মুনওয়াকার মাইকেল জ্যাকসনের গানভরতি খাতার মধ্য থেকে যে-কোনো একটি বেছে নেওয়া কঠিন কাজ। তাঁকে শুনতে (এবং অবশ্যই দেখতেও) বসলে পারফেক্ট চয়েস বলে কিছু বাছাই করা মুশকিল হয়! জ্যাকসন ফাইভের হয়ে যে-কৃষ্ণবালক মঞ্চ মাতিয়ে রাখত, তার সঙ্গে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবধি বিচিত্র উত্থান-পতনে নাটকীয় মাইকেল জ্যাকসনকে মিলানো কঠিন।
নাচগানে শ্রোতা-দর্শককে মুগ্ধ করতে ভাইবোনদের সঙ্গে যে-বালক মঞ্চে উঠত, তার জীবন ছিল বিষমোড়ানো বড়ি। নির্দয় মাতাল বাপের কাছে বালক জ্যাকসন টাকা কামানোর মেশিন ছাড়া কিছু ছিল না। মদের খর্চা উঠানোর নিয়তে কৃষ্ণ বালককে বাপ মঞ্চে উঠাত। দুর্ভাগা মাইকেল বাপের ভালোবাসা পায়নি;—না পেয়েছে আদর ও সহানুভূতি।
জগৎজোড়া নামধাম কামানোর দিনকালে একই মাইকেল, আশ্চর্য হলেও সত্য,—বাপকে ক্ষমা করে দিয়েছিল। কেন ক্ষমা করে দিচ্ছে তার কারণ স্বগতোক্তির মতো লিখতে থাকা জবানীতে রেখে গেছেন গায়ক। সাবলীল আর উপভোগ্য সেই জবানী। মাইকেলের সহজাত প্রতিভা গান ও নাচের মুদ্রায় বন্দি রাখেনি নিজেকে। কলমচি হিসেবে নেমে পড়লে মনে হয় না খারাপ করতেন তিনি। লেখার হাত কিন্তু মন্দ ছিল না তাঁর।
আবেগপ্রবণ মাইকেল জ্যাকসন কি কেবল বাপ-মা ও পরিবারের কথাই বলে গেছেন? ঘটনা সেরকম কিছু নয়। বাপ-মা ও পরিবারের কথা যেমন বলেছেন, কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের ভিতর-বাহির আর মানব-সমাজের সেকাল-একাল ও ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়েও নিজের দৃষ্টিভঙ্গি জানাচ্ছেন মাইকেল।
মঞ্চে গান করার সময় অগ্নিকাণ্ডে দেহের চামড়া ঝলসে যাওয়ার মর্মন্তুদ বিবরণ তাঁর জবানে আমরা পাচ্ছি সেখানে। প্লাস্টিক সার্জনের ছুরির নিচে বারবার দেহ সঁপে দেওয়ার পেছনে অগ্নিকাণ্ড বড়ো ভূমিকা রেখেছিল বোঝা যায়। সঙ্গে জুটেছিল বর্ণবাদের জন্মশিকার কৃষ্ণবালকের মনে জমা হওয়া সংক্ষোভ। শ্বেত-আধিপত্য মোকাবিলার জটিল যেসব রসায়ন মাইকেল জ্যাকসনের থ্রিলার ও ব্যাড অ্যালবামের গানগুলোয় আমরা পাই, গায়ের রংয়ের বিবর্তন সেখানে অন্যতম। গানের-পর-গানে এসব মুদ্রিত করে গেছেন শিল্পী।
গানের মঞ্চে মাইকেল জ্যাকসনকে আমরা ফিরে-ফিরে তাঁর পুরুষাঙ্গে হাত রাখতে দেখি। এটি কি কেবল নাচের মুদ্রা ছিল তাঁর? আমার সেরকম মনে হয়নি কখনো। গানগুলোর ভিতরে সঞ্চারিত কথার সঙ্গে এই মুদ্রার গভীর সংযোগ রয়েছে। শ্বেত-আধিপত্যকে এভাবে হয়তো বার্তাটি দিতেন মুনওয়াকার,—তিনি আসলে কিছু ভোলেননি! সাফল্যের স্বর্ণশিখরে আরোহণের পর তাঁর জীবনকে বিচিত্র পথে যারা বিষের বড়িতে পরিণত করে,—তাদেরকে টপকে তাঁর পুরুষত্ব এখনো সজাগ!
পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও গণমাধ্যমের কোনোটাই প্রকৃত অর্থে মাইকেল জ্যাকসনের জন্য ভরসার জায়গা হতে পারেনি কখনো। আকাশচুম্বি খ্যাতি আর মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া অর্থের স্রোত বরং তাঁর জন্য বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারা তাঁকে একটি মেশিনে পরিণত করে। পারলে চব্বিশ ঘণ্টা যেটি চালানোর জন্য উদগ্রীব ছিল সবাই! প্রিন্সেস ডায়ানার পর মাইকেল জ্যাকসন সম্ভবত দ্বিতীয় ব্যক্তি,—মিডিয়া ট্রায়ালের একটানা কোপাকুপি যাঁকে অকালে বিদায় নিতে বাধ্য করে। হলিউড টুনাইট কিংবা মনস্টার-এর মতো অপ্রকাশিত গান হয়তো এ-কারণে বেঁধেছিলেন গায়ক।
লেডি ডায়ানা সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন মাইকেল পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার বেশ আগে। ফেউয়ের মতো পাপারাজ্জিরা পেছনে তাড়া করছিল। বুলিমিয়া রোগে আক্রান্ত প্রিন্সেস ডায়ানার জীবনে রাজ পরিবার ও বাইরের জগতে কোনো ফারাক থাকেনি। ডায়ানাকে নিবেদন করে গাওয়া এলটন জনের গানে যদিও এর আভাস অতটা প্রকটিত নয়। কিন্তু বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ডায়ানা তো জানিয়েছিলেন,—তিনি কতোভাবে বন্দি এক পাখি! পাবলো ল্যারেনের চলচ্চিত্র স্পেন্সার-এ যার কিছু ইশারা সম্প্রতি উঠে এসেছিল।
প্রাইভেসি বলে কিছুর বালাই ডায়ানার জীবনে ছিল না। মুখরোচক খবর বেঁচতে তৎপর পাপারাজ্জিরা বাথরুম পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। স্নানাগারে গোপন ক্যামেরা ফিট করার মতো ঝুঁকিপূর্ণ অনৈতিক কাজ করতেও পিছপা হয়নি তারা! মাইকেল জ্যাকসনের জীবনে এমন কিছু না ঘটলেও তাঁর ওপর আনা অ্যালিগেশনের ষোলআনা মিডিয়াসৃষ্ট ও মিডিয়া নির্ধারিত ছিল বলে অনেকে অভিমত রেখেছেন তখন;—রাখছেন এখন। জ্যাকসনকে প্রথম নির্দয়ভাবে ব্যবহার করে তাঁর পিতা। তাতে করে বালক জ্যাকসনের মরণযাত্রা নিশ্চিত হয়।
দ্বিতীয়বার তাঁকে ব্যবহারে-ব্যবহারে ছিবড়ে ও পরিশেষে কিশোরমোহবৈকল্য আর মাদকাসক্ত বানিয়ে ছারখার করে দেয় মিডিয়া। খ্যাতি সুতরাং জ্যাকসনের জীবনে একতিল সুখ বয়ে আনেনি। ভালোবাসা আর স্নেহের খোঁজে ভিখারি গায়কের অকালপ্রয়াণ তাই অবধারিত ছিল।
মাইকেল জ্যাকসন চলে গেলেও তাঁর প্রতি দুনিয়াজোড়া মানুষের ভালোবাসা আজো অমলিন। অর্জনটি তিনি নিশ্চিত করে যেতে পেরেছিলেন। যে-কারণে এই পঁচিশ সনে বসেও তাঁর গান মানুষ শোনে এবং দেখে। কোনো বয়সের বালাই সেখানে নেই। এলভিস প্রেসলি, ফারুখ বুলসারা ওরফে ফ্রেডি মার্কারি, বিটলস ব্যান্ডের চার মহারথী, আর সর্বাগ্রে মাইকেল জ্যাকসন… এঁনারা মানুষের যে-অবিশ্বাস্য ভালোবাসা পেয়েছেন, সেটি এখন ও আগামীতে অন্য কারো কপালে জোটার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
দুনিয়া জুড়ে জ্যাকসনঝড় অবধারিত নিয়মে বাংলাদেশেও আছড়ে পড়তে সময় নেয়নি। সিনেমার জন্য গাওয়া সৈয়দ আব্দুল হাদীর গানে আউল-বাউল লালনের দেশে জ্যাকসনের আগমনকে ক্ষতিকর হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল! গ্রামবাংলার চিরায়ত সংস্কৃতির মধ্যে বেনোজলের মতো এক পপশিল্পীর প্রবেশ ও তাঁকে নিয়ে নাগরিক সমাজে মাতনকে হালকাচালে পরিহাস করা হয়েছিল গানে। প্রশ্ন হলো,—মাইকেল জ্যাকসন কি বাংলায় অথবা উপমহাদেশে আসলেও প্রবেশ করেছিলেন সেইসময়? উত্তরে বলতেই হচ্ছে,—না জনাব, বাংলাদেশে মাইকেল জ্যাকসন তখন প্রবেশ করেনি। আজো এই লোকটি এখানকার জল-মাটি-হাওয়ায় নিজের এন্ট্রি নিশ্চিত করতে সমান ব্যর্থ!
