মুখবন্ধ : থার্ড লেন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের নিয়মিত আলাপে বেলাল ভাই রবার্ট গ্রিনের পাঠসফল বই দ্য আর্ট অব সিডাকশন নিয়ে আলাপ তুলেছিলেন। তার আগে পর্যন্ত বইটি বা এর লেখকের নাম আমার কানে আসেনি। নেটালাপ-এ বেলাল ভাই জানতে চেয়েছিলেন,- পাঠকরা কেন হঠাৎ গ্রিনের বই পাইকারি হারে খরিদ করছেন? বইটি নিয়ে এতো আগ্রহ ও আলোচনার কী কারণ থাকতে পারে ইত্যাদি। বেলাল ভাইয়ের কৌতূহল আমার মধ্যে সংক্রমিত হলো তাৎক্ষণিক। রবার্ট গ্রিনের বই পাঠক কেন গোগ্রাসে গিলছেন সেটি জানার আগ্রহ নিজের ভিতর টের পাচ্ছিলাম। নেটে কয়েকদফা ঘাঁটাঘাঁটির পরে যেসব ধারণায় পৌঁছেছি সেগুলোর সারসংক্ষেপ এই লেখা। বলে রাখা প্রয়োজন,- রবার্ট গ্রিন ও তাঁর বইয়ের গভীর কোনো ক্রিটিক আমি এখানে করিনি। এর জন্য নিবিড়পাঠ ও সময় প্রয়োজন। সেইসঙ্গে এও বলে রাখছি,- আমি যে-কথাগুলো এখানে বলছি তার মধ্যে ভুলত্রুটি থাকতে পারে। সেরকম কিছু চোখে পড়লে পাঠকরা ধরিয়ে দেবেন আশা করি।
. . .
পাশ্চাত্য দেশগুলোয় আমরা জানি বিচিত্র বিষয়ে লেখালেখির ধারা অনেকদিনের। সাহিত্যের প্রচলিত ঘরানার বাইরে বৈচিত্র্যপূর্ণ নানান বিষয় নিয়ে চর্চা সেখানে প্রবল। লেখালেখির এই সমস্ত ঘরানায় জনপ্রিয় লেখকের সংখ্যাও ব্যাপক। রবার্ট গ্রিন যেমন মানব সমাজে আধিপত্যের ধরন ও মানুষের মনোজগতে এর প্রভাব ইত্যাদি নিয়ে অনেকদিন ধরে লিখছেন। মার্কিন দেশের নাগরিক গ্রিন তাঁর এ-সমস্ত কাজের জন্য পাঠকমহলে ভালোই পরিচিত। মানুষজন তাঁর লেখা বই সাগ্রহে পাঠ করেন। একাধিক বেস্ট সেলিং বইয়ের জনক এই লেখক। দ্য ফরটিএইট লজ অব পাওয়ার (The 48 Laws of Power) লিখে প্রথম নজরে আসেন গ্রিন। বইটি গত শতাব্দীর নববই দশকের শেষ দিকে বাজারে আসে। প্রথম বইয়ে বাজিমাত ঘটান গ্রিন।
ক্ষমতা বলতে আমরা কী বুঝব তার আলোচনা ছিল বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য। ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ক্ষমতার ভূমিকা এবং আমরা সেটি কীভাবে রপ্ত করতে পারি ইত্যাদি নিয়ে সবিস্তারে লিখেছেন সেখানে। ক্ষমতা অর্জনের কলাকৌশল নিয়ে গ্রিনের সাবলীল আলাপ বইটির ব্যাপারে পাঠককে আগ্রহী করে তোলে সেইসময়। প্রথম বইয়ের সাফল্য পরে ধরে রাখতে সফল হন রবার্ট গ্রিন। দ্বিতীয় বইয়ে এসে সাফল্য পায় পূর্ণতা। দ্য আর্ট অফ সিডাকশন (The Art of Seduction) বাজারে আসা মাত্র পাঠকমন জয় করে নিয়েছিল। দুনিয়া জুড়ে পরিচিত হয়ে উঠেন রবার্ট গ্রিন। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। দ্য লজ অব হিউমান নেচার, মাস্টারি, দি থার্টিথ্রি স্ট্রাটেজিজ অব ওয়ার, দি ফিফটিথ ল নামে একের-পর-এক বই বাজারে আসতে থাকে। কমবেশি পাঠপ্রিয়ও হয় বইগুলো। বাজারকাটতি লেখক হিসেবে রবার্ট গ্রিনের সাফল্য যে ঈর্ষণীয় তাতে সন্দেহ নেই।
আজ থেকে প্রায় চব্বিশ বছর আগে দ্য আর্ট অব সিডাকশন বইটি বাজারে এসেছিল। প্রায় পাঁচশো পৃষ্ঠা জুড়ে মানুষের মনোজগৎ চষে বেড়িয়েছেন লেখক। মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্কের গতি-প্রকৃতি ও নানাবিধ চোরাটানের ওপর আলো ফেলেছেন। মানব মনস্তত্ত্ব নিয়ে যারা আগ্রহী তারা এই বইটিকে নির্দেশিকা গণ্য করে থাকেন। সিডাকশন বা প্রলোভন বস্তুটি আসলে কেমন? আমরা কেন প্রলোভিত হই? এর পেছনে নিহিত মনস্তত্ত্ব কী হতে