হোমড়া-চোমড়া জাদরেল যেই হোন-না-কেন, সাহসী এই রমণীর প্রশ্নবাণের মুখে পড়তে হবে ভেবে একটু হলেও কলিজা কেঁপে উঠত। এটাই ছিল ফাল্লাচির এথিকস;- একজন সাংবাদিক যখন প্রশ্ন করবেন তিনি কাকে প্রশ্ন করছেন সেটি মুখ্য নয়, মুখ্য হচ্ছে তিনি কী প্রশ্ন করছেন? কতটা অনুসন্ধানী হতে পারছেন।
ফাল্লাচির এই ডিসেকশনটা মারাত্মক ছিল। শেখ মুজিবের মতো ব্যক্তির সঙ্গে অহং কতটা যায় বা সেটি গণতন্ত্রের জন্য লড়াকু এক নেতার জন্য কি শোভন? মূলত এ-ব্যাপারে নিশ্চিত হতে তিনি ঢাকায় পা রেখেছিলেন। উনার এই সাক্ষাৎকারের ফুটেজ নেটে পাওয়া যায় না। যেটি পাওয়া যায় সেটি আমার কাছে মুজিববিদ্বেষীদের এডিট করা মনে হয়েছে। তবে বইয়ের অডিও পডকাস্ট নেটে পাওয়া যায়, আগ্রহীরা ইচ্ছে করলে শুনতে পারেন সেটি। মুজিবের সঙ্গে আলাপে ফাল্লাচি উনার মধ্যে ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বীজ প্রবল দেখতে পেয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারটি, তাঁর বয়ান মোতাবেক জঘন্য ছিল। মুজিবকে ফাল্লাচি যেভাবে উপস্থান করেছেন সেটি আমার কাছে নানাকারণে সন্দেহজনক মনে হয়েছে।
যেসব তথ্যের ভিত্তিতে উনি শেখ মুজিবের সাক্ষাৎকার নিতে ঢাকা এসেছিলেন, এবং আসার পর যে-অভিজ্ঞতা, কার মধ্যে ঘাটতি ও ভুল বোঝাবুঝি দুটোই ছিল মনে হয়েছে। নারীবাদ ও ফ্যাসিবাদ বিষয়ে ফাল্লাচির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন, বিখ্যাত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় সেটি প্রকারান্তরে উনি তাঁদের ওপর চাপিয়েও দিতেন। সবমিলিয়ে তাঁর প্ররোচনামূলক সাংবাদিকতার ধারা এবং তথ্য সংগ্রহের ধাঁচ ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন ও তর্ক সবসময় জারি থেকেছে। এতদসত্ত্বেও ফাল্লাচি ভীষণ আকর্ষণীয় এক চরিত্র ছিলেন, যাঁকে উপেক্ষা করা কঠিন। শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতা ও মুজিবকে পরিষ্কার ফ্যাসিস্ট বলে ডিক্লেয়ার করার কায়দা নাটকীয় হলেও সম্যক না জেনে এই ব্যাপারে কথা বাড়ানো সংগত নয়। দুজনকেই অপমান করা হয় তাতে।
ফাল্লাচি দেখিয়ে গেছেন, এ্যাথিকাল জার্নালিজম মানে মিউ-মিউ টাইপের প্রশ্ন নয়, তার মধ্যে থাকতে হবে বারুদ। থাকতে হবে উসকানি। তাৎক্ষণিক সব মুহূর্ত, যা সাংবাদিক তৈরি করে নেবেন আসল মানুষটাকে সামনে আনতে। প্রভোকেটিভ জার্নালিজমের কারণে প্রচণ্ড বিতর্কিত ফাল্লাচি কিন্তু সাংবাদিকতার ডিকশন পাল্টে দিয়েছিলেন তখন। ফাল্লাচি বিশ্বাস করতেন একজন সাংবাদিক স্রেফ কোনো টেপরেকর্ডার নয়। তার নিজের একটি অবস্থান থাকতে হবে, এবং সেই অবস্থানটা অবশ্যই পরিবর্তনের স্বপক্ষে হবে। এবং, যে-সাংবাদিকের কোনো শত্রু নেই, সাংবাদিকতার বাইবেলে তাকে ভালো সাংবাদিক বলার কোনো মানে থাকে না। মতিউর রহমানের কাছে এসব আশা করা বাতুলতা। মাসুদ কামালরাও যখন সমালোচনা করেন সেখানে পক্ষপাতটা প্রকট হওয়ার কারণে সব মাঠে মারা যায়।
আমাদের সাংবাদিকরা দলীয় শিবিরে বিভক্ত। তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, সন্তোষ গুপ্ত, নির্মল সেন, এমনকি আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতো ঝানু কলাম লেখক কি দেখতে পান এখন? মোনাজাতউদ্দিন মানের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা তো সোনার পাথর বাটি! তাঁর ওইসব সাহসী অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, সংবাদ সংগ্রহে নিজের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা আজো স্মৃতিতে অমলিন। খালেদ মহিউদ্দনের মধ্যে সাহসী সাংবাদিকতার স্পিরিট ছিল, কিন্তু উনি যার সঙ্গে আলাপে বসেন, তাকে কথা বলার স্কোপ সেভাবে দিতে চান না। তর্ক করতে বসে যান। ফলে আসলি কিছু বেরিয়ে আসার চান্স কমে যায়।
ওসব বাদ। বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস-এ স্টিফেন স্যাকুরের আলাপ যদি লক্ষ্য করেন, উনি কিন্তু শান্ত মেজাজে প্রশ্ন করেন, এবং তার মধ্যে জায়গা বুঝে মোক্ষম পাঞ্চলাইন ঠুকে বসেন। সিএনএন-এ ল্যারি কিং লাইভও এরকম ছিল। অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানকে ল্যারি কিং লাইভে প্রশ্নের উত্তর দিতে বসে বিব্রত হতে দেখেছি। গণমাধ্যম কার্যত স্বাধীন না হলে, নিজেকে স্বাধীন ভাবতে না পারলে, মালিকপক্ষের চাওয়ার বাইরে যেতে না পারলে সাহসী সাংবাদিকতা সম্ভব নয়। এবিএম মুসার মধ্যে এই সাহস ছিল, যদিও একটা পর্যায়ে আর কাজ করেনি। হাসিনা তাঁকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছিলেন। এখন অথবা বহুদিন ধরে যেমন নিষ্ক্রিয় আর মতলবি চরিত্র ধারণ করে বসে আছেন মতিউর রহমান।
. . .