যে-তখন প্রবেশ করেছিল বলে আমরা ধরে নিয়েছি,—সে আসলে মাইকেল জ্যাকসন নামক নাচ-পারদর্শী এক গায়কের খোলস ছাড়া কিছু নয়। উপমহাদেশে মাইকেল জ্যাকসনের অনুপ্রবেশ মানে হচ্ছে ওই ব্রেক ডান্স, যার প্রভাবে প্রভু দেবার উত্থান ঘটেছিল। জ্যাকসন স্বয়ং যার নাচের প্রশংসা করেন তখন।
বাংলাদেশ তথা সমগ্র উপমহাদেশ মাইকেল জ্যাকসনের গায়কি ও তার গানে নিহিত বারুদমাখা ভালোবাসার আবেদন লোকজনের ভিতরে আদৌ পৌঁছায়নি। বিদেশি গানবাজনা শুনতে ভালোবাসেন এমন শ্রোতা-দর্শক-সমালোচক তাঁর গানের ব্যবচ্ছেদে কখনো উৎসাহও বোধ করেননি। এমনকি মিউজিশিয়ানরা জ্যাকসনগানে উচ্ছলিত জীবনবেদকে পাখির চোখ করে দেখার তাড়না বোধ করেননি কোনোদিন। যার ফলে অন্যান্য গায়কদের তুলনায় উপমহাদেশে জ্যাকসনের প্রভাব বিশেষ নেই।
জিম মরিসন, জন ডেনভার, পিটার সার্স্টেড অঞ্জন দত্তের গানে যথেষ্ট ছাপ ফেলেছেন। বব ডিলান, পিট সিগার, লিওনার্ড কোহেনরা প্রভাবিত করেছেন কবীর সুমনসহ আরো শিল্পীদের। বিটলস, পিঙ্ক ফ্লয়েড, গানস এন’ রোজেস-এর মতো রকব্যান্ড দুই বাংলার ব্যান্ড সংগীতকে প্রভাবিত করেছে নানান সময়। মাইকেল জ্যাকসন সেখানে ফুটনোট। তাঁর গানে সম্মোহন থাকলেও এর গভীরে যাওয়ার তাড়া বাংলা তথা সমগ্র উপমহাদেশে পরিপুষ্ট হতে পারেনি। সুতরাং জ্যাকসন এখানে প্রবেশ করেছে বলা হলেও,—তাঁর প্রবেশ আসলে ঘটেনি। এন্ট্রি নিতে পারেনি লোকটা। যদি নিতো তাহলে বাংলা গানের বৈচিত্র্যে নতুন মাত্রা যোগ হতে দেখতাম সকলে।
সে যাকগে, মাইকেল জ্যাকসনের গানের খাতা থেকে আপাতত হিউম্যান নেচার গানটি বাংলা ভাষান্তরে এখানে সংযুক্ত রাখছি। ভাষান্তরকে সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই। নিছক গানের মর্মে প্রবেশের তাড়না থেকে করা। না করলেও ক্ষতি ছিল না বিশেষ। বব ডিলান বা কোহেনের মতো কবিতালগ্ন রূপকতায় জটিল-বন্ধুর নয় জ্যাকসনের গানের খাতা। গানটি অবশ্য মাইকেলের নিজের রচনা নয়। জন বেটিস ও স্টিভেন এম. পোরকারো মিলে লিখেছিলেন তখন। মাইকেলের পরিবেশনগুণে যেটি গভীরতা পেয়েছে যথেষ্ট।
হিউম্যান নেচার গানটির বাংলা ভাষান্তর এখানকার উপযোগী করে গাওয়ানো সম্ভব। সর্ববিদ্যা পারদর্শী চ্যাটজিপিটিকে ভাষান্তরটি দিতেই আলাপ জুড়লেন ভাইজান। আলাপের পরিশেষে গানটির সংগীত আয়োজনের হদিশ পাওয়া গেল কিছুটা। ভাবছি, গায়ক আর সুরকারের নাগাল পেলে গানটি তোলা যেত দিব্যি।
