সংযুক্ত গুহাচিত্রের বয়স চৌদ্দ হাজার বছর। ঈসা নবির জন্মদিনটারে বেঞ্চমার্ক ধরলে চৌদ্দ হাজার। বেথেলহেমে উনি ভূমিষ্ট হওয়ার চৌদ্দ হাজার বছর আগে স্পেনের কান্তাব্রিয়া প্রদেশের প্রাচীন গুহার ছাদে ছবিখানা আঁকা হয়। ঈসায়ী সন শুরু হওয়ার আগে চৌদ্দ ও পরবর্তী দুই হাজার বৎসর যদি গোনায় ধরি, ছবির বয়স তাহলে ষোল হাজারে দাঁড়াইতেছে। বয়সভারে জবুথবু হইলেও চুনাপাথরের গুহায় দিব্যি টিকে আছে। গুহাটি এখন কেভপেন্টিংয়ের খনি আলতামিরা কিনা এই ব্যাপারে নিশ্চিত হইতে পারি নাই।
উত্তর স্পেনের কান্তাব্রিয়া প্রদেশে আলতামিরা অবস্থিত বইলা গুগলমামা তথ্য দিতেছেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে দশ বছর আগে স্পেনের উত্তরাঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও খননকার্য চালানো হইছিল। প্রত্নবিশারদ অ্যালান রেড্ডি যার নেতৃত্বে ছিলেন। গুহাচিত্রটি সেইসময় উনাদের চোখে পড়ে। কার্বন ডেটিংয়ের সাহায্যে তার বয়স বের করা হয়। রাসায়নিক পরীক্ষা ও বিজ্ঞানসম্মত ময়নাতদন্ত শেষে গুহাচিত্র বিষয়ে নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও মতামত উনারা গণমাধ্যমে ঘোষণাও করেন।
অ্যালান রেড্ডির মতে ছবিখানার প্রাচীনত্ব অবাককরা কোনো বিষয় নয়। যে-বার্তা সে বহন করতেছে সেইটা বরং এখানে দামি। গুহার ছাদে আঁকা ছবিখানা আমলে নিলে আমরা বুঝতে পারি বনিআদমের জীবনে তার নিজেকে নিয়া বিরক্তি, অসন্তোষ ও অনিশ্চয়তা অতি প্রাচীন ঘটনা। গুহাবাসের কালপর্বে নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা তার মধ্যে সুতীব্র ছিল। পেটের খিদে মিটাইবার উপায় ছিল কঠিন। শিকারের পেছনে সময় আর খাটনির অন্ত ছিল না। এসব ঘটনার অভিঘাত ছিল মারাত্মক। পরস্পরকে তারা উত্যক্ত করত। শারীরিক ও মানসিক পীড়া দিতে ত্রুটি করত না। সোজা বাংলায় মনের ভিত্রে শয়তানি আধুনিক কালপর্বের বিষয় না। তিন দফায় দেখা দেওয়া বরফযুগে গুহামানবের মনের ভিত্রে শয়তানির কমতি ছিল না। মানসিক চাপ আর মনোবৈকল্যকে কাজেই প্রাগৈতিহাসিক বইলা আমরা ভাবতে পারি। চারকোলে আঁকা গুহাচিত্রে যার নমুনা অ্যালান রেড্ডি পাইতেছেন এখন।
উনার ব্যাখ্যা শোনার পর ছবিখানাকে যে-কেউ দূরবিন দিয়া নজরে নিতে বাধ্য। আমিও নিলাম তাৎক্ষণিক! কথা মিথ্যা নয়, বরফযুগে আঁকা ছবিখানা আলতামিরা বা এরকম সুপ্রাচীন গুহায় আবিষ্কৃত ছবি থেকে ভিন্ন। ওই সমস্ত ছবি মোটাদাগে শিকারি জীবনের পরিচয় তুইলা ধরে। গুহামানবরা কী শিকার করতেন, কোন টাইপের অস্ত্র তারা ব্যবহার করত, শিকারের টেকনিক কেমন ছিল, এবং মাংসের বিলিবণ্টন কীভাবে করা হইত সেখানে,- এসব সওয়ালের জবাব পাইতে ছবিগুলা কাজে দেয়। শিল্পমান বিচারে লা জবাব। দ্বিমাত্রিক আদলে চারকোল দিয়া একের-পর-এক ছবি তারা আঁকছেন সেইসময়! ভাবলেই মাথা চক্কর দিয়া ওঠে!
