জ্যা
ফজলুররহমান বাবুল
আমরা মানুষ। আমাদের হৃদয়ে দৃশ্যত কোনও জ্যা নেই, কিন্তু রয়েছে ক্ষুদ্র ও বৃহত্তর বৃত্ত, যা এককেন্দ্রিক হতে চায়, স্পর্শ করতে চায় একে-অন্যকে। কখনও কখনও হয় সমদ্বিখণ্ডিত। অনেক কসরতের পর আমরা বুঝতে সক্ষম হই যে, জ্যা এই জগতেরই একটা-কিছু, ধারণা। জ্যা, ধনুকের গুণ/ছিলা। কথা হল, ধনুকটা কী? কেবল আমরা শুনেছি ধনুক দিয়ে নিক্ষেপ করা হয় তির। আর সেটাও-বা কোথায়? আমরা মানুষ, কোনও তির ছাড়াই রক্তাক্ত করতে পারি মানুষের মন। আমাদের মনে স্পষ্টত কোনও জ্যা কিংবা তির-ধনুক নেই, কিন্তু আছে ক্ষুদ্র ও বৃহত্তর বৃত্ত, যা এককেন্দ্রিক হতে চায়, স্পর্শ করতে চায় একে-অন্যকে এবং কখনও কখনও হয় সমদ্বিখণ্ডিত। আমাদের মনের সঙ্গে জ্যায়ের সম্পর্ক থাকুক কিংবা না-থাকুক, কোনও জলাবর্তের সম্পর্ক আছে কি? জ্যা কি কোনও দেখার জানালা? আমরা যদি বলি, জ্যা দুই বিন্দুতে কোনও বৃত্তের পরিধি স্পর্শকারী রেখা, হয়তো প্রমাণ করতে বলা হবে যে, ‘দুটি বৃত্ত এককেন্দ্রিক হলে এবং বৃত্তটির কোনও জ্যা ক্ষুদ্রতর বৃত্তটিকে স্পর্শ করলে উক্ত জ্যা স্পর্শবিন্দুতে সমদ্বিখণ্ডিত হয়।’ কথা হল কোনও মগের মুল্লুকে আমরা যদি প্রমাণ করতে পারি, মানবে কি সকলে?
. . .
পাঠ-সংযোজন
বৃত্তের জটিল ধাঁধা
. . .
কবিতার রহসঘন ভাষায় আলাপটা তুলছেন বইলা আপনার সঙ্গে আমার ধারণা ভিন্ন হইতেও পারে বাবুল ভাই। তো সেই ভিন্নতা স্বীকার গিয়া বলি,- জ্যা, বৃত্ত, ধনুকের সম্পর্কটা মনে হইতেছে পারস্পরিক। বৃত্ত যদি থাকে তাইলে ধনুকও সেই বৃত্তকে ভেদ করার জন্য থাকবে। ধনুক থাকলে জ্যা লাগবে। এখন এর মধ্যে কোনটা আগে আর কোনটা পরে তার মামলা এককথায় ডিসমিশ করা কঠিন।
হাইপোথ্যাটিকালি ধরে নেন, আমরা বৃত্ত। বৃত্তের মাপ এখন ভিন্ন-ভিন্ন হইতে পারে। তো এই বৃত্ত মানে যদি শূন্য ধরি, কিছু নাই বইলা ভাবি, তাহলে সেইটা মিথ্যা। কারণ বৃত্ত রূপে আমরা নিজেকে ধরতেছি সেখানে। এখন বৃত্ত যদি থাকে তাইলে ধনুক ও জ্যার অস্তিত্ব আমরা মাইনা নিতে বাধ্য। কারণ সে যদি নাই থাকে তাইলে বৃত্তের সমদ্বিখণ্ডিত হওয়াটা আপনি পাইতেছেন কোথা থেকে? মানব অস্তিত্ব কাজেই প্রহেলিকা।
হেনরি ওয়ার্ডসওয়ার্থ লংফেলোর বিখ্যাত The Arrow and the Song কবিতার অনুরূপ এই সম্পর্ক। কবি একটা তির ছুড়ে মারছিলেন। আপনার ওই বৃত্তরূপী পৃথিবীপৃষ্ঠে দাঁড়িয়ে নির্দিষ্ট কিছু টার্গেট না করে তিরখানা ছুড়ছিলেন তিনি। উদ্দেশ্যহীন সেই তির বাতাস ভেদ করে দ্রুত ছুটতে থাকে। কবির কাছে মনে হয় তিনি অনিশ্চিত পৃথিবীপৃষ্ঠে যেমন দাঁড়াইয়া আছেন, দ্রুত ধাবমান তিরফলাও সেরকম। এমন এক সংগীতের জন্ম সে দিতেছে এখন যাকে অচিহ্নিত ভাবতে তিনি বাধ্য।
অনেকদিন বাদ একটা ওক গাছে তিরটা উনি খুঁজে পায়। গাছে গেঁথে আছে তখনো। তাঁর মনে হইতে থাকে এইটা এখন এমন এক সংগীত যার আদিঅন্ত কোনো একদিন তিনি গাইছিলেন, আর এখন অনামা দোস্তের হৃদয়ে গানটা গীত হইতেছে। ওক গাছে তিরটার দেখা মিলবে, কবি কখনো সেকথা ভাবেন নাই। গান যখন গাইছিলেন তার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। অন্য কাউকে এখন গাইতে দেখবেন ভেবে গান নাই তখন।
জটিল কবিতা। আপনার ওই জ্যার মতোই যার অর্থ অনুমান দুরূহ। মূল পয়েন্ট, যেখানে আপনি ও হেনরি লংফেলো এসে মিলতেছেন, সেইটা হলো, আমরা বৃত্ত হয়ে আসি অথবা অন্যকিছু, যতই পরস্পরকে মিলতে চাই, মাঝখানে ধনুক, জ্যা এসে তারে ছেদ করবেই। যে-কারণে মানুষের অস্তিত্ব হইতে সম্পর্ক যাপনের সবটাই ছেদ এবং বিচ্ছেদ এবং পুনরায় বৃত্তে বিভাজিত হওয়ার মধ্যে সদা সক্রিয়।
. . .