অনতিউচ্চ টিলার ঢাল ঘেঁষে হালকা ঝোপঝাড় ও ঘাসে ছাওয়া একটুখানি সমতল। জায়গাটি নির্জন তাতে সন্দেহের কারণ নেই। দর্শক সেখানে একটি মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছেন। ম্রিয়মান দিবালোকে জননির্জন পাহাড়ি সমতলে লোকটি দাঁড়িয়ে আছে;- দর্শকের এই অনুভূতিমধ্যে স্মৃতিকাতর দীর্ঘশ্বাস আমরা টের পাচ্ছি। বুড়ি পৃথিবীর কাছে যদিও তার এই দীর্ঘশ্বাস অবাককরা ব্যাপার নয়। দূর অতীতে লোকটির মতো দেখতে কেউ পাহাড়ি সমতলে দাঁড়িয়ে থেকেছে। নিকট অতীতে দাঁড়িয়েছে। আসন্ন কোনো দিনেও কাউকে-না-কাউকে এভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবেন দর্শক। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এখানে স্মৃতিকোষকে জীবন্ত করলেও মানতেই হবে,- পাহাড়ি সমতলে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে নিয়ে উত্তেজিত হওয়ার কারণ নেই।
লোকটির এই পাহাড়ি সমতলে দাঁড়িয়ে থাকা, হাঁটু থেকে কোমর, তারপর কোমর থেকে বুক অবধি দেবে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে দর্শকের বিস্ময় প্রকাশ যে-কারণে অর্থহীন। পাহাড়ি সমতলে যে-দাঁড়িয়ে পড়েছে, সে একজন স্বাধীনচেতা মানুষ। দাঁড়িয়ে থাকবে, নাকি দেবে যাবে, এর সবটাই তার ইচ্ছাধীন। সামনের দিকে তাকিয়ে মাটিতে দেবে যাচ্ছে সে। বুড়ি পৃথিবীপানে চোখ রেখে আস্তে-আস্তে মাটিতে বুক অবধি সেঁধিয়ে যাচ্ছে লোকটি। অনেককিছু দেখা সাঙ্গ হলে মানুষ তখন আর কোনোকিছু দেখার আছে বলে ভাবে না। লোকটি মনে হচ্ছে কিছু দেখার নেই ধরে নিয়ে মাটিতে সমাহিত হওয়ার পাঁয়তারা করছে।
জগৎ রকমারি বিস্ময়ের খনি! নিজচোখে দেখেছি বলে দোহাই দিলেও অনেকসময় সেটি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না। পাহাড়ি সমতলে লোকটির দাঁড়িয়ে থাকা নিয়ে দর্শকরা এতক্ষণ নিশ্চিন্ত ছিলেন। এখন তার মাটিতে দেবে যাওয়ার ঘটনায় সন্দেহ পোষণ করছেন তারা! অনিশ্চিত বোধ করছেন একথা ভেবে,- দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় একটু-একটু করে মাটিতে সেঁধিয়ে যাওয়া অসম্ভব, সুতরাং যে-দৃশ্যটি তারা খোলা চোখে এখন দেখেছেন সেটি সত্য নয়। চোখে ভুল দেখছেন তারা! পাহাড়ি সমতলে লোকটির দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটি সত্য হলেও মাটিতে সেঁধিয়ে যাওয়ার ঘটনা অতিকল্পনা! স্নায়ুবিকার। দর্শকমন বিচিত্র কারণে লোকটির এই জীবন্ত মাটিতে সেঁধিয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারছে না। কেন পারছে না তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে দর্শক এই উপসংহারে পৌঁছান,- লোকটি স্বয়ং তারা ছাড়া অন্য কেউ নয়।
. . .
দর্শক এখন মনে করার চেষ্টা করছেন, সমাধিস্থ হওয়ার বাসনায় সে কখন এবং কীভাবে অনতিউচ্চ ঘাসে-ছাওয়া পাহাড়ি সমতলে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ঘর থেকে বের হওয়ার পর কোনো একভাবে জায়গাটিতে সে পৌঁছায়। নিজেকে নিয়ে তার মনে যে-সন্দেহ ছিল সেখানে পৌঁছানোর পর সেটি কাটতে শুরু করে। এই প্রথম সে নিশ্চিত হয় ভেবে, তাকে যারা চেনে ওইসব পরিচিত লোক হয়তো অন্য কেউ ছিল। নিজের নাম-পরিচয় তার নিজের নয়! যে-নামে সে পরিচিত, সেটি তার বাবা-মা রেখেছিল। যে -ঘরে সে এতকাল কাটিয়েছে সেটিও নিজের নয়;- পৈতৃক সূত্রে পাওয়া। সে কী করবে এবং ঠিক কী কী করা উচিত হবে… তার সবটাই আগে থেকে ঠিক করা ছিল। সে কেবল সেগুলো পালন করে গেছে। এভাবে সে আবিষ্কার করে,- তার চারপাশের লোকজন তারা প্রত্যেকে কমবেশি এসব অভিজ্ঞতার বাইরে নয়। তারা কে এবং তারা কী করবে, সেটি সবসময় তাদের হয়ে অন্য কেউ স্থির করে দিচ্ছে!