এখন অ্যালান রেড্ডির দলবল যে-দুইখানা ছবি সামনে হাজির করতেছেন সেখানে প্রেক্ষাপট ভিন্ন। প্রথম ছবিতে আমরা দেখতেছি মাতবর কিসিমের এক লোক মৃত কোনো পশুর চামড়ার উপ্রে বইসা আছে। বসার ভঙ্গির মধ্যে বস-বস ভাব ফুটে বাহির হইতেছে। থুতনিতে হাত ঠেকাইয়া যেভাবে বসছে তার থেকে বুইঝা নিতে অসুবিধা নাই,- বস এখন টেন্সড আছেন। গুহার ভিত্রে কিছু তো ঘটছে! সেইটা নিয়া টেনশনে আছে উনি। মেজাজ তাই খাপ্পা কিছুটা! রেড্ডি জানাইতেছেন, ঘটনা মধ্যরাত্রে ঘটছিল। কার্বনরেটিং ও রসায়নিক পরীক্ষা সে-তথ্যই জানাইতেছে তাঁদের।
অ্যালান রেড্ডির অবজারভেশন মোতাবেক গুহাচিত্রে মেটেহলুদ যেভাবে ব্যবহৃত হইছে, এখন তার রাসায়নিক বিশ্লেষণ টেন্সড পরিস্থিতির সিগন্যাল দিয়া যায়। মৃত পশুর চামড়ার উপ্রে বসা মাতবর কনকনে শীতে ঘামতেছেন। তার সামনে আজব ভঙ্গিতে যে-লোকটারে আমরা দেখতেছি, সে হইতেছে টেনশনের কারণ। কেন? উত্তরে রেড্ডি ব্যাখ্যা দিতেছেন,- লোকটা আগুন জ্বালানোর চেষ্টায় আছে কিন্তু কোনোভাবে কাজ হইতেছে না। বস কাজেই তার কারবার দেখে মনে-মনে বিরক্ত। আগুন এখন ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য অথবা অন্য কারণে জ্বালানোর প্রয়োজন হইতেছে কিনা সে-ব্যাপারে রেড্ডি ঝেড়ে কাশেন নাই। বাইরে হয়তো শ্বাপদ জন্তু ঘোরাফিরা করতেছিল। তাদেরকে ভয় দেখানোর জন্যও কাজটা তারা করে থাকতে পারে। ঘটনা যেমন হোক,- লোকটার সকল চেষ্টা বৃথা যায় দেখে বস মারাত্মক টেনশনে পড়ছেন।
বস ওরফে মাতবরকে পেছন দিয়া দাঁড়ানো নারীর কারবার আরো ইন্টারেস্টিং। অ্যালান রেড্ডি সূক্ষ্ম পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে রায় ঠুকছেন,- নারীটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লিপ্ত। তার হাতে পাথরের টুকরা। উরুদেশ দিয়া রক্ত ঝরতেছে। কেন ঝরতেছে সেইটা অনুমান করা দুঃসাধ্য। ওইসময় কী ঘটছিল তার কিছুই আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব না। আগুন জ্বালাইতে না পারায় মাতবর হয়তো পুরুষটির সঙ্গে নারীকেও ঝাড়ছেন একচোট। মনের ঝাল মিটাইতে পাথরের টুকরা নিজ উরুতে ঘঁষে আগুন জ্বালানোর তালে আছে সে। নারী চিরকালের জেদি হাসিনা! এই ঘটনায় তা পুনরায় প্রমাণিত। গুহাচিত্রের জিদ্দি নারী জানে এতে কাজ হবে না। মনের খেদ জুড়াইতে নিজেকে জখম করতেসে খামোখা। এর ভিতর দিয়া মাতবরের উপ্রে কি তার অ্যাগোনি প্রকাশ পাইতেছে বইলা আমরা ধরতে পারি? স্ট্রেস রিলিফ করতেছে সে এভাবে? হইতে পারে! যে-সিচুয়েশন এখানে শিল্পী আঁকছেন,- এর অধিক আন্দাজ করা কঠিন।
অ্যালান রেড্ডি আরেকখানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যোগ করছেন। উনার মতে, ছবিটা তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি প্রকাশ যাইতে শিল্পী গুহায় আঁকছিল। যদিও উনার দলবল রাসায়নিক পরীক্ষায় নিশ্চিত হইছেন,- গুহায় এমনসব ছবি আছে যেগুলা তাৎক্ষিণক আঁকা হয়নি। দিনের-পর-দিন এমনকি বছর ধরে গুহার দেয়াল ও ছাদে ছবি আঁকার কাম তারা শেষ করত। বিশেষ করে পশু শিকারের ছবিগুলা ওই ধাঁচের।
সদ্য আবিষ্কৃত বাইসন শিকারের আরেকখানা ছবির প্রসঙ্গে রেড্ডির অনুমান,- অতিভোজনের চক্রে আটক থাকার জের ধরে ওবেসিটি বা অতিরিক্ত স্থূলতা রোগের শিকার হওয়া আজকের সমস্যা নয়। গুহাযুগে এর প্রকোপ কমবেশি ভালোই বহাল ছিল। ওজনের ভার টানতে না পেরে গুহায় অলস সময় পার করত এসব লোক। শিকারে গিয়া বিড়ম্বনায় পড়তে হইত। ওবেসিটির দোষে শিকার কব্জা করতে না পারার ঘটনা গুহাচিত্রে এঁকে গেছে তারা।
. . .