পারে? কীভাবে আমরা তাকে মোকাবিলা করব? প্রলোভন কত প্রকার ও কী কী? মানবজীবনে প্রলোভনের কোনো ইতিবাচক ভূমিকা আছে কি? যদি থাকে তাহলে কীভাবে বুঝব কোনটি ভালো আর কোনটি পরিহার করা উচিত? বিচিত্র সব প্রলোভন রপ্ত করার কৌশল কেমন হতে পারে,- যেগুলো কিনা একজন মানুষকে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ, আকর্ষণীয় ও সফল করতে ভূমিকা রাখে? এরকম অনেকগুলো প্রশ্নের সমীকরণ রবার্ট গ্রিন তাঁর ঢাউস আকৃতির বইয়ে মিলানোর চেষ্টা করেছেন। প্রলোভনকে সচরাচর আমরা যেসব নৈতিক মাপকাঠি দিয়ে বিচার করি, সেগুলোর বাইরে গিয়ে তার মূল্য ও প্রভাব নিরূপণ করায় বইটি দ্রুত পাঠকের মনোযোগ কেড়ে নেয়।
প্রলোভনের তদন্তে নেমে রবার্ট গ্রিন কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিয়েছেন। মানবমনে সক্রিয় উপলব্ধি অর্থাৎ মানুষের মনোভাব ও চিন্তার ধরনকে গুরুত্ব সহকারে আমলে নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি। অন্যরা আসলে কী ভাবছে, কোন বিষয়গুলো তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছে ইত্যাদি লক্ষণগুলো প্রলোভনের মাত্রা ও চরিত্র বোঝার জন্য জরুরি বলে ব্যাখ্যা করেছেন এই লেখক। তাঁর মতে, এগুলোকে যদি মার্ক করা যায় তাহলে নিজের অভীষ্ট পূরণে সম্ভাব্য কৌশল তৈরি সহজ হয়ে ওঠে।
এখানে এসে পারফরম্যান্স বা সোজা কথায় কৌশলকে আমরা কীভাবে বাস্তবে রূপ দিচ্ছি সেটি নিয়ে আলাপ তুলেছেন লেখক। বিভিন্ন মানবচরিত্র ও তাদের মধ্যে সক্রিয় নানান বৈশিষ্ট্য আলোচনা করে গ্রিন দেখিয়েছেন সিডাকশন বা প্রলোভন তৈরির উপাদান রূপে এগুলোকে কেন আমরা আমলে নিতে বাধ্য। ভান ও অভিনয় করার ক্ষমতা নিয়েও আলাপ তুলেছেন লেখক। মানুষ কেন ও কীভাবে আকর্ষণীয় চরিত্র রূপে উপস্থাপন করতে মরিয়া হয় সেদিকটা তার আলোচনায় এসেছে। এসবের সুবাদে সমন্বয়কে অতি প্রয়োজনীয় বলে মানছেন গ্রিন। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত ও সেই মোতাবেক কাজে নেমে পড়ার বিষয় তো রয়েছেই।
দ্য আর্ট অব সিডাকশন বইয়ের অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হলো রবার্ট গ্রিন নিজ বক্তব্যের সমর্থনে ইতিহাসের পাতা থেকে দারুণ সব ঐতিহাসিক চরিত্রকে তুলে এনেছেন। বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন তাঁরা কীভাবে প্রলোভনের সূক্ষ্ম কলাকৌশল কাজে লাগিয়ে সমাজে প্রভাববিস্তারী ও সফল হয়েছেন। উদ্দেশ্য সিদ্ধির নিরিখে প্রলোভন হচ্ছে শিল্প। প্রলোভনের শৈল্পিক আবেদন যদি না থাকত তাহলে আমাদের পক্ষে কোনো উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হতো না। নেতিবাচক ও ইতিবাচক উভয় দিক থেকে এটি হচ্ছে মানবস্বভাবে সক্রিয় এজেন্ট। তাকে বাদ দিয়ে কোনো অগ্রগতি কাজেই সম্ভব নয়। বইয়ে এরকম চব্বিশটি প্রলোভনের নীতিনিয়ম ও সেগুলো বাস্তব করে তোলার শৈল্পিক কৌশলের বিবরণ বইয়ে ঠেসে দিয়েছেন গ্রিন। ব্যক্তিগত জীবনে আমরা কমবেশি এগুলো বহন ও প্রয়োগ করে থাকি বা করতে পারি বলে মত রাখছেন তিনি।
