. . .
এটা যদিও আমার সন্তানের স্কুলে ক্লোজ রিডিং হিসেবে পাঠ্য, পড়তে ও পড়াতে গিয়ে আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল, কিছুটা ভয়ও লাগছিল।
লোম দাঁড়িয়ে যাওয়া ও ভয়ের কারণ বোধহয় আন্দাজ করতে পারছি। বাচ্চাকে গল্পটি পড়ানোর সময় আপনি বাংলাদেশকে দেখতে পাচ্ছিলেন। গল্পটি যেভাবে বলা হয়েছে, এখন এর ন্যারেটিভ বা বয়ান আমাদের এখনকার পরিস্থিতির সঙ্গে বেশ মিলে যাচ্ছে। তবু জানতে চাই, আর কী কারণ ছিল ভয় পাওয়ার? ফয়েজ আহমদ রাজিব শিশুপাঠ্য যে-গল্পটি এখানে শেয়ার করলেন সেটি অর্থ ও তাৎপর্য বহন করছে। জাভেদ এই ব্যাপারে কিছু বলবেন?
. . .
মার্কিন দেশের প্রেক্ষাপটে গল্পটির প্রাসঙ্গিকতা আছে। বাচ্চাদের মনোজগৎ থেকে শুরু করে বয়স্ক নাগরিক সবাই এই ন্যারেটিভে অভ্যস্ত। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দোহাই দিয়ে বিশ্বব্যাপী মার্কিনিদের সামরিক ও অন্যান্য হস্তক্ষেপ পরিচালিত হয়ে থাকে। গণমাধ্যম থেকে আরম্ভ করে বুদ্ধিজীবীদের বড়ো অংশ এরকম ন্যারেটিভ তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকেন।
ভোগবাদী সমাজে মানুষকে বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া বাল্যকাল থেকে তারা শুরু করে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকা সম্পর্কে আমেরিকায় সচেতনা ব্যাপক নয়। সামান্য কিছু মানুষ এই বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামান বা প্রশ্ন তোলেন। বাদবাকিরা পড়ে থাকেন অন্ধকারে। তবে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় সচেতনতার মাত্রা ব্যাপক ছিল। এর পেছনে একাধিক কারণ থাকলেও মূল কারণ ছিল প্রচুর পরিমাণ মার্কিন সেনার হতাহত হওয়ার ঘটনা। সম্প্রতি গাজায় ইসরাইলের হামলাকে কেন্দ্র করেও যুক্তরাষ্ট্রের ছাত্রসমাজে বিক্ষোভ তীব্র হতে দেখেছি আমরা। তবে মোটা দাগে পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে বিশ্ব জুড়ে যেসব সমালোচনা হয়ে থাকে, দেশটির জগনগণ সেই ব্যাপারে হয় অসেচতন, নয়তো সরকার ও গণমাধ্যম পরিবেমিত বয়ানকে সত্য ধরে নেন। রাজনীতি সচেতনার মাত্রা যুক্তরাষ্ট্রে কখনোই তীব্র হতে দেখিনি। সুতরাং গল্পে বয়ানটি যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, এখন এর সত্য-মিথ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পরিবর্তে বিশ্বাস করার সম্ভাবনা বেশি থাকছে। যুক্তরাষ্ট্রে সেভাবেই ছক সাজানো থাকে।
ঠিকই ধরেছেন জাভেদ। গল্পে ন্যারেটিভ যেভাবে আসতেছে সেখানে আপনার কথাগুলাই আগে মনে আসবে। আমাদের জায়গা হইতে যখন দেখতেছি তখন সেইটা আসতে বাধ্য। এখন রাজিবের পরিস্থিতি কল্পনা করেন। বাচ্চাকে গল্পটা পড়ে শুনাইতেছেন। আমি নিশ্চিত নই উনি আম্রিকা থাকেন কিনা। ইতালি বা পশ্চিম ইউরোপের কোনো দেশেও থাকতে পারে। ধরে নিতেছি আম্রিকায় থাকেন। বাচ্চাকে গল্পটি পড়াইতে গিয়া তাঁর গায়ের লোম দাঁড়াইয়া যাইতেছে। বাংলাদেশকে ইমাজিন করতেছে উনি। বাংলাদেশের পরিস্থিতির সঙ্গে গল্পে যে-ন্যারেটিভ আমরা পাইতেছি সেইটা বেশ মিলে যায়। কাজেই এই জায়গাটা তাঁকে হন্ট করতেছে হয়তো।
গল্পটার উৎস সম্পর্কে অবশ্য নিশ্চিত হইতে পারি নাই। নেটে এই নামে একখানা কল্পকাহিনির সন্ধান পাইতেছি। লেখক স্টিফেন জে এ্যামব্রোস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে কাহিনি সাজাইছেন লেখক। শত্রুর মোকাবিলায় নর্মান্ডি সাগরতট ধরে ইউরোপ অভিমুখে অগ্রসর মিত্রবাহিনীর অভিযান কাহিনির উপজীব্য বিষয় ছিল। এখন সিটিজেন সোলজারস বলতে নিয়মিত ও পেশাদার সেনাসদস্য সবসময় মিন নাও করতে পারে। যুদ্ধ বা কমব্যাট মিশনে সাহায্যকারী অতিরিক্ত ফোর্স হিসেবে অনেকসময় আধা-সামরিক বাহিনি গড়ে তোলা হয়। সিটিজেন সোলজারস অনেকটা সেরকম একখান বস্তু। যুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাদের।ঊনিশশো একাত্তরে আমরা যেমন মুক্তিবাহিনি গড়ে তুলছিলাম, যারা আদতে ওই সিটিজেন সোলজারসের সংজ্ঞায় খানিক পড়তেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মিত্রবাহিনীর হয়ে এরকম বাহিনি হয়তো তৈরি করা হইছিল অথবা লেখক সেইটা ইমাজিন করতেছেন এখানে। স্কুলপাঠ্য গল্পটি এ্যামব্রোসের টার্ম ব্যবহার করে তৈরি করছেন উনারা।