এই প্রথম সে বুঝতে পারছিল তাকে দিয়ে ঘটনা ঘটানো হচ্ছে এবং এছাড়া পৃথিবীতে বেঁচে থাকা কঠিন। অনতিউচ্চ টিলা যেমন বলতে পারছে না, সে কেন পৃথিবীতে জায়গা দখল করে রেখেছে? তার পক্ষেও বলা সম্ভব নয় কী কারণে তাকে ঠিক তাই এবং তাই করতে হবে যা সবাই করছে! সুতরাং এটি অনিবার্য ছিল,- কোনো একদিন তার নিজেকে সে সন্দেহ করতে বাধ্য হবে। তার মনে হবে,- সে একটি প্রস্থানবিন্দুর ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং সমতলের মাটি চোরাবালি হয়ে তাকে নিচে টানছে। নিমিষে বুঝে ফেলবে,- এটি হচ্ছে সেই বিন্দু যেখানে একবার প্রবেশ করলে আর ফেরত আসা যায় না।
ঢোকার পর কি ঘটতে পারে সেটি অবশ্য তাকে কৌতূহলী রেখেছিল। স্বেচ্ছাসমাধিস্থ হওয়ার ক্ষণেও কৌতূহল জারি ছিল লোকটির। সে বুঝতে চেয়েছিল,- এভাবে মাটির নিচে সমাধি লাভের পরে এমন কিছু ঘটে কি না যেটি তাকে আবার নতুন নাম-পরিচয়ে পৃথিবীতে অথবা অন্য কোনোখানে ফেরত পাঠাবে।
. . .
সংযুক্তি :
ব্রিটিশ আলোকচিত্রী কিথ আর্নাটের Self Burial নামক শিল্পকর্মটি ১৯৬৯ সনে আলোকচিত্রায়িত ও ইন্সটলেশন আর্টের অংশ হিসেবে টেলিভিশনে প্রদর্শিত হয়েছিল। শিল্পকর্মটির ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে আগ্রহী পাঠক tate ও Keith Arnatt Estate নামক দুটি ওয়েবসাইট ভ্রমণ করতে পারেন। ডোয়েনি মাইকেল বা ডেভিড হকনি তাঁদের শিল্পকর্মে যে-ধারার আলোকচিত্রায়নকে বিশিষ্টতা দিয়ে থাকেন, কিথ আর্নাটের কাজে এসবের প্রভাব রয়েছে। অস্তিত্বের নির্গমন, স্থানবদল ও রূপান্তরের বিষয়টি তাঁকে গভীরভাবে ভাবিয়েছে। মানুষ অথবা কোনো বস্তুও হতে পারে, তার দৃশ্যমান হয়ে ওঠা, স্থানকালের পরিসরে বিচরণ, নির্গমন ও রূপান্তরের মধ্য দিয়ে স্থানকালে অন্যভাবে অস্তিত্ব যাপনের দার্শনিক ভাবনাকে কিথ আর্নাট তাঁর আলোকচিত্রে ব্যবহার করেছেন।
Self Burial স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, রক্ত-মাংসের মানুষটি আর নেই, যে কিনা একদিন নিজেকে সমাধিস্থ করেছিল! সে নেই কিন্তু তার ছায়াঅস্তিত্ব পৃথিবীতে এখনো সংযুক্ত ও ক্রিয়াশীল। তাঁর অধিকাংশ আলোকচিত্র এরকম সব ইঙ্গিতে ভাস্বর। কিথ আর্নাট যাঁর কাজ দেখে প্রথম প্রভাবিত হয়েছিলেন সেই ডোয়েনি মাইকেল এমতো ভাবনায় আজতক সক্রিয় ও সৃষ্টিশীল। যার মূল কথা হচ্ছে, প্রতিটি অস্তিত্ব পৃথিবীর বুকে নিজ দাগ রেখে যায় এবং বিলয়ের পরে সেই দাগ তার অস্তিত্বিক প্রতিনিধিত্ব করে। বদ্রিলারের তত্ত্বের সঙ্গে এই ভাবনার নিবিড় সাযুজ্য রয়েছে।
‘প্রস্থানবিন্দুর পর’ নামক রচনালেখ্য Self Burial-এর অনুপ্রেরণায় রচিত হলেও রচয়িতা তার নিজস্ব বয়ানে আলোকচিত্রের নেপথ্য ঘটনাকে পাঠ ও বিবেচনা করেছেন। শিল্পী কিথ আর্নাট স্বয়ং, তাঁর আলোকচিত্রের সমালোচক ও দর্শকদের মন্তব্য-মতামতের সঙ্গে রচনার ভিন্নতা থাকা কাজেই স্বাভাবিক। পাঠের সময় বিষয়টি স্মরণ রাখা প্রয়োজন।
. . .
. . .