অনলাইন ওয়েবজিন গানপার গুনে-গুনে বোধহয় সাত বছর পার করল সম্প্রতি। নেপথ্যশ্রমিক জাহেদ আহমদ, আলফ্রেড আমিন ও শোভন সরকার বছরের-পর-বছর ধরে প্রতিকূল স্রোত ঠেলে তরিখানা বাইছেন। জাহেদ আহমদ এমন এক সময়ে বসে তরি নদীতে ভাসানোর কথা ভাবলেন, যখন কিনা বাংলা ভাষায় গানচর্চার কমতি না থাকলেও তাকে নিয়ে বিচিত্র আলাপ ও লেখালেখিকে সযত্নে জায়গা দেবে এরকম তরির দেখা মিলেনি কোথাও! এখনো কি মিলছে খুব? অন্তর্জালে বাংলা ভাষায় লেখালেখিচর্চার শুরু থেকে সাহিত্যে ঠেকনা দিয়ে ঝাঁকের কৈয়ের মতো পত্রিকার ছড়াছড়ি পাঠক দেখেছে। মোটের ওপর এই ধারায় বাংলা ভাষার মসিজীবীরা আজো কলম ঘষেন। বিচিত্র বিষয়ে কেন্দ্রীভূত অনলাইন মুখপত্র দুরবিন দিয়ে খুঁজতে হচ্ছে এখনো! কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মার কাটকাট যুগে পা দিয়ে বসে আছি অথচ বুদ্ধির গোড়ায় শান দেওয়ার মতো প্লাটফর্মের আকাল আজো গেল না হায়! সৃজনশীল বিষয়াদি নিয়ে নিরলস মুখপত্র কি পাচ্ছি সেভাবে? গানপারঘাটে বসে এর কাণ্ডারিদের সাত বছরের নাও বাওয়া ইয়াদ করার ক্ষণে প্রশ্নটি মনে তুরতুর করছে।
ব্যক্তিগত ব্লগিংয়ের জায়গা থেকে যদি খুঁজি, গান-নাটক-আলোকচিত্র অথবা চলচ্চিত্র বিষয়ক ব্লগিংয়ের পরিসর বাংলা ভাষায় পর্যাপ্ত নয়। কমিউনিটি ব্লগিংয়ের ঝাপসা আভাস যেসব অনলাইন মুখপত্রে পাঠক পাচ্ছে, সেখানে আবার এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে চর্চার বহর দেখে মনে হয় কেউ একজন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কারো দিকে ঢিল ছুড়ছে! এই যখন পরিস্থিতি, সেখানে সূচনা থেকে ওয়ানম্যান আর্মির নিয়তি মেনে আগুয়ান গানপারমাঝিদের বড়ো ব্যতিক্রম লাগে দেখে! জানি না জাহেদ আহমদ যখন এটি চালু করার কথা ভাবছিলেন, তখন কেবল গান বিষয়ক তৎপরতাকে অনলাইন পরিসরে ধারণের ভাবনা ও জেদ তাঁর মনে একচ্ছত্র ছিল কিনা! কথাটি এজন্য বলা,- সংগীতের সাতরংকে গানপার সযত্নে ধারণ করতে এখনো সচল, এবং এর বাইরে অজস্র রংসুরআলোয় বোনা জীবনের বিচিত্র সরঞ্জামকে মাঝিরা নৌকায় বোঝাই করতে সচেষ্ট আগাগোড়া। গানপার-পাঠকরা এই বিষয়টি কতটা খেয়াল করেন জানা নেই, তবে খেয়াল করা উচিত বলে মানি এখন।