আপাতত এআই দিয়ে একটি সংস্করণ বানিয়ে নেওয়া গেল। বলে নেওয়া ভালো,—নতুন সংস্করণটি মাইকেল জ্যাকসনের মূল গান থেকে বেরিয়ে এসে করা। তাঁকে অনুকরণ কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। অপ্রয়োজনীয়ও বটে। এআই দিয়ে তৈরি সংস্করণ, গানের কথা বাদ দিলে,—মাইকেলের মূল গানের সঙ্গে সর্ম্পকিত নয় কোনোভাবে।
গানটির কম্পোজিশনে পিয়ানো ও অ্যাকুইস্টিক গিটার থাকছে। জনরা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে জ্যাকসন ব্যবহৃত আর অ্যান্ড বির সঙ্গে ডান্স পপ সংযুক্ত করা হয়েছে। শোনার পর মনে হলো উচ্চারণগত কিছু বিচ্যুতি বাদ দিলে শুনতে মন্দ নয়। ওস্তাদ মিউজিয়াশিয়ান ও গায়কের হাতে পড়লে নতুন পরিবেশনায় গানটির গভীর রূপ দান সম্ভব। জ্যাকসনের মূল গানের সঙ্গে এআই-এর সাহায্যে তৈরি গানের সংযোগ না থাকতে পারে, কিন্তু গানটির আদি প্রেরণা তো মুনওয়াকার স্বয়ং। অতএব, এটি তাঁর না হয়েও তাঁর গানই থাকল!
. . .
মানব স্বভাব
(মাইকেল জ্যাকসন গীত, জন বেটিস ও স্টিভেন এম. পোরকারো রচিত হিউম্যান নেচার গানের ভাববস্তু অবলম্বনে ইষৎ সংক্ষেপিত বাংলা ভাষান্তর)
. . .
জানালার বাইরে তাকাই
রাতের সময়রেখায়
শহর পলক ফেলছে নির্ঘুম
তার কণ্ঠ
কাঁপে জানালায়
যেন মিষ্টি প্রগলভ দীর্ঘশ্বাস
হারাব রাতের গভীর
চার দেয়াল আটকাতে পারবে না আমায়
শহরটি যদি ধরো আপেল হয়
আমি বসাবো কামড়
যদি জানতে চায় কেউ,—কেন কেন কেন?
বলে দিও,—
মানুষের এটাই স্বভাব
যদি জানতে চায়,—কেন কেন কেন?
আমার সাথেও কি তার এম্নি আচরণ?
যদি জানতে চায়,—কী কারণ?
বলে দিও—
মানুষের এটাই স্বভাব
যদি জানতে চায়,—কেন কেন কেন?
আমার সাথেও কি তার এম্নি আচরণ?
অচেনাকে ছুঁবো বলে
বাড়িয়েছি হাত
নিয়ন আলোয় মোড়া চোখ
ঘুরছে সবখানে
দেখেছি মেয়ে এক
জানে সে, আমি দেখছি তাকে
মেয়ে চাইছে, যেন তাকিয়ে থাকি এভাবেই
যদি জানতে চায় কেউ,—কেন কেন কেন?
বলে দিও,—
মানুষের এটাই স্বভাব
যদি জানতে চায়,—কেন কেন কেন?
আমার সাথেও কি তার এম্নি আচরণ?
যদি জানতে চায়,—কী কারণ?
বলে দিও—
মানুষের এটাই স্বভাব
যদি জানতে চায়,—কেন কেন কেন?
আমার সাথেও কি তার এম্নি আচরণ?
এভাবেই বাঁচতে ভালোবাসি
ভালোবাসি থাকতে এমন
কেন? কেন হে?
(এভাবেই) কেন? বলো, কী সে কারণ?
বাইরে তাকাই
ভোর ছাপিয়ে
শহরের স্পন্দন শুরু হয়েছে যেখানে
তার কাঁধে রেখেছি এই হাত
স্বপ্ন দেখছি জানি দাঁড়িয়ে রাস্তায়!
. . .

. . .