সৌদিকণ্ঠে বব মার্লে : আমাদের কণ্ঠে কী?
…
সৌদি শিল্পী মহামেদ এলবকরির পরিবেশনায় বব মার্লেকে নবযৌবন পাইতে দেখা বড়ো আনন্দের! রেগে সংগীতের লহরি নিয়া তাঁর বিশ্বজয় পুরাতন ঘটনা। সারা বিশ্বে তিনি গীত হইতেছেন। হইতে থাকবেন অবিরত। আই শুট দ্য শেরিফ-এর মতো দ্বৈতাভাসে পূর্ণ গানের কারণে সদা প্রাসঙ্গিক গায়কের কাজেই নতুন করে পুনরুজ্জীবন লাভের কিছু নাই। কিন্তু মরুর দেশ সৌদি আরবে মহামেদ এলবকরির কন্ঠে এই-যে উনি গীত হইলেন,- বব নিজেও বোধহয় এইটা ভাবেন নাই কখনো!
বব মার্লের জাতভাই আলফা ব্লন্ডিকে আমরা রেগের সুরে ইসলামি ভাবধারা বহন করে এমন সব গান গাইতে দেখছি। বড়ো ভালো গান আলফা ব্লন্ডি। কিন্তু তিনি তো বব মার্লে না। পৃথিবীতে বব মার্লে একবার আসছিল, বারবার আসবে না। অমরত্ব পাইতে আসছিলেন,- অমরত্ব লাভ করছেন। তথাপি মরুর বুকে তিনি নির্বাসিত ছিলেন একপ্রকার। সৌদি যুবরাজ সালমানের কল্যাণে মহামেদ এলবকরির কণ্ঠে ডেজার্টল্যান্ডে অবশেষে গীত হইতেছেন তিনি! বড়ো আনন্দ। হুমায়ূন আহমেদের পাগলাটে কোনো চরিত্রের মতো বলতে ইচ্ছা করতেছে,- বড়োই সৌন্দর্য! চোখে জল আসতেছে। জল কি মুছব? না থাক, মুছব না। এলবকরি গাইতে থাকেন গেট আপ, স্ট্যান্ড আপ, স্ট্যান্ড আপ ফর ইওর রাইটস।
. . .
আমরা বাংলাদেশে বব মার্লেকে ধারণ করছি, যখন উনি মার্কিনবলয়ে প্রবেশ যাইতেছেন, সেই তখন থেকে। আশি থেকে নব্বইয়ের পরিধি জুড়ে বাংলাদেশী ব্যান্ড গানের উত্থানে ইংরেজি ভাষায় গীত রক এন রোলের প্রভাব অপরিসীম। রক গানের যত ঘরানা ততদিনে বিকশিত, তার সবটাই কমবেশি বাংলাদেশের ব্যান্ডবাজরা ধারণ করছিলেন। মাকসদু, আইয়ুর বাচ্চু, জেমস, হাসান, হামিন-শাফিনরা সকলে অভিজাত হোটেল আর পারিবারিক অনুষ্ঠানে ইংরেজি নাম্বার গাইতেন। বিটলস-এর হাত ধরে জন লেনন, জর্জ হ্যারিসন, পল ম্যাককার্টনি, রিঙ্গো স্টার, এরিক ক্ল্যাপটন আর রাজার ওয়াটার্সরা তো ষাট-সত্তরের দশকে এখানে ঢুকলেন। উনাদের পেছন-পেছন সুতীব্র নৈরাশ্য আর নির্বেদ নিয়া জিম মরিসনের সাইকেডেলিক রকও ঢুকল আউল-বাউলের বাংলায়। তার মধ্যে রেগে নিয়া সক্রিয় বব মার্লের প্রভাব ছিল সবচেয়ে সর্বজনীন।
বব মার্লের গানের ধাঁচটাই এমন,- এর কথা, সুর, লয়, তাল সবটা পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তের মানুষকে স্পর্শ করে যায়। উনি যখন গানের মধ্যে গেট আপ, স্ট্যান্ড আপ, স্ট্যান্ড আপ ফর ইওর রাইটস বইলা ডাক দেয়, তখন আর সেইটা কোনো দেশকালে আবদ্ধ থাকে না। সকলের হক জন্ম নিতে থাকে সেখানে। সমান তালে সংক্রামিত হইতে থাকেন বব মার্লে।