গানপারমেনুতে যখন চোখ রাখছি, পয়লা নজরে মনে হবে এটি একটি বিশেষায়িত ওয়েবজিন। সংগীতকে সে ধারণ করতে উতলা। যে-মেনুতে ক্লিকাই না কেন, গানচর্চার বিচিত্র সুলুক সেখানে গেলে পাবো। গায়ক, গান, বাদক, অ্যালবামরিভিয়্যু, কর্ন্সাটরিভুয়্যু;- মেনুতে সাজানো বারোখানা পদের মধ্যে পাঁচখানাই গান-সারগামে বাঁধা। তার মধ্যে আবার বইরিভুয়্যু, কথাবার্তা আর গানপারঘাট নামে তিনটি পৃথক পদ পাচ্ছি সেখানে। প্রশ্ন জাগতেই পারে,- পঞ্চ-ব্যাঞ্জনে সাজানো সূচিপত্র তো গানবাজনার বিষয়আশয় পাঠকের পাতে তুলে দিতে যথেষ্ট, তাহলে বাকি তিনখানা পদের কী কাজ? তার বিশেষত্ব আসলে সেখানে নিহিত। গানপার নামে নিজেকে বিশেষায়িত করলেও ওয়েবজিনটি স্বভাবের দিক থেকে অনির্দিষ্ট। আমরা তা ধরে নিতে বাধ্য এখন।
গদ্য শিরোনামে সাজানো মেনু হাতে নিলে যেসব ব্যাঞ্জন চোখে পড়বে সেগুলো নানান স্বাদে তৈরি। চারপাশের ছড়ানো খুঁটিনাটিকে ধারণ করতে তারা আকুল। গুরুগম্ভীর বিষয়ে যেমন বিচিত্র ছাদের দীর্ঘ, মাঝারি ও সরু গদ্য সেখানে পাঠক দেখতে পায়,- হালকাচালে জীবনের ইতিউতি দিকগুলো নিয়েও গদ্যের কমতি নেই। গানপার সঞ্চালকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত জানাশোনা রয়েছে বলে খানিক বুঝি, কেন তাঁরা পঞ্চব্যাঞ্জনের বাইরে আরো তিনখানা পদ সেখানে পরিবেশন করছেন অবিরত। গানপার-র কাণ্ডারি খনিশ্রমিক কবি, গদ্যকার ও গীতিয়াল জাহেদ আহমদ একাধিকবার বলেছেন বটে,- কেবল গান-সারগামে এই অনলাইন মুখপত্রকে বন্দি রাখায় তাঁর সায় নেই। না তার সহযোদ্ধারা তা মনে করেন। চটজলদি তখন বুঝে যাই, কী-হেন-কারণে গানসপ্তকে সুর সাধলেও গানপার নয় কেবল গানের তারে সাধা।
গানপারমাঝির দল গানসমুদ্রে ভেলা নিয়ে ভেসেছেন ঠিক আছে, কিন্তু সাগর ও তার তটভূমিতে যত কাণ্ড চলছে দিবারাত, এখন সেগুলোর ব্যাপারে তারা নয় উদাসীন ভোলানাথ। জাহেদ আহমদের কথার সত্যতা গানপার-এ ঘুরান দিলে পাঠক মানতে বাধ্য। বিষয়বৈচিত্র্যে সে মনোহর। হাওরে অচেনা কোনো ফুল-ফল-উদ্ভিদ সটান নীল আসমানের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। হতে পারে হিজল-ছাতিম-করচা গাছের গায়ে-গায়ে লেগে হাওরে ওঠা আফালের ধাক্কায় ক্ষণে-ক্ষণে জলের দিকে তারা নুয়ে পড়ছে। সটান দাঁড়িয়ে থাকা ও নুয়ে পড়ার খবর পাঠককে দিচ্ছে গানপার। পঠিত কোনো বই, সিনেমা অথবা ব্যক্তিত্বের সন্দেশ পৌঁছে দিচ্ছে নিয়মিত। আছে সরাসরি অথবা ভাষান্তরে তুলে আনা বিচিত্র আলাপচারিতা। ভাবুক যতীন সরকার আর হলিউডের আলোঝলমল জগৎ থেকে নেমে আসা কেট উইন্সলেট যেখানে গলেমিশে একাকার! ডিলান-কোহেন-লেলন-ডেনভারের গানের ব্যবচ্ছেদ ও তর্জমার সঙ্গে তাল দিয়ে অবিরত আগুয়ান বাচ্চু-জেমস-মাকসুদ ও তাঁদের উত্তরসূরি বাংলা গানের তরুণ তুর্কিরাও;- সব্বাই যেখানে একসুতোয় গাঁথা। পাঠক তার কতটা খেয়াল করেন জানা নেই সম্যক।