এখন এই চব্বিশটির মধ্য থেকে কয়েকটি নমুনা হিসেবে আমরা নিতে পারি। উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য প্রলোভনের সাহায্য আমরা নিয়ে থাকি। এখন একে সফল করতে কিছু বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন। গ্রিনের ভাষায় প্রথমে ভিকটিম কাকে করব সেটি ঠিক করে নিতে হবে। এখানে ভিকটিম বলতে যে বা যাদেরকে আমি প্রলোভনের ফাঁদে বন্দি করব বলে ঠিক করেছি সেই তাদেরকে বোঝানো হয়েছে। ভিকটিম নির্বাচনে ভুল হলে সব মাঠে মারা যাবে। গ্রিনের মতে, আরেকটি জরুরি জিনিস হলো ভিকটিমের মনোজগতে নিজের ব্যাপারে ধারণা তৈরি করতে হবে। তারা যেন ভাবে,- এই লোকটিকে বিশ্বাস করা যায় বা আমি তার কাছে নিরাপদ। নিরাপত্তার মিথ্যা বাতাবরণ তৈরি করাটা প্রলোভন সফল করার অন্যতম শর্ত।
এছাড়াও নিজের ব্যাপারে ভিকটিমের মনে রহস্যজাল তৈরি করতে হবে। তার কাছে নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে যেন সে আশ্বস্ত বোধ করে। সে যেন ধরে নেয় এই মানুষটি অনেক গভীর ও তার চরিত্রের নাগাল পাওয়া তার পক্ষে সহজ নয়। নিজের সাফল্য ও প্রতিপক্ষের দুর্বলতার ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা ও আস্থা থাকতে হবে। ভিকটিমের কাছে সাফল্যগুলো ভালোভাবে তুলে ধরতে হবে। অন্যদিকে প্রতিপক্ষের দুর্বল দিকগুলোও তার সামনে হাজির করা জরুরি। এছাড়া কোনো তুলনায় তাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। রবার্ট গ্রিন বোঝাই যাচ্ছে, নিজে এসব কৌশল বাস্তবজীবনে কাজে লাগিয়ে বেস্ট সেলার লেখক হয়ে উঠতে পেরেছেন। এদিক থেকে ভাবলে সিডাকশনকে ইতিবাচক মনে হওয়টাই স্বাভাবিক।
গ্রিনের বই মূলত বাস্তবজীবনে সাফল্যের নিয়ামক হিসেবে কৌশলী হওয়ার গুরুত্বকে তুলে ধরেছে। একে রপ্ত করার স্বার্থে দর্শনশাস্ত্র প্রচারিত নৈতিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে সযত্নে পাশ কাটিয়ে গেছেন লেখক। তাঁর লক্ষ্য হচ্ছে প্রলোভনকে এমনভাবে উপস্থাপন করা যেন এ-সংক্রান্ত সকল ধর্মীয়, সামাজিক ও দার্শনিক প্রস্তাবনার বাইরে গিয়ে মানুষ এটিকে গ্রহণ করতে পারে। প্রলোভনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সময় দার্শনিক দ্বিধা যেন তাকে গ্রাস না করে সেটি মাথায় রেখে বইটি লিখেছেন গ্রিন। প্রলোভনের বাস্তবসম্মত ভিত্তির প্রশ্নে মেকিয়াভেলীকে যে-কারণে তিনি দ্য গ্রেট সিডিউসার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। মেকিয়াভেলির প্রলোভিত করার ক্ষমতায় স্বয়ং প্রলোভিত হওয়ার কথাও বলেছেন অকপট। দার্শনিক অন্বেষায় নিহিত প্রলোভন বিষয়ক আলাপকে অস্বীকার ও এড়িয়ে যাওয়ার এই প্রবণতা তাঁর বইয়ে পাঠকের চোখে পড়ার কথা।
রবার্ট গ্রিন মানুষকে দেখছেন সহজাত স্বভাবের অনুগত জীব রূপে। সমাজবিকাশের ঐতিহাসিক কার্যকারণ সূত্রে সে সঙ্গপিয়াসী ও বাসনাবিলাসী। লোভ তার স্বভাবে সহজাত নিয়মে সক্রিয়। সমাজে নিজেকে সফল ও প্রভাববিস্তারী হিসেবে দেখার আগ্রহও মজ্জাগত। এগুলোকে এখন নীতিনৈতিকতা দিয়ে আমরা যখন ঢাকা দিতে যাই, তখন মানুষের মধ্যে জটিলতা, স্ববিরোধ ও বিচিত্র ভণ্ডামি সক্রিয় হতে থাকে। প্রলোভনের সম্ভাব্য লাভ ও ক্ষতির পরিমাপ স্বয়ং প্রলোভনের মাত্রা ও চরিত্র আমলে নিয়ে মানুষকে নির্ধারণ করতে হবে। প্রলোভন মানে খারাপ বা ক্ষতিকর এরকম ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। রবার্ট গ্রিন সেই ছকে বইটি লিখেছেন। বাস্তবজীবনে মানুষ তার নিজের ভিতরে প্রলোভনকে যেভাবে সক্রিয় হতে দেখে, তার সঙ্গে ছকটি মিলে যাওয়ার কারণে গ্রিনকে তারা লুফে নিয়েছিল। বইটির তুলকালাম সাফল্যের এটি মনে হচ্ছে বড়ো কারণ।
. . .
. . .