যাই হোক, অ্যালান রেড্ডি তাঁর নিজের মতো করে গুহাচিত্রের ব্যাখ্যা দিছেন। উনার ব্যাখ্যা সত্য হইতে পারে, আবার মন চাইলে মিথ্যা বইলাও ভাবতে পারেন কেউ। প্রকৃত ঘটনা জানার পথ এখানে খোলা নাই। প্রাগৈতিহাসিক সময়রে সঙ্গে আমাদের সংযোগ বলতে এইসব গুহাচিত্র। তাদের ব্যাপারে অনুমান ও ব্যাখ্যা হইতেছে বাস্তবতা। সময় এখানে ফিকশন,- প্র্যাকটিক্যাল নয় একদম। অতীত মানে হইতেছে অ্যান্টিকুইটি বা প্রত্নতাত্ত্বিক। সে ততখানি বাস্তব, যতখানি তার টুটাফাটা চিহ্ন আমরা খুঁজে পাইতেছি।
ফরাসি ভাবুক জাঁ বদ্রিলার এসব কারণে বাস্তবতাকে অলীক ভাবতেন। সময় অতীত হওয়া মাত্র প্রকৃত বাস্তবতা তিরোহিত হয়। সময় যত অতিক্রান্ত হইতে থাকবে তার সঙ্গে আমাদের সংযোগ ক্ষীণ, অস্পষ্ট আর নিরালম্ব অবস্থায় উপনীত হবে। সে তখন কিছু নিদর্শন বা চিহ্নের উপ্রে টিকে থাকার চেষ্টা করে প্রাণপণ। হোর্হে লুইস বোর্হেসের The desert of the real itself গল্পের অবস্থায় পতিত হয় অতীত।
বোর্হেসের গল্প দূর অতীতে বিদ্যমান বিরাট একখানা রাজ্যের বিবরণ পাঠককে শোনাইতে চেষ্টা করে। রাজ্যসীমা বাড়াইতে রাজা যেখানে মানচিত্র তৈরি করছিল। মানচিত্র অনুসারে রাজ্যের সীমানা সে ও তার উত্তরপুরুষরা বাড়াইতে সফলকাম হয়। কালের নিয়মে রাজ্যটি এখন নাই। সীমানায় রদবদল ঘটছে। রাজ্যকে কেন্দ্র করে বিদ্যমান বাস্তবতা কাজেই জীবিত নাই। সময়গর্ভে বিলুপ্ত হইছে।
এখন সে-রাজ্যের বিশালতা ঠার যাওয়ার উপায় কি? উপায় ওই মানচিত্র, যার টুটাফাটা অংশগুলা এখনো পাওয়া যাইতেছে ইধার-উধার। সময়য়ের বাস্তবতাকে ঠার যাওয়ার বিকল্প সূত্র এছাড়া অবশিষ্ট নাই। মানচিত্রের ছিন্ন অংশগুলাকে কেন্দ্র করে যে-ন্যারেটিভ জন্ম নিতেছে সেইটা এখন অতীতে বিলীন রাজ্যের বাস্তবতা বোঝার চাবি সেখানে। বোর্হেস বিরচিত গল্প নিয়া বদ্রিলারের বয়ান যদি আমরা আমলে নেই তাহলে অ্যালান রেড্ডির বক্তব্যকে অযৌক্তিক বইলা খারিজের সুযোগ থাকে না।
জ্ঞানীরা এ-কারণে বইলা থাকেন,- তুমি যতক্ষণ বেঁচে আছো ততক্ষণ তুমি আছো। মারা যাওয়ার পরে গুহার দেয়ালে ও ছাদে আঁকা ছবিগুলার মতো টুকিটাকি নমুনার উপ্রে আমাদের বেঁচে থাকা নির্ভর করে। যেসব নমুনা আমার বা আমাদের স্মৃতি বহন করতেছে তারা এখন অধিক মূল্যবান। বলা যাইতে পারে, আমাদের হয়ে তারা তখন আমাদের জীবন কাটায়। সময়চাপে ওইসব স্মৃতিস্মারক ধরা থেকে ইরেজ হইতে থাকবে। যে-মানুষটি ছিল তাকে তখন অচেনা আর পরাবাস্তব মনে হবে। যেন সে কোনোদিন ছিল না এখানে! দুঃস্বপ্নের মতো চকিত দেখা দিয়া মিলিয়ে গেছে হাওয়ায়। আমরা হইতেছি জলের বুদবুদ। এই আছি… একটু পরে থাকব না আর! এই হইতেছে আমাদের মানবজীবন। মিম… মিম… এছাড়া কিছু না।
. . .
. . .