জেমসের দুখিনী দুঃখ করোনা কানে আসলে যে-কারণে অটোমেটিক তাঁরে আমরা স্মরণ করি। জেমসের দুখিনীকে মার্লের নো ওম্যান, নো ক্রাইর সঙ্গে একাত্ম করতে কালবিলম্ব করি না। সংস্কৃতির শক্তি,- সে সর্বজনীন হইতে চায় সদা। স্থানিকতার রসে যত গভীর হয়, তার মধ্যে বৈশ্বিকতার সুর তত গাঢ় হইতে থাকে। কারণ, সত্যিকার স্থানিকতা আদতে মৌলিক কিছু নয়। বিশ্বের নানা প্রান্ত হইতে নানা তরঙ্গ মিলেমিশে দেশভেদে স্বকীয় যে-চেহারা পাইতে থাকে, এখন সেইটাকে আমরা স্থানিকতা বইলা বুঝি। আদতে তার জন্মই হইছে বৈশ্বিক তরঙ্গ হইতে।
ভারতীয় দরবারি সংগীত সৃষ্টি হইছিল লোক উৎসে ছড়ানো বিচিত্র স্বর আত্মস্থ করে। পরে দরবারি সংগীত আবার নতুন তরঙ্গ জুড়তে লোক উৎসকে প্রভাবিত করছে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস এসব নিয়া কত লিখছেন! সেগুলা তো পড়ছি একসময়। পড়ে কী লাভ হলো সেইটা আজকের বাংলাদেশকে দেখে মাথায় ধরে না। হদ্দ বেকুব লাগে নিজেক। হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে পোড়াইয়া দিতে ইচ্ছা করে।
বিশ্বাস করি তথাপি,- বিনিময় সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। তার কোনো ভাষা, জাতি, সীমানা নাই। সৌদিরা, আমার ধারণা,- অবরুদ্ধ খোপে বসে গান গাইতেন সংগোপন। না গেয়ে যাবেন কোথায়। তাদের রক্তে তো বেদুইন বহমান। গোত্রশাসিত আরবজীবন চিরকাল সংগীত, নৃত্য আর কবিতাপ্রিয়। ইবনে খলদুনের আল মুকাদ্দিমায় আরবি কবিতার বিস্তারিত বিবরণ ছিল মনে পড়ে। আল ফারাবির মুসিকা তো পুরোটাই সংগীতের ময়নাতদন্ত। আরবি ভাষাটা যেমন ধনী, তার প্রতি পরতে ছড়ানো সংস্কৃতি ততধিক ধনী। মাঝখানে একটা দুঃসহ অমানিশায় বন্দি ছিল তারা। বন্দিদশা কাটতে আরম্ভ করায় আরবরক্তে পুরাতন ছন্দ ফেরত আসতেছে।
. . .
মহামেদ এলবকরি গাইতেছেন নিজস্ব ধাঁচে গেট আপ স্ট্যান্ড আপ। উঠো, উইঠা দাঁড়াও। নিজের অধিকারের পক্ষে দাঁড়াও। আমরা কত না উঠে দাঁড়ানো গান করছি সেদিনতক! আজ বসে পড়তেছি, দেবে যাইতেছি, ধসে যাইতেছি। সৌদিতে আলো আসিতেছে…। আমরা দেখতেছি,- আলো ক্রমশ নিভিতেছে…! রজনী অমাবস্যায় গাঢ় হইতেছেন ক্রমশ। আলো নাই! বঙ্কিম যে-রজনীকে প্রেমের চক্ষু দিয়া দেখিতে গিয়া কম্পিত হইলেন, উনার মনে হইল এই প্রেম উনি চক্ষু দিয়া দেখতে পারবে না,- আমরা কী তাহলে বঙ্কিমকে মিম করে অন্য অর্থ কহিব এখন? বলিব কি…
ধীরে, রজনী, ধীরে! ধীরে, ধীরে, রজনী, ঐ অন্ধ নয়ন উন্মীলিত কর। দেখ, আমায় দেখ, আমি তোমায় দেখি! ঐ দেখিতেছি- তোমার নয়নপদ্ম ক্রমে প্রস্ফুটিত হইতেছে-ক্রমে, ক্রমে, ক্রমে, ধীরে, ধীরে, ধীরে, ধীরে, নয়নরাজীব ফুটিতেছে! এ সংসারে কাহার না নয়ন আছে? গো, মেষ, কুক্কুর, মার্জার, ইহাদিগেরও নয়ন আছে-তোমার নাই? নাই নাই, তবে আমারও নাই! আমিও আর চক্ষু চাহিব না।
. . .