গান-কড়চার ফাঁক গলে উঁকি মারতে দেখি কবিতা, গল্প আর এমনকি ধারাবাহিক পর্বে প্রকাশিত আখ্যান। গানপার এভাবে একইঅঙ্গে হালকা ও গুরুপাককে ধারণে মত্ত গত সাতটি বছর। কিস্তির-পর-কিস্তিতে বোনা সিরিয়াস গদ্য যেমন আছে, ফিচার মেজাজে লেখা মাস্তিও মজুদ সেখানে। সবমিলিয়ে গানপার তার নিজস্ব মেজাজে গানপত্রিকা হওয়ার ছলে গানের বাহিরানায় বিচরণ করে হামেশা। এখান থেকে ভাবনাটি মনে জাগে,- গানপারমাঝিরা তো ইচ্ছে করলে কেবল গান এবং গান দিয়ে সাতটি বছর অনায়াস পার করতে পারতেন! বাংলা ভাষায় একখানা রোলিং স্টোন পাওয়ার সুখ সেই সুুবাদে পাঠকের কপালে জুটত। একগামী না থেকে কেন তারা বহুগামী হতে থাকলেন ক্রমাগত?
সঠিক কারণ মাঝিরা ভালো বলতে পারবেন, তবে আমরা পাঠক বোধহয় কিছুটা হলেও কারণটি আন্দাজ করতে পারি। কেবল গান দিয়ে একটি পত্রিকা এই দেশে বছরের-পর-বছর টানতে থাকা অসম্ভব ঘটনা! বড়ো কারণ,- লেখার সংকট। সংগীত বিষয়ক যেসব লেখাপত্র এখানে পাঠক পাচ্ছে, তার ষোলআনার চৌদ্দআনা স্বয়ং সঞ্চালক জাহেদ আহমদকে অবিরত লিখে যেতে হয়েছে। গান বিষয়ক যত আলোচনা, তর্জমা অথবা খবরাদি, যত রোমন্থন ও ইতিনেতি বিচার, তার সবটাই দীর্ঘ থেকে খুদে পরিসরে একরোখার মতো টানা লিখে গেছেন জাহেদ। ননস্টপ লিখেছেন একসময়;- যেখানে তাঁকে সঙ্গ দিতে পারে এমন সহযোগী এতটা বছর পরেও খুঁজে পেয়েছেন কি এই গানপারমাঝি? জাহেদের বাইরে যারা গান নিয়ে দুছত্র লিখেছেন নানান সময়, সেটি সাগরে একফোঁটা শিশিরের অধিক নয়। কাজেই গান এবং গানকে ধারণ করে দাপুটে রোলিং স্টোন হওয়ার খোয়াব জাহেদ যদি শুরুতে দেখেও থাকেন, আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে গমন করেছেন পৃথক ভাবনায়।
নমস্য সিনেমা-পাঠক রজার ইবার্ট সিনেমার ময়নাতদন্ত সারতে স্বনামে অনলাইনে সক্রিয় এখনো। অনলাইনে সচল সেই জগতে ঢুকলে সিনেমার আগাপাশতলা ব্যবচ্ছেদের খবর পাঠক পায়। রজার ইবার্ট সেখানে একলা কামলা খাটেন না। বয়সভারে জীর্ণ কিংবদন্তি সিনেমা দেখা ও তার অভিজ্ঞতা পাঠকের সঙ্গে বিনিময়ের দিন অনেক আগে পার করে এসেছেন। তা-বলে কিছু আটকাচ্ছে না একদম। একঝাঁক সিনেক্রিটিক অবিরত পর্দায় সদ্য অবমুক্ত চলচ্চিত্র নিয়ে লিখছেন সেখানে। বাংলাদেশে এই মাত্রার পেশাদারিত্ব অকল্পনীয় ঘটনা! সুতরাং গানের সারগামে থেকেও গানের বাইরে গমন ছাড়া গানপার বোধ করি এতদিনে টেসে যেত।