রাজিব অভিবাসী। উনার কাছে গল্পটি কাজেই আর আম্রিকাকে পজিটিভ ভূমিকায় দেখার জায়গায় থাকতেছে না। মনে অন্য ভাবনা চলতেছে, কিন্তু বাচ্চাদের সেইটা উনি বলতে পারবে না। বলতে গেলে অসুবিধা আছে। যার ফলে উনার অবস্থান থেকে গল্পের মোরাল বাচ্চাদের গিলানো শক্ত কাজ। আবার জন্মসূত্রে শ্বেতাঙ্গ বা মার্কিনির কাছে ডিফিকাল্ট না। সে এই গল্পকে একরৈখিক জায়গা হইতে পাঠ করবে, যেখানে কিনা আম্রিকার অবদানকে গ্লোরিফাই করা হইতেছে। হলিউডে এভাবেই তারা ভিয়েতনাম নিয়া কাড়ি-কাড়ি সিনেবয়ান তৈরি করছে একসময়;- টু গ্লোরিফাই দেয়ার ওয়ারহিরো;- যারা কিনা নাপাম বোমা ফালাইতে সেখানে গমন করছিল।
ভিয়েতনাম বা বাংলাদেশ বাদ দেন, আম্রিকা এবং জাতিসংঘ শান্তি মিশনের হয়ে এখন যারা সংক্ষুব্ধ কোনো দেশে শান্তি ফিরাইতে গমন করে, পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় আসলে? দেশটি কার্যত নিজের ব্যর্থতাকে প্রকাশ করে সেখানে। তারপর অনেককিছু ঘটে… ওসব সকলের জানা।
গল্পটি ভেবেচিন্তে লেখা হইছে। যে-বাচ্চাটি তার সৈনিক মায়ের সঙ্গে ভিডিওকলে আলাপ করে তার কাছে আম্রিকার পজিটিভ ইমেজ এখানে মায়ের মাধ্যমে ইনোসেন্ট বয়ানে প্রেজেন্ট করা হইতেছে। কী… আম্রিকার কাজ হইতেছে যেখানে অশান্তি ও হানাহানি সেখানে শান্তির দূত হয়ে গমন করা। এইটা গেল ন্যারেটিভের একটা দিক। অন্যদিকে যেইটা গল্পে হাইড করা হইতেছে, সেইটা হলো শান্তি স্থাপনের মিশনে যারা যাইতেছে, বাচ্চটার মায়ের কথাই ধরি, সে কিন্তু মারা যাইতেও পারে। এখন যদি মারা যায়, আম্রিকার মতো দেশ তারে বীরের মর্যাদা দিবে ঠিক, কিন্তু সে তো জানে কী কারণে তারে যাইতে হচ্ছে সেখানে।
সাদ্দাম পরবর্তী ইরাকে জুনিয়র বুশ মার্কিন সেনাদের পাঠায়। মাইকেল মুরের ডকুমেন্টারি ফারেনহাইট 9/11 মনে আছে আপনার? মুর অবশ্য এই ব্যানারে পরে আরো তথ্যচিত্র তৈরি করছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প কী-কারণে ক্ষমতায় সেইটা মুরের ভাষ্য মোতাবেক, দুইহাজার আটারো সনে নির্মিত ফারেনহাইট 11/9 দেখলে দর্শক ঠার করতে পারবেন। যাই হোক, ফারেনহাইট 9/11-এর বয়ানে উনি দেখাইতেছে,- হাজারের উপ্রে সৈন্য মারা পড়ছিল, যারা তখন অনেকে যুদ্ধে যাইতে চায় নাই। না গিয়া উপায় ছিল না, তাই যাইতে হইছিল। আবু গারিবের কারাগারে অকথ্য নির্যাতনে অংশ নিতে হইছে তাদেরকে। বোতেরোর পেইন্টিংয়ে যা অমরত্ব লাভ করছে পরে। এইটা হলো দ্য আদার ডার্ক সাইড অব দ্য স্টোরি হুইচ দে অলওয়েজ হাইড ফ্রম আস! আম্রিকা সবসময় এইটা হাইড করবে, যার কোনো ন্যারেটিভ আপনি কোনোদিনও পাইবেন না।
. . .
গায়ে কাঁটা দেয়ার পুরোটাই অনবদ্যভাবে আলোচিত হয়েছে। ভয় ওটাই লাগতেছিল যে,- কাকতালীয়ভাবে আমার দেশে এসে পড়বে নাতো! আর কিছু তথ্য ফারাক এর কারণে আমি দুঃখিত। আমার আরেকটু বিস্তারিত লেখা উচিত ছিল। আমি পরিবার নিয়ে সিলেটেই থাকি। পেশায় সরকারি বীমাজীবী। সাধারণ বীমা কর্পোরেশনে আছি। আর আমার ছেলেমেয়েরা স্টেমেইজ স্কুল, হাউজিং এস্টেটে পড়ে। এডেক্সেল কারিকুলাম। সিইও হলেন মাহবুব সুন্নাহ। আপনারা কেউ চিনেন কিনা জানিনা। আপনাদের সমসাময়িকও হতে পারেন। উনি আম্রিকা থাকেন। ওখান থেকেই হয়তোবা স্টাডি ম্যাটেরিয়ালস পাঠান।
. . .
আদি নেটালাপ : অক্টোবর ২৭, ২০২৪ : থার্ড লেন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