বাংলা ভাষায় বিষয়ভিত্তিক ওয়েবজিন যে-কারণে সোনার পাথরবাটি! অন্যদিকে গানের ভিতরে থেকে বাহিরে গমনের কারণে বিরাট লস হয়েছে সেটি আবার বলা যাচ্ছে না। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠকে ধরে রাখার ভাবনায় বাধ্য হয়ে গমন করলেও গেল সাতবছরে একটি লেখকবৃত্ত অন্তত তৈরি করে নিতে পেরেছেন তাঁরা। সংখ্যাটি সেখানে বড়ো না হতে পারে, কিন্তু নিবেদিত। বাংলাদেশের নামিদামি আর জাতে ওঠা কবিলেখকদের যেখানে ভিড় করতে দেখে না পাঠক। জাহেদ আহমদের প্রজন্মে যারা উঁচা জাতে উঠালেন নিজেকে, তাঁরা সেখানে বড়ো একটা মসি চালনা করেননি আজোবধি। সিনিয়র থেকে হাঁটুর বয়সী জুনিয়র, যারা সমাজমাধ্যম দাপিয়ে বেড়ান,- তাঁদের দেখা গানপারঘাট-এ মিলবে কদাচিৎ। দেশজুড়ে পরিচিত যদি বলি,- মৌসুমী ভৌমিক, মাকসুদ নয় শিবু কুমার শীল-এ এসে লিস্টি খতম। গানপারমাঝিদের তরফ থেকে লিস্টি বড়ো করার তাগিদ আছে বলে মনে হয়নি কখনো। তাগিদ কেন নেই সেটি বুঝতে হলে পাঠককে এই ওয়েবজিনে এ-পর্যন্ত প্রকাশিত লেখাপত্র প্রকাশ ও প্রচারণার ধাঁচ আগে বুঝতে হবে। সেটি যদি পাঠক না বোঝেন তাহলে বোঝা সম্ভব নয় কী-কারণে সাত বছর পার করেও গানপার উঁচা জাতে নিজেকে শরিক করতে নাচার।
প্রশ্ন ওঠে পুনরায়,- জাহেদ আহমদ তো ইচ্ছে করলে এঁনাদের সংযোগ করতে পারতেন। স্বার্থ হাসিল করতে লাজশরমের মাথা খেয়ে লেখার জন্য ধর্না ও তোষামোদী করলে কী এমন ক্ষতি হতো তাঁর? নাম ফাটত বরং রাতারাতি। সমাজমাধ্যমে নজর কাড়ত কাড়ি-কাড়ি পাঠকের। না, জাহেদ ও তাঁর টিমমেট এখানে একবগগা সুবিমল মিশ্র। এই আমাদের সিকি লেবু নিংড়ানি শিরোনামে একটি বই ছেপেছিলেন সুবিমল। বইয়ের প্রচ্ছদে কাঠগোঁয়ার এই লেখক লেটারিংয়ে লেবুজলে চোবানো আবেদন নিশ্চিত করে তবে বই বাজারে ছেড়েছিলেন। নিজের রক্ত আদতে নিংড়ে দিয়েছিলেন বইয়ে। গানপার-র চরিত্র খানিক সেরকম। ঘোষণা দিয়ে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জঙ্গে সে কখনো নামেনি। বাসনাও নেই নামবার, কিন্তু দুখী বাংলার জনপদে খাবি খাওয়া মানুষ থেকে আরম্ভ করে সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে প্রাণবন্ত জনজীবনের রসদকে সে ওই সিকি লেবু নিংড়ানো রসে চুবিয়ে হাজির করার বাসনা আগাগোড়া ধারণ করে।
গানপারমাঝিরা যে-কারণে সময়স্রোতে বেমানান। উদ্ভট ও কিম্ভুত! ফেসবুকে লেখার লিংক পেশ করে নিজের দায় সারেন তাঁরা। ইচ্ছে করলে লেখার আভাস ফেসবুক পেজ অনুসারীদের দিতে পারেন, কিন্তু দিতে নারাজ। এই ব্যাপারে তাঁরা কৃপণ ও খামোশ। সেটি এজন্য যে, তাঁরা ভাবেন,- পাঠআগ্রহ যার আছে সে ওই লিংকে ক্লিকাবে। লেখার অন্ধিসন্ধিতে গমন করবে স্বেচ্ছায়। আগ্রহ যার নেই তাকে লেখার আভাস ধরিয়ে দেওয়ার ঠেকা গানপার বোধ করে না। ঘটনাটি একদিক থেকে লেখাপাঠে দুই বাংলার পাঠকদের পাঠঅনীহা বা পাঠ-স্থবিরতার ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে। সারা বিশ্ব জুড়ে এই মড়ক এখন বিস্তারিত। গানপার নিজেও কি ঠিকঠাক জানে,- সাত বছরের সংগ্রামী সফরে কারা তাকে অনুসরণ ও পঠিত ভাবেন? কারা খামোখা ভেটকি মাছের মতো পড়ে থাকেন অনুসরণ নামের ভান সম্বল করে? উত্তরটি গানপার টিমকে ফের কোনোদিন আড্ডায় পেলে পুছব ভাবছি।
পাঠআকালের মধ্যেও এই-যে গানপার নিরন্তর সক্রিয়, নানান ছাদের লেখায় ভরতি তার সংগ্রহশালা, সেখানে কবি ও গদ্যকার জাহেদ আহমদকে মাঝেমধ্যে ভীষণ একলা, একরোখা আর জেদি দেখায়! তিনি জানেন,- তাঁর এই খাটনির মূল্য পোড়াকপাল দেশে জুটবে না একরতি। কাল যদি গানপার নিজেকে নজরুলের মতো স্তব্ধ করে দেয়, কেউ তার কারণ জানতে চাইবে না। চাপ দেবে না ফেরত আসার। জয় গোস্বামীর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে এইবেলা। স্বেচ্ছানির্বাসিত কবি লেখালেখি থেকে বিরতি নিয়েছেন। লেখা তাঁর জীবিকা ছিল এতদিন। সেই জীবিকা থেকে নিয়েছেন অবসর। বাড়িতে বসে লিখেন কিন্তু কোথাও ছাপতে দেন না। তাঁর মনে হয়েছে, তিনি যা লিখতে চেয়েছেন তার কিছু পঞ্চাশ বছরের লেখালেখি জীবনে লিখতে পারেননি। তাঁর আগ্রহের জায়গা বদল ঘটেছে। কবিতায় নিমজ্জিত জয়কে এখন টানে মহাকাশ বিজ্ঞান, ভূগর্ভ, শাস্ত্রীয় সংগীত কিংবা ক্রিকেট থেকে আরম্ভ করে বিচিত্র বিষয়। এসব বোঝাপাড়ার মধ্যে হয়তো খোঁজেন আগামী দিনের কবিতার রসদ।
দেশ-আনন্দবাজার জয়কে বেঁচে থাকার উপায় দিয়েছিল। নাম-যশ-স্বীকৃতি সবটা পেয়েছেন কবি। এর জন্য অবশ্য তাদের মর্জিমাফিক নিজেকে নিংড়ে দিতে হয়েছিল। তিনি তো সুনীল গাঙ্গুলী নন। সুনীলকে তারা যতটা নিংড়ে নিয়েছে, যতভাবে ব্যবহার করেছে,- সুনীল তার সবটাই কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নিয়েছেন। দেশ-আনন্দবাজারের ওপর কর্তৃৃত্ব খাটাতেন আটারোআনা। জয়কে দিয়ে সেটি হওয়ার ছিল না। সূর্যপোড়া ছাইয়ের কবি হার মেনে এখন স্বেচ্ছা নির্বাসিত। বেছে নিয়েছেন নিঃসঙ্গতা। বুলেটিন লিখে জানিয়ে দিয়েছিলেন,- এখন থেকে তিনি আর কোথাও লেখা ছাপবেন না। তাঁর এই ঘোষণায় কারো কিছু যায় আসেনি। কেউ জানতে চায়নি কেন এই নির্বাসন? আজ এসব কথা জয় যখন বলছেন, একদল পাঠক তাঁকে মমতা সরকারের দালাল ও চাটুকার বলে ধুয়ে দিচ্ছে।
আমরা এমন এক অঞ্চলে বাস করি, যেখানে জয়ের মতো লেখক ইচ্ছে করলেও লেখাকে পেশা করে নিজ মর্জিমাফিক লিখতে পারতেন না। মানিক থেকে আল মাহমুদ অথবা জয়… চিত্র বদলায়নি এতখানি! মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে সংসার চালাতেন। তাঁর লেখার ভক্ত কয়েকজন তরুণ গিয়েছিলেন দেখা করতে। গিয়ে দেখলেন কী দুঃসহ দারিদ্র্যের সঙ্গে নিরন্তর লড়াইলিপ্ত তাদের প্রিয় লেখক! মানিক তখন বাজারের থলে হাতে ঘরে ঢুকছেন। তাদের দিকে একপলক তাকিয়ে বলেছিলেন,- কী মনে হয় তোমাদের, লেখকরা হাওয়া খেয়ে বাঁচে? তাদেরকেও বাজার করতে হয়। দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা জয় চড়া মাশুল দিয়ে দারিদ্র্য জয় করেছেন। সুবিমল মিশ্রের মতো দাঁতে দাঁত চেপে লড়তে সবাই পারে না। আবার লড়ে খুব-যে উপকার হয় তাও নয়। জয় যতটা ফতুর এখন, সুবিমলও একলা লড়তে-লড়তে একরোখা আক্রোশে ফতুর করে গেছেন নিজেকে। এখানে লেখক হওয়া কাজেই অভিশাপ। কারো দায় নেই তার শ্রমের মূল্য বোঝে! না আছে দরদ!
এই বেদরদি ভূমিতে বসে জাহেদ আহমদ গানপার-এ নিজেকে ব্যয় করেন এখনো! একরোখা জেদ ছাড়া কাজটি কিছুতেই সম্ভব নয়। এতে করে কবি জাহেদ আহমদকে পাঠকের হারাতে হয়েছে। যে-সময় তিনি এই গাধার খাটনিতে ব্যয় করলেন, সেটি কবিতায় ব্যয় করলে হয়তো এতোদিনে কয়েক হাজার কবিতা অনায়াস লিখে ফেলতে পারতেন। হয়তো নীরবে লেখেন, ছাপতে অনীহা প্রকট। তাঁর কোনো কবিতার বই বাজারে নেই। কবিকে একত্রে একরাশ কবিতায় বাঁধাই করে পাঠক পড়বে,- তার নাই সুযোগ। পাঠককে সেই মওকা দিতে ঘোরতর অনীহা কবির। গান বাঁধেন ও নিজে গায়েনের ভূমিকায় মাঝেমধ্যে নেমেও পড়েন। কাছের দুচারজন ছাড়া সে-খবর রাখে না কেউ! বিমান তালুকদার যদি কবির কিছু গান অবিরত গেয়ে না বেড়াতেন, কারো জানার সাধ্য ছিল না,- গানপারঘাটে বসে জাহেদ আহমদ আকসার গান বাঁধেন। চাপের মধ্যেই চমৎকার শুনতে একরাশ গানে ভরতি তাঁর জীবনখাতা।
সব মিলিয়ে মানুষটি ও তাঁর সহযোদ্ধাদের কথা মাঝেমধ্যে ভাবি, আর মন তখন ওয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতাচরণে আচমকা ধাক্কা খায় : Water, water everywhere, nor any drop to drink. জাহেদ এমন এক গানপারঘাটে বসে সাতটি বছর ধরে গানের খাতা বাঁধছেন আর বাঁধছেন; তার চারদিকে থই থই পানির সাগর, তবু হায় তার এক ফোঁটা মুখে তোলার নয়। সবটাই লবণাক্ত। পোড়া দেশে লেগে থাকার এই হলো পুরস্কার! লবণাক্ত এই একরোখা লড়াকুদের তথাপি সেলাম।
. . .